।। মুফতি এনায়েতুল্লাহ ।।
ইগো শব্দের সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত। শব্দটি বেশ মজার। প্রচলিত ইগো শব্দটি ইংরেজি। বাংলায় এর অনেকগুলো অর্থ রয়েছে। তবে সবথেকে যথাযথ অর্থ হলো- অহমবোধ। আর গ্রিক ভাষার ইগো মানে- আমি। ইগো শব্দের এই ব্যবচ্ছেদ দ্বারা বোঝা যায়, কিভাবে ইগোর ব্যবহার ইংরেজি আর অন্য ভাষার হতে পারে। কালক্রমে ইংরেজি থেকে বাংলায়- নিজেকে বড় দেখানো কিংবা ভাবাই হলো- ইগো। ইগোর অনেকগুলো প্রচলিত সংজ্ঞা আছে, রায়ান হলিডের সংজ্ঞাটি এক্ষেত্রে বেশ যুৎসই। সেটা হলো- ‘নিজের বড়ত্বের প্রতি এক অস্বাভাবিক বিশ্বাস। যার সঙ্গে মিশে থাকে অতি অহঙ্কার এবং আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ’।
কোনো ব্যক্তির ইগোর কারণে একটি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এটা যখন ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, দল আর মতাদর্শে অনুপ্রবেশ করে, তখন সেটা সমাজ ও দেশকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করে। সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয়। এই শ্রেণির লোকেরা ভাবতে থাকেন- তিনি কিংবা দলের কর্মপন্থা অন্য সবার থেকে আলাদা ও ভালো, আমাদের দলের লোকেরা সবার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। আমরা হলাম- এই পৃথিবীর জন্য বড় উপহার, আমরাই সবার মধ্যমনি। কাজেই আমাদের ঘিরেই সব ধরনের কাজ হওয়া উচিত। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, আমার-আপনার আশপাশে, এমন চিন্তার বহু মানুষ রয়েছে। এই শ্রেণির লোকদের দ্বারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও রাজনৈতিক দল পরিচালিত হচ্ছে। ফলে সংক্রামণ ব্যাধির মতো সেগুলোও আক্রান্ত হচ্ছে- ইগো রোগে।
যেহেতু ইগো একটি রোগ, সেহেতু এর নিরাময় জরুরি। ইসলামি স্কলারদের অভিমত হলো, ইগো কমানোর সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হলো- নিজেকে চেনা, নিজেকে জানা। আর জ্ঞানীরা বলেন- ‘নিজেকে যে চিনতে পারলো, সে সবচেয়ে বড় জ্ঞান অর্জন করলো। নিজেকে চেনার বিপরীত দিক হলো- নিজের সম্পর্কে অজ্ঞতা। মানুষের সবচেয়ে বড় অজ্ঞতা হচ্ছে, নিজেকে চিনতে না পারা। সুঅভ্যাস গড়ার ক্ষেত্রেও নিজেকে চেনা ও জানা জরুরি।’
ইগোর কারণে মানুষ অনেক সময় নিজের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। এর পেছনের কারণ হলো, মানুষটি নিজের মনের ভেতরে আজীবন যা লালন করছে; তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়। অনেকক্ষেত্রে অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মরণও মানসিক পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বিষয়গুলো নিজেকে চেনা এবং জানার পথে অন্যতম অন্তরায়, এটা কখনও কখনও অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। মানুষ কখনও কখনও কাজের মাঝে এতো বেশি ডুবে থাকে যে, চিন্তা-ভাবনার অবকাশ পায় না, এই অবকাশ না পাওয়াকে তখন তারা নানা অজুহাত দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করে। সচেতনভাবে নিজের দায় এড়িয়ে যায়। এসব বিষয়ও মানুষের ভুল, জীবন চলার ভুল। ইগো আক্রান্তদের জন্য এটা আরেকটি মরণ ফাঁদ।
অনেকেই আবার মনে করেন, নিজেকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে গেলে জীবনের চলমান স্বাভাবিক গতি বিঘিœত হতে পারে। এ ধরনের মানুষ দৈনন্দিন চিন্তা-ভাবনার বাইরে গিয়ে নিজেকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে চান না। তার পরও মানুষ খুব গর্বের সঙ্গে বলে, ‘নিজেকে চিনতে পেরেছি। আমার চিন্তাই সঠিক, আমার দলের গৃহীত কর্মপন্থাই যথার্থ।’ কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন সব দিক থেকে যায় যা নিজের কাছে ধরা পড়ে না। এ ক্ষেত্রে একজন ভালো বন্ধু এবং নিজের খুব কাছের মানুষগুলো সহযোগিতা করতে পারে। নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী বা স্ত্রী এবং ভালো কোনো বন্ধুর সহযোগিতা নিতে পারি আমরা। তাদেরকে আমার কিছু ভালো ও কিছু মন্দ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত করার অনুরোধ জানাতে পারি। এরপর আপনি যখন নিজের ভালো ও মন্দ দিকগুলো জানতে পারবেন তখন নিজেই বিস্মিত হবেন। কারণ, এর আগে আপনি হয়তো কখনোই এই দিকগুলো নিয়ে চিন্তা করেননি, আপনার কাছে তা কখনোই হয়তো ধরা দেয়নি।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
সমাজ বিশ্লেষক, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও মনস্তত্ত্ববিদের মতে নিজেকে চেনা এবং জানার বেশ কিছু স্তর রয়েছে, এর সবগুলোই মনস্তাত্ত্বিক। মনের দিক থেকে একেক ব্যক্তি একেক স্তরে অবস্থান করে। প্রথমস্তরঃ এই সময়টাকে মানুষ জীবনে কেবল তখনই আনন্দ পায়, যখন তাদের বাবা-মা সন্তুষ্ট হন। অর্থাৎ বাবা-মা আমাদেরকে শাস্তি দিলে মন খারাপ হয় এবং তারা খুশি হলে ও উৎসাহ দিলে আমরা খুশি হই। হয়তো আপনি ভাবছেন, এই ধাপটি কেবল শৈশবের জন্য প্রযোজ্য, বিষয়টি আসলে এমন নয়। এই পর্যায়টি বয়সের গ-িতে আবদ্ধ নয়। কারণ, এমন অনেকেই আছেন যারা বড় হয়ে এমনকি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই স্তরেই রয়ে যান। এ থেকে বের হতে পারেন না।
দ্বিতীয় স্তরঃ এই পর্যায়ে আমাদের চেষ্টা থাকে বাইরের জগতের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করার। এই ধাপে বন্ধুমহল এবং পরিবারের বাইরের লোকজনের সন্তুষ্টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই ধাপে মানুষ অন্যের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে গিয়ে অসামাজিক কিংবা বেআইনি কাজও করে ফেলতে পারে। আসলে এ স্তরে থাকা ব্যক্তি অন্যের দৃষ্টিআকর্ষণ করাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। অন্যের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য নানা পদক্ষেপ নিতে থাকে এই স্তরে থাকা মানুষেরা। বেফাঁস মন্তব্য, অন্যকে নিয়ে কটূক্তি এগুলোর অন্যতম।
নিজেকে চেনা-জানার ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিকভাবে তৃতীয় স্তরটি হচ্ছে- বেশি মারাত্মক। কারণ এই সময়টি মানুষের বিকাশলাভ ও আত্মপরিচিতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ধাপ। এই স্তরে থাকার অর্থ হলো- আমরা নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। নিজের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় এই ধাপে। এই স্তরে মানুষ কেবল নিজের সঙ্গেই নিজে প্রতিযোগিতা করে। অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ এই স্তরের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না। সহজ বাংলায় যাকে বলে, ‘আমার চেয়ে বড় কিংবা ভালো আর কেউ নেই। আমিই সব কাজের কাজী। আমিই একমাত্র যোগ্য।’ এই স্তরে মানুষ পরিবার কিংবা বাইরের মানুষের কাছে নয় বরং নিজেকে নিজের কাছে প্রমাণ করতে চায়। তখন এই স্তরের মানুষের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি জাগ্রত হয়। তখন সে ভাবতে থাকে, তার অতীতের অনেক আচরণ ও কাজ ছিল ভুল এবং অন্যকে খুশি করার জন্য সেগুলো করা উচিত হয়নি। এটাও বুঝতে পারে যে, অতীত আচরণ নিজের জন্য ক্ষতিকর ছিল। এ কারণে এই স্তরে উত্তীর্ণ ব্যক্তিরা অতীতের অনেক অভ্যাস বর্জন করেন। একইসঙ্গে এমন সব কাজে বেশি মনোযোগী হন যা নিজের অন্তরাত্মা থেকে অনুমোদিত মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়- অনাকাক্সিক্ষত। এমন অনাকাক্সিক্ষত আচরণের কারণে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব, দলীয় মতবিরোধ, আন্তঃকলহ ও ভাঙন ইত্যাদির জন্ম নেয়।
এখানে যে বিষয়টি স্পষ্ট, কেউ যদি নিজেকে সঠিকভাবে চিনতে না পারে- তাহলে সে নানা সমস্যায় পতিত হয়। তার মধ্যে ভুল প্রত্যাশার জন্ম নেয়। আত্মজ্ঞানের অভাবে নিজের মধ্যে অনিরাপত্তার অনুভূতির জন্ম নেয়ার পাশাপাশি সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়। ফলে সে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে, একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী আচরণ করতে থাকে। নিজেকে চিনতে না পারার কারণে সহজেই বিদ্যমান পরিস্থিতির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। ফলে সে শোনা কথায় বিশ্বাস করে সিদ্ধান্ত নেয়, মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখে। এমতাবস্থায় পারস্পরিক সম্পর্ক তখন অকারণে জটিল হয়ে ওঠে। এভাবেই মানুষ ব্যক্তি ও সমাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতালোভী হয়, আর ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ রাখতে অন্যায়কে সহ্য করা, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া, অন্যায়কারীর সঙ্গে হাত মেলানো হয় স্বাভাবিক বিষয়।
মানুষ যখন নিজেকে চিনতে পারেন- তখন তিনি সমাজে নিজেকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন, এর ফলে তিনি আনন্দবোধ করেন। নিজের ভালো লাগার বিষয়গুলো যখন প্রকাশ করতে পারে, তখন প্রাপ্তির সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়। আত্মদ্বন্দ্ব কমতে শুরু করে। আপনি যখন কোনো পদক্ষেপ নেন তা আপনার ভেতরের অনুভূতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। এর ফলে ভেতরের দ্বন্দ্ব কম ঘটে। নিজেকে চেনার পর যেকোনো বিষয়েই সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়, তুলনামূলক সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। একটা টুপি কেনার মতো ছোটখাটো সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের মতো বড় সিদ্ধান্ত পর্যন্ত সব কিছুতেই তা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয় নিজেকে চিনতে পারলে। নিজের সঙ্গে চেনা ও জানার গভীরতা যত বেশি হয়, তত ভালোভাবে নিজের অভ্যাসগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। খারাপ অভ্যাসগুলো বাদ দিয়ে সুঅভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিজেকে চেনার গুরুত্ব অপরিসীম।
আপনি নিজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও ভালো-মন্দ দিক জানার পর আপনি আরও ভালো হওয়ার চেষ্টা করবেন- এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক চাপ কিংবা অন্যেরা কী ভাবছে- এমন চিন্তায় মশগুল না থেকে আপনি তখন দৃঢ়ভাবে সঠিক পথে চলার শক্তি পাবেন অনেক বেশি। আপনি যখন আপনার মূল্যবোধগুলো ভালোভাবে চিনবেন তখন অন্যকে এসবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক যেকোনো বিষয়ে সহজেই ‘না’ বলে দিতে পারবেন। নিজেকে চেনার মাধ্যমে নিজের দুর্বল দিক ও সমস্যাগুলো নিজের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর ফলে আপনি অন্যদের সমস্যা ও দুর্বলতা ভালোভাবে বুঝতে পারেন এবং অন্যদের প্রতি সহমর্মী হতে পারেন। সব মিলিয়ে আপনি নতুন ধরনের অফুরন্ত স্বাদ ও আনন্দের নাগাল পাবেন। নিজেকে না চিনলে কখনোই তা পাওয়া যায় না। এবার আপনার কাছে প্রশ্ন, দুনিয়ায় আপনার আগমন, কর্মপন্থা এবং বিভিন্ন ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকার বাসনা উত্তম, না এর বিপরীতটা?
লেখক : সাংবাদিক।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/