নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা

।। তারেকুল ইসলাম ।।

সম্প্রতি ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সদ্যসাবেক মুখপাত্র নূপুর শর্মা প্রকাশ্যে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে চরম অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। এর প্রতিবাদে ভারতের মুসলমানরা রাস্তায় আন্দোলনে নেমে এলে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। এতে কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হন বলে জানা যায়। এ ছাড়া রাসূলের অবমাননার প্রতিবাদ-বিক্ষোভে অংশ নেয়ায় উত্তরপ্রদেশের সরকার বুলডোজার দিয়ে তরুণ মুসলিম অ্যাক্টিভিস্ট আফরিন ফাতিমার বাড়িসহ অনেকের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, ফাতিমার বাবাকেও ষড়যন্ত্রের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। সন্দেহ নেই, মুসলিম নির্মূলে ইসরাইলি বুলডোজার নীতি আজ ভারতেও প্রয়োগ করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে তিন শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, ভারতের মুসলমানদের আজ শুধু টিকে থাকার লড়াই-ই নয়, ঈমানি পরীক্ষাও দিতে হচ্ছে। ভিকটিম আফরিন ফাতিমা এক আবেগঘন টুইটে লিখেছেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপ কি মহব্বত মে মেরা ঘার, মেরি জান, মেরা মাল, মেরে মা-বাপ, মেরে ভাই-বেহেন, আপ পার সাব কুরবান। ও লোগ মেরা ঘার তোঢ় সাকতে হ্যায়, লেকিন মেরে ঈমান কো কামজোর নেহি কার সাকতে।’

নূপুর শর্মার মন্তব্যের স্ক্রিনশট টুইটারে শেয়ার দিয়ে সমর্থন জানায় দলটির দিল্লি শাখার মিডিয়া সেলের প্রধান নবীন কুমার জিন্দালও। ধারণা করা হয়, এর পরপরই বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্যের আরব নাগরিকদের নজরে পড়লে তারা টুইটারে প্রতিবাদ করতে থাকেন। একপর্যায়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতকে ক্ষমা চাইতে বলে কাতার। শেষ পর্যন্ত ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্র কড়া ভাষায় ভারতকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। ওআইসি শক্ত ভাষায় নিন্দা ও প্রতিবাদ করে। আরব দেশগুলোর তুমুল চাপে পড়ে ভারত। আরব নাগরিক ও ব্যবসায়ীরা ভারতীয় পণ্য বর্জন করা শুরু করে। পরিস্থিতি এমন বেগতিক দেখে বিজেপি সরকার তড়িঘড়ি করে নূপুর শর্মা ও নবীন কুমার জিন্দালকে দল থেকে বহিষ্কার করে এবং বিবৃতি দিয়ে বলে, আক্রমণাত্মক কোনো টুইট ও মন্তব্য ‘কোনোভাবেই বিজেপি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন নয়। এগুলো ব্যক্তিগত মতামত।’ তাতেও উত্তেজনা প্রশমিত না হওয়ায় অবশেষে দুই সপ্তাহ পর শর্মা ও জিন্দালের বিরুদ্ধে ‘লোক দেখানো’ মামলা করা হয়েছে। কিন্তু কূটকৌশলে বিজেপি যতই গা বাঁচানোর চেষ্টা করুক না কেন, নূপুর শর্মা ও নবীন কুমার জিন্দাল যে তাদেরই মতাদর্শের লোক ও দলের মুসলিমবিরোধী নীতিই যে তাদের ভূমিকায় প্রতিফলিত হয়েছে, তা বলাবাহুল্য।

নূপুর শর্মার বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র নেড প্রাইসও। এ ছাড়া গত ১৪ জুন ওয়াশিংটন পোস্টের এডিটোরিয়াল বোর্ড খুবই শক্ত ভাষায় বিজেপির নীতির সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিয়ে লিখেছে, ‘The U.S. must oppose India’s rising Islamophobia. It should increase the pressure. Secretary of State Antony Blinken said in April that the Biden administration is monitoring human rights abuses in India; this month, he named India as a country with deteriorating religious freedoms. But the White House has been silent as this most recent controversy has unfolded. India could be a pluralistic democracy or a country defined by a dark, intolerant nationalism. The United States should work actively in favor of the former.’

অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ভারতের ক্রমবর্ধমান ইসলামবিদ্বেষের বিরোধিতা করতে হবে। ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ানো উচিত। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন এপ্রিলে বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন ভারতে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলো নজরে রাখছেন। এ মাসে তিনি ভারতকে ধর্মীয় স্বাধীনতায় অবনতিশীল একটি দেশ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক এ বিতর্কের ব্যাপারে হোয়াইট হাউজ নিশ্চুপ। ভারত যাতে একটি অন্ধকার, অসহিষ্ণু জাতিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত না হয়ে বরং একটি বহুজাতিভিত্তিক গণতান্ত্রিক দেশ হয়, সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সক্রিয়ভাবে কাজ করা।

রাসূল সা:-এর শানে নূপুর শর্মার অবমাননামূলক মন্তব্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। প্রভাবশালী শীর্ষস্থানীয় আলেমদের দীর্ঘ দিন কারাবন্দী করে রাখা হলেও দেশের পাবলিক-প্রাইভেট ভার্সিটিগুলো থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও ঈমানের তাগিদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে নেমে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেছে, যা ছিল অভাবনীয়। তাদের রাসূলপ্রেমের সুঘ্রাণে মেতে উঠেছিল গোটা দেশ। রাসূল (সা:) অবমাননা ইস্যুতে নটর ডেম কলেজের মতো অগ্রসর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও শাপলা চত্বরে জমায়েত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করেছে। রাসূলপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এক মোহনায় এসে মিশে যেতে দেখা গেল ধর্মপ্রাণ এক নতুন তরুণ প্রজন্মকে। ঈমানি চেতনার বীজ আজ ফুল হয়ে পাপড়ি মেলেছে ডালে ডালে। এ এক নতুন বাংলাদেশ! দীর্ঘ দিন ধরে আলেমদের নির্বিচারে জেলবন্দী করে রাখা হয়েছে। এতে ‘মৌলবাদ’ দমন হয়েছে ভেবে উগ্র সেকুলার মহল বেশ স্বস্তিতে দিন গুজরান করছিল। কিন্তু কারাবন্দী আলেমদের শূন্যতায় অপ্রত্যাশিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পুরো দেশ প্রতিবাদে মুখর করে তুলল। ফলে ইসলামবিদ্বেষী সেকুলারদের এত দিনের স্বস্তিতে খানিকটা ধাক্কা লাগার কথা। সূরা আল ইমরানের ৫৪ নং আয়াত মনে পড়ে গেল : ‘তারাও পরিকল্পনা করে, আল্লাহও পরিকল্পনা করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী।’

আরও পড়তে পারেন-

যাই হোক, প্রায় ৫৭টি মুসলিম দেশ নূপুর শর্মার মন্তব্যের কঠোর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানালেও বিস্ময়করভাবে নীরব ভূমিকা পালন করে আমাদের সরকার। ধর্মপ্রাণ গণমানুষের চাপ ও তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও আমাদের সরকার এ ইস্যুতে ভারতের উদ্দেশে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়নি। এ ব্যাপারে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ‘বহু দেশ নিন্দা করলেও মৈত্রী, ঘরে শান্তির লক্ষ্যে নূপুর-মন্তব্য নিয়ে এখনো চুপ ঢাকা’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট করেছে। আমাদের দেশের এক শ্রেণীর সেকুলার নূপুর শর্মার মন্তব্যকে ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টা করেছেন; অথচ ইস্যুটি যেভাবে মুসলিম বিশ্বসহ আন্তর্জাতিকভাবে আলোড়ন তুলেছে, তাতে করে সেটি অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে আর থাকেনি। সবচেয়ে বড় কথা, রাসূলের অবমাননা দেশ-কাল-সীমানা নির্বিশেষে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের ধর্মপ্রাণ মুসলিমের হৃদয়ে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে এবং সে কারণে তারা প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হয়। এ ব্যাপারে তাদের আপসহীন হিসেবেই দেখা গেছে সবসময়।

ফ্রি স্পিচ মানেই হেট স্পিচের স্বাধীনতা নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করার ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন নেই। যেকোনো বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু বাকস্বাধীনতার নামে রাসূল সা: ও উম্মাহাতুল মুমিনিন সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘৃণামূলক মিথ্যাচার ও কটূক্তি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। হেট স্পিচ কোনোভাবেই বাকস্বাধীনতার নৈতিক অধিকারের আওতায় পড়ে না। কারণ জাতিসঙ্ঘের একটি ফোরামে ধর্ম অবমাননাকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ সাব্যস্ত করে একটি রেজুল্যুশন পাস করা হয়েছিল (২৭ মার্চ ২০০৯, রয়টার্স)।

এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১৮ জুন হেট স্পিচের ওপর জাতিসঙ্ঘের কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন-

‘Hate speech is a direct assault on our core values of tolerance, inclusion and respect for human rights and human dignity. It sets groups against each other, contributes to violence and conflict, and undermines all our efforts for peace, stability and sustainable development. As such, addressing it is a priority for the entire United Nations system. Addressing hate speech does not mean limiting or prohibiting freedom of speech. It means keeping hate speech from escalating into something more dangerous, particularly incitement to discrimination, hostility and violence, which is prohibited under international law.’

অর্থাৎ, হেট স্পিচ বা ঘৃণামূলক বক্তব্য মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা, সৌহার্দ্য ও সহিষ্ণুতার মূল্যবোধের ওপর সরাসরি আঘাত। এটি মানুষকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়, সহিংসতা ও দ্বন্দ্ব তৈরি করে ও টেকসই উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা এবং শান্তির পক্ষে আমাদের প্রচেষ্টাগুলোকে ক্ষতি করে। সুতরাং হেট স্পিচকে মোকাবেলা করাটা জাতিসঙ্ঘের জন্য একটি অগ্রাধিকারের বিষয়। হেট স্পিচকে মোকাবেলা করার মানে বাকস্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত বা নিষিদ্ধ করা নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ সহিংসতা, শত্রুতা, অস্থিরতা ও বৈষম্যের ক্ষেত্রে হেট স্পিচের প্রভাবকে রোধ করা।

ভারতের পেনাল কোডের ২৯৫ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ধর্ম বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বোধবিশ্বাসকে অপমানিত করে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ালে তা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ছাড়া হেট স্পিচকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে ভারতীয় পেনাল কোডের আরো কয়েকটি ধারায়। অন্য দিকে ব্রিটেনের কয়েকটি আইনে হেট স্পিচ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্রিটেনের পাবলিক অর্ডার আইন-১৯৮৬, রেসিয়াল অ্যান্ড রিলিজিয়াস হেটরেড অ্যাক্ট-২০০৬ এবং ক্রিমিনাল জাস্টিস অ্যান্ড ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট-২০০৮ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির বর্ণ, জাতি, অক্ষমতা, জাতীয়তা (নাগরিকত্বসহ), নৃতাত্ত্বিক অথবা জাতিগত ব্যুৎপত্তি, ধর্ম, অথবা লিঙ্গকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশিত যেকোনো ঘৃণামূলক উক্তিই নিষিদ্ধ।

বিশেষত ব্রিটেনের পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট-১৯৮৬-এর ২৯ (খ) ধারা অনুসারে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা ধর্মকে উদ্দেশ্য করে বিদ্বেষপ্রসূত ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করে রেখেছে। আমেরিকার ইলিনোইস রাজ্যে ‘হেট স্পিচে’-এর বিরুদ্ধে একটি আইন আছে। আইনটির মূল মর্ম হলো- An Illinois law making it illegal to publish or exhibit any writing or picture portraying the ‘depravity, criminality, unchastety, or lack of virtue of a class of citizens of any race, color, creed or religion’ was constitutional. অর্থাৎ, কোনো বর্ণ, জাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায় সম্পর্কে অবমাননামূলক লেখালেখি/ছবি প্রদর্শন করা বেআইনি আখ্যা দিয়েছে ইলিনোইসের এই আইন। পরবর্তীতে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট এই আইনটিকে সাংবিধানিকভাবে সমন্বয় করে আরো উন্নত করে।

গঠনমূলক সমালোচনা ও হেট স্পিচ- এ দুটোর মধ্যে মৌলিক তফাত আছে। একটা গ্রান্টেড, কিন্তু পরেরটা অবশ্যই সব বিচারে দণ্ডনীয় অপরাধ। গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানানো যায়, কিন্তু কটূক্তি, অবমাননা, গালাগালি ও হেট স্পিচের মাধ্যমে অন্যের বোধবিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার নাম বাকস্বাধীনতা কিংবা মুক্তচিন্তা হতে পারে না।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট। Email- tareqislampt@admin_767

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।