।। আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ।।
যুগে যুগে এই দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলা মানব জাতিকে সঠিক পথের দিশা দিতে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা মহান আল্লাহর ওহী লাভে ধন্য হয়ে মানুষকে সরল ও সঠিক পথে পরিচালিত করতে দিন-রাত প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। নবুওয়্যাত লাভ কোনো শিক্ষা, যোগ্যতা বা অর্জনযোগ্য বিষয়ের নাম নয়। দক্ষতা, মেধা বা প্রতিভা দিয়ে এটি লাভ করা যায় না। চর্চা, অধ্যবসায়, অনুশীলন ও সাধনা দ্বারা দুনিয়ার অনেক কিছু অর্জন সম্ভব হলেও নবুওয়্যাত ও রিসালাত অর্জন সম্ভব নয়। এটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার মনোনয়নের বিষয়। মহান আল্লাহর পয়গাম মানব জাতির কাছে প্রচার করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবী-রাসূল মনোনীত করেছেন। এ মর্মে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
“আল্লাহ ফেরেশতা ও মানবকূল থেকে রাসূল মনোনীত করে থাকেন”। (সূরা হজ্জ, আয়াত- ৭৫)।
যুগে যুগে মানুষের হিদায়াতের জন্য নবী-রাসূল প্রেরণের ধারাবাহিকতার সর্বশেষ নবী হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর পরে কিয়ামত পর্যন্ত জগতে আর কোন নবী আসবেন না। তাঁকে নবীগণের সর্দার এবং সর্বশেষ নবীর মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে এবং তাঁর উম্মতগণই হলেন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত।
এই আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর চরিত্র-মাধুর্য কেমন ছিল, এই প্রশ্নের উত্তরে আম্মাজান হযরত আয়েশা (রাযি.) বর্ণনা করেন, ‘জেনে রেখো, পুরো কুরআনই হলো রাসূল (সা.)এর চরিত্র’। অর্থাৎ তিনি ছিলেন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত উত্তম মু’মিনের বাস্তব নমুনা। (মুসনাদ আহমদ, হাদীস নং- ২৫৮১৩)।
রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মাধ্যমে সেই কুরআন আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। তাঁর দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুওয়্যাতী জীবনে এ কুরআনই ছিল তাঁর দিক-নির্দেশক। সেই পবিত্র কুরআনে তাঁর পরিচয় কীভাবে বিধৃত হয়েছে; তা আমাদের জানা প্রয়োজন। কেননা, অন্য যে কোন ঐতিহাসিক তত্ত্ব ও তথ্যের চেয়ে পবিত্র কুরআন তার বাহকের যে পরিচয় দিয়েছে, তা শতভাগ নির্ভুল ও তত্ত্ব সমৃদ্ধ। তাই পবিত্র কুরআনের বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অনুপম গুণাবলী ও চরিত্র-মাধুর্য কেমন ছিল, তা জানার চেষ্টা করব আমরা।
তিনি আল্লাহর রাসূল; অন্যদের মতো তিনিও মরণশীল
ওহুদ যুদ্ধের সাময়িক পরাজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.)এর শাহাদাতের গুজব রটার ফলে কিছু সংখ্যক সাহাবা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের সেই নৈরাশভাব দূর করার জন্য আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
আর মুহাম্মদ তো একজন রাসূল মাত্র; তাঁর পূর্বেও বহু রাসূল গত হয়েছেন। তাহলে কি যদি তিনি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে কি তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? (সূরা আলে-ইমরান- ১৪৪)।
তিনি সার্বজনীন রাসূল; তাঁর রিসালাত বিশ্বজনীন
রাসূলুল্লাহ (সা.) বিগত নবীগণের মতো কোন বিশেষ জাতি কিংবা বিশেষ ভূখন্ড অথবা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে তাঁর রিসালাত সীমিত নয়; বরং তাঁর রিসালাত সমগ্র বিশ্ব মানবের জন্য। তাঁর দাওয়াতি মিশন বিশ্বের প্রতিটি অংশ প্রতিটি দেশ ও রাষ্ট্র এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কিয়ামত কাল পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। এছাড়াও জ্বীন জাতির জন্যও তিনি আবির্ভূত ছিলেন।
এ ক্ষেত্রে কুরআনের ঘোষণা- আপনি বলুন, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য সেই আল্লাহর রাসূল, যিনি আসমান ও যমীনের সার্বভৌমত্বের মালিক। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সুতরাং তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তাঁর বাণীবাহক উম্মী নবীর প্রতি, যিনি ঈমান রাখেন আল্লাহর প্রতি ও তাঁর বাণীতে। আর তোমরা তাঁর অনুসরণ করো, যাতে তোমরা সঠিক পথ প্রাপ্ত হও। (সূরা আ’রাফ- ১৫৮)।
“মহান পবিত্র বরকতওয়ালা সেই আল্লাহ্; যিনি পার্থক্যকারী কিতাব নাযিল করেছেন তাঁর বান্দাহর উপর, যেন সে সমগ্র বিশ্বলোকের জন্য সতর্ককারী হতে পারে। (সূরা ফুরক্বান- ১)।
“আমি তোমাকে মানুষ মাত্রের জন্য রাসূলরূপে পাঠিয়েছি। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ্ই যথেষ্ট”। (সূরা নিসা- ৭৯)।
“আমি তোমাকে সমগ্র মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপেই পাঠিয়েছি”। (সূরা সাবা- ২৮)।
আর এই রাসূলের আগমন অন্যান্য সেই লোকদের জন্যও, যারা এখনও তাদের সাথে এসে মিলিত হয়নি (অর্থাৎ পরে এসে মিলিত হবে)। (সূরা জুমুআহ- ৩)।
তিনি জগদ্বাসীর জন্য রহমত স্বরূপঃ
তিনি ছিলে মানবতার পরম বন্ধু। সার্বিক মঙ্গল ও কল্যাণের আধার। তাঁর আগমন ছিলো বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ। কুরআনের ভাষায়- আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া- ১০৭)।
কুরআনের বর্ণনায় রাসূল (সা.)এর অন্যতম পাঁচটি বিশেষ গুণ। যথা-
হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহ্বায়করূপে ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে। (সূরা আহযাব- ৪৫, ৪৬)।
এই দুই আয়াতে আল্লাহ তাঁর হাবীবের পাঁচটি বিশেষ গুণের বর্ণনা করেছেন। এগুলো হলো-
১. কিয়ামত দিবসে উম্মতের জন্য সাক্ষদাতা।
২. মু’মিনদের জন্য সুসংবাদ প্রদানকারী।
৩. তাগুতের অনুসারীদের সতর্কতাকারী।
৪. সত্যের পথে আহ্বানকারী।
৫. তিনি জ্যোতিষ্মান আলোকবর্তিকা। (সংক্ষিপ্ত বাংলা মাআরিফুল কুরআন- ১০৮৭-৮৮ পৃষ্ঠা)।
তিনি শুধুমাত্র সতর্ককারী
এই লোকেরা বলেছে যে, এই লোকটির ব্যাপারে তার রবের পক্ষ থেকে নিদর্শনাবলী কেন নাযিল করা হলো না? বলুন- নিদর্শন সমূহ তো আল্লাহর নিকট, আর আমি তো শুধুমাত্র প্রকাশ্য সতর্ককারী। (সূরা আনকাবুত- ৫০ আয়াত)।
তিনি সরল-সঠিক পথের দিশারী
আর এমনিভাবে- আমি তোমার কাছে আমার নির্দেশ থেকে ‘রূহ’ (জিব্রাইল আ.)কে ওহী যোগে প্রেরণ করেছি। তুমি জানতে না কিতাব কী এবং ঈমান কী? কিন্তু আমি একে আলো বানিয়েছি, যার মাধ্যমে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করি। আর নিশ্চয় তুমি সরল পথের দিক নির্দেশনা দাও। (সূরা আশ্-শূরা- ৫২)।
তিনি মনগড়া কিছু করেন না
তাহলে বলে দাও, হে নবী! এই কুরআনকে নিজের পক্ষ থেকে পরিবর্তিত করা আমার কাজ নয়। আমি সে নির্দেশেরই আনুগত্য করি, যা আমার কাছে আসে। আমি যদি স্বীয় পরওয়ারদিগারের নাফরমানী করি, তবে কঠিন দিবসের আযাবের ভয় করি। (সূরা ইউনুস- ১৫)।
তিনি উম্মী নবী
আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা.)এর নবুওয়্যাত প্রমাণ করার জন্য যেসব মু’জিযা প্রকাশ করেছেন, তন্মধ্যে তাঁকে পূর্ব থেকে নিরক্ষর রাখাও অন্যতম। তিনি লিখিত কোন কিছু পাঠ করতে পারতেন না এবং নিজে কিছু লিখতেও সক্ষম ছিলেন না। এই অবস্থায়ই তিনি জীবনের চল্লিশটি বছর মক্কাবাসীদের সামনে অতিবাহিত করেন।
এরপর হঠাৎ তাঁর পবিত্র মুখ থেকে এমন কালাম উচ্চারিত হতে থাকে, যা বিষয়বস্তু ও ভাবের দিক দিয়ে ছিল মু’জিযা, তেমনি শাব্দিক ব্যাপকতা ও অলংকারের মোহনীয়তার দিক দিয়েও ছিল অনন্য। (সংক্ষিপ্ত তাফ্সীরে মাআরিফুল কুরআন-১০৩২ পৃষ্ঠা)।
কিন্তু কাফির মুশরিকরা এ সত্য উপলব্ধি করতে পারেনি। তারা বলতে লাগলো ‘এটি তো জঘন্য মিথ্যা যা সে রটনা করেছে আর অন্য এক দল তাকে সাহায্য করেছে’। এভাবে তারা যুলম ও মিথ্যা নিয়ে এসেছে। তারা বলে, ‘এটি প্রাচীনকালের উপকথা যা সে লিখিয়ে নিয়েছে; এগুলো সকাল-সন্ধ্যায় তার কাছে পাঠ করা হয়। (সূরা ফুরক্বান- ৪-৫)।
এই একই আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলিষ্ঠ ভাষায় তাদের এই ধারণা এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, ওরা বড়ই যুলুম ও কঠিন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়া নিম্নোক্ত আয়াতসমূহেও তাদের এই ধারণা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে।
আপনি তো এর পূর্বে কোন কিতাব পাঠ করেননি এবং স্বীয় দক্ষিণ হস্ত দ্বারা কোন কিতাব লিখেননি। এরূপ হলে মিথ্যাবাদীরা অবশ্যই সন্দেহ পোষণ করত। (সূরা আনকাবুত- ৪৮ আয়াত)।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
“যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবী; যার গুণাবলী তারা নিজদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বারণ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে। আর তাদের থেকে বোঝা ও শৃঙ্খল- যা তাদের উপরে ছিল- অপসারণ করে। সুতরাং যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার সাথে যে নূর নাযিল করা হয়েছে তা অনুসরণ করে তারাই সফলকাম”।
“বল, হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল, যার রয়েছে আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু দেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো ও তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর প্রতি, যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীসমূহের প্রতি ঈমান রাখে। আর তোমরা তার অনুসরণ কর, আশা করা যায়, তোমরা হিদায়াত লাভ করবে”। (সূরা আ’রাফ- ১৫৭-৫৮)।
উপর্যুক্ত দু’টি আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবের দশটি পরিচয় প্রদান করেছেন। সে দশটি গুণ বা পরিচিতি এই-
১. তিনি রাসূল।
২. তিনি নবী।
৩. তিনি উম্মী।
৪. তাঁর নাম তাওরাত ও ইঞ্জিলে উল্লেখ রয়েছে।
৫. তিনি মা’রূফ- ভালো কাজের আদেশ করেন।
৬. তিনি মুনকার- মন্দ ও শরীয়ত বিরোধী কাজ থেকে নিষেধ করেন।
৭. তিনি যাবতীয় উত্তম, উৎকৃষ্ট, পবিত্র দ্রব্যাদিকে হালাল ঘোষণা করেন।
৮. তিনি সব খারাপ, নিকৃষ্ট, দুর্গন্ধময় জিনিসকে হারাম ঘোষণা করেন।
৯. তিনি লোকদের উপর চাপানো অস্বাভাবিক ও দুর্বহ বোঝাসমূহ দূর করে দেন (মানুষের উপর থেকে আল্লাহদ্রোহী শক্তির আইন পালনের বাধ্যবাধকতা সরিয়ে দেন)।
১০. তিনি মানুষকে নানা প্রকারের দাসত্ব ও শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন। (আল-কুরআনে নবুওয়্যাত ও রিসালাত- ১৭৩ পৃষ্ঠা)।
তাঁর আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য
আল্লাহ তাআলা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর আনুগত্যকে সকলের উপর ফরয করেছেন। যারা তাঁর আনুগত্য করবে তারা প্রকারান্তরে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য বাধ্যতামূলক। তাই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
যারা আপনার কাছে আনুগত্যের শপথ করে, তারা তো আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে। (সূরা ফাতহ- ১০ আয়াত)।
তিনি আমাদের মতোই মানুষ
বলুন, আমিও তোমাদের মতোই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ। (সূরা কাহাফ- ১১০)।
তিনি গায়েবের খবর জানেন না
গায়েবের খবর জানেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা, জানেন তিনি উপস্থিতকেও। এ ‘গায়েব’ তিনি ছাড়া আর কারোরই জানার কোন সাধ্য নেই। তবে তিনি যাকে ইচ্ছা জানাতে পারেন। আর তিনি যাকে জানাবেন, তার পক্ষেই সম্ভব তা জানা- ততটুকুই জানা সম্ভব, যতটুকু আল্লাহ তাকে জানাবেন বা জানতে দিবেন।
অতএব, এসব গায়েব পর্যায়ের বিষয় সম্পর্কে রাসূলে কারীম (সা.) যা কিছু বলেছেন, তা সবই আল্লাহর জানানো ইলম, আল্লাহর নিকিট থেকে জেনে নিয়েই তিনি তা দুনিয়ার মানুষকে জানিয়েছেন। তাই বলে রাসূল (সা.) গায়েবের খবর জানতেন; তা বলা যায় না। যদি কেউ তা বিশ্বাস করে, তবে সে আল্লাহর সাথে স্পষ্ট শিরক করল।
এ পর্যায়ে কুরআনের ষোষণা- “বলুন হে নবী! আমি তোমাদের বলছি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধনভান্ডার রয়েছে। আর আমি গায়েব জানি না। আমি তো শুধু তা-ই অনুসরণ করে চলি, যা আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়”। (সূরা আনআম- ৫০)।
আমি তো তোমাদের বলি না যে, আল্লাহর ধনভান্ডার আমার কাছে রয়েছে। আর আমি তো গায়েব জানি না; এটাও বলি না যে, আমি একজন ফেরেশতা। (সূরা হূদ- ৩১)।
বলুন হে নবী! আমি আমার নিজের জন্য কল্যাণ ও ক্ষতির মালিক নই। তবে ঘটবে তা-ই যা আল্লাহ চাইবেন। আমি যদি গায়েব-ই জানতাম, তাহলে আমি বিপুল কল্যাণ লাভ করে নিতাম এবং কোনরূপ অনিষ্টই আমাকে স্পর্শও করত না। আমি তো আর কিছু নয়ই, শুধু সতর্ককারী ও ঈমানদার লোকদের জন্য সুসংবাদদাতা। (সূরা আ’রাফ- ১৮৮ আয়াত)।
তিনি সর্বশেষ নবী
হযরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন নবুওয়্যাত ও রিসালাতের এ ধারার সমাপ্তকারী। তাঁর মাধ্যমেই দ্বীন ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। তাঁর পরে আর কোন নবী বা রাসূল আসবেন না। পবিত্র কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতখানা অত্যন্ত জোরালোভাবে সে কথারই প্রমাণ দেয়-
মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তির পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। (সূরা আহযাব ৪০)।
উক্ত আয়াত তো স্পষ্টভাবে রাসূল (সা.)কে খাতামুন্ নাবিয়্যীন বলে ঘোষণা দিচ্ছে। এছাড়াও প্রায় ১০০টি আয়াত রয়েছে, যা রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত নবুওয়্যাত ও রিসালাত ধারার সমাপ্তির ইঙ্গিত দেয়।
তিনি কবিও নন গণকও নন
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর নবুওয়্যাত অমান্যকারী কাফিররা মানুষের মনে কুরআনের বিস্ময়কর প্রভাবের কথা অস্বীকার করতে পারত না। তাই তারা কখনও কুরআনকে যাদু এবং রাসূল (সা.)কে যাদুকর বলত। কখনও কুরআনকে কাব্য এবং রাসূল (সা.)কে কবি বলে আখ্যা দিত।
এভাবে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করত যে, এই বিস্ময়কর প্রভাব আসমানী কালাম হওয়ার জন্য নয়; বরং হয় এটা যাদু, যা মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে, না হয় কবিতা যা সাধারণের মনে সাড়া জাগাতে পারে। আল্লাহ তাআলা তাদের এই ধারণাকে অসার প্রমাণিত করেন এবং বলেন-
আমি রাসূলকে কবিতা শিক্ষা দেইনি এবং তা তার জন্য শোভনীয়ও নয়। এটা তো এক উপদেশ ও প্রকাশ্য কুরআন। (সূরা ইয়াসীন- ৬৯)।
এবং এটা কোন কবির কালাম নয়; তোমরা কমই বিশ্বাস কর এবং এটা কোন গণকের কথাও নয়; তোমরা কমই অনুধাবন কর। (সূরা হাক্কাহ- ৪১, ৪২)।
তিনি বিভ্রান্ত নন, মস্তিষ্ক বিকৃত নন, উন্মাদ নন, তিনি ভীতি প্রদর্শনকারী।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়্যাত দাবির পূর্ব পর্যন্ত মক্কাবাসী কাফিরদের কাছে ছিলেন সত্যবাদী। তাঁর চরিত্র, অভ্যাস, সততা ও বিশ্বস্ততার জন্য তারা তাঁকে আল-আমীন বলে সম্বোধন করত। কিন্তু তিনি যখন তাওহীদের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন, তখন তারা তাঁকে মিথ্যাবাদী, মস্তিষ্ক বিকৃত পাগল ও বিভ্রান্ত বলে অপপ্রচার শুরু করে দিল। মহান আল্লাহ তাআলা তাদের এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। তীব্র ভাষায় তাদেরকে জানিয়ে দিলেন- তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হননি, বিপথগামীও হননি এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। কুরআন ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়। (সূরা নাজ্ম- ২-৪ আয়াত)।
তারা কি লক্ষ করেনি যে, তাদের সঙ্গী লোকটির মস্তিষ্কে কোন বিকৃতি নেই? তিনি তো প্রকৃষ্টভাবে ভীতি প্রদর্শনকারী। (সূরা আ’রাফ- ১৮৪ আয়াত)।
আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহে আপনি উন্মাদ নন। (সূরা ক্বলম- ২)। এবং তোমাদের সাথী উন্মাদ পাগল নন। (সূরা তাক্বীর- ২২)।
তিনি ও তাঁর সাথীবৃন্দ
মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সাথীরা কাফিরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল, আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু, সিজদারত দেখবেন। তাদের মুখমন্ডলে রয়েছে সিজদার চিহ্ন। (সূরা ফাতহ- ২৯)।
তিনি মু’মিনদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন
নবী মু’মিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতা। (সূরা আহযাব- ৬)।
তিনি অনুসরণীয়
রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য, যারা আল্লাহ ও আখিরাতের আকাক্সক্ষা পোষণ করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে। (সূরা আহযাব- ২১)।
তিনি আদর্শ চরিত্রের অধিকারী
আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। (সূরা ক্বলম- ৪ আয়াত)।
আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয়ের হয়েছেন। পক্ষান্তরে আপনি যদি রূঢ় ও কঠিন হৃদয় হতেন, তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেতো। (সূরা আলে ইমরান- ১৫৯)।
উপর্যুক্ত আয়াতসমূহ থেকে পবিত্র কুরআন রাসূলুল্লাহ (সা.)কে আমাদের সামনে কতই না গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, তা সহজে স্পষ্ট হলো। পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর নির্দেশ পরিপূর্ণ ও যথাযথভাবে পালন করতে তাঁরই রাসূলের সুন্নাহ মোতাবেক জীবনকে সাজানোর তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখক: মহাপরিচালক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম, সিনিয়র নায়েবে আমীর- হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, সহসভাপতি- বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/