।। আল্লামা মুফতি খলীল আহমদ কাসেমী ।।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- وَاعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا
অর্থাৎ- “তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ করো; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (আলে-ইমরান- ১০৩ আয়াত)।
বর্তমানে আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ গভীর হতাশাজনক এক কঠিন সময় পার করছে। চতুর্দিকে অন্যায়-অনাচার, জুলুম-নির্যাতন আর পাশবিকতার জয়জয়কার। মুসলমানরা আজ কুরআন হাদিস থেকে দূরে সরে পড়ার কারণে আদর্শিক, নৈতিক ও চরিত্রগতভাবে ভয়ংকর অধঃপতনের শিকার। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের সহজ উপায় কী, এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা যদি তাওফীক দান করেন, কিছু আলোচনার প্রয়াস পাব।
আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবীব (সা.)কে উদ্দেশ্য করে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-
فَذَکِّرۡ، اِنَّمَاۤ اَنۡتَ مُذَکِّرٌ۔ لَسۡتَ عَلَیۡهِمۡ بِمُصَۜیۡطِرٍ۔ اِلَّا مَنۡ تَوَلّٰی وَ کَفَرَ۔ فَیُعَذِّبُهُ اللّٰهُ الۡعَذَابَ الۡاَکۡبَرَ۔
অর্থাৎ- “অতএব, আপনি উপদেশ দিন, আপনি তো একজন উপদেশদাতা মাত্র। আপনি তাদের উপর শক্তি প্রয়োগকারী নন। তবে যে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং কুফরি করে, ফলে আল্লাহ তাকে কঠোর আযাব দেবেন। (সূরা আল-গাশিয়া, ২১-২৪)।
বৃষ্টির পানিতে যেমনিভাবে গাছের শক্তি বৃদ্ধি পায়, ফসলাদি তরুতাজা হয়ে যায়, কুরআন-সুন্নাহর আলোচনা শোনার দ্বারা মুমিনদের ঈমানি গাছ সতেজ হয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَاعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا
‘তোমরা আল্লাহর রশিকে সম্মিলিতভাবে আঁকড়ে ধরো। তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’। এই রশির নাম হলো কুরআন। আল্লাহর কুরআনকে মজবুতির সাথে সম্মিলিতভাবে ধরার কথা বলা হয়েছে এবং বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো- কুরআনকে কীভাবে ধরবো? ধরার প্রথম মাধ্যম হলো কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা করা। আর এটা পুরুষ-মহিলা, ব্যবসায়ী-চাকরিজীবী, কৃষক-শ্রমিক, ছেলে-মেয়ে সকলের জন্য ফরযে আইন। কেননা, নামায ফরযে আইন। আর নামাযে কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত করাও ফরযে আইন। তাই সূরা ফাতেহার সাথে সাথে অন্তত আরো ৪/৫টা সূরা মুখস্ত থাকা আবশ্যক। তাছাড়া কুরআন বিশুদ্ধভাবে তিলাওয়াতের মাঝে আল্লাহ তাআলা সওয়াব রেখেছেন। অযু ছাড়া পড়লে ১০ নেকি, অযুর সাথে পড়লে ২৫ নেকি, নামাযে বসে পড়লে ৫০ নেকি, দাঁড়িয়ে পড়লে ১০০ নেকি।
পৃথিবীতে কুরআনে কারীম ছাড়া অন্য কোন কিতাবের ব্যাপারে এই গ্যারান্টি নেই। কেননা, কুরআন হলো আল্লাহ পাকের কালাম। আল্লাহ পাক মহান, তাঁর কালামও মহান। তিনি পবিত্র, তাঁর কালামও পবিত্র। তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী, তাঁর কালামেও অসীম ক্ষমতা রয়েছে। তাই কুরআনের সাথে যার সম্পর্ক হবে, নিঃসন্দেহে তার সম্পর্ক আল্লাহ পাকের সাথে হয়ে যাবে। আর আল্লাহ পাকের সাথে যার সম্পর্ক হবে, তার জীবনে শান্তি, কল্যাণ এবং বরকতের বাতাস প্রবাহিত হবে। দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে শান্তিতে থাকবে। সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
এই কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ক করা প্রয়োজন। এর জন্য প্রথম কাজ হলো কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা করা। আমরা যারা শৈশবে নাযেরা (দেখে দেখে পড়া) শিখতে পারিনি, তারা বয়সের দিকে না তাকিয়ে এখনই নাযেরার ছাত্র হয়ে যেতে পারি। সাহাবায়ে কেরাম যখনই ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তখনই কুরআন শিক্ষা করেছেন। কেউ বৃদ্ধ বয়সে আবার কেউ মধ্যম বয়সে। তাই কুরআন শিক্ষার কোন বয়স নেই।
হরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাযি.) বর্ণনা করেন, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ، وَالّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ، وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقّ، لَهُ أَجْرَانِ.
অর্থাৎ- যারা উত্তমরূপে কুরআন তিলাওয়াত করবে, তারা থাকবে অনুগত সম্মানিত ফিরিশতাদের সাথে। আর যে কুরআন পড়তে গিয়ে আটকে আটকে যায় এবং কষ্ট হয়, তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব। (সহীহ মুসলিম, হাদীস- ৭৯৮)।
নবীজি (সা.)এর এ হাদীসটি একদিকে যেভাবে তিলাওয়াতে পারদর্শী ব্যক্তিদের জন্য সুসংবাদ প্রদানকারী, তেমনি কুরআন তিলাওয়াতে যাদের কষ্ট হয়, মুখে আটকে আটকে যায়, তাদের জন্যও এ বাণী আশা সঞ্চারক এবং উৎসাহব্যঞ্জক। এ ধরনের ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী দ্বিগুণ সওয়াব। তিলাওয়াতের সওয়াব এবং তিলাওয়াতের জন্য যে কষ্ট হয় সেই কষ্টের সওয়াব। তাই যারা এখনো সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত শিখিনি, সাবলীল তিলাওয়াত করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি, তাদের হতাশ বা বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে এবং দ্বিগুণ সওয়াব লাভের আশায় মেহনত ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আর এভাবে চেষ্টা করতে করতে যখন তিলাওয়াত সাবলীল হয়ে যাবে, তখন তো কথাই নেই- আল্লাহর নেককার ফেরেশতাদের সঙ্গী হবেন, ইনশাআল্লাহ। তাই সকলে কুরআনের ছাত্র হয়ে যান। যারা তিলাওয়াত করতে সক্ষম তারা বেশি বেশি তিলাওয়াত করবেন। হাফেযে কুরআনরা নামাযে বেশি বেশি তিলাওয়াত করবেন।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
হযরত মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রহ.) ছাত্রদেরকে নামাযে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াতের আদেশ দিতেন। ছাত্ররা একদিন দরসে হযরতকে জিজ্ঞেস করলো, হুযূর! আপনি দৈনিক কত পারা তিলাওয়াত করেন? তিনি উত্তর দিলেন- ৮ রাকআত তাহাজ্জুদে ৮ পারা, নফল, সুন্নাত মিলে সারাদিনে ৪০ পারা তিলাওয়াত করি। শেষ বয়সেও তিনি প্রতিদিন ১৫/১৬ পারা তিলাওয়াত করতেন। দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম কারী তাইয়্যেব সাহেব (রহ.) প্রতিদিন নামাযে সোয়া পারা করে তিলাওয়াত করতেন।
কুরআনে কারীম ধরার দ্বিতীয় মাধ্যম হলো কুরআনের হাফেয হওয়া। এটা অনেক বড় মর্যাদার বিষয়। কুরআনের সিনা হলো লওহে মাহফুয। লওহে মাহফুযে যেভাবে কুরআন সংরক্ষিত তেমনিভাবে হাফেযে কুরআনের সিনায়ও ৩০ পারা কুরআন সংরক্ষিত থাকে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا الۡمُزَّمِّلُ ۙ۔ قُمِ الَّیۡلَ اِلَّا قَلِیۡلًا۔ نِّصۡفَهٗۤ اَوِ انۡقُصۡ مِنۡهُ قَلِیۡلًا۔ اَوۡ زِدۡ عَلَیۡهِ وَ رَتِّلِ الۡقُرۡاٰنَ تَرۡتِیۡلًا۔
অর্থাৎ- হে চাদর আবৃত (নবী)! আপনি রাতে সালাতে দাঁড়ান, কিছু অংশ ছাড়া। রাতের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে কিছুটা কম। অথবা তার চেয়ে একটু বাড়িয়ে। আর স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন তিলাওয়াত করুন। (সূরা মুযাম্মিল, ১-৩ আয়াত)।
কুরআনে কারীমের তিলাওয়াতে রয়েছে বহুবিধ কল্যাণ ও উপকারিতা। জাগতিক, পারলৌকিক, বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক। পৃথিবীর বুকে কুরআন কারীম একমাত্র কিতাব, যার তিলাওয়াতে রয়েছে হরফে হরফে নেকী। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন-
مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ.
যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পড়ল, তার জন্য রয়েছে একটি নেকী। আর একটি নেকী দশ নেকী সমতুল্য। নবীজী (সা.) বলেন, আমি বলছি না যে, আলিফ লাম মীম- একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯১০)।
অতএব আলিফ, লাম, মীম তিলাওয়াত করলে কমপক্ষে ত্রিশ নেকী লাভ হবে, ইনশাআল্লাহ। লক্ষ করার বিষয় হল, নবীজী (সা.) দৃষ্টান্ত স্বরূপ আলিম-লাম-মীম উল্লেখ করেছেন। আর এটি এমন এক শব্দ, যার অর্থ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। বুঝা গেল, কুরআন মাজীদের অর্থ না বুঝে পড়লেও রয়েছে অনেক সাওয়াব, অনেক ফায়দা। আর যদি কেউ বুঝে বুঝে উপলব্ধির সাথে কুরআন তিলাওয়াত করে, তাহলে আল্লাহ তাকে আরো কত দেবেন, তা তো আল্লাহ পাকই ভালো জানেন!
তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান কুরআনের হাফেয। তিনি নিজেই তারাবীহ পড়ান। তিলাওয়াতও চমৎকার। যে কারণে তার ঈমানি শক্তি এত বেশি যে, তিনি আমেরিকা, রাশিয়া, চীনের মতো শক্তিশালী দেশগুলোকেও ভয় পান না। আজ মুসলিম উম্মাহ কুরআন থেকে দূরে সরে গেছে। যার কারণে সমাজে অশান্তি বিরাজমান, সমাজ ধ্বংসের মুখে পড়ে গেছে। মুসলিম জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হলো কুরআনকে ধরার মাঝে।
আফসোসের বিষয় হল, যেই মুসলমানের ঘর কুরআন তিলাওয়াতের সুমধুর ধ্বনিতে গুঞ্জরিত হওয়ার কথা ছিল সেখানে অনেক ঘর এমন পাওয়া যায়- যেখানে সারা বছরই কুরআন শরীফ আলমারির শোভা হয়ে থাকে। রমযান এলে আবার মনে পড়ে কালামুল্লাহর কথা। এটা অত্যন্ত আপত্তিকর ও হতাশার বিষয়। মুমিনের জীবন তো আবর্তিত হওয়ার কথা কুরআনকে ঘিরে। কুরআন থেকে সে আলো গ্রহণ করবে। সে আলোতে পথ দেখবে। তবেই তো গন্তব্যের দেখা মিলবে! তাই আসুন, কুরআনের আরো ঘনিষ্ঠ হই। পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও অধীনস্তসহ সবাইকে কুরআনের কাছে থেকে কাছে আনার ফিকির করি। [চলবে]
লেখক: মহাপরিচালক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/