।। মুফতি আবদুল্লাহ নোমান ।।
বর্তমান শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের এক ভয়াবহ মহামারীর নাম পর্ণোগ্রাফি। যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে পতিতার চিত্রায়ন। এর প্রতি প্রথমে তৈরি হয় কৌতূহল, এরপর আগ্রহ, আগ্রহ থেকে অভ্যাস আর অভ্যাস থেকে আসক্তি। পর্ণোর ভয়াল থাবায় মানবতা আজ বিপর্যস্ত। আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে ধর্ষণ, মাস্টারবেশন, সমকামিতা এবং পরকীয়াসহ নানা অপকর্ম। বিলুপ্ত হচ্ছে মানুষের সুকুমারবৃত্তির সুবাস, হারিয়ে যাচ্ছে শালীনতা ও লজ্জাশীলতার ভূষণ। ফিকে হয়ে আসছে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ। পর্ণোর করালগ্রাসে দাম্পত্য জীবনেও জ্বলছে অশান্তির আগুন। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে হতাশা, অকর্মণ্যতা এবং বেকারত্বের অভিশাপ। পর্ণোর ধোঁয়াটে উন্মাদনায় হৃদয়পাড়ায় সৃষ্টি হয় এক দুর্বিষহ যন্ত্রনা। জীবনটা হয়ে উঠে এক ঘোরতর বেদনা। পর্ণোর সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা ডিপ্রেশনের তীব্রতায় কেউ কেউ বেছে নেয় আত্মহত্যার সর্বনাশা পথ। তাছাড়া পর্ণোর সর্বনাশা ঝড় নিভিয়ে দেয় ঈমানের চেরাগ। বেহায়াপনার জোয়ারে ঝুঁকির মুখে পড়ে নৈতিকতার বাঁধ। অপবিত্রতার খানাখন্দে বিলীন হয়ে যায় আত্মার পবিত্রতা। একটু চিন্তা করে দেখুন তো, সারা পৃথিবীতে আজ লক্ষ-লক্ষ মানুষ পর্ণোগ্রাফিতে আসক্ত। এই আসক্তি আপামর জনসাধারণের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। নিজের অজান্তেই নিজের অসংখ্য ক্ষতি করে বসছে। বেশির ভাগ মানুষই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত নয়। আমাদের বর্তমান সমাজ যেখানে শারীরিক সুস্থতা নিয়ে অনেক সচেতনতা সৃষ্টি করছে, সেখানে পর্ণোগ্রাফির বিষয়টাতে এমন অসচেতনতা সত্যিই দুঃখজনক। তাই পর্ণোর মুখোশ উন্মোচন এবং তার ঘাতক রূপ সবার সামনে তুলে ধরা সময়ের অপরিহার্য দাবি।
নগ্নতা শয়তানের হাতিয়ার
তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় পর্ণোগ্রাফি ও অশ্লীল ভিডিও বর্তমানে এতটাই সহজলভ্য হয়ে গেছে যে, নর্তকীদের নির্লজ্জ নোংরামি এবং ভাড়ামি দেখার জন্য এখন সিনেমা হলের প্রয়োজন পড়ে না। এক ক্লিকে হারিয়ে যাওয়া যায় বেহায়াপনার নীল জগতে। হাতের মুঠোয় কিংবা পকেটে রাখা ছোট্ট মোবাইলেই এখন সব ওপেন। চরম বেদনার কথা হলো, অনেক দ্বীনদার শ্রেণিও অভিশপ্ত এ নেশা থেকে মুক্ত নয়। তাছাড়া সত্তোরোর্ধ্ব বৃদ্ধও পর্ণোগ্রাফি এডিক্টেড মর্মে খবর শোনা যায়। যিনি হয়তো কিছুদিন পরেই কবরে পাড়ি জমাবেন। হায়! অবক্ষয়ের কোন প্রান্তে এসে আমরা পৌঁছেছি! বস্তুত মানুষকে জাহান্নামের দিকে ধাবিত করার জন্য শয়তানের অন্যতম অস্ত্র হলো নগ্নতা। তাইতো সে আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম (আ.)ও হাওয়া (আ.)কে জান্নাত থেকে বের করার জন্য এ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়েছিল। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- ‘হে আদম সন্তান! শয়তান যেন তোমাদের বিভ্রান্ত না করে ফেলে, যেমন সে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে এমতাবস্থায় বের করেছিল যে, তাদের (দেহ) থেকে তাদের বস্ত্র অপসারিত করে দিয়েছিল তাদের লজ্জাস্থান তাদের দেখানোর জন্য। (সূরা আ’রাফ- ২৭)।
মানুষকে নগ্ন করে বিপথে নেওয়ার মিস্টার ইবলিশের সেই চক্রান্ত এখনো চলমান। আরো আকর্ষণীয়ভাবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে। নেট দুনিয়ায় উন্মুক্ত বিচরণের সুযোগ আবিষ্কারের মাধ্যমে।
পর্ণোগ্রাফির বিষক্রিয়া
মানুষের শরীর নিয়ে রমরমা ব্যবসার ঘৃণ্য কালচার যুগ যুগ ধরে চলমান। এই একবিংশ শতাব্দীতে এর নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা যেন আরো চাঙ্গা হয়ে উঠছে ক্রমান্বয়ে। এর ভয়ানক দৃষ্টান্ত ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার কল্যাণে (?) পর্ণো ভিডিওর বিশ্বময় সয়লাব। গবেষণা বলছে, পর্ণো শুধু মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন করেই ক্ষান্ত হয় না; বরং তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচার, কর্মোদ্দীপনা ও কর্মদক্ষতার ওপরও চরম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এমনকি ব্যক্তি জীবন ছাড়িয়ে সমাজে অস্থিরতা, অপরাধ প্রবণতা ও নানা রকম সহিংসতা বৃদ্ধিতেও অসামান্য ভূমিকা পালন করে পর্ণো। তাই পর্ণো আসক্তি নিঃসন্দেহে বিষধর সাপ তুল্য। যার বিষক্রিয়ায় হাল জমানার অনেক সম্ভাবনাময় তরুণদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে। ভাটা পড়ছে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায়। নষ্ট হচ্ছে তাদের অর্থ, স্বাস্থ্য ও সময়। অপরাধ জগতের গডফাদারে পরিণত হচ্ছে পিতার হাড়ভাঙা পরিশ্রমে লালিত ধন এবং বুকের বাধঁন। মায়ের স্নেহ ভালোবাসায় প্রস্ফূটিত গোলাপ ঝরে পড়ছে কলিতেই । মুখ থুবড়ে পড়ছে তাদের স্বপ্নের ময়ূর। ফলে কান্নার নোনা জলে ভাসছে ভুক্তভোগী মা-বাবার জীবনতরী। অথচ সে মা-বাবাই সন্তানের হাতে নির্বিঘ্নে তুলে দেন স্মার্টফোন নামক কালসাপ। এর এক ছোবলে যে কারও প্রাণনাশ হতে পারে। সাপের বিষকে কাজে লাগানো কি সবার সাধ্যের বিষয়!
সময় কাটানো কিংবা বাড়তি কিছু শেখার খোঁড়া অজুহাতে তাদেরকে নানা উপলক্ষ্যে সারপ্রাইজ দেওয়া হয় ইলেকট্রনিক ডিভাইস। পরিবারের ছোট থেকে ছোট কোনো সদস্যও ইমু, মেসেঞ্জার কিংবা ইউটিউবের ছুঁতোয় নেটে প্রবেশ করতে পারে। অভিভাবকগণও এটাকে সহজভাবে নেয়, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখে। অথচ এর মাধ্যমেই তারা নিজ সন্তানদের নীতি-নৈতিকতাকে গলাটিপে হত্যা করে। ছুরি চালায় তাদের সোনাঝরা রঙিন মখমল শৈশবের নরম গলায়।
পর্ণোর শারীরিক ক্ষতি
অনেকে মনের বিষন্নতা দূর করার জন্য মিউজিক কিংবা পর্ণোগ্রাফিতে হারিয়ে যায়। এতে সাময়িক আনন্দ উপভোগ করলেও পরক্ষণেই তাকে হতাশা এবং দুশ্চিন্তা অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে। তা অনেকটা জাঙ্ক ফুডের মতো। স্বাস্থ্যকর খাবার দেহ গঠনে সহায়তা এবং ভিটামিনের ঘাটতি পূরণসহ নানা উপকার করে থাকে। অপরদিকে জাঙ্ক ফুড জিহ্বায় সুস্বাদু লাগলেও দিনশেষে তা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জটিল কঠিন রোগ শরীরে বাসা বাঁধে তার অজান্তেই। মর্মবেদনা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূরীকরণে পর্ণোগ্রাফি দেখতে থাকা ঠিক তেমনই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পর্ণো ইন্ডাস্ট্রি পুরুষ ডমিনেটেড ইন্ডাস্ট্রি। এর অধিকাংশ গ্রাহক পুরুষরাই। অথচ তা তাদেরই অবর্ণনীয় ক্ষতিসাধন করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বীরদর্পে ব্যবসা করে যাচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। কতইনা বোকা পুরুষজাতি! কোথায় তাদের বিবেক বুদ্ধি! ক্যাম্বিস ইউনিভার্সিটির একটি স্টাডিতে দেখা যায়, পর্ণো আসক্ত ব্যক্তিদের যৌন চাহিদা ও সক্ষমতা অন্যদের থেকে কম। নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে দেখা দেয় সেক্সুয়াল ডিসফাংশন। যারা যত বেশি পর্ণো দেখে তাদের সেক্সুয়াল পারফরমেন্স তত কমে যায়। এছাড়াও নানা স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দেয় তাদের। যেমন প্রস্রাবের প্রবলেম, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া, ক্ষয় রোগ, মাথাব্যথা, ঘাড় ব্যথা ইত্যাদি।
পর্ণোর মানসিক ক্ষতি
পর্ণোর যেমন শারীরিক ক্ষতি রয়েছে, রয়েছে মানসিক ক্ষতিও। তা মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি, স্মৃতিশক্তি ও বিচক্ষণতা কমিয়ে দেয়। বিরূপ প্রভাব ফেলে কর্মদক্ষতা ও প্রাণবন্ততায়। তৈরি করে ডিপ্রেশন, মনোবেদনা এবং দুশ্চিন্তা। প্রিয়জনদের সাথেও সৃষ্টি হয় মনোমালিন্য। রোমান্টিক সম্পর্কগুলো ভরে যায় তিক্ততায়। হুমকির মুখে পড়ে দাম্পত্য জীবনের স্থিতিশীলতা। ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণা, অবহেলা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের আগ্নেয়গিরি দম্পতির মন মানসে। বস্তুত পর্ণো পরস্পরের ভালোবাসা শেখায় না; শুধু লালসা চরিতার্থ করাই শেখায়। গবেষণা বলে, পর্ণ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক চিন্তা প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। তাছাড়া পর্ণো আসক্তির কারণে পরকীয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় বহুগুণ। ৫৬ শতাংশ ডিভোর্স পর্ণোগ্রাফির এডিকশনের কারণেই হয়। তাই পর্নোগ্রাফি ব্যক্তি জীবনের জন্য যেমন চরম অভিশাপ, তেমনি দাম্পত্য জীবনের জন্যেও মারাত্মক রিস্ক। তাছাড়া অনেকেই অশ্লীল ভিডিওর নর্দমায় হাবুডুবু খেয়ে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। হৃদয় জমিন চৌচির হয় বিষন্নতা ও বিষাদগ্রস্ততার খরায়। কলুষতার বিষবাষ্পে তাদের জীবন হয়ে উঠে যন্ত্রণাময়, অস্বস্তিকর। পর্ণোগ্রাফির বিষাক্ত ছোবলে আজ জর্জরিত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র।
পর্ণোগ্রাফি ও মাস্টারবেশন
পর্ণোর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত মাস্টারবেশন বা হস্তমৈথুন। অনেকে পর্ণো দেখে সানন্দে হস্তমৈথুন করার জন্য। আবার কেউ পর্ণো দেখার পর অবচেতন মনে মাস্টারবেশন করে ফেলে। ১৯৬৮ সালে যখন মাস্টারবেশনকে স্বাভাবিক বলে মনোরোগের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় এর পরের বছরই সর্বপ্রথম রিলিজ হয় পর্ণো মুভি। বিশ্বের বড় বড় সাইনটিস্টরা পর্ণোকে খারাপ বললেও মাস্টারবেশনকে তারা নির্লজ্জভাবে সমর্থন করে। কেননা, মাস্টারবেশনের ওপরেই টিকে আছে পশ্চিমা নরপিশাচদের হাজার কোটি ডলারের পর্ণো ইন্ডাস্ট্রি। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পর্ণো কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন তথা দশ হাজার কোটি ডলার আয় করে থাকে। টপ লেভেলের পাঁচটি পর্ণো সাইট প্রতিদিন ২০ কোটি বার ভিজিট হয়। নিঃসন্দেহে মানবতার চিরশত্রু এই পর্ণো ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রেখেছে পর্ণো দর্শকরাই। তাদের অসংখ্য নগ্ন ভিডিওর ভিউই এই ভ্রষ্ট কোম্পানির বীরদর্পে এগিয়ে যাওয়ার মূল নিয়ামক। অথচ পর্ণোগ্রাফি ও মাস্টারবেশনের ধ্বংসযজ্ঞে দেশের সোনার ছেলেদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এ পাপদ্বয়ে তারা অহর্নিশি লিপ্ত হয়ে নিজের অজান্তেই নিক্ষিপ্ত হচ্ছে ধ্বংসের অতল গহ্বরে। কখনো কি ভেবে দেখেছি? যারা পর্ণোর সাদা নীলের জগতে হারিয়ে অভিশপ্ত এই ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে থাকতে সাহায্য করছে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ শাস্তি; দুনিয়াতে ও আখেরাতে। এপারে যেমন তাদের ব্যর্থতা নিশ্চিত, ওপারেও তাদের শাস্তি সন্দেহাতীত। পবিত্র কুরআনে হুঁশিয়ারি বাণী উচ্চারণ করে রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘যারা কামনা করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতা প্রসার হোক, নিশ্চয়ই তাদের জন্য রয়েছে যাতনাদায়ক শাস্তি দুনিয়া ও আখেরাতে। আর আল্লাহ জানেন তোমরা জানো না।’ (সূরা নূর : ১৯) নেটে বুঁদ হয়ে থেকে আপনি অশ্লীলতার প্রচারে সহযোগী হচ্ছেন না তো? মানবতার শত্রু পর্ণো ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন না তো? ভাবার বিষয়!
পর্ণো আসক্তি বনাম মাদকাসক্তি
মেডিকেল সাইন্সের কথা হলো, আমাদের ছোট বড় প্রতিটি আনন্দ ও ভালো লাগার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে ব্রেইন থেকে নিঃসরিত ডোপামিন নামের এক প্রকার হরমোন। আমরা যে কাজে যত বেশি আনন্দ অনুভব করি সে কাজে ডোপামিন তত বেশি নিঃসরণ হয়। ফলে সুযোগ পেলেই ব্রেইন এতে ডু মারতে চায়। মাদক যেমনিভাবে বেশি পরিমাণ ডোপামিন বের করে সুখানুভূতির মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তি সেই মজা পেতে বারবার মদপান করতে থাকে তেমনি পর্ণোর ক্ষেত্রেও একই কারিকুলামে আসক্তির সৃষ্টি হয়। তাছাড়া পূর্বে যে পরিমাণ ডোপামিন বের হলে মজা অনুভব হতো সে পরিমাণ ডোপামিন বের করতে ক্রমান্বয়ে মাদকের ডোজ বাড়াতে হয়। পর্ণোতেও একই ঘটনা ঘটে। পর্ণো দেখতে দেখতে একই জাতীয় পর্ণো আর ভাল্লাগেনা, তৃপ্তি মেটে না। মস্তিষ্ক বৈচিত্র খুঁজতে থাকে। তাই আরো হাই লেভেলের পর্ণো দেখতে সে নেট দুনিয়ায় স্ক্রল করতে থাকে মাইলের পর মাইল। সাদা নীলের জগতে ব্যয় করতে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। ইলেকট্রনিক্স এই যুগে পর্ণো ভিডিও অনেকটা মাদকদ্রব্যের মতো কাজ করে। শরাব যেমন দেহ বা শরীরের তরল মাদক, তেমনি পর্ণো চোখ ও নফসের অতরল মাদক। সচরাচর যে কোন মাদকই নেশার উদ্রেককর। মিউজিক ও অশ্লীল ভিডিও এর ব্যতিক্রম নয়। পানীয় মাদকের নেশায় মানুষ পশুর চেয়েও নিচে নেমে যায় কাজকর্মেও চিন্তা-চেতনায়। পর্ণোগ্রাফির মাদকতায় ধ্বংসাত্মক নানা পাপাচারে কুকুর শূকরকেও সে ছাড়িয়ে যায়। তাইতো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা World Health Organization পর্ণো এডিকশনকে একটি আচরণগত রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘অক্সিটোসিন’কে বলা হয় ভালোবাসার হরমোন। কারণ, এই হরমোন দু’জন মানুষের মাঝে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। সহবাসের সময় যেমন এই হরমোন নিঃসৃত হয় তেমনি পর্ণো দেখার মুহূর্তে এই হরমোন নিঃসরণ হয়। যা পর্ণোর প্রতি টান এবং আকর্ষণ সৃষ্টি করে।
পর্ণোর ভিকটিম নারী সমাজ
সন্দেহ নেই, মানবতার ধর্ম ইসলাম নারীকে আসীন করেছে রানীর মর্যাদায়। প্রদান করেছে তাকে সম্মানের রাজমুকুট। কিন্তু বর্তমানে তাদের সাথে পুরুষের আচরণ এতটাই বিষজর্জর এবং বীভৎস, যেন তারা ভিনগ্রহের প্রাণী, অনুভূতিহীন নির্বোধ জীব। এর পেছনে অভিশপ্ত পর্ণো এবং হলুদ মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত শক্তিশালী। পর্ণো আসক্ত ব্যক্তি নারীদেরকে অনুভূতিহীন ভোগ্যপণ্য এবং পুরুষদেরকে যৌন-তাড়িত প্রাণী হিসেবেই দেখে। তার কাছে নিজেকে এবং অন্যকে একটি সেক্সুয়াল মেশিন বা যৌন বস্তুর চেয়ে বেশি কিছু মনে করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাই মহিলাদের প্রতি সহিংসতাপূর্ণ আচরণ এবং পাশবিক নির্যাতনকেও মেনে নেয় সে সহজভাবে। ঘাতক পর্ণোর সবচেয়ে বড় ভিকটিম হয় নারী জাতি।
অনলাইনে অফলাইনে একদিকে যেমন তাদেরকে নরপশুদের ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট’-এর শিকার হতে হয়, অন্যদিকে ঘরের ভেতর পর্ণো আসক্ত স্বামীর সহিংসতা ও নির্যাতনেও পিষ্ট হতে হয়। পর্ণোতে মেকাপ, সার্জারি, এডিটিং, অভিনয় ইত্যাদি করে অনেক কিছুই অতিরিক্ত দেখানো হয়, বাস্তবতার সঙ্গে যার মিল নেই। এদিকে দর্শক তা বাস্তব মনে করে সঙ্গীকে অন্যভাবে কল্পনা করতে শুরু করে। পর্ণোর ধাঁচে পার্টনারকে না পেয়ে পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি হয় ঝগড়া- বিবাদ। এর জের ধরে অনেক সময় সংসারও ভেঙে যায়। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, নারীদের প্রতি সহিংসতা ও কদর্যতার নানা কৌশলের আবিষ্কারক এই পর্ণোগ্রাফি। তাছাড়া শিশুধর্ষণ থেকে শুরু করে শিশুপাচার, নারীপাচার, খুন, গুমসহ দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের পেছনেও পর্ণোর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
পর্ণোগ্রাফি ও শিশু-কিশোর
তিক্ত হলেও সত্য, প্রতিবছর শিশু কেন্দ্রিক পর্ণোর জনপ্রিয়তা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। একটা স্টাডিতে দেখা যায়, ২০১৯ সালে প্রায় সাত কোটি শিশুকে সেক্সুয়ালী অ্যাবিউজড্ পাওয়া গেছে। তাছাড়া পর্ণোগ্রাফি তৈরির কাজেও যুক্ত হচ্ছে প্রায় ত্রিশ শতাংশ শিশু। দিন যত গড়াচ্ছে এই চিত্র আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশের এক জরিপে দেখা গেছে, স্কুলপড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ পর্ণো এডিক্টেড। ইউরোপ আমেরিকায় প্রতিবছর ২০ লক্ষ শিশু পাচার হয়। ল্যাটিন আমেরিকায় আরো ৪০ লক্ষ শিশু এই যৌন পেশায় নিয়োজিত। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, জার্মান ইত্যাদি দেশগুলোতে পাচার হয় লক্ষ লক্ষ শিশু। আমাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য সেই ঘাতকরাই আয়োজন করে বিশ্বকাপের জমকালো নগ্নোৎসব। মুসলিম নামধারী যুবকরা তাদের সাপোর্টার হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। রকমারি পতাকার বাহারে রঙিন করে তুলে রাস্তাঘাট।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
হায়! নির্লজ্জতার শেষ কোথায়! অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো বর্তমানে শিশু-কিশোররা পর্ণোর ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে দুর্বার গতিতে ধাবমান। মন্দ পরিবেশ বা অসৎ সঙ্গের পাল্লায় পড়ে। এসব শিশুরা যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা পরিবারের সাথে থাকে, তখনো দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকে তাদের অসুস্থ মন। পর্ণোর জগতে ফিরে যাওয়ার জন্য আকুপাকু করতে থাকে তাদের রুগ্ন অন্তর। লোক চক্ষুর আড়ালে একাকী থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে পর্ণো দেখার সুবিধার্থে। নিজেকে পারিবারিক ও সামাজিক কাজগুলো থেকেও গুটিয়ে রাখে। আচরণের পরিবর্তন দেখা যায় তাদের। যখন তখন রেগে ওঠে। মেজাজ থাকে খিটখিটে। বাস্তবে শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা যা দেখে তা প্র্যাকটিক্যালি করতে চায়।
১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী পর্ণো এডিক্টেড শিশু- কিশোরদের ক্ষেত্রে খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় আত্মঘাতী প্রবণতা, জীবনবিধ্বংসী সহিংসতা। দিহান আনুশকাদের লোমহর্ষক ঘটনাগুলো কি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না পর্ণের কদর্যতার ভয়াবহ রূপ? পর্ণো এডিকশন ছেলে ও মেয়ে শিশু উভয়ের ধর্ষণের প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে না বহুগুণ? ১০-১১ বছরের কোমলমতি শিশুরাও এখন হার্ডকোর পর্ণোর নিকৃষ্ট দৃশ্য দেখে এবং স্বাভাবিকভাবেই যৌন সহিংস কাজে জড়িয়ে যায়। ভেবে দেখুন তো, এটা আমাদের মূল্যবোধকে কোথায় নামিয়ে দিচ্ছে! পর্ণোগ্রাফি বাচ্চাদের ফুলেল চরিত্র অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
পর্ণ আসক্তি থেকে পরিত্রাণের উপায়
সবাই জীবনে সফল হতে চায়। সুখী ও সৌভাগ্যবান হতে চায়। নিরাপদে, স্বস্তিতে, শান্তি ও প্রশান্তিতে দিনাতিপাত করতে চায়। স্বপ্ন দেখে জীবনে বড় কিছু হতে। আপনিও নিশ্চয় এর ব্যতিক্রম নন। আপনি যদি স্বপ্নভঙ্গের বেদনা থেকে পরিত্রাণ চান, আশা ঝলসে যাওয়ার কান্না থেকে বাঁচতে চান, আর এগিয়ে যেতে চান জীবনের টার্গেটে সংহত পদক্ষেপে, তাহলে মন থেকে সিদ্ধান্ত নিন, এখন থেকে আর পর্ণো দেখবেন না। কালক্ষেপণ না করে দুর্বার গতিতে ছুটে চলুন জীবনের লক্ষ্য পানে। নিজেকে প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যস্ত রাখুন। ক্যারিয়ার গড়ার পেছনে সময় দিন। ত্যাগ ও আত্মত্যাগে হাসিয়ে তুলুন চারপাশ। উম্মাহর কথা ভাবুন। অসহায়দের পাশে দাঁড়ান। দাওয়াত ও তাবলীগের কল্যাণময় মেহনতে নিজেকে জড়িত রাখুন। পরিশুদ্ধ করুন অন্তরাত্মা। পথহারা মানুষকে ডাকুন দ্বীনের পথে। মনে রাখবেন, আপনার নৈতিক অবক্ষয় যেমনি অনেকের অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করবে, তেমনি আপনার আত্মিক উৎকর্ষতা অনেকের জান্নাতের পথিক হওয়ার পথ সুগম করবে।
বদলে যান, বদলে দিন
একবার ভাবুন তো, পর্ণো আসক্তি কীভাবে আমাদের পেশা এবং সামাজিক জীবনের ওপর কুপ্রভাব ফেলছে? বন্যপশুর চেয়েও নিচে নামিয়ে ফেলছে আমাদের আচার-আচরণ! জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে দিচ্ছে কি পর্ণো এডিকশন? এসব প্রশ্ন নিজেকে বারবার করুন। দেখবেন, পর্ণোর নাম নিতেও আপনার ঘৃণা লাগবে। সুখের কথা হলো, পর্ণো ছাড়ার মাধ্যমে আপনি মানবতার রক্তখেকো অভিশপ্ত ইন্ডাস্ট্রির শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। নিজেকে এবং পুরো সমাজকে বদলানোর একটি মধুর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। ব্যাপারটা সত্যিই অসাধারণ নয় কি? আপনি হয়তো ভাবছেন, এখনো আমি যুবক। যৌবন তো ফ্যান্টাসি করার সময়। আমোদ-প্রমোদে মেতে ওঠার মাহেন্দ্রক্ষণ। বার্ধক্যের ভারে যখন নুয়ে পড়ব তখন তো পাক্কা আল্লাহর অলি হয়েই কবরে যাব। প্রিয় বন্ধু! কবরস্থানে তো নীরবে-নিভৃতে শুয়ে আছে এমন অনেক যুবক, যাদের আগামীকাল থেকে ভালো হওয়ার কথা ছিল। কারো বা নিয়ত ছিল, বৃদ্ধ বয়সে পূর্ণ ধার্মিক হয়ে যাবে। তারা কি সেই সুযোগ পেয়েছে? আপনিও যে পাবেন তার কী গ্যারান্টি আছে? তাই আর দেরি নয়। বদলে যান, বদলে দিন। স্বস্তি পান, স্বস্তি দিন। আজকেই, এখনই।
ব্যস্ত রাখুন নিজেকে
মনোবিদদের ভাষ্যমতে হাতে কোন কাজ না থাকলেই পর্ণো দেখার ইচ্ছেটা খুব বেশি বাড়ে। কর্মব্যস্ততা না থাকাই হলো নৈতিক অধঃপতনের অন্যতম কারণ। তাই পর্ণোর অভিশাপ থেকে বাঁচতে হলে অলস সময় পার করা যাবে না। বেকার সময় কাটানো যাবে না। অলস ও অকর্মণ্যদের জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে মোটেও ভুল করে না শয়তান। সাদা নীল জগতের নালা নর্দমায় বনি আদমকে নিক্ষেপ করে ইবলিশ হাসতে থাকে। রাক্ষসের অট্টহাসি। বেকার সময়ের সুবর্ণ সুযোগকে লুফে নিতে সে হামলা চালায় খুব সূক্ষ্মভাবে। তাই ফাঁকা সময়ে ডিভাইস নয়; ইসলামী বই পড়ুন। জীবন গড়ুন। সমৃদ্ধ করুন জ্ঞানের ঝুলি। শাণিত করুন চেতনা। কুরআনের তাফসীর পড়ুন। সিরাত চর্চা করুন। মসজিদে, ঘরে তালীমের ব্যবস্থা করুন। খালি সময় বা কাজের ফাঁকে ফাঁকে মুখে চালু রাখুন আল্লাহর যিকির। পড়তে থাকুন, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদুলিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী পৃথিবীর সকল ধনভান্ডারের মালিক হবার চেয়েও এ বাক্যগুলো বলা অনেক বেশি উত্তম। (মুসলিম- ৬৭৪০)।
কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরীফ ও ইস্তেগফারে মুখরিত রাখুন আপনার যবান, সঞ্চয় করুন আখিরাতের পুঁজি। পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতের সাথে পড়ার চেষ্টা করুন। জেনে অবাক হবেন, মানুষ চির সুখের জান্নাতে প্রবেশ করেও একটি বিষয়ের জন্য খুবই আফসোস করবে। আর তা হলো আল্লাহর যিকির ব্যতীত অলস কাটানো সময়। (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান- ৫১২)। নেটের অসুস্থ পরিবেশে সময় নষ্ট না করে রসিক ভ্রমর হয়ে যান জান্নাতের ফুলবাগিচার। বর্ণিল ইবাদতে ও স্বপ্নীল বন্দেগীর মোহনীয় সুবাসে আমোদিত করে রাখুন জীবনের উঠোন।
ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারে সতর্ক হোন
প্রিয় ভাই! আপনি কি চান না জীবনের অঙ্গণে বরণীয় হতে? সাধনার প্রাঙ্গণে স্মরণীয় হতে? সর্বোপরি ইহ-পরকালে মহাসৌভাগ্যবান হতে? তাহলে আর দেরি কেন? সৎসাহস বুকে নিয়ে পর্ণোকে চিরতরে ‘না’ বলুন। নোংরামির ভাইরাসকে ঝেটিয়ে বিদায় জানান আপনার জীবনাচার থেকে। যতটা সম্ভব মোবাইল থেকে দূরে থাকুন। পারলে বাটন ফোন ব্যবহার করুন। নিদেনপক্ষে দুই থেকে তিন মাস স্মার্টফোনের সঙ্গ ত্যাগ করুন। পর্ণো আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে এটি অত্যন্ত কার্যকরী। প্রয়োজনে স্মার্টফোন ব্যবহার করলেও তাকে একটা লিমিটে নিয়ে আসুন। নির্ধারিত সময়ের বাইরে অবশ্যই নেট থেকে বিরত থাকা চাই। আর সন্তানদের প্রতি লক্ষ রাখুন। তারা যেন ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে বাথরুমে যেতে না পারে। আর ল্যাপটপ, কম্পিউটার উন্মুক্ত স্থানে রাখুন। যাতে তা সবার নজরে পড়ে। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন, নেটের সর্বব্যাপী আয়োজনটাই নোংরামির কন্টেন্টে ভরা। এতে মানুষ খুব সহজেই চোখের গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায় এবং এটাকে খুব স্বাভাবিক ধরে নেয়। অথচ হাদিস শরীফে কত কঠিন কথা বলা হয়েছে এ প্রসঙ্গে-زنا العين النظر দৃষ্টি নিক্ষেপ হলো চোখের যিনা’। (সহীহ বুখারী- ৬২৪৩)।
সন্দেহ নেই, চোখের যিনার রেশ ধরেই মানুষ পর্ণোগ্রাফির অনলে ঝাঁপ দেয়। তাই এর লাগাম টেনে ধরতে হবে সূচনাতেই। অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনেও দৃষ্টিশক্তি সংযত রাখতে হবে। ফোন এবং ল্যাপটপের স্ক্রিনে লিখে রাখুন- Allah is watching ‘আল্লাহ আমাকে দেখছেন’। বেডরুমেও আর্ট বা ক্যালিগ্রাফি করে লিখে রাখতে পারেন। মহান আল্লাহ বলেন- ألم يعلم بأن الله يرى ‘সে কি জানে না যে, আল্লাহ দেখছেন’। (সূরা আলাক- ১৪)।
মনের সাথে যুদ্ধ করুন
রাত যত গভীর হয় শয়তানের প্ররোচনা এবং নফসের তাড়না পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। তাই রাত দশটা বা এগারোটার পর বেডরুমে একা একা ডিভাইস হাতে নিবেন না। ঘুমের মাসনুন আমল করে যিকির করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ুন দ্রুত। আর হ্যাঁ, কখনো মনে পর্ণো দেখার কুপ্রবৃত্তি জেগে উঠলে মনোযোগ অন্যদিকে ডাইভার্ট করার চেষ্টা করুন। মনের সাথে যুদ্ধ করে হলেও অন্য কোন কাজে লেগে যান। এক্সারসাইজ করুন। একাকীত্বের বলয় ভেঙে জনসমাগমে চলে আসুন। গল্পে মেতে উঠুন পিতা-মাতা, ভাই-বোন কিংবা বন্ধুবান্ধবদের সাথে। জান্নাতের ফুলকলি শিশুদের সাথে খেলা করুন। আপনার পছন্দের কোন ইসলামী স্কলারের লেকচার শুনুন। কোন বুজুর্গ আলিমের হৃদয়স্পর্শী বয়ান শুনুন। দেখবেন পর্ণো দেখার তাড়না নাই হয়ে যাবে আপনাতেই। এভাবে মনের সাথে যুদ্ধ করে যদি আপনি বিজয়ী হতে পারেন, তাহলে আপনার ঠিকানা কোথায় জানেন? আল্লাহ তাআলার ভাষায় শুনুন-
وأما من خاف مقام ربه ونهى النفس عن الهوى. فإن الجنة هي المأوى.
‘আর যে ব্যক্তি রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করেছে এবং নিজেকে কুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত রেখেছে, জান্নাতই হবে তার ঠিকানা’। (সূরা নাজিয়াত- ৪০-৪১)।
বিশ্বাস করুন, আল্লাহর ভালোবাসায় আপনার এ ত্যাগ আপনাকে পৌঁছে দিবে জান্নাতী সেই স্বর্ণতোরণে, যা বর্ণনাতীত সৌন্দর্য ও দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যে দয়াময় রব সাজিয়ে রেখেছেন আপনার জন্য। হ্যাঁ, আপনার জন্যই। সেখানে আপনি ধন্য হবেন করুণাময় রবের দর্শনে। স্বচক্ষে দেখতে পাবেন তাঁকে। যা মুমিনের পরম আরাধ্য। সুমহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
وجوه يومئذ ناضرة. إلى ربها ناظرة.
অর্থাৎ- ‘সেদিন কিছু চেহারা খুব উজ্জ্বল দেখাবে। তারা তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে’। (সূরা কিয়ামাহ- ২২-২৩)।
তাই হারাম দৃষ্টির ইচ্ছেটা হেরে যাক আসমানি ভালোবাসার কাছে। পর্ণো দেখার ইচ্ছা জাগলেই গুনগুনিয়ে বলতে থাকুন-
‘যে চোখে দেখব প্রিয়তম রব, সে চোখে পর্ণো কী করে সম্ভব!
পর্ণো সাইট ব্লক করুন
কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের অ্যাডাল্ট যে ছবি বা ভিডিও বা অন্যান্য কনটেন্টগুলো আছে সেগুলো মুছে ফেলুন। সেই সাথে ব্রাউজার হিস্ট্রি ক্লিয়ার করে ফেলুন। আনন্দের কথা হলো বর্তমানে পর্ণোগ্রাফি সাইট খুবই সহজেই ব্লক করা যায়। আপনি চাইলে ১ মিনিটেই পর্ণোগ্রাফির সাইড বন্ধ করে দিতে পারবেন। আপনি যদি নিজেকে, ছোট ভাইকে বা আপনার সন্তানকে পর্ণোর কালো ছায়া থেকে বাচাতে চান তাহলে অবশ্যই এই সাইড ব্লক করে দিন। প্রথমে মোবাইলের সেটিং এ চলে যাবেন। খুঁজে বের করুন Connection & sharing- অপশনে প্রবেশ করুন। তারপরে প্রাইভেট ডি এন এস (Private DNS) এই অপশনে টাচ করুন। এখন তিনটি অপশন দেখতে পাবেন। এর মধ্য থেকে Private DNS provider hostname -এই অপশনে টাচ করুন। এখানে adult-filter-dns.cleanbrowsing.org -এই লেখাটা লিখে সেভ করে দিন। এতোটুকু করলেই সমস্ত পর্ণো সাইট আপনার ফোন থেকে বন্ধ হয়ে যাবে। আপনার এই মধুর কুরবানী আপনার জন্য বয়ে আনবে অফুরন্ত কল্যাণ, অসামান্য প্রতিদান। আপনার জীবন হোক ঈর্ষায় ঈর্ষায় ছাওয়া; ফলময়তায় নুওয়া। চির সুখের জান্নাত আপনার অপেক্ষায় । অপরূপা হুরেরা আপনার প্রতীক্ষায়। যাদেরকে রব স্বর্গীয় সৌন্দর্যে সৃষ্টি করেছেন আপনার জন্যই। তাই পঁচা নর্তকী দেখার ইচ্ছেটা হেরে যাক জান্নাতী রমণীদের প্রণয়ের কাছে।
দোয়া করুন অশ্রুসিক্ত নয়নে
পর্ণো আসক্তি থেকে বাঁচতে সাধ্যানুযায়ী সব চেষ্টা চালিয়ে যান। তাকওয়া বা আল্লাহভীতি হৃদয়ে জাগরুক রাখুন অনুক্ষণ। অতীতের গুনাহগুলো মুছে ফেলুন তাওবার অশ্রুতে। করুণাময় রবের সকাশে আত্মসমর্পণ করে উদ্দীপ্ত হোন নবজীবনে । সর্বোপরি আল্লাহর কাছে সকাতর প্রার্থনা করুন। ঝর ঝর করে চোখের অশ্রু ফেলে দোয়া করুন। তিনি যেন পর্ণো আসক্তি কাটিয়ে আপনাকে গুনাহমুক্ত জীবন দান করেন। ঈমান ও আমলের উপর আমৃত্যু অবিচল রাখেন।
থামুন, একটু ভাবুন প্রিয় ভাই! একটু কল্পনা করুন তো। আপনি একজন সৌভাগ্যবান মুসলিম রাজপুত্র। আপনার জীবনকে রাঙিয়ে দিতে আসবে একজন রাজকন্যা। যে হবে আপনার স্বপ্নের রানী। মধুর এক দাম্পত্য সাম্রাজ্য হবে আপনাদের। এই পুষ্পিত সংসারে ফুটবে অনেকগুলো মানবকলি। যাদের চন্দ্রমুখের মুক্তোঝরা হাসিতে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাবে আপনার অস্তিত্বজুড়ে। তাদের আধু আধু বুল এবং মধুময় ছোটা ছুটিতে পরিবারে সৃষ্টি হবে খুশির আমেজ। বয়বে সুখানুভূতির নির্মল বাতাস। আপনার ফুলেল যৌবনকে সেই প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্যই সংরক্ষণ করুন, যাকে আল্লাহ নির্ধারণ করে রেখেছেন আপনার জন্য। তার অপেক্ষায় একটু ধৈর্য ধরুন, যাকে নিয়ে রঙিন ফানুস উড়াবেন মন-মুকুরে। জোছনাধোয়া রাতে যার সাথে মেতে উঠবেন মধুর খুশ-গল্পে। শিশির ভেজা সকালে দুজন হাঁটবেন হাত ধরাধরি করে। গোলাপ হাতে যাকে জানাবেন প্রণয়ের ম্যাসেজ। ধুমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দুজনে উপভোগ করবেন বারান্দা-বিলাস আর রিমঝিম বৃষ্টিতে করবেন বৃষ্টিবিলাস। একসাথে কোরআন তেলাওয়াত এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে হারিয়ে যাবেন রোমাঞ্চকর এক জগতে দুজন দুজনায়। তার প্রতীক্ষায় একটু সবর করা কি যায় না? বলুন! তাহলে কেন মল-মূত্রে গড়াগড়ি খাওয়া শূকরের পালের মাঝে আপনার বিচরণ?
ইন্টারনেটের পচা গলা ময়লার ভাগাড়ে আপনার বসবাস? যেখানে কোন সুস্থ মানুষ এক মিনিট থাকলেও পেট উল্টে বমি আসবে। দম বন্ধ হয়ে আসবে। কে হতে চায় মল-মূত্রের গর্তে হাবুডুবু খাওয়া এসব মানবরূপী জানোয়ারের মতো, যারা মানুষের ঘরে জন্ম নিয়েও পশুর জীবন বেচে নেয়! আপনি কি আপনার সুবাসিত অন্তরাত্মাকে সেই কুকুরদের পায়ের নিচে পিষ্ট করতে চান? আপনার এই সুন্দর নয়নজোড়া তো তারা দেয়নি আপনাকে। যিনি আপনার জীবনকে অসংখ্য নিয়ামত দিয়ে ভরপুর রেখেছেন তাকে দিব্যি ভুলে গেলেন? কখনো কি ভেবে দেখেছেন! আল্লাহ প্রদত্ত এই চোখ দুটোর অপব্যবহার করে আপনি যখন ব্লু ফিল্মে বুঁদ হয়ে থাকেন, দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকার রুমে লিপ্ত হন তার নাফরমানিতে, তখনও জানালার ফাঁক গলে তিনিই আপনার অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেন! চালু রাখেন আপনার হার্টবিট! জারি রাখেন শ্বাস-প্রশ্বাস! স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের জানালায় পর্ণের নীল অন্ধকারে ডুবে থাকা অবস্থায় যদি আপনার মৃত্যু চলে আসে, তখন কী পরিণতি হবে আপনার? একটু ভাবুন তো! কায়মনোবাক্যে দোয়া করুন বিশ্বাস করুন, হে প্রিয়! আমরা যদি আল্লাহর দিকে ফিরে আসি পর্ণ ও অশ্লীলতা বর্জন করে, আর দিবস-রজনীর প্রহরগুলো মুখরিত করে তুলি নেকি ও পূণ্যের সমাহারে, নিঃসন্দেহে আল্লাহর প্রিয়পাত্রে পরিণত হব আমরা। রাশি রাশি করুণায় আলোর বিচ্ছুরণ ঘটবে আমাদের হৃদয়ের অন্দরে। শুভ্রতার কাঙ্ক্ষিত তরী পৌঁছে যাবে আসমানী নির্ভরতার বন্দরে। সেই সাথে জীবনের চৈতালি খরা দূর হয়ে পরিলক্ষিত হবে সবুজের আবাহন। শান্তি ও প্রশান্তিতে ফুল্ল-ফুলেল হবে আমাদের জীবনকানন। হৃদয়গহীনে প্রস্ফুটিত হবে শুদ্ধতার ফুল। জাগবে নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন।
তাই আসুন! পর্ণ আসক্তি থেকে বাঁচতে যারপরনাই চেষ্টা চালাই। তাকওয়া ও আল্লাহভীতি হৃদয়ে জাগরুক রাখি অনুক্ষণ। অতীতের গুনাহগুলো মুছে ফেলি তাওবার অশ্রুতে। করুণাময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে উদ্দীপ্ত হই নবজীবনে। সর্বোপরি দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে সকাতর প্রার্থনা করি। নির্জনে চোখের পানি ফেলে দোয়া করি। আকুল ফরিয়াদ জানাই, মাবুদ, না বুঝে অনেক জুলুম করেছি নিজের উপর। এখন আমি অনুতপ্ত, লজ্জিত। পাপের অন্ধকার জগত ছেড়ে ফিরে এসেছি আপনার দরবারে! ওগো মালিক, দয়াকরে আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না খালি হাতে! আমি আপনার দয়ার ভিখারী, রহমতের কাঙ্গাল! ইয়া আল্লাহ, আমি বড় পাপী, দুর্বল, ছিন্নবস্ত্র এক। আমার পাপরাশি ক্ষমা করে দিন নিজ করুণায়! পর্ণ আসক্তি কাটিয়ে আমাকে দান করুন গুনাহমুক্ত জীবন! ঈমান ও আমলের উপর অবিচল রাখুন আমৃত্যু! رب أني مغلوب فانتصر ‘হে আমার রব, আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। এবার আপনিই ব্যবস্থা নিন।’ শয়তান ও নফসের থাবায় আমি বিপর্যস্ত। আপনিই আমাকে রক্ষা করুন। আমীন।
লেখক: উস্তাযুল হাদীস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম, কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/