পরিচালনায়- ইসলামী আইন ও গবেষণা বিভাগ
আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
সালাত বা নামাযবিষয়ক জিজ্ঞাসার শরয়ী সমাধান
(৯২৩১) মাহমুদুল আমিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম।
জিজ্ঞাসা: ২০২১ সালের দ্বিতীয় রমযানের যোহরের ফরয নামাযে ইমাম সাহেব তৃতীয় রাকাতে বসে গেলে মুসল্লিগণ লোকমা দেয়ায় ইমাম সাহেব চতুর্থ রাকাত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে যান। যথারীতি চতুর্থ রাকাত শেষ করে বসে যাওয়ার স্থলে দাঁড়িয়ে পঞ্চম রাকাত আরম্ভ করেন।
এমতাবস্থায় মুসল্লিগণ উচ্চস্বরে লোকমা দিতে থাকলে ইমাম সাহেব পঞ্চম রাকাত শেষ করে বসে সাহু সিজদার মাধ্যমে নামায শেষ করেন। এতে মুসল্লিগণ ফরয নামায আদায় হয়নি মর্মে ইমাম সাহেবকে চাপ দিতে থাকলে তিনি পুনরায় যথা নিয়মে নামায পড়ান।
আমার জানার বিষয় হল, প্রথমে যে নামায পড়ানো হয়েছে তাতে ফরয আদায় হয়েছে কি না? নাকি প্রথমবারের নামায বাতিল হয়ে দ্বিতীয় বারের নামায দ্বারা ফরয আদায় হয়েছে? বিস্তারিত জানিয়ে চিরকৃতজ্ঞ করবেন।
সমাধান: প্রশ্নোক্ত সূরতে প্রথমবারের নামায দ্বারা ফরয আদায় হয়নি। চার রাকআত নামায পাঁচ রাকাত পড়ার কারণে তা নফলে পরিণত হয়ে গেছে। অবশ্য উপর্যুক্ত পাঁচ রাকাতের প্রথম দুই রাকাত নফল বিবেচিত হবে। আর চতুর্থ রাকাতে বৈঠক না করার দরুন বাকি তিন রাকআত বাতিল বিবেচিত হবে। পুনরায় যথা নিয়মে নামায পাড়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল এবং এই দ্বিতীয়বারের নামাযের দ্বারা আপনাদের ফরয আদায় হয়ে গেছে।
উল্লেখ্য যে, কেউ যদি চার রাকাত বিশিষ্ট ফরয নামাযে ভুলক্রমে শেষ বৈঠক না করে পঞ্চম রাকআতের জন্য দাঁড়িয়ে যায় এবং পঞ্চম রাকাতও পূর্ণ করে ফেলে, তখন তার উচিত, সে যেন এর সাথে আরো এক রাকাত পড়ে নেয়, যাতে নামায ছয় রাকাতে পূর্ণ হয়। এতে কোনো রাকাত বাতিল বিবেচিত হবে না। পুরো ছয় রাকাতই নফল গণ্য হবে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ৩৪৬১, দুররুল মুখতার- ২/৬৬৪, হিদায়া- ১/১৫৯)।
(৯২৩২) মুহাম্মদ আল আমীন, বগুড়া।
সমাধান: জী, নামায সঠিক হবে। যদি কেউ ভুলবশত প্রথম রাকআতে একটি সিজদা দিয়ে পরের রাকআতে তিন সিজদা দেয়। অতঃপর সাহু সিজদা দিয়ে নামায শেষ করে, তাহলে নামায সহীহ হয়ে যাবে। (সহীহ মুসলিম- ৫৬২, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ৩৫২৫, কিতাবুল আসল-১/২০৬, মাবসুত- ২/৮০)।
(৯২৩৩) মাওলানা আব্দুল্লাহ, রাজশাহী।
জিজ্ঞাসা: কোনো ব্যভিচারিণীর সন্তান যদি আলেম হয় তাহলে তার পেছনে কি নামায পড়া যাবে? যদি নামায পড়া যায় কোন শর্তে?
সমাধান: ব্যভিচারিণীর আলেম সন্তানের পেছনে নামায পড়া জায়েয, যদি তার ইমামতিতে মুসল্লিগণ সন্তুষ্ট থাকে, নতুবা মাকরূহ। (হিদায়া- ১/১১০, দুররে মুখতর- ২/৩৫৮, রদ্দুল মুহতার- ২/৩৫৮, আল- বাহরুর রায়েক- ১/৬১০)।
(৯২৩৪) মাহবুবুল হক, ময়মনসিংহ।
জিজ্ঞাসা: মসজিদে নাবালেগ ছেলেদেরকে নামায পড়ার সময় কোন জায়গায় দাঁড় করানো হবে? তারা কি বালেগদের কাতারের সাথে মিলেমিশে দাঁড়াতে পারবে? নাকি আলাদাভাবে দাঁড়াবে? বালেগদের মধ্যে নাবালেগ দাঁড়ালে কোনো অসুবিধা আছে কি? জানতে আগ্রহী।
সমাধান: সাধারণত নাবালেগদের নামাযের কাতার হলো বালেগদের পিছনে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই কাতার বিন্যাস করতেন। সাহাবী আবু মালিক আশআরী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাতার বিন্যাস নীতি প্রসঙ্গে বলেন-
وَيَجْعَلُ الرِّجَالَ قُدَّامَ الْغِلْمَانِ، وَالْغِلْمَانَ خَلْفَهُمْ
পুরুষদেরকে নাবালেগদের সামনে দাঁড় করাতেন আর নাবালেগদেরকে পুরুষদের পেছনে দাঁড় করাতেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস- ২২৯১১, হাদিসটি হাসান)।
তাই মসজিদে বাচ্চারা বড়দের পিছনে ভিন্ন কাতারে দাঁড়াবে। এটিই সুন্নাহ। তবে প্রয়োজনে ব্যতিক্রম করারও অবকাশ রয়েছে। যদি বাচ্চা একজন হয় তাহলে ভিন্ন কাতারে না দাঁড়িয়ে বড়দের পাশে দাঁড়াতে পারবে; বরং একা পিছনে থাকার দরুন অসঙ্গত কাজ করার আশঙ্কা থাকলে বড়দের পাশে দাঁড়ানোই শ্রেয়। (দুররুল মুখতার- ১/৮৪, হেদায়া- ১/১২৪, আল-বাহরুর রায়েক- ১/৩৫৩, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী- ১/৮৯, ফাতহুল কাদীর- ১/৩১১, কানযুদ্দাকায়েক- ২৯, আহসানুল ফাতাওয়া- ৩/২৮০, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া- ৯/৭৬, ফাতাওয়ায়ে দারুল উলূম- ৩/৩৪২)।
(৯২৩৫) বিলাল আহমদ, রামু, কক্সবাজার।
জিজ্ঞাসা: আমি এক মসজিদের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনলাম একজন হাফিজ সাহেব একটি সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করছেন। কিছু সময় পর আবার ঐ মসজিদের পার্শ্ব দিয়ে আসলে আবার ঐ হাফিজ সাহেবকে ঐ আয়াত পড়তে শুনলাম। এখন আমার জানার বিষয় হল, আমার উপর কয়টি সিজদা ওয়াজিব হবে। জানিয়ে বাধিত করবেন।
সমাধান: প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনার উপর দুটি সিজদা ওয়াজিব হয়েছে। কেননা, সিজদার আয়াতের তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে একই আয়াত স্থান পরিবর্তন করে পড়লে বা শ্রবণ করলে যতবার স্থান পরিবর্তন করবে ততবার সিজদা ওয়াজিব হবে। সুতরাং আপনি যেহেতু দু’বার স্থান পরিবর্তন করে আয়াত শ্রবণ করেছেন। তাই আপনাকে দু’টি সিজদা দিতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে- ১/১৮২, মারাকিউল ফালাহ শরহে নূরুল ইযাহ- ২৭০, রদ্দুল মুহতার- ২/১১৪)।
সিয়াম-ইতিকাফ বিষয়ক জিজ্ঞাসার শরয়ী সমাধান
(৯২৩৬) তাসলিমা বেগম, ঢাকা।
জিজ্ঞাসা: আমার ছোট বাচ্চাটা দুগ্ধপোষ্য। বয়স দেড় মাস। আমি রোযা রাখলে দুপুরের পর আর দুধ পায় না। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকতে তার জন্য কষ্টকর হয়ে যায়। খুব কান্নাকাটি করে। ভিন্ন কিছু খেতেও চায় না। অবশ্য আমি রোযা না রেখে ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করলে তার কোনো কষ্ট হয় না। এমতাবস্থায় আমার জন্য রোযা না রাখার অনুমতি আছে কি না?
সমাধান: আপনার জন্য রোযা না রাখার অনুমতি আছে। বাচ্চা দুধ ছেড়ে দিলে বা পরবর্তীকালে রোযা রাখার দরুন বাচ্চার কোনো সমস্যা না হলে এই রোযাগুলো কাযা করে নেবেন। দুগ্ধপোষ্য বাচ্চার দুধ পেতে সমস্যা হলে স্তন্যদানকারীর জন্য রোযা বিলম্বিত করার অনুমতি রয়েছে।
হযরত আনাস (রাযি.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা গর্ভবতী মহিলা এবং দুগ্ধদানকারী মহিলা থেকে রোযা মুলতবি করে দিয়েছেন। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস- ২২৭৪, কিতাবুল আছল- ২/১৭২, মাবসূত সারাখসি- ৩/১১০, বাদায়েউস সানায়ে- ২/৯৭)।
(৯২৩৭) আমজাদ হুসাইন, চট্টগ্রাম।
জিজ্ঞাসা: আমার স্ত্রী ছয় মাসের গর্ভবতী। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রমাযান মাসে রোযা রাখা গর্ভের সন্তানের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এমতাবস্থায় তার জন্য রোযা না রাখার অনুমতি আছে কি?
সমাধান: রোযা রাখার দরুন গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা হলে গর্ভবতী মায়ের রোযা না রাখার অনুমতি আছে। পরবর্তী সময় কাযা করে নিবে। গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিলে হাদীসে রোযা না রাখার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, গর্ভবতী মহিলা এবং স্তন্যদানকারি মহিলা যদি তাদের সন্তানের ব্যাপারে আশঙ্কা করে তাহলে তারা যেনো রোযা ভাঙে এবং পানাহার করে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস- ২৩১৮, কিতাবুল আছল- ২/১৮২, মাবসূত সারাখসি- ৩/১১০, বাদায়েউস সানায়ে- ২/২৫০)।
(৯২৩৮) আবুল কালাম, ফেনী।
জিজ্ঞাসা: রমাযান মাসে ইতিকাফের সময় কখন আরম্ভ হয় আর কখন শেষ হয়? জানিয়ে বাধিত করবেন।
সমাধান: রামাযানের শেষ ৯/১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নাত। ইতিকাফের সময় আরম্ভ হয় বিশ তারিখের সূর্য অস্ত যাওয়া থেকে। একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশ দিন ইতিকাফ করতেন। আর ইসলামে দিন বা তারিখ আরম্ভ হয় সূর্যাস্তের সময় থেকে। তাই সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বেই মসজিদে প্রবেশ করতে হবে। আর শেষ হবে শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে।
হজ্জবিষয়ক জিজ্ঞাসার শরয়ী সমাধান
(৯২৩৯) নিআমত আলী, কুমিল্লা।
জিজ্ঞাসা: আমার বাবার হজ্জ করার প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। সামান্য জমিজমা আছে, যার ফসল দিয়ে সংসারের জীবিকা নির্বাহ হয়। তবে তা বিক্রি করলে হজ্জ করা যাবে। এমতাবস্থায় কি আমার বাবার উপর হজ্জ ফরয?
সমাধান: আপনার বাবার উপর হজ্জ ফরয নয়। কারণ, উপর্যুক্ত জমি মৌলিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। আর হজ্জ ফরয হওয়ার জন্য হজ্জে গমনেচ্ছু ব্যক্তির কাছে তার সংসারের স্বাভাবিক প্রয়োজন মিটানোর পর তার কাছে এ পরিমাণ সম্পদ থাকতে হয়, যা দিয়ে তিনি হজ্জের খরচ নির্বাহ করে ঘরে ফিরতে পারবেন এবং ততদিন তার সংসার তার উপর নির্ভরশীল থাকবে না। অর্থাৎ হজ্জ থেকে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত সংসার স্বাভাবিকভাবে চলতে পারবে। আর এ পরিমাণ সম্পদ আপনার বাবার কাছে নেই। যথাসামান্য প্রয়োজনীয় সম্পত্তি বিক্রি করে হজ্জ আদায় করে ওয়ারিসদেরকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে মাহরূম করা, তাদেরকে অভাবী করে রেখে যাওয়া সমীচীন নয়।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-
إِنَّكَ أَنْ تَذَرَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ، خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً.
‘ওয়ারিসদেরকে স্বচ্ছল অবস্থায় রেখে যাওয়া; নিঃস্ব করে রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম’। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ১২৯৫, আলমুহীতুল বুরহানী- ২/৪১৮, ফাতাওয়া হিন্দিয়া- ১/২১৮)।
(৯২৪০) মাহদীউল আলম, ঢাকা।
জিজ্ঞাসা: একজন সম্পদশালী ব্যক্তি আমাকে নিয়ে হজ্জ করতে চাচ্ছে এবং সে ব্যক্তি আমার হজ্জের সম্পূর্ণ খরচ বহন করবে এবং সে নিজ হাতে খরচ করবে। কিন্তু আমি গরিব হওয়ায় বর্তমানে আমার উপর হজ্জ ফরয না, এমতাবস্থায় আমি যদি হজ্জ করি, তাহলে আমার ফরয হজ্জ আদায় হবে কিনা? যদি ভবিষ্যতে আমি সম্পদশালী হই, আমাকে হজ্জ করতে হবে নাকি প্রথম হজ্জই যথেষ্ট হবে?
সমাধান: প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনি ফরয হজ্জের নিয়ত করলে ফরয হজ্জ আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় আপনি সম্পদশালী হলেও হজ্জের ফরয আর আপনার উপর বর্তাবে না। তবে নফল হজ ও উমরাহ করতে পারবেন। (মাবসূতে সারাখসী- ৪/১৫০, হিদায়া- ১/১৩২, ফাতাওয়া হিন্দিয়া- ১/২১৭. রদ্দুল মুহতার- ২/৪৬০)।
(৯২৪১) আব্দুল করিম, ঢাকা।
জিজ্ঞাসা: আমার এক আত্মীয় হজ্জ করার উদ্দেশ্যে মক্কায় যান। সাথে কিছু মাল-সামানা নিয়ে যান ব্যবসা করার জন্য। এখন আমার জানার বিষয় হলো, তিনি কি হজ্জের পরিপূর্ণ সাওয়াব পাবেন?
সমাধান: হজ্জে গিয়ে ব্যবসা করার অনুমতি রয়েছে। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
{لَيْسَ عَلَيْكُم جنَاح أَن تَبْتَغُوا فضلا من ربكُم} [البقرة: ১৯৮]
‘তোমাদের জন্য তোমাদের রবের অনুগ্রহ (হালাল উপার্জন) অন্বেষণ করার মাঝে কোনো পাপ নেই।’ (সূরা বাকারা- ১৯৮)।
হযরত ইবনে উমার (রাযি.), হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) প্রমুখ সাহাবাগণ বলেন, এ আয়াতটি হজ্জে ব্যবসার অনুমতি প্রদানে নাযিল হয়েছে। (তাফসীরে তাবারী-৪/১৬৩)।
তবে উত্তম হলো, হজ্জের সফরে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য সব ধরনের কর্মকা- পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকা। (ফাতহুল কাদীর- ২/৪১৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়্যা- ১/২২০)।
মুআমালা বা লেনদেন বিষয়ক জিজ্ঞাসার শরয়ী সমাধান
(৯২৪২) মামুনুর রশিদ, মিরপুর, ঢাকা।
জিজ্ঞাসা: আমি একটি বিল্ডিং উঠাতে চাচ্ছি। কিন্তু ক্যাডার গংরা আমাকে বিল্ডিং উঠাতে দিচ্ছে না; যতক্ষণ পর্যন্ত দুই লক্ষ টাকা চাঁদা না দিব। এ পরিস্থিতিতে তাদেরকে আমি সুদের টাকা দিয়ে চাঁদা দিতে পারব কি না? সঠিক সমাধানে কৃতজ্ঞ করবেন।
সমাধন: সুদের টাকা হারাম মালের অন্তর্ভুক্ত। আপনার হস্তগত হারাম সম্পদের মালিক আপনি নন। তাই আপনাকে তা বাধ্যতামূলক মূল মালিকের কাছে ফেরত দিতে হবে। মূল মালিক খুঁজে না পেলে সদাকা করতে হবে। অন্য কোনো খাতে খরচ করা যাবে না। সুতরাং আপনি সুদের টাকা দিয়ে চাঁদাবাজদেরকে চাঁদা দিতে পারবেন না। হ্যাঁ, যদি জানা যায় যে, চাঁদাবাজ ব্যক্তি গরিব তাহলে অপারগ হয়ে দেয়া যেতে পারে। (বাযলুল মাজহুদ ফি হল্লে আবি দাউদ- ১/৩৭, ফাতাওয়ায়ে শামী- ২/৪৩১, ফাতাওয়ায়ে রশিদিয়া- ৫৪২, ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া- ৯/২৬৮)।
(৯২৪৩) আতিকুর রহমান, সাভার, ঢাকা।
জিজ্ঞাসা: সরকারি বিভিন্ন অফিস বা আদালতে এবং বিভিন্ন হাসপাতালে এমন কিছু লোক থাকে যাদেরকে কিছু টাকা দিলে কাজগুলো তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। এখন আমার জানার বিষয় হলো, এদেরকে টাকা দিয়ে কাজ আদায় করা জায়েয হবে কি না?
সমাধান: প্রশ্নে উল্লিখিত সূরতে টাকা দেয়া-নেয়া বৈধ নয়। অফিস বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ থেকে যেহেতু কর্মচারিদের বেতন নির্ধারণ করা থাকে এবং কর্মচারিরা নিজ দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য, তাই তাদের দায়িত্ব পালন না করা বা পালনে অবহেলা করা এবং নিয়ম বহির্ভূত কাজ নেয়ার জন্য তাদেরকে বাড়তি টাকা দেয়া, এমনিভাবে নিয়মবহির্ভূত বাড়তি সুবিধা ভোগ করার জন্য টাকা দেয়া-নেয়া সবই অপরাধ। এ প্রকৃতির লেনদেন শরীয়াত সম্মত নয়; প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অনুমোদিতও নয়।
উল্লেখ্য যে, এ প্রকৃতির লেনদেন আমাদের সমাজে এক ভয়াবহ মহামারির রূপ নিয়েছে। কোনো কোনো কার্যালয়ে তো রীতিমত রেওয়াযে পরিণত হয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। এতে যেভাবে সমাজ বিনষ্ট হচ্ছে তেমনি ব্যক্তির নীতি নৈতিকতাও ধ্বংস হচ্ছে। তাই ছোট বড় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও কার্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত এর প্রতিকার খুঁজে বের করা। এ ধরনের অবৈধ ও অনৈতিক কর্মনীতিকে বন্ধ করা।
সাধারণ মানুষেরও উচিত এমন লেনদেনে না জড়ানো। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কারণেই কর্মচারিদের অভ্যাস নষ্ট হয়। একটু বিলম্ব হবে তাই আমরা ঘুষ দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ আদায় করতে চাই। আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অজুহাতে অবৈধ সুবিধা পাবার মানসে আমরাই এ ধরনের অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ি। আমাদেরকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
অবশ্য, বাড়তি টাকা না দিলে যদি নিজের প্রাপ্য হক বিনষ্ট হওয়ার বা বৃহৎ ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয় তাহলে প্রয়োজন অনুপাতে অন্তরে ঘৃণা রেখে বাড়তি টাকা দেয়া যেতে পারে। (সূরা নিসা- ২৯, আল-বাহরুর রায়েক- ৬/৪৪১, আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল- ৭/২২৬)।
ওয়াক্ফ বিষয়ক জিজ্ঞাসার শরয়ী সমাধান
(৯২৪৪) আসাদুল্লাহ মাহমুদ, নেত্রকোনা।
জিজ্ঞাসা: আমার মসজিদের পাশে কবরস্থান। অবগতির জন্য বলা হচ্ছে, মসজিদ ও কবরস্থানের ফান্ড ভিন্ন-ভিন্ন। আমি গত শুক্রবার মসজিদের জন্য (মসজিদের কথা উল্লেখ করে) নারকেলের চারা কালেকশন করেছি। এখন জানার বিষয় হলো, এই চারা কি কবরস্থানের জায়গায় লাগানো যাবে? দলীলসহ জানালে উপকৃত হবো।
সমাধান: যেহেতু চারাগুলো মসজিদের জন্য কালেকশন করা হয়েছে। তাই মালিকের ইচ্ছার বাহিরে ভিন্ন কোনো খাতে ব্যবহার করা যাবে না। ওয়াকফ ও দানের ক্ষেত্রে মালিকের ইচ্ছার গুরুত্ব অপরিসীম। মালিক যে খাতে ব্যয় করতে বলেছে সেই খাতেই ব্যয় করতে হবে। যার ফলে প্রশ্নোল্লিখিত চারাগুলো মসজিদের জায়গাতেই লাগাতে হবে। কবরস্থানের জায়গায় লাগানো যাবে না। (আল-জাওহারাতুন নাইয়িরাহ- ২/৮, আল-মুহিতুল বুরহানী- ৯/১৪৯, রদ্দুল মুহতার- ৬/৫৫৪)।
বিবিধ জিজ্ঞাসার শরয়ী সমাধান
(৯২৪৫) আনোয়ার হুসাইন, চট্টগ্রাম।
জিজ্ঞাসা: আমাদের সমাজে দেখা যায় ব্যক্তির নামে মসজিদের নামকরণ করা হয়। কখনো নির্মাতার নাম দেওয়া হয় আবার কখনো বা ভিন্ন কোনো নাম দেওয়া হয়। এভাবে মসজিদের নামকরণ করা কি শরীয়াত সম্মত? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।
সমাধান: মসজিদ আল্লাহর ঘর। মসজিদের মালিকও একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তাই কোনো ব্যক্তি মসজিদের মালিক হতে পারে না। তবে মসজিদের পরিচয়ের জন্য কোনো ব্যক্তির নামে নামকরণ করার অবকাশ রয়েছে। একাধিক হাদীসে নামকরণকৃত মাসজিদের কথা বর্ণিত হয়েছে। যথা সাহাবী আবদুল্লাহ বিন আবদুর রহমান রাযি. বলেন-
جَاءَنَا النَّبِيُّ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – فَصَلَّى بِنَا فِي مَسْجِدِ بَنِي عَبْدِ الْأَشْهَلِ
‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট এসেছেন। তিনি আমাদের নিয়ে বনু আবদিল আশহাল মসজিদে ইমামতি করেছেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস- ১০৩১, মুসনাদে আহমদ, হাদীস- ১৮৯৫৩)।
হযরত ইবনে উমর (রাযি.) বলেন-
أَنَّ النَّبِىَّ دَخَلَ مَسْجِدَ بَنِى عَمْرِو بْنِ عَوْفٍ فَدَخَلَ النَّاسُ
‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু আমর বিন আউফ মসজিদে প্রবেশ করলেন, অতঃপর লোকেরা প্রবেশ করল।’ (মুসনাদে দারিমী, হাদীস- ১৪১৩, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস- ১০১৭)।
ইমাম বুখারী (রহ.) স্বীয় সহীহ কিতাবে بَاب هَلْ يُقَالُ مَسْجِدُ بَنِي فُلَانٍ অধ্যায়ে নিম্নের হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। হযরত ইবনে উমর (রাযি.) বলেন-
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَابَقَ بَيْنَ الْخَيْلِ الَّتِي أُضْمِرَتْ مِنْ الْحَفْيَاءِ وَأَمَدُهَا ثَنِيَّةُ الْوَدَاعِ وَسَابَقَ بَيْنَ الْخَيْلِ الَّتِي لَمْ تُضْمَرْ مِنْ الثَّنِيَّةِ إِلَى مَسْجِدِ بَنِي زُرَيْقٍ
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের জন্য তৈরি ঘোড়াকে “হাফয়া” থেকে “সানিয়্যাতুল ওয়াদা” পর্যন্ত দৌড় প্রতিযোগিতা করিয়েছিলেন এবং যুদ্ধের জন্য তৈরি নয় এমন ঘোড়াকে “সানিয়্যাতুল ওয়াদা” থেকে মসজিদে বনী যুরাইক পর্যন্ত দৌড় প্রতিযোগিতা করিয়েছিলেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস-৪২০)।
ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (রহ.) এই হাদীসের ব্যাখ্যায় প্রশ্ন করে বলেন-
هَل يجوز أَن يُقَال ذَلِك؟ نعم، يجوز، وَالدَّلِيل عَلَيْهِ حَدِيث ابْن عمر
‘এরকম (অমুকের মসজিদ) বলা কি জায়েয আছে। হ্যাঁ, জায়েয। ইবনে উমরের হাদীস তার প্রমাণ।’ (উমদাতুল কারী- ৪/১৫৮)।
কখনো কখনো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও মদীনার মসজিদকে নিজের দিকে নিসবত করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) বলেন-
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ صَلَاةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ صَلَاةٍ فِيمَا سِوَاهُ إِلَّا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ
‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমার এই মসজিদে নামায পড়া, মসজিদে হারাম ব্যতীত অন্য যেকোনো মসজিদে এক হাজার রাকাত নামায পড়ার চাইতে উত্তম’। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ১১৯০)।
ইমাম ইবনুল আরাবী (রহ.) বলেন-
المساجد وإن كانت لله ملكا وتشريفا ، فإنها قد نسبت إلى غيره تعريفا , فيقال : مسجد فلان۔ انتهى.
‘মসজিদ যদিও মালিকানা এবং সম্মানের দিক থেকে আল্লাহর জন্যই। কিন্তু কখনো তাকে পরিচিতির জন্য অন্য কারও দিকে নিসবত করা হয়। আর বলা হয়, ‘অমুকের মসজিদ।’ (আহকামুল কুরআন- ৪/২৭৭)
ইমাম নববী (রহ.) বলেন-
ولا بأس أن يقال مسجد فلان ، ومسجد بني فلان على سبيل التعريف۔ انتهى
‘অমুকের মসজিদ বলাতে কোন সমস্যা নেই। অমুকের মসজিদ পরিচিতির জন্যই বলা হয়ে থাকে।’ (আল-মাজমূ- ২/৪০৮)।
এ সকল হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মসজিদের পরিচয়ের জন্য কোনো ব্যক্তি বা সমাজের নাম যুক্ত করা যেতে পারে। তবে মালিক বা একক কর্তৃত্ব জ্ঞাপনার্থে কোনো ব্যক্তি বা সমাজের নামে মসজিদের নামকরণ করা ঠিক নয়। এ কারণে সালাফের কোনো কোনো ইমাম এরূপ বলতে নিষেধ করেছেন। (দ্র. ফাতহুল বারী; ইবনে রাজব (রহ.)- ৩/১৭৪)।
(৯২৪৬) কে. বি. কালীম, যুক্তরাজ্য।
জিজ্ঞাসা: আমি একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। তবে আমি লেখাপড়া করেছি খ্রিস্টান মিশনারী পরিচালিত একটি স্কুলে। তাদের সিলেবাসের অনেক বইয়ে ঈসা (আ.)এর জীবনের অনেক অংশ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। তার মাঝে কিছু কথা এমন আছে, যা ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক এবং শিরক বলে বিবেচিত। ঐ স্কুলে পড়াকালে আমি সেই কথাগুলো বারবার বলতাম এবং খ্রিস্টানদের উপাসনায় যোগ দিতাম। এটি যে ভুল এবং গোনাহর কাজ তা আমার জানা ছিল না। যখন আমি জানতে পারলাম তখনই আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে আল্লাহর কাছে তাওবা করি। আমি আমার কৃত পাপের জন্য এখন লজ্জিত এবং শঙ্কিত। গোনাহর উপলব্ধি অন্তরে আসার পর থেকে আমার ভেতরে উদ্বিগ্নতা এবং অস্থিরতা কাজ করে যাচ্ছে। আমি এখন কঠিন হতাশায় সময় পার করছি। দয়া করে আমাকে সঠিক রাস্তা দেখাবেন।
সমাধান: প্রশ্নে বর্ণিত পরিস্থিতি অনুযায়ী আপনি আপনার গোনাহের জন্য অনুতপ্ত এবং এখনও অনুশোচনা করছেন। সুতরাং স্কুল জামানার কৃত গোনাহের জন্য ইতোমধ্যে আপনার তাওবা করা হয়ে গেছে। আশা করি আল্লাহ তাআলা আপনার তাওবা কবুল করেছেন। আপনার উদ্বিগ্নতা, অস্থিরতা এবং ডিপ্রেশন এসবই আপনার আন্তরিকভাবে তাওবা করার প্রমাণ এবং তাওবা কবুল হওয়ারও ইঙ্গিত বহন করে। আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল এবং করুণাময়। তিনি তার বান্দাদের তাওবা পছন্দ করেন।
সুতরাং আপনার অধিক উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনার উচিত তাওবার ফযিলতগুলো স্মরণ রাখা। আপনি এ সম্পর্কে কুরআনের অনেক আয়াত এবং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদীস পেয়ে যাবেন। উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
{إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ} [البقرة: ২২২]
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাওবাকারীকে ভালবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরকেও ভালবাসেন’। (সূরা বাকারা, আয়াত- ২২২)।
তিনি আরও ইরশাদ করেন-
{ إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِنْ قَرِيبٍ فَأُولَئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا} [النساء: ১৭]
‘অবশ্যই আল্লাহ্ তাদের তাওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিল¤ে¦ তাওবা করে; এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ্ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ্ মহাজ্ঞানী, রহস্যময়’। (সূরা নিসা, আয়াত- ১৭)।
অন্যত্র ইরশাদ করেন-
{وَهُوَ الَّذِي يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَعْفُو عَنِ السَّيِّئَاتِ وَيَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ } [الشورى: ২৫]
‘তিনি তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করেন পাপসমূহ মার্জনা করেন এবং তোমাদের কৃত বিষয় সম্পর্কে অবগত রয়েছেন’। (সূরা শূরা, আয়াত- ২৫)।
হযরত আনাস বিন মালেক (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
্রكُلُّ ابْنِ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَগ্ধ (رواه الترمذي في جامعه ২৪৯৯ وابن ماجه في سننه ৪২৫১ والحديث حسن.)
‘প্রত্যেক বনী আদম গোনাহগার। গোনাহকারীদের মধ্যে উত্তম তারাই যারা তাওবা করে।’ (সুনানে তিরমীযী, হাদীস- ২৪৯৯, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস- ৪২৫১)।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
التَّائِبُ مِنَ الذَّنْبِ ، كَمَنْ لاَ ذَنْبَ لَهُ. (رواه ابن ماجه في سننه ৪২৫০ والحديث حسن.)
‘গোনাহ থেকে তাওবাকারী সেই ব্যক্তির ন্যায়, যার কোন গোনাহ নেই’। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস- ৪২৫০)।
হযরত আনাস বিন মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
্রاللَّهُ أَفْرَحُ بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ مِنْ أَحَدِكُمْ، سَقَطَ عَلَى بَعِيرِهِ، وَقَدْ أَضَلَّهُ فِي أَرْضِ فَلاَةٍগ্ধ (متفق عليه. صحيح البخاري ৬৩০৯ وصحيح مسلم ৭১২৮)
‘আল্লাহ তাআলা তার বান্দার তাওবায় তোমাদের সেই লোকটির চেয়ে বেশি খুশি হন, যে লোক মরুভূমিতে তার উট হারিয়ে ফেলেছে, অতঃপর তা খুঁজে পেয়েছে’। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ৬৩০৯, সহীহ মুসলিম, হাদীস- ৭১২৮)।
হযরত আনাস বিন মালেক রাযি. বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি-
قَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلَا أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ، وَلَا أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِي لَا تُشْرِكُ بِي شَيْئًا لَأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً. (رواه الترمذي في جامعه ৩৫৪০ وحسنه.)
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান, হে আদম সন্তান! যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আমাকে ডাকতে থাকবে এবং আমার কাছে ক্ষমার আশা করবে, তোমার গোনাহ যতধিক হোক, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব। এতে কোনো পরোয়া করব না। হে আদম সন্তান! তোমার গোনাহ যদি ঊর্ধ্বাকাশ পর্যন্তও পৌঁছে যায় অতঃপর তুমি আমার কাছে ক্ষমার আর্জি পেশ কর। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব। এতে কোনও পরোয়া করব না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি পুরো পৃথিবী পরিমাণ গোনাহ নিয়ে আমার কাছে আসো এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে থাকো, তাহলে আমি পৃথিবী সমপরিমাণ ক্ষমা নিয়ে তোমার সামনে হাযির হবো’। (সুনানে তিরমীযী, হাদীস- ৩৫৪০)।
সর্বোপরি সর্বদা তাওবার ফযিলতসমূহ স্মরণ রাখুন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং ভবিষ্যতে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী জীবন যাপন করুন।
উলূমে হাদীস: ইতিকাফ কখন শুরু করতে হবে?
(৯২৪৭) রাশেদ আহমদ, বাঁশখালী।
জিজ্ঞাসা: আমরা জানি যে, ইতিকাফের সময় আরম্ভ হয়, বিশ তারিখের সূর্য অস্ত যাওয়া থেকে। এক সালাফী ভাই বললেন, এটা ঠিক নয়; বরং ইতিকাফ আরম্ভ হবে, একুশ তারিখের ফজর থেকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকি বিশ তারিখের ফজর থেকেই ইতিকাফ আরম্ভ করতেন। এ ব্যক্তির কথাটি কি ঠিক? হাদীসের আলোকে বিস্তারিত জানিয়ে কৃতজ্ঞ করবেন।
সমাধান: ইতিকাফের সময় বিশ তারিখের সূর্যাস্ত থেকেই আরম্ভ হবে। এটিই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। একাধিক সহীহ হাদীসে العشر সংখ্যা উল্লেখ হয়েছে। আর এ সংখ্যাটি রাতের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। তাই রাত সহ ৯/১০ দিন ইতিকাফ করতে হবে। অথচ একুশ তারিখের ফজর থেকে আরম্ভ হলে একটি রাত বাদ যায়। এছাড়া ইতিকাফের বড় একটি উদ্দেশ্য লাইলাতুল কদর প্রাপ্ত হওয়া। আর ২১ তারিখের রাত তথা বিশ তারিখের দিবাগত রাত লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাব্য রাত। তাই রাত থেকে ইতিকাফ করাই অধিক যুক্তিযুক্ত। এছাড়া সাহাবা ও তাবেঈনের আমলের ভিত্তিতে ইমাম আবু হানীফা (রহ.), ইমাম মালেক (রহ.), ইমাম শাফেঈ (রহ.), ইমাম আহমদ বিন হাম্বলসহ জুমহুর ইমাম ও ফকীহগণ ২০ তারিখের দিবাগত রাত থেকে ইতিকাফ আরম্ভ হওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।
সুতরাং ইতিকাফ ২১ তারিখের ফজর থেকে আরম্ভ হবে এমন বক্তব্য সঠিক নয়। কোনো সহীহ হাদীসে এ কথা সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ হয়নি যে, ‘রাসূল (সা.) ২১ তারিখের ফজর থেকে ইতিকাফ আরম্ভ করতেন’। এ ক্ষেত্রে যে হাদীসটি উল্লেখ করা হয় তা আলোচ্য বিষয়ে অস্পষ্ট; বরং তা ২১ তারিখ রাত থেকেই ইতিকাফ আরম্ভ হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।
হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانٍ وَإِذَا صَلَّى الْغَدَاةَ دَخَلَ مَكَانَهُ الَّذِي اعْتَكَفَ فِيهِ
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমাযানে ইতিকাফ করতেন। যখন তিনি ফজরের নামায শেষ করতেন তখন যে স্থানে ইতিকাফ নেওয়ার জন্য অবস্থান নিয়েছেন সেখানে প্রবেশ করতেন’। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ২০৪১)। এই বর্ণনাটি বিস্তারিত। কোনো কোনো বর্ণনায় دخل معتكفه শব্দ উল্লেখ হয়েছে)।
এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়: এক. হাদীসে ফজরের নামাযের কথা উল্লেখ হয়েছে; কিন্তু কোন দিনের ফজর ২০ তারিখের, নাকি ২১ তারিখের তা সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ হয়নি। একারণে হাদীসের কোনো কোনো ব্যাখ্যাকার তা ২০ তারিখের ফজর হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন হাম্বলী মাযহাবের ইমাম কাজী আবু ইয়ালা (রহ.) এ
হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন-
كَانَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَفْعَل ذَلِكَ فِي يَوْم الْعِشْرِينَ
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশতম দিনে এ কাজটি করতেন’। (আল ফুরূ- ৫/১৫৯)। সিন্দী (রহ.) সহীহ বুখারীর টীকায় এ ব্যাখ্যাটিকেই অধিক যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি উক্ত ব্যাখ্যা উল্লেখ করে বলেন-
وَهَذَا الْجَوَاب هُوَ الَّذِي يُفِيدهُ النَّظَر ، فَهُوَ أَوْلَى وَبِالاعْتِمَادِ َأَحْرَى
‘এ জবাবটিই অধিক যুক্তিযুক্ত। তাই এটাই অগ্রগণ্য এবং এর উপর ভরসা করাই যুক্তিযুক্ত’।
দুই. রাসূল (সা.) ফজরের পরে ইতিকাফ আরম্ভ করতেন তা কিন্তু হাদীসে উল্লেখ নেই। উল্লেখ হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের পর যে স্থানে তিনি ইতিকাফ করেছেন সেখানে প্রবেশ করতেন। অর্থাৎ ইতিকাফের জন্য রাসূল পর্দা দিয়ে মসজিদের একটি স্থান নির্দিষ্ট করতেন এবং সেখানে প্রবেশ করতেন। হাদীসের শব্দ اعْتَكَفَ فِيهِ। এটি অতীতকাল ব্যঞ্জক; (Present Perfect Tense) যা নামাযের পূর্বেই ইতিকাফ হয়ে যাওয়া বুঝাচ্ছে। সুতরাং হাদীসটির সঠিক ব্যাখ্যা হলো, রাসূল (সা.) নামায আদায় করে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে তিনি ইতিকাফের জন্য যে স্থানে অবস্থান নিয়েছেন সেখানে প্রবেশ করতেন। একাধিক হাদীস বিশারদগণ এভাবে হাদীসটির ব্যাখ্যা করেছেন।
ইমাম নববী (রহ.) বলেন-
وَأَوَّلُوا الْحَدِيث عَلَى أَنَّهُ دَخَلَ الْمُعْتَكَفَ وَانْقَطَعَ فِيهِ وَتَخَلَّى بِنَفْسِهِ بَعْدَ صَلَاتِهِ الصُّبْحَ لَا أَنَّ ذَلِكَ وَقْتَ ابْتِدَاءِ الِاعْتِكَافِ بَلْ كَانَ مِنْ قَبْلِ الْمَغْرِبِ مُعْتَكِفًا لَابِثًا فِي جُمْلَةِ الْمَسْجِدِ فَلَمَّا صَلَّى الصُّبْحَ انْفَرَدَ. اهـ .
‘তারা হাদীসটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, তিনি ইতিকাফের নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করেছেন এবং ফজরের নামাযের পর সেখানে একাকিত্ব গ্রহণ করেছেন। এর অর্থ এটা নয় যে, সেটাই ইতিকাফের সূচনার সময়; বরং তিনি মাগরিবের পূর্বেই মসজিদে মুতাকিফ হয়ে অবস্থানরত ছিলেন। যখন ফজরের নামায সমাপ্ত হলো, তিনি সেখানে নির্জনতা গ্রহণ করলেন।’ (আল মিনহাজ- ৮/৬৯)। খোদ সালাফীদের মান্যবর আলেম ইবনে উসাইমীন; তিনিও এই ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করেছেন এবং প্রাধান্য দিয়েছেন।
তিনি বলেন-
্রجمهور أهل العلم على أن ابتداء الاعتكاف من ليلة إحدى وعشرين لا من فجر إحدى وعشرين، وإن كان بعض العلماء ذهب إلى أن ابتداء الاعتكاف من فجر إحدى وعشرين مستدلاًّ بحديث عائشة رضي الله عنها عند البخاري: (فلما صلى الصبح دخل معتكفه) لكن أجاب الجمهور عن ذلك بأن الرسول عليه الصلاة والسلام انفرد من الصباح عن الناس، وأما نية الاعتكاف فهي من أول الليل ، لأن العشر الأواخر تبتدىء من غروب الشمس يوم عشرينগ্ধ اهـ .(فتاوى الصيام ৫০১)
‘অধিকাংশ আহলুল ইলমের মতে একুশ তারিখ রজনী থেকেই ইতিকাফের সূচনা হয়; একুশ তারিখ ফজর থেকে নয়। যদিও কতক আলেম একুশ তারিখ ফজরের সময় ইতিকাফের সূচনার মতটি গ্রহণ করেছেন। তারা সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হযরত আয়েশা (রাযি.)এর হাদীস- “ফজরের সালাত শেষে তিনি ইতিকাফের স্থানে প্রবেশ করলেন”, দ্বারা দলীল পেশ করেন। কিন্তু জুমহুর এর জবাবে বলেন যে, (এর ব্যাখ্যা হলো) রাসূল (সা.) ফজরের পর লোকজন থেকে নির্জনতা গ্রহণ করলেন। আর ইতিকাফের নিয়ত রজনীর প্রথমভাগেই সম্পন্ন হয়েছে। কেননা বিশ তারিখ সূর্যাস্তের পর থেকেই শেষ দশক শুরু হয়’। (ফাতাওয়াস সিয়াম- ৫০১)।
সর্বোপরি, রাসূল (সা.) একুশ তারিখের ফজর থেকে ইতিকাফ আরম্ভ করেছেন এমন দাবি সঠিক নয়। ২০ তারিখ দিবাগত রাত থেকে ইতিকাফ আরম্ভ হবে এটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/