পানাহারের যে নিয়ম ও আদব রাসূলুল্লাহ (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন

।। আলহাজ্ব সৈয়দ জহির উদ্দীন ।।

মানুষের আদর্শ জীবন যাপনের সকল স্তরে আখেরী নবী (সা.) উত্তম জীবনাদর্শ রেখে গেছেন। তিনি পরকালীন জীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভের জন্য যেমন সঠিক উপায়ে ইবাদত-বন্দেগীর নিয়ম শেখানো ও উৎসাহ দিয়ে গেছেন, তেমনি দুনিয়াবী জীবনকে সুখী, সাবলীল, সুস্থ ও সুন্দর রাখতে ছোট-বড় সকল স্তরে শিক্ষা দিয়ে গেছেন।

খাবার শুধু মুখের তৃপ্তি পেতে গ্রহণ করা হয় না, বরং বেঁচে থাকার জন্য খাবার গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে প্রতিদিন আমাদেরকে অসংখ্য বার খাবার গ্রহণ করতে হয়। তাছাড়া আল্লাহর ইবাদত ও বান্দার হক আদায় করার জন্য শরীরে শক্তি প্রয়োজন।

সুস্থ থাকতে যেমন খাবার নির্বাচন ও গ্রহণ করতে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়, তেমনি খাবার গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) খাবার গ্রহণ পদ্ধতির উপরও উম্মাহর জন্য আদর্শ ও সুন্নাহ রেখে গেছেন। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, দেড় হাজার বছর পরের আধুনিক বিজ্ঞানও গবেষণা করে দেখেছে যে, ইসলামের নবীর নির্দেশিত খাবার গ্রহণের পন্থা একজন মানুষের সুস্থ, সবল থাকার জন্য অত্যন্ত উপযোগী। নবীজি (সা.)এর সুন্নাত মোতাবেক খাবার গ্রহণে যেমন রয়েছে পরকালীন সওয়াব লাভের আশা, তেমনি পার্থিব জীবনেও অসংখ্যা কল্যাণ ও উপকার রয়েছে। খাবারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংক্ষেপে কিছু সুন্নাত ও আদবের কথা নি¤েœ তুলে ধারা হল-

খাবারের শুরুতে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নেওয়া। অতঃপর ‘বিসমিল্লাহি ওয়ালা বারকাতিল্লাহ’ দোয়া পড়া। রাসূল (সা.) খাবারের শুরুতে সব সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলে খাবার শুরু করতেন এবং তার অন্য সাথীদের খাবারের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে উৎসাহিত করতেন।

রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে ও ডান হাত দ্বারা খাও এবং তোমার দিক হতে খাও।’ (মুসলিম- ২/১৭২, বুখারি- ৫১৬৭)। হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যখন তোমরা খানা খেতে শুরু করো তখন আল্লাহর নাম স্মরণ করো। আর যদি আল্লাহর নাম স্মরণ করতে ভুলে যাও তাহলে (মাঝখানে স্মরণ হলে) বলো ‘বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ও আখিরাহ’ (রিয়াজুস সালেহিন- ৭২৯)।

আরও পড়তে পারেন-

খাবার পরিবেশনের সময় দস্তরখান বিছিয়ে তার উপর খাবারের পাত্র রাখা সুন্নাত। হযরত আনাস (রাযি.) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) পায়াবিশিষ্ট বড় পাত্রে খাবার খেতেন না। কাতাদা (রাযি.)কে জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে কীসের ওপর খানা খেতেন? তিনি বললেন, ‘চামড়ার দস্তরখানের ওপর’। (বুখারি- ৫৩৮৬)।

ডান হাত দ্বারা খাবার খাওয়া সুন্নাত। রাসূল (সা.) আজীবন ডান হাত দ্বারা খাবার খেয়েছেন। এবং বাম হাত দ্বারা খাবার খেতে নিষেধ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা বাম হাত দ্বারা খাবার খেয়ো না এবং পান করো না। কেননা শয়তান বাম হাতে খায় ও পান করে’। (তিরমিযী- ১৯১২)।

খাবারের মজলিসে সবচেয়ে বড় এবং মান্য ব্যক্তিকে দিয়ে আরম্ভ করা। (মুসলিম- ২/১৭১)। খাবার এক আইটেমের হলে শুধু নিজের সামনে থেকে খাওয়া। (বুখারি- ২/৮১০)। খাওয়ার সময় কিছু পড়ে গেলে সেটা উঠিয়ে পরিষ্কার করে খাওয়া। রাসূল (সা.)এর খাবারকালে যদি কোনো খাবার পড়ে যেত, তাহলে তিনি তুলে খেতেন। জাবের (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের খাবার আহারকালে যদি লুকমা পড়ে যায়, তাহলে ময়লা ফেলে তা ভক্ষণ করো। শয়তানের জন্য ফেলে রেখো না। ’ (তিরমিযী- ১৯১৫, ইবনে মাজাহ- ৩৪০৩)।

হেলান দিয়ে বসে না খাওয়া। হাদিসে খাবার গ্রহণকালে বসার তিনটি পদ্ধতির বিবরণ পাওয়া যায়Ñ ১. উভয় হাঁটু উঠিয়ে বসা। ২. এক হাঁটু উঠিয়ে এবং অন্য হাঁটু মাটিতে বিছিয়ে বসা। ৩. দুই হাঁটু গেড়ে বসা। মোটকথা যেভাবেই বসা হোক সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসবে। (বুখারি- ২/৮১২)।

অনেককে দেখা যায় খাবারের মধ্যে নানারূপ দোষ-ত্রুটি ধরে। এ নিয়ে পরিবারে ঝগড়াঝাঁটিও হয়। অথচ রাসূল (সা.) এর সমগ্র জীবনে কখনও খাবারের দোষ ধরেননি। আবু হুরায়রা (রাযি.) বলেন, রাসূল (সা.) কখনও খাবারের দোষ-ত্রুটি ধরতেন না। সামনে উপস্থাপিত খাবার তার পছন্দ হলে খেতেন আর অপছন্দ হলে বিরত থাকতেন। (বুখারি- ৫১৯৮)।

খাবারের মধ্যে ফুঁ দেওয়ায় নানান রোগব্যাধি সৃষ্টির আশংকা প্রবল। রাসূল (সা.) খাবারে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন। ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) কখনও খাবারে ফুঁ দিতেন না। ফুঁ দিতেন না কোনো কিছু পানকালেও। (ইবনে মাজাহ- ৩৪১৩)। আধুনিক বিজ্ঞানেও খাবারে ফুঁ না দেওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

সব শেষে হাত ও আঙ্গুল চেটে খাওয়া। রাসূল (সা.) খাওয়ার সময় সর্বদা হাত চেটে খেতেন। না চাটা পর্যন্ত কখনও হাত মুছতেন না। ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা যখন খাবার গ্রহণ করবে, তখন হাত চাটা শেষ না করে তোমরা হাতকে মুছবে না’। (বুখারি- ৫২৪৫)।

আঙ্গুল চেটে খাওয়ার ফলে বরকত লাভের অধিক সম্ভাবনা থাকে। কারণ, খাবারের বরকত কোথায় রয়েছে মানুষ তা জানে না। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা যখন খাবার গ্রহণ করো তখন আঙ্গুল চেটে খাও। কেননা বরকত কোথায় রয়েছে তা তোমরা জানো না’। (ইবনে মাজাহ- ১৯১৪)।

রাসূল (সা.) খাবার শেষে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাতেন। দোয়া পড়তেন। হযরত আবু উসামা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) খাবার শেষ করে বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহি হামদান কাসিরান তায়্যিবান মুবারাকান ফিহি গায়রা মাকফিইন ওলা মুয়াদ্দায়িন ওলা মুসতাগনা আনহু রাব্বানা’। তিনি কখনও এই দোয়া পড়তেনÑ ‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাযী আত-আমানা ওয়াসাকানা ওয়াজাআলানা মিনাল মুসলিমীন।’ অর্থাৎ, ‘সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি আমাদের আহার করালেন, পানি পান করালেন এবং মুসলমানদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করলেন’। (বুখারি- ৫৪৫৮)।

আর কারো দাওয়াতে অংশ নিয়ে খাবার গ্রহণ করলে মেজবানের জন্য এ দোয়া করাÑ ‘আল্লাহুম্মা আতইম মান আতআমানী ওয়াসকি মান সাকানী’। অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! যিনি আমাকে খাইয়েছেন, আপনি তাকে খাওয়ান। যে আমাকে পান করিয়েছেন, আপনি তাকে পান করান’। (মুসলিম- ২/১৮০)।

রাাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুমহান সুন্নাতসমূহ আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করে চলতে পারলে পরকালীন জীবনের কামিয়াবীর পাশাপাশি দুনিয়াবী জীবনও সুস্থ, নিরাপদ ও সুন্দর হবে, ইনশাআল্লাহ।

মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।