পিতার প্রতি হযরত ইবরাহীম (আ.)এর নসীহত

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

মহান আল্লাহ সূরা মারয়ামের ৪১-৪৫ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَبِيًّا (৪১) إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا يَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنْكَ شَيْئًا (৪২) يَا أَبَتِ إِنِّي قَدْ جَاءَنِي مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ يَأْتِكَ فَاتَّبِعْنِي أَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِيًّا (৪৩) يَا أَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَنِ عَصِيًّا (৪৪) يَا أَبَتِ إِنِّي أَخَافُ أَنْ يَمَسَّكَ عَذَابٌ مِنَ الرَّحْمَنِ فَتَكُونَ لِلشَّيْطَانِ وَلِيًّا (৪৫)

অনুবাদ : (৪১) এ কিতাবে ইবরাহীমের বৃত্তান্তও বিবৃত কর। নিশ্চয়ই সে ছিল সত্যনিষ্ঠ নবী। (৪২) স্মরণ কর, যখন সে নিজ পিতাকে বলেছিল, আব্বাজী! আপনি এমন জিনিসের ইবাদত কেন করেন, যা কিছু শোনে না, দেখে না এবং আপনার কোন কাজও করতে পারে না (৪৩) আব্বাজী! আমার নিকট এমন এক জ্ঞান এসেছে যা আপনার কাছে আসেনি। কাজেই আপনি আমার কথা শুনুন, আমি আপনাকে সরল পথ বাতলে দেব। (৪৪) আব্বাজী! শয়তানের ইবাদত করবেন না। নিশ্চয়ই শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য। (৪৫) আব্বাজী! আমার আশঙ্কা দয়াময়ের পক্ষ হতে কোন শাস্তি আপনাকে স্পর্শ করবে। ফলে আপনি শয়তানের সঙ্গী হয়ে যাবেন।

তাফসীর: খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা (আ.)কে আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করত। পবিত্র কুরআনে (পূর্বের আয়াতে) হযরত ঈসার দাওয়াতের আলোচনার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা এই ভ্রান্ত বিশ্বাসকে খ-ন করেছে। আরবের মুশরিকরা ফেরেশতাগণকে আল্লাহর কন্যা বলে বিশ্বাস করত। এবং মূর্তি বানিয়ে তাদের পূজাও করত। আল্লাহ তাআলা আলোচ্য আয়াতে মক্কার মুশরিকদের পূর্ব পুরুষ হযরত ইবরাহীম (আ.)এর আলোচনার মাধ্যমে তাদের ভ্রান্ত ধারণার খণ্ডন করছেন।

আলোচ্য আয়াতে হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর পিতাকে চারটি দরদমাখা নসীহত করেছেন। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, হযরত ইবরাহীমের পিতা আযর ছিলেন একজন কট্টর মূর্তিপূজারী। তারপরও হযরত ইবরাহীম পিতাকে দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে খুব নম্র ও দরদমাখা ভাষা ব্যবহার করেছেন। এখানে দাঈগণের জন্য রয়েছে অনেক বড় একটি শিক্ষা।

হাকীমুল উম্মাহ আশরাফ আলী থানবী (রহ.) বলেন, হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর দাওয়াতের ক্ষেত্রে উত্তম চরিত্র ও শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ রেখেছেন। যাতে করে সম্বোধক ব্যক্তি কোনো প্রকারে দুষ্টামি ও উচ্ছৃঙ্খলার আশ্রয় নিতে না পারে। (তাফসীরে মাজেদি)।

আয়াতে হযরত ইবরাহীমকে সিদ্দীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সিদ্দীকের দুই অর্থ। এক. সত্যাগ্রহী। অর্থাৎ যার মাঝে সত্য গ্রহণ করার উচ্চ যোগ্যতা থাকে। আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছুই আসে তা কোনরূপ সন্দেহ ছাড়া যিনি কবুল করে নেন তিনি সিদ্দীক। এটা অনেক বড় একটি গুণ। এর উপরে আর ভালো গুণ নেই। নবীর পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে সিদ্দীকের। হযরত আবু বকর (রাযি.) সিদ্দীক উপাধি পেয়েছিলেন। সকল নবীগণ সিদ্দীক ছিলেন। সিদ্দীকের এই গুণে হযরত ইবরাহীম ছিলেন সবার শীর্ষে উরত্তীর্ণ।

দুই. সিদ্দীকের আরেক অর্থ হলো বেশি বেশি সত্য যিনি বলেন। মিথ্যার কোনো কল্পনা যার কাছ থেকে করা যায় না। সিদ্দীকের দুই অর্থই কাছাকাছি। সিদ্দীকের এই গুণটি অর্জন করা কত কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তা আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা বলি ও করি, তার উপর অনুমান করলে সহজে বুঝতে পারবো। দিন-রাত আমরা কত মিথ্যা বলি!?

বাইবেলের দুই স্থানে হযরত ইবরাহীম (আ.)এর দিকে মিথ্যার সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। পবিত্র কুরআনের সিদ্দীক শব্দটি সেই মিথ্যার খ-নের দিকেই ঈঙ্গিত করে। কুরআনে অনর্থক কোনো শব্দ নেই। ইহুদি-খ্রিস্টানদের মতে নবীর জন্য সিদ্দীক হওয়া জরুরি নয়। তাদের মতে নবুওয়াত এক ধরনের গণক বিদ্যার মতো, যা মন্দের সাথেও একত্রিত হতে পারে। (তাফসীরে মাজেদি- ৪/১৯৪ পৃষ্ঠা)।

আরও পড়তে পারেন-

হযরত ইবরাহীম (আ.)এর এই গুণটি এখানে উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা আরবের মুশরিকদেরকে এই ইতিহাসটি স্মরণ করে দিতে চাচ্ছেন যে, তোমরা তো এই ইবরাহীমেরই সন্তান। যিনি সিদ্দীক ছিলেন। তোমাদের পিতার এই গুণ তোমাদের মাঝেও থাকা উচিত। তোমাদের জন্য উচিত ছিল, কোনো প্রকারের সন্দেহ ও আগ-পিছ না ভেবে কুরআন ও তাওহীদের এই দাওয়াতকে গ্রহণ করে নেয়া। (তাফসীরে হিদায়াতুল কুরআন- ৫/২৬৯ পৃষ্ঠা)।

প্রথম নসীহত: (স্মরণ করো, যখন সে নিজ পিতাকে বলেছিল, আব্বাজী! আপনি এমন জিনিসের ইবাদত কেন করেন, যা কিছু শোনে না, দেখে না এবং আপনার কোন কাজও করতে পারে না) অর্থাৎ সাধারণত যেসকল মানুষ শোনেন, অন্যের কাজে সহযোগিতা করতে পারেন (যেমন, নবীগণ, ওলীগণ।), যেখানে তাঁদের ইবাদত করা পর্যন্ত জায়েয নেই। সেখানে যারা শোনে না, বুঝে না, কারো উপকার করতে পারে না, মানুষই যাদের তৈরি করে, তাদের ইবাদত কীভাবে জায়েয হবে? ইট-পাথরের এসব মূর্তির পূজা করা; এটা তো সম্পূর্ণ মূর্খতা!

দ্বিতীয় নসীহত: (আব্বাজী! আমার নিকট এমন এক জ্ঞান এসেছে যা আপনার কাছে আসেনি। কাজেই আপনি আমার কথা শুনুন, আমি আপনাকে সরল পথ বাতলে দেব।) অর্থাৎ সত্য উপাস্যকে (মাবুদ) শুধু বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে চেনা যায় না। এর জন্য ইলমে ওহীর আলো প্রয়োজন। আর এই ওহীর আলো আমার কাছে আছে। সুতরাং আপনি আমার অনুসরণ করুন। আমি আপনাকে আল্লাহর পথ দেখাবো, মুক্তির পথে নিয়ে যাবো।

তৃতীয় নসীহত: (আব্বাজী! শয়তানের ইবাদত করবেন না। নিশ্চয়ই শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য) অর্থাৎ আব্বা! শয়তান ধোঁকা দিয়ে আপনাদের মাধ্যমে মূর্তিপূজা শুরু করে দিয়েছে। মূর্তিপূজার নাম দিয়ে শয়তান মূলত মানুষকে তারই ইবাদত করাচ্ছে। অথচ শয়তান নিজেই আল্লাহর নাফরমান বান্দা। সে কীভাবে আপনাদেরকে আল্লাহর পথ দেখাবে? মানুষের উচিত নবীগণের পথে চলা। তাঁরা আল্লাহর আনুগত্যশীল বান্দা। তারা মানুষকে সেই পথ দেখায়, যেখানে আছে চিরস্থায়ী শান্তি ও মুক্তি।

চতুর্থ নসীহত: (আব্বাজী! আমার আশঙ্কা দয়াময়ের পক্ষ হতে কোন শাস্তি আপনাকে স্পর্শ করবে। ফলে আপনি শয়তানের সঙ্গী হয়ে যাবেন) অর্থাৎ আব্বাজান, আমার ভয় হচ্ছে। শয়তানের অনুসরণের ফলশ্রুতিতে দুনিয়াতে আপনাদেরকে আল্লাহর আযাব গ্রাস করে নিবে এবং আখেরাতে চিরস্থায়ীভাবে শয়তানের সাথে জাহান্নামে থাকতে হবে। সুতরাং এখনো সুযোগ আছে, সুযোগকে কাজে লাগান সত্যের পথে আসুন।

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নাম হিসেবে রহমান গুণটি উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ঐ কথার দিকেই ঈঙ্গিত করা হচ্ছে যে, মহান আল্লাহ তাআলা বান্দার উপর অত্যন্ত দয়াশীল। তিনি আযাব দিয়ে বান্দাকে তখনই ধ্বংস করেন, যখন বান্দা নাফরমানির একদম চূড়ান্ত ধাপ অতিক্রম করে ফেলে।

হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর পিতাকে খুব দরদমাখা কণ্ঠে নসীহত করেছেন, প্রত্যেক নাসীহার শুরুতে তিনি ইয়া আবাতি (হে আমার আব্বাজান) বলে সম্বোধন করেছেন, হিদায়াতকে আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত না করে নিজের দিকে করেছেন। এগুলোর মূল কারণ হচ্ছে, যাতে করে হযরত ইবরাহীমের পিতা তাঁর নাসীহা শ্রবণের ক্ষেত্রে দূরত্ব ও অস্বস্তি অনুভব না করে নৈকট্য এবং ভালোবাসা অনুভব করে। কিন্তু তাঁর পাথরহৃদয় পিতা তাঁকে কী উত্তর দিয়েছে- তা আগামী সংখ্যায়, ইনশাআল্লাহ।

লেখক: মুফতি, মুহাদ্দিস ও মুঈনে মুহতামিম- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।