।। মুফতি এনায়েতুল্লাহ ।।
প্রশংসা। সমালোচনা। অতিভক্তি। অন্ধ বিরোধিতা। ভিন্নমত। সহমত। এই ছয় শব্দে যেন আটকে গেছে আমাদের জীবন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলে একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। প্রচ- বিরোধী মনোভাবাপন্ন কোনো বুদ্ধিজীবী যদি আলোচিত কোনো আলেমের সঙ্গে সাক্ষাত করেন, এটা নিয়ে শুরু হয় আশার নানা ঝলকানি। কেউ ওই বুদ্ধিজীবীকে ছোট করে আলেমকে বড় করে দেখাতে শুরু করেন। কেউ আবার ওই আলেমকে নানাভাবে হেয় করার চেষ্টা করেন। মাঝখানে আরেক দলের উদয় ঘটে, তাদের অভিমত- এই সাক্ষাতের কী দরকার, তাতে কী আর হবে এমন! অতীতে এমন আরও অনেক সাক্ষাতের ঘটনা ঘটেছে বলে পুরো বিষয়টিই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তারা।
কিছু হোক বা না হোক, এটা নিয়ে এই যে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হলো মানুষ, তাতে উম্মাহর খুব এটা ফায়দা না হলেও, আমাদের মধ্যকার চলমান বিভক্তি আরেকটু চওড়া হলো বৈকি। আমাদের মধ্যকার চিন্তার ফারাক আর আদর্শগত মতভেদ দৃশ্যমান হওয়ায় কিন্তু শত্রুপক্ষ লাভবান হয়। আমি-আপনি, আমরা-তারা এভাবেই নিজেদের ভেতরকার দুর্বলতাগুলো প্রকাশ করে দিচ্ছি। জানান দিচ্ছি মুখোশের অন্তরালে থাকা জেদ, ক্ষোভ আর অন্তর্দ্বন্দ্বের ছাইচাপা আগুন।
এটা নিরেট সত্য কথা, খুব কম মানুষই আছেন- যিনি প্রশংসা শুনতে পছন্দ করেন না। আবার এই অভিযোগও অস্বীকার করার উপায় নেই, জাতি হিসেবে আমরা মন খুলে কারও প্রশংসা করতে পারি না! করলে খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলি কিংবা অদ্ভুতভাবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে একেবারেই প্রশংসা করি না।
আমি বলছি না, কারও পক্ষ নেয়া- অন্যায়। বরং আমি তো বলি, আত্মনিষ্ঠতাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে বস্তুনিষ্ঠভাবে যে কারও প্রশংসা করা যেতে পারে। অনেকে তো এটা মানতেই নারাজ। কারণ, আমাদের কাছে আত্মনিষ্ঠতা বস্তুনিষ্ঠতার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি ও মহান। গ্রামের সেই তুখোড় সমালোচক বুড়ির গল্পের মতো। বুড়ি ভীষণ ভালো রান্না করে এবং আর যে যত ভালোই রান্না করুক না কেন, সে তাতে একটা খুঁত বের করবেই। সবাই মিলে পরিকল্পনা করে একদিন এমন ভালো করে তরকারি রান্না করল- যেন বুড়ি কোনো খুঁতই ধরতে না পারে। তারপর বুড়ির সামনে আনা হলো সেই তরকারি। বুড়ি খেয়ে, অনেকক্ষণ ধরে ভেবে, শেষ পর্যন্ত বলল, ‘ভালোই হইছে, তবে বেশি ভালো কিন্তু ভালো না’।
প্রশংসার আত্মনিষ্ঠতা নিয়ে কথা হলো। কিন্তু সেই আত্মনিষ্ঠতা কই? অনেক সময় কারও সামনে অনেক প্রশংসার পর সে চলে গেলেই শুরু হয় নিন্দা। কী অদ্ভুত চরিত্র আমাদের। এই দ্বিচারিতাই যত নষ্টের মূল। সত্যটাকে সোজাভাবে বলতে না পারা, সত্য গ্রহণ করতে না পারা, সমালোচনা থেকে শিক্ষা না নেয়া, সার্বক্ষণিক গুণকীর্তক সহযোগী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকা লোকদের পক্ষে বাইরের দুনিয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে জানা কঠিন।
দুনিয়া মানে জগত প্রসঙ্গ যেহেতু এলো, তাই একটু ভিন্ন কথা বলা যেতে পারে। আমাদের সমাজে এখন কারও প্রশংসা কিংবা সমালোচনার জন্য খুব বৈঠক, মজমা আর মজলিসের প্রয়োজন হয় না। নিজের মত প্রকাশে খুব কসরত-কষ্ট করতে হয় না। নিজেকে কারও অনুসারী কিংবা সমালোচক আর তা না হলেও কথিত নিরপেক্ষাবাদী প্রকাশের জন্য খুব সংগ্রাম করতে হয় না। কারণ, আমাদের হাতে আছে ফেসবুকসহ নানা যোগাযোগ মাধ্যম। ওটাই তো এখনকার মোক্ষম অস্ত্র। নিজের ক্ষোভ, আবেগ, চাওয়া, অক্ষমতাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা মোড়কে ছেড়ে দিয়ে একট ভজঘট পাকানোর উপযুক্ত জায়গা।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
প্রশ্ন হতে পারে, প্রশংসা-সমালোচনা ইত্যাদি নিয়ে হঠাৎ এত আলোচনা কেন? এত উদাহরণ আর উপমা কেন? আমাদের ছোট্ট দেশের বিশাল তরুণ গোষ্ঠী যখন গায়ে গা লাগিয়ে আগামীর দিকে এক পা দুই পা করে এগিয়ে যাবে, তখন তাদের সবচেয়ে বড় পাথেয় হবে পরস্পরের সহযোগিতা। আর সেই সহযোগিতা যত না শারীরিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক। একে অপরের ভালো কাজের প্রশংসা করা, একে অপরকে উৎসাহিত করা। এই পিঠ চাপড়ানো, প্রশংসা কিংবা উৎসাহই কিন্তু হাজারও রাত জাগা, হাজার মাইল হাঁটার কষ্টকে ভুলিয়ে দিতে পারে। আর তৈরি করতে পারে একটা অগ্রসরমান বাংলাদেশ। সেটা হচ্ছে না- বলেই তো এত গীত! এর পেছনে দায়ি লেখার শুরুতে উল্লেখিত শব্দমালার ব্যবহার ও প্রয়োগ।
ভক্তি ও অতি ভক্তি। সমালোচনা ও বিরোধীতা। এ দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থান এই সময়ে বেশি প্রয়োজন, সেটা আমরা ভুলেই গেছি। জ্ঞানীদের মতে, অতি ভক্তি মানুষের বিবেকের বিচারবোধ ও চেতনাকে গ্রাস করে ফেলে, তাই এটি পরিত্যাজ্য। ভক্তির কারণে, নিজের দলের নেতা, পীর, শায়খের ভুলগুলোকে সঠিক মনে করার প্রবণতায় ব্যক্তি পরিবার সমাজ সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভক্তির কারণে, যথার্থ সমালোচনা ও ভুলকে পক্ষাবলম্বনকারীরা এড়িয়ে যান। অন্যদিকে সমালোচকরা এটা সহজভাবে নিতে পারে না। শুরু হয় কুরুক্ষেত্র। এর ফলে এক পলকে প্রিয় বন্ধুর তালিকা থেকে নাম কেটে তাকে শত্রুর খাতায় ফেলে দেওয়া হয়। অথচ ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলে এই সমালোচনাই আমাদের বহুদূর এগিয়ে নিতে পারতো।
সমালোচনা, ঝগড়াঝাঁটি আর মান-অভিমানও কিন্তু এক নয়। প্রথম কথা হলো, সমালোচনা কেন হচ্ছে, সেটা নিয়ে ভাবুন। যে সমালোচনা করছে, তার উদ্দেশ্য নিয়ে চিন্তা করুন। এটা কি কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে করা হচ্ছে, নাকি সত্যিই আপনার কাজে কোনো ত্রুটি আছে, তা বুঝে নিন। অনেক সময় শুভাকাক্সক্ষী কোনো বন্ধু আমাদের ভালোর জন্যই ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চায়। যদি কেউ আপনার ভুল ধরিয়ে দিতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে, সে আপনার ভালো চায় বলেই এটা করছে। সুতরাং কান কথা শুনে, তুষ্টিবাদী সহযোগীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমালোচনাকারীকে শত্রুর তালিকায় ফেলে দেয়াটা কোনো কাজের কথা নয়। মনে রাখবেন, চারপাশে শুধু মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা বন্ধু-সহযোগীর চেয়ে দুয়েকজন সমালোচনা করার মতো বন্ধু থাকা ভালো। সৎসাহস থাকলে, নিজেকে দায়িত্বশীল ভাবলে সমালোচনাকারীর সঙ্গে বসুন, ঠিক কী কী বিষয়ে তাদের আপত্তি, তা জেনে নিন। দেখবেন, আপনাকে আর হরিহর মার্কা ভক্তদের নিয়ে চলতে হবে না। আপনি পৌঁছবেন অনন্য উচ্চতায়।
বড্ড কঠিন সময় পার করছি আমরা। এখনও যদি আত্মতুষ্টির যাবর কেটে দিন গুজরান করি, সেটা হবে চরম বোকামী। এখন সময় বিভাজন-বিভক্তি দূর করে একসঙ্গে পথচলার উদ্যোগ গ্রহণের। বিভক্তি-বিভাজন মূলত শয়তানের কৌশল। কারণ উম্মাহ যখন বিভক্ত হয়, তখন সবাইকেই ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। উম্মাহ যখন বিভাজিত হয়, সবাই সার্বিকভাবে দুর্বল হয়।
অভিশপ্ত শয়তান উম্মতের মধ্যে বিভক্তি ছড়ানোর জন্য কয়েকটি কৌশলে অগ্রসর হয়। প্রথমত, সে উম্মতের মধ্যে নানা শ্রেণি, গ্রুপ ও সম্প্রদায় তৈরি করে তাদের মাঝে সংঘাত সৃষ্টি করে। শয়তান মানুষের ভেতর কল্পিত কিছু ইস্যুর জন্ম দিয়ে তার ভিত্তিতে বিভাজন সৃষ্টি করে। আমরা সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই। প্রকৃতপক্ষে এ ইস্যুগুলোর হয়তো কোনো অস্তিত্বই নেই। শয়তান রাষ্ট্র, বর্ণ, গোত্রের ইস্যুকে ব্যবহার করেও আমাদেরকে বিভক্ত করে।
শয়তান আমাদেরকে দিয়ে আরেকটি খারাপ কাজ করায়। তাহলো, আমরা খুব আনন্দের সঙ্গে দলবাজি করি। ধরুন, কেউ বলছে, অমুক লাইনের সবাই খারাপ। অমুক দলের, দেশের কিংবা অঞ্চলের এই দোষ, ওই দোষ। এমন ঢালাওভাবে কোনো মন্তব্য কিংবা চিহ্নিতকরণ সঠিক নয়। সব জায়গাতেই ভালো মন্দ আছে। কিন্তু ঢালাওভাবে কাউকে নেতিবাচকভাবে চিত্রায়ণ করা উচিত নয়। অথচ আমরা শয়তানের পাল্লায় পড়ে হরহামেশা এমনটা করে থাকি। নিজেকে সাধু, সত্যানুসন্ধানী এবং একমাত্র হকের দাবিদার মনে করি। এই মনোভাব থেকে বের হয়ে আসা দরকার।
শয়তান যদি গোত্রীয় স্তরে বিভক্তি সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে সে ব্যক্তি পর্যায়ে তার অপচেষ্টা শুরু করে। এক ভাই যেন তার অপর ভাইয়ের সঙ্গে কথা না বলে, এক নেতা যেন অপর নেতার সঙ্গে না মেশে, এক পীর যেন অপর পীরের ছায়া না মাড়ায়, তাদের মাঝে যেন অসন্তোষ জমে থাকে, পরস্পরের মধ্যে যেন হিংসা লেগে থাকে, কেউ যেন কারো ভালো দেখতে না পারে- শয়তান এমন পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করে। সোজা হিসাব, আপনার সঙ্গে যদি কারও আগে সম্পর্ক ভালো থেকে থাকে আর এখন যদি কোনো দূরত্ব অনুভব করেন- তাহলে বুঝবেন শয়তান আপনাদের মাঝে প্রবলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আপনি শয়তানের কাছে হেরে যাচ্ছেন। আপনি সিদ্ধান্ত নিন, আপনার কী করা দরকার।
পরনিন্দা, শোনা কথা বিশ্বাস ও গুজব ছড়ানো- সব শয়তানি কৌশল। কেউ এসে আপনার কাছে অপরের নামে নিন্দা করছে, আপনার বিরুদ্ধে অপরকে কথা বলতে উসকানি দিচ্ছে- তাহলে বুঝবেন শয়তান সক্রিয়। চেষ্টা করুন, উদ্যোগী হোন, মেহনত করুন, চোখ-কান খোলা রেখে উপায় অন্বেষণ করুন- শয়তানের এসব কৌশল প্রতিহত করার। যদি পারেন, তবেই আপনি সফল। এবার আপনার অধিকার আছে, নেতা হওয়ার, দাঈ হওয়ার, মানুষকে ভালো কাজের প্রতি আহ্বান করার। তখন আর আপনার মাঝে প্রশংসার বাতাস, সমালোচনার ধাক্কা, অতিভক্তির পরাকাষ্ঠা, অন্ধ বিরেধিতার বাধা, ভিন্নমতের স্রোত আর সহমতের জোয়ার কোনো ক্রিয়া সৃষ্টি করবে না। নিষ্কলুষ হবে আপনার পথচলা। সিদ্ধান্ত নিন আপনার করণীয় কী?
লেখক: সাংবাদিক।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/