প্রসঙ্গ: রমযানে তাহাজ্জুদের জামাতের হুকুম: একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

।। মুফতি হেলাল আসহাব কাসেমী ।।

রমযান মাস আসলেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে জামাতের সাথে তাহাজ্জুদের নামায আদায়ের হিড়িক পড়ে যায়। অনেকে জামাতের সাথে তাহাজ্জুদ পড়াকে শুধু সুন্নাহই মনে করেন না বরং ওয়াজিবের সমপর্যায়ে মনে করেন। তারা শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ.)এর একটি ফতওয়াকে মূলত দলীল হিসেবে পেশ করে থাকেন। আবার অনেকে তাদের বিরোধিতা করে বিদআতেরও ফাতওয়া দিয়ে থাকেন। এমনকি বিভিন্ন জায়গায় উক্ত মাসআলাকে কেন্দ্র করে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটতে শুনেছি। তাই, আলোচিত এ মাসআলার শরয়ী সমাধানের জন্য ক্ষুদ্র এ প্রয়াস।

ভূমিকা: যে সমস্ত নফল নামায জামাতের সাথে আদায় করার বৈধতা ‘নস’ দ্বারা প্রমাণিত (যেমন- সালাতুল কুসুফ, ইসতেসকা, সালাতুল ঈদ এবং কিয়ামু রমযান) তাছাড়া সমস্ত নফল নামায রমযানে হোক বা রমযানের বাইরে হোক, জামাতবদ্ধ হয়ে تداعي (ঘোষণা দিয়ে/ডাকাডাকি)র সাথে আদায় করা মাকরূহে তাহরিমী। উক্ত মাসআলায় হানাফি মাযহাবের কোনো ফকীহের ভিন্নমত পরিলক্ষিত হয়নি। আর হ্যাঁ, এর ওপরই ফকীহ ও মুহাদ্দিসীনদের ফাতওয়া। (ফিকহী মাকালাত- ২/৩৭, থানভী)।

নফল নামাযের জামাতের জন্য আহ্বান করা:
নফল নামায জামাত সহকারে তাদায়ি (ঘোষণা দিয়ে/ডাকাডাকি)র সাথে আদায় করলে মুসল্লি সংখ্যা একজন হলেও মাকরূহে তাহরিমী হবে। التطوع بالجماعة إنما يكره إذا كان على سبيل التداعي (তাতারখানিয়াহ- ২/২৯৩, যাকারিয়া)।

ঘোষণা বা ডাকাডাকি ছাড়া মুক্তাদির সংখ্যা তিনের কম হলে নফল নামায জামাত সহকারে পড়ার অবকাশ আছে। আর মুসল্লি সংখ্যা তিন হলে কোন কোন ফকীহ বলেন মাকরূহ হবে। আবার কেউ কেউ বলেছেন জায়েয আছে।

তবে মুক্তাদি সংখ্যা চার বা চারের অধিক হলে সর্বাবস্থায় নফল নামাযের জামাত মাকরূহে তাহরিমী হবে, ডাকাডাকির সাথে হোক বা ডাকাডাকি ছাড়া হোক, রমযানে হোক বা রমযানের বাইরে হোক। কেননা, চার বা চারের অধিক সংখ্যক মুক্তাদি নফল নামাযের জামাতের ক্ষেত্রে অটোমেটিকভাবে تداعي হয়ে যায়। আর তাদায়ীর সাথে নফল নামায জামাত সহকারে পড়া জায়েয নয়।

التطوع بالجماعة إنما يكره إذا كان على سبيل التداعي أما لو اقتدى واحد بواحد أو اثنان بواحد لا يكره وإذا اقتدى ثلاثة بواحد اختلف فيه وإن اقتدى أربعة بواحد كره اتفاقا. (তাতারখানিয়াহ- ২/২৯৩, যাকারিয়া)।

وتطوع على سبيل التداعي مكروهة، قال الطحطاوي ; والتداعي أن يجتمع أربعة على إمام. (হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাদ দুর- ১/২৪০, রশিদীয়াহ)।

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ، أَنَّ جَدَّتَهُ مُلَيْكَةَ ، دَعَتْ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِطَعَامٍ صَنَعَتْهُ ، فَأَكَلَ مِنْهُ ، ثُمَّ قَالَ : قُومُوا فَأُصَلِّيَ لَكُمْ ، قَالَ أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ فَقُمْتُ إِلَى حَصِيرٍ لَنَا قَدِ اسْوَدَّ مِنْ طُولِ مَا لُبِسَ ، فَنَضَحْتُهُ بِمَاءٍ ، فَقَامَ عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَصَفَفْتُ أَنَا ، وَالْيَتِيمُ وَرَاءَهُ ، وَالْعَجُوزُ مِنْ وَرَائِنَا ، فَصَلَّى لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَكْعَتَيْنِ ، ثُمَّ انْصَرَفَ. (সহিহ বুখারী, হাদিস নং- ৮৫২, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ৬৫৮)।

আর তাদায়ির সাথে বা তাদায়ি ছাড়াই তিনের অধিক সংখ্যক মুসল্লি নিয়ে প্রতিনিয়ত নফল নামাযের জামাত কায়েম করা বিদআতের স্তরে পৌঁছে যায়।

وإن كان على سبيل المواظبة كان بدعة مكروهة لأنه خلاف المتوارث (রাদ্দুল মুহতার- ২/৬০৪, থানভী)।

যেই সমস্ত নফল নামায জামাতের সাথে আদায়ের বৈধতা স্পষ্ট নস দ্বারা প্রমাণিত তন্মধ্যে রমযানের কিয়ামুল লাইলও অন্তর্ভুক্ত। হাদিসে কিয়ামুল লাইলের অসংখ্য ফযীলত বর্ণিত রয়েছে। যেমন-

عن سلمان الفارسيؓ قال; خطبنا رسول الله صلى الله عليه وسلم في آخر يوم من شعبان فقال: يا أيها الناس قد أظلكم شهر عظيم مبارك شهر فيه ليلة خير من ألف شهر، شهر جعل الله صيامه فريضة، وقيام ليله تطوعا، من تقرب فيه بخصلة من الخير كان كمن أدى فريضة فيما سواه، ومن أدى فريضة فيه كان كمن أدى سبعين فريضة فيما سواه، (সূত্র- সহিহ ইবনু খুযাইমা, হাদিস নং- ১৮৮৭)।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ (সূত্র- সহিহ বুখারী, হাদিস নং- ৩৭, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ৭৫৯)।

إن الجماعة فى التطوع ليست بسنة إلا في قيام رمضان. (রাদ্দুল মুহতার- ২/৬০৪, থানভী)।

তাহাজ্জুদ কি কিয়ামুল লাইল বা কিয়ামু রমযানের অন্তর্ভুক্ত?
প্রায় সমস্ত ফকীহ, মুহাদ্দিসদের মতানুসারে তাহাজ্জুদ কিয়ামু রমযানের অন্তর্ভুক্ত না; বরং কিয়ামু রমযান বা কিয়ামুল লাইল দ্বারা সালাতুত তারাবীহ উদ্দেশ্য। তবে,আল্লামা আইনী ও শায়খুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) বলেন- তাহাজ্জুদ কিয়ামুল লাইল বা কিয়ামু রমযানের অন্তর্ভুক্ত। আর রমযানে কিয়ামুল লাইল বা রাতের বেলায় নফল নামায জামাতের সাথে আদায়ের বৈধতা নস দ্বারা প্রমাণিত। তাহাজ্জুদ যেহেতু কিয়ামুল লাইল এর অন্তর্ভুক্ত, তাই রমযানে তাহাজ্জুদের জামাআত بالتداعي বা بلا تداعي (অর্থাৎ- ডাকাডাকির সাথে হোক বা ডাকাডাকি ছাড়া হোক) কোন প্রকার কারাহাত ছাড়াই বৈধ। বরং মুস্তাহাবও বটে।

শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ.)এর দলীল-
إن الجماعة في التطوع ليست بسنة إلا في قيام رمضان (রাদ্দুল মুহতার- ২/৬০৪, থানভী)।

ويكره صلاة التطوع جماعة ما خلا قيام رمضان وصلاة الكسوف অর্থাৎ- কিয়ামে রমযান আর সালাতুল কুসুফ ছাড়া নফল নামায জামাতের সাথে আদায় করা মাকরূহ। (সূত্র- ফাতহুল কাদির- ১/৪৩৮)।

উল্লেখিত নসসমূহে কিয়ামে রমযান জামাআতের সাথে আদায় করার বৈধতা প্রমাণিত করেছে। আর কিয়ামে রমযান তারাবির সাথে নির্দিষ্ট নয়। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে রমযানের তৃতীয় রাত্রি পর্যন্ত এবং সাহাবায়ে কেরাম থেকে শেষ রাত্রি পর্যন্ত নফল নামায জামাতের সাথে আদায় করা প্রমাণিত আছে।

قال الإمام محمد؛ وبهذا نأخذ، لا بأس بالصلاة في شهر رمضان أن يصلي الناس بإمام تطوعا لأن المسلمين أجمعوا على ذالك. (মুয়াত্তা ইমাম মালিক, পৃষ্ঠা- ১১১)।

أي قيام لياليه مصلياً والمراد من قيام الليل ما يحصل به مطلق القيام (ফাতহুল বারী- ৪/২১৫)।

ومعنى من قام رمضان؛ من قام بالطاعة في ليال رمضان و يقال يريد صلاة التراويح وقال بعضهم؛ لا يختص ذالك بصلاة التراويح، بل في أي وقت صلى تطوعاً حصل له ذالك الفضل. (উমদাতুল ক্বারী- ১/২৮১)।

উল্লিখিত দলিলসমূহের সারকথা-
রমযানের রাতের বেলার প্রত্যেক ঐ নামায যার মধ্যে কিয়াম পাওয়া যায় তাও কিয়ামে রমযানের অন্তর্ভুক্ত। আর তাহাজ্জুদের মধ্যেও যেহেতু কিয়াম পাওয়া যায় তাই তাহাজ্জুদও কিয়ামে রমযানের অন্তর্ভুক্ত। আর কিয়ামে রমযান জামাআতের সাথে আদায় করা আহ্বানের সাথে হোক বা আহ্বান ছাড়া হোক, নসদ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং তাহাজ্জুদের জামাআতও আহ্বানের সাথে হোক বা আহ্বান ছাড়া হোক, আদায়ের বৈধতা প্রমাণিত।

শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ.) বলেন-
এছাড়াও আমাদের আকাবির কুতুবুল আলম হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)কেও মক্কাতে তাহাজ্জুদের জামাআত করতে দেখেছি। এমনকি শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান (রহি.)্এর মামুলও এটা ছিলো। (দেখুন-ফাতাওয়া শায়খুল ইসলাম, পৃষ্ঠা- ৪৩-৪৫, মাকতাবায়ে দ্বীনিয়াহ, ফিকহি মাকালাত- ২/৩-৩৫, থানভী)।

কিয়ামুল লাইল বা কিয়ামু রমযানের বিশ্লেষণ:
শাব্দিক অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে তো কিয়ামুল লাইল বা কিয়ামু রমযান ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ, যার মধ্যে তাহাজ্জুদের পাশাপাশি রাতের সমস্ত নফল নামাযই অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে, ফকীহ ও মুহাদ্দিসদের পরিভাষায় কিয়ামু রমযান দ্বারা শুধুমাত্র তারাবির নামাযই উদ্দেশ্য এবং নির্দিষ্ট।

হাদিস ও ফিকহের কিতাবাদিতে ‘তারাবিহ’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘কিয়ামুল লাইল বা কিয়ামু রমাযান’ শব্দ ব্যবহারের হেতু বলতে গিয়ে ফিকহে হানাফি›র প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‹আল হিদায়াহ›র ব্যাখ্যাকার আল্লামা বাবরতি (রহ.) বলেন-

وترجم بقيام رمضان اتباعا للفظ الحديث صلعم ‹إن الله تعالى فرض عليكم صيامه و سننت لكم قيامه

অর্থাৎ- হাদিসের শব্দের অনুসরণার্থে (তারাবিহ শব্দ দ্বারা শিরোনাম না করে) ‘কিয়ামে রমযান’ দ্বারা শিরোনাম করা হয়েছে। হাদিসে আছে- “আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর রমযানের রোযা ফরয করেছেন এবং কিয়ামে রমযানকে তোমাদের জন্য আমি সুন্নাহ বানিয়েছি”। (আল ইনায়াহ আলা হামিশিল ফাতহ- ১/৩৩৩)।

পর্যালোচনা
এক. ফকীহদের উক্তির উদ্দিষ্ট (কিয়ামে রমযান ছাড়া অন্যান্য নফল নামাযের জামাত মাকরূহ) হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ যেমন ফাতহুল বারী,উমদাতুল কারী ইত্যাদি থেকে না নিয়ে হাদিস বা স্বয়ং ফকীহদের ইবারত থেকেই নেয়া উচিত। কেননা, হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থে এই জায়গায় নফল নামাযের জামাতের আলোচনা মূখ্য নয় বরং من قام رمضان إيمانا এর ব্যাখ্যার মাধ্যমে রমযানের ফযীলতের আলোচনাই মূখ্য উদ্দেশ্য।

আমরা এখানে ফকীহ ও মুহাদ্দিসের এমন কিছু ইবারত উল্লেখ করবো যা উক্ত মাসআলার ক্ষেত্রে নস হিসেবে বিবেচিত হবে।

১. হিদায়া গ্রন্থে فصل فى التراويح বা তারাবিহ অধ্যায়ের পরিবর্তে فصل فى قيام رمضان শিরোনাম ধার্য্য করে তারাবির মাসায়িল উল্লেখ করা হয়েছে এবং হিদায়াহ গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইবনুল হুমাম এই জায়গায় قيام رمضان এর ব্যাখ্যা না করে তারাবিহেরই ব্যাখ্যা করেছেন-

(فصل فى قيام رمضان) التراويح جمع ترويحة (ফাতহুল বারী- ১/৩৩৩)।
২. শামসুল আইম্মা সারাখসী (রহ.) বলেন- الفصل الخامس فى كيفية النية واختلفوا فيها والصحيح أن ينوي التراويح أو قيام الليل. (আল মাবসুত লিস সারাখাসী- ২/১৪৫)।

(৩) إن نوى التراويح أو سنة الوقت أو قيام الليل فى رمضان جاز (খানিয়া আলা হামিশিল আলমগীরিয়াহ- ১/৬১২)।

তারাবির নিয়তের জন্যে কিয়ামুল লাইল বা তারাবি যেকোনটিই বলা যাবে, তাহলে বুঝা গেলো দুটিই সমার্থবোধক শব্দ।

৪. এছাড়াও পূর্বোল্লিখিত দুই হাদিস এবং সুনানে নাসাঈ›র হাদিস -افترض الله عليكم صيامه وسننت لكم قيامه এর মধ্যে قيام দ্বারা ‹তারাবিহ› ছাড়া অন্য কিছু উদ্দেশ্য হতেই পারে না। কেননা, قيام দ্বারা যদি তাহাজ্জুদ উদ্দেশ্য ধরা হয়, তাহলে قيامه تطوعا এই বাক্য অনর্থক হয়ে যাবে। কেননা,তাহাজ্জুদ নফল হওয়ার সাথে রমযানের কী সম্পর্ক? রমযান ছাড়াও তো তাহাজ্জুদের নামায নফল! সুতরাং বুঝা গেলো قيام দ্বারা তারাবিই উদ্দেশ্য।

আরও পড়তে পারেন-

৫. সহিহ মুসলিমের শিরোনাম (নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিসদের লাগানো)।

باب الترغيب فى قيام رمضان وهو التراويح (সহিহ মুসলিম- ১/২৫৯)।

৬. আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) লেখেছেন- باب ماجاء فى قيام شهر رمضان أي التراويح (আল আরফুশ শাজী- ১/৩২৯)।

৭. আল্লামা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) লেখেন- باب فى قيام شهر رمضان، هذا القيام كان عاما ثم اختص بالتراويح، فمطلقه يراد به التراويح (আল কাওকাবুদ দুররী- ১/২৬৭)।

উল্লিখিত নস দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কিয়ামে রমযান দ্বারা তারাবিহ ছাড়া অন্য কোন নফল নামায উদ্দেশ্য হওয়ার কোন সুযোগ নেই।

দুই. ইমাম মুহাম্মদ রাহি.এর ঐ ইবারত যা শায়খুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) দলীল হিশাবে উপস্থাপন করেছেন যে, ্রকিয়ামে রমযানের জামাত বৈধ হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ইজমাগ্ধ তা শুধুমাত্র তারাবির উপরই প্রযোজ্য হবে, তাহাজ্জুদের উপর হবে না। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবাদের যুগে তারাবি ছাড়া তাহাজ্জুদ বা অন্য কোন নফল নামায আহ্বান’সহ জামাতের সাথে আদায় করা প্রমাণিত নয়। বরং তারাবির নামাযই সর্বাবস্থায় জামাতের সাথে আদায়ের উপর উম্মাহের ইজমা প্রমাণিত হয়েছে। অন্য কোন নফল নামায জামাতের সাথে আদায়ের উপর উম্মতের ইজমা প্রমাণিত নয়।

একটি মূলনীতি:
নফল নামাযে গোপনীয়তা উদ্দেশ্য থাকে। আর এটাই কিয়াসের চাহিদা। এখন যদি কোন নফল নামায কিয়াসের বাহিরে গিয়ে গোপনে না পড়ে জামাত সহকারে আদায় করার বৈধতা নসদ্বারা প্রমাণিত থাকে তাহলে ঐ নসের হুকুম ঐ নামাযের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকবে, তার ওপর অন্য নামাযকে কিয়াস করা যাবে না।

وأن لايكون الأصل معدولاً به عن القياس (সূত্র- আল হুসামী, পৃষ্ঠা- ৯২, আশরাফী, দেওবন্দ)।

এখন আসা যাক আমাদের মূল আলোচনায়, তারাবি নফল নামাযের অন্তর্ভুক্ত। আর নফল নামাযে গোপনীয়তা উদ্দেশ্য থাকে। এখন যেহেতু কিয়াসের বাহিরে গিয়ে তারাবির নামায জামাত সহকারে আদায় করার বৈধতা নসদ্বারা প্রমাণিত তাই উক্ত নসের হুকুম তারাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এটার উপর তাহাজ্জুদের নামাযকে কিয়াস করা যাবে না।

আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দের ফাতাওয়া:
এক. হাকিমুল উম্মত থানভী (রহ.) বলেন- مثلا اگر تراویح کے بعد یہ عمل ہو تو نفل کی جماعت مجمع کثیر کیساتھ ہونا، جو کہ مکروہ ہے.
অর্থাৎ- “তারাবির পরে যদি এই আমল হয় তাহলে নফলের জামাত বড় একটা দলের সমন্বয়ে হওয়া লাযিম আসবে আর তা মাকরূহ”। (ইমদাদুল ফাতাওয়া- ১/৩০০)।

দুই. মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) বলেন-

جماعت نوافل کی سواے ان مواقع کے کہ حدیث سے ثابت ہیں مکروہ تحریمہ ہے، فقہ میں لکھا ہے اگر تداعی ہو اور تداعی سے مراد چار آدمی مقتدی کا ہونا ہے، جماعت صلوة کسوف ،تراویح استسقاء کی درست اور باقی سب مکروہ ہیں.

অর্থাৎ-“হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নফল নামাযের জামাত ছাড়া বাকি সমস্ত নফল নামাযের জামাত মাকরূহে তাহরিমী। ফিকহের কিতাবাদিতে লেখা আছে, যদি আহ্বান পাওয়া যায়; আর আহ্বান দ্বারা উদ্দেশ্য এক ইমামের পেছনে চারজন মুকতাদি হওয়া। সুতরাং কুসুফ, ইসতেসকা আর তারাবির নামায জামাতে আদায় করা বৈধ আছে। এ ছাড়া বাকি সমস্ত নফল নামাযের জামাত মাকরূহ হবে”। (সূত্র- ফাতাওয়ায়ে রশিদীয়াহ, পৃষ্ঠা- ৩৫৪, জসিম বুকশপ)।

তিন.
نوافل کی جماعت تہجد ہو یا غیر تہجد سواے تراویح وکسوف واستسقاء کے اگر چار مقتدی ہوں تو حنفیہ کے نزدیک مکروہ تحریمہ ہے خواہ خود جمع ہوں خواہ بطلب آویں. (ফাতাওয়ায়ে রশিদীয়াহ, পৃষ্ঠা- ৩৫৫ জসিম বুকশপ)।

চার.
শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ.)এর এই মাসআলার পর্যালোচনা করতে গিয়ে তাঁরই আপন নাতি মাওলানা সায়্যিদ সালমান মনসুরপুরী (হাফি.) ফাতাওয়ায়ে শায়খুল ইসলামের তা’লিকে লিখেন-

یہ مسئلہ حضرتؒ کی تفردات میں سے ہے، جسے مجتہدانہ بصیرت سے کام لیتے ہوۓ براہ راست احادیث شریفہ سے مستنبط فرمایاہے، لیکن احقر کو حضرت کے اس موقف کی تائيد فقہ حنفی کے کسی جزئيہ سے نہیں ملی، بلکہ مبسوط سرخسی اور دیگر معتبرکتب احناف میں ٤-٣ سے زیادہ مقتدی ہونے کی صورت میں نوافل کی جماعت کو مطلقا مکروہ قرار دیا گیاہے. بریں بنا مسئلہ زیر بحث میں فقہ حنفی کی رو سے حضرت گنگوہیؒ کا موقف ہی راجح اور مضبوط ہے. محمد سلمان.

অর্থাৎ- এই মাসআলা হযরত (রহ.)এর তাফাররুদাতের একটি, যা তিনি তার গবেষণার মনোচক্ষুকে কাজে লাগিয়ে সরাসরি হাদিস থেকে ইসতেম্বাত করেছেন। কিন্তু অধমের কাছে হযরতের এই অবস্থানের পক্ষে ফিকহে হানাফির কোন জুযইয়াহ মেলেনি। বরং মাবসুতসহ হানাফি মাযহাবের অন্যান্য নির্ভরযোগ্য কিতাবাদিতে ইমামের পেছনে ৩ বা ৪ থেকে বেশি মুকতাদি হওয়ার সূরতে নফল নামযের জামাত সর্বাবস্থায় মাকরূহ বলা হয়েছে। এই জন্যেই এই মাসআলায় ফিকহে হানাফির আলোকে হযরত গাঙ্গুহী (রহ.)এর অবস্থানই প্রণিধান্যযোগ্য ও দৃঢ়। মুহাম্মাদ সালমান। (সূত্র- ফাতাওয়ায়ে শায়খুল ইসলাম, পৃষ্ঠা- ৪৫, মাকতাবায়ে দ্বীনিয়াহ)।

পাঁচ. হযরতুল উস্তায মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী (রহ.) সহিহ বুখারীর দরসে প্রায়ই প্রসঙ্গত বলতেন ‘মাদানী (রহ.)এর সন্তানরা তাহাজ্জুদের যে সিলসিলা জারি রেখেছে তা মাদানী (রহ.) তাফাররুদাতের অনুকরণ মাত্র’।
হযরত (রহ.) ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা’র রেফারেন্সে বলতেন ‘আর সুন্নাহ ছেড়ে আকাবিরদের তাফাররুদাতকে আকড়ে ধরা দ্বীন বিকৃতির নামান্তর’।

ছয়. শায়খুল ইসলাম তাকি উসমানী (হাফি.) বলেন, হাজি সাহেব (রহ.)এর মা’মুল সম্পর্কে তো জানা নেই, তবে শায়খুল হিন্দ (রহ.)এর ব্যাপারে এতটুকু দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে জানা আছে যে, প্রথমে প্রথমে তিনি ডাকাডাকি ছাড়া দুয়েকজন মুকতাদি নিয়ে তাহাজ্জুদের জামাআত করে নিতেন, কিন্তু পরবর্তীতে মুসল্লি সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে কারাহাত থেকে বাঁচার জন্যে সারারাতই তারাবির আমল জারি রাখতেন। এমনকি তারাবির জামাতে ৮-১০ পারা পড়ে সাহরির সময় শেষ করতেন। (ফিকহি মাকালাত- ২/৪৯, থানভী)।

সারকথা: কিয়ামুল লাইল বা কিয়ামু রমযান দ্বারা তারাবিই উদ্দেশ্য; তাহাজ্জুদ উদ্দেশ্য নয়। তারাবির নামায জামাতের সাথে আদায় করার বৈধতা নস দ্বারা প্রমাণিত। তাহাজ্জুদের নামায জামাতসহকারে আহ্বানের সাথে আদায় করার বৈধতা নসদ্বারা প্রমাণিত নয়, এবং হানাফি মাযহাবের ফকিহগণ ঐকমত্য যে, চারের অধিক মুকতাদির সাথে জামাত কায়েম করা ডাকাডাকি করে হোক বা ডাকাডাকি ছাড়া হোক সর্বাবস্থায় মাকরূহ। আর এটা প্রতিনিয়ত করা বিদআত।

শেষ কথা: আলহামদুলিল্লাহ, আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দ আমাদেরকে যেমনভাবে আকাবিরদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি করতে শিখাননি, তেমনিভাবে অন্ধানুসরণ বা অন্ধ বিশ্বাস করতেও শিখাননি।

মানহাযে দেওবন্দ আসলাফ ও আকাবিরদের ভয়, ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং অনুসরণ-অনুকরণ করতে যেমন শিখিয়েছে, দ্বীনি বিষয়ে আদাব রক্ষা করে দালীলিক আলোচনা-পর্যালোচনা করারও অধিকার দিয়েছে।

আরেকটা কথা, শরীয়তের মাসায়েলের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে রায় প্রকাশ করা শিষ্টাচার পরিপন্থি নয়; বরং শাগরেদের উন্মুক্ত মতামত প্রকাশই বুজুর্গদের আত্মিক ফুয়ুজের ফসল।

তাই তো দ্বীনি বিষয়ে কারো বিচ্যুতি হলেই অন্য কেউ না কেউ দালীলিকভাবে তানকিদ করেছেন বা উন্মুক্ত মতামত পেশ করেছেন। তার একাধিক নযির আমরা দেখতে পেয়েছি। যেমন- ইবনে হাজার খ্যাত আল্লামা হাবিবুর রহমান আজমী (হাফি.) সায়্যিদ সালমান মনসুরপুরী এবং আমাদের সেরে-তাজ, মারকাযুদ-দাওয়ার মাওলানা আবদুল মালিক সাহেব (হাফি.) সহ অনেকেই আছেন।

এমনকি শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকি উসমানী (হাফি.) যখন মাত্র ১৬-১৭ বছর বয়স তখন তাঁর সম্মানিত পিতা ফকীহুন নাফস মুফতি শফি (রহ.)এর নির্দেশে শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ.)এর এই ফাতওয়ার পর্যালোচনায় প্রায় পনেরো পৃষ্ঠা বিশিষ্ট একটি রিসালাহ লিখেছেন।

আসলাফ ও আকাবিরদের শুযুয-তাফাররুদাত বা বিচ্ছিন্ন মতামত ছিলো, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তাফাররুদাতকে আপন জায়গায়ই রাখা উচিত। কেননা, আকাবিরদের তাফাররুদাত অনুসরণযোগ্য নয়।

شذوذ العلماء مستثناة من التقليد

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং আকাবিরদের নিয়ে বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি থেকে হেফাযত করুন। আমিন।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।