বাঁশের কেল্লার বীর শহীদ তিতুমীর (রহ.)

।। মাওলানা খন্দকার মনসুর আহমদ ।।

ভারত উপমহাদেশে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যাবার পর তা পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় যাঁরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর (রহ.) তাঁদের অন্যতম। অত্যাচারী ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সমর্থনপুষ্ট হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারে তৎকালীন বাংলার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো জুলুমের বিভীষিকা। সে সঙ্কটকালে তিতুমীর (রহ.) জালিম ইংরেজ সরকার ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং শেষ পর্যন্ত সেই সংগ্রামেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর ১৭৮১ সালে চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটকাল থেকেই তিনি ছিলেন সুস্বাস্থ্য ও সুঠাম দেহের অধিকারী। মল্লযুদ্ধেও তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। জীবনের ধাপে ধাপে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে সামনে এগিয়ে যান। ব্যক্তি জীবনে উচ্চ শিক্ষা লাভেরও তাঁর সুযোগ হয়েছিলো। ঊনচল্লিশ বছর বয়সে তিনি পবিত্র হজব্রত পালন করেন। হজ্জ করতে গিয়ে পবিত্র মক্কা শরীফে ভারতবর্ষের জিহাদ আন্দোলনের নেতা ও আধ্যাত্ম ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে ধর্মীয় ও আধ্যাত্ম শিক্ষা লাভ করেন।

১৮২৭ সালে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তখন এদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় জীবন মোটেও স্বস্তির ছিলো না। মুসলমানগণ শিরক-বিদআতমূলক বিভিন্ন কুসংস্কারে লিপ্ত ছিলো। তিনি দেখলেন এ যে নিতান্ত গর্হিত কাজ। তাই তিনি সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মানুষকে আল্লাহ ও রসূলের সঠিক পথ দেখানোর মাধ্যমে তাদের মধ্যে সঠিক ধর্মীয় অনুভূতির বিকাশ ঘটান এবং একই সালে তিনি ইংরেজদের অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধেও মুসলমানদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ হতে আহ্বান জানান। তিতুমীরের এই বিপ্লবী আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলে দলে মুসলমান তার দলে যোগ দেয়। শুরু হয় ইংরেজবিরোধী আন্দোলন।

তিতুমীরের আন্দোলন কর্মসূচি ব্যাপক হওয়ার পর ইংরেজ সমর্থনপুষ্ট হিন্দু জমিদাররা দারুণভাবে ক্ষেপে ওঠে। তারা ইংরেজ শাসকদের মদদে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। এসব পৈশাচিক কার্যকলাপে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে পুর্নিয়ার কুখ্যাত হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়। এই বর্বর হিন্দু জমিদার তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের দাড়ির জরিমানাস্বরূপ আড়াই টাকা করে কর ধার্য করে এবং বল প্রয়োগ করে তা আদায়ের ব্যবস্থা করে। মুসলমানদের গ্রাম ঘরবাড়ি লুট করে তা জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় উগ্র হিন্দুরা মুসলমানদের একটি মসজিদও পুড়িয়ে দেয়।

আরও পড়তে পারেন-

আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
মুমিন জীবনে নামাযের গুরুত্ব
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি

এ ব্যাপারে তিতুমীর প্রশাসনের কাছে ন্যায় বিচার দাবি করলে থানার হিন্দু দারোগা তিতুমীর ও তার সহযোগীদের দোষী করে উল্টো অভিযোগ তোলে। তিতুমীর ও তার সহযোগীরা ওদের এ অন্যায়-অবিচার নীরবে সহ্য করতে চাইলেন না। তাঁরা জেগে উঠলেন ঈমানি চেতনায় এবং এক পর্যায়ে মুক্তির সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন তাঁরা। তাঁদের লক্ষ্য ছিলো ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা। তাঁদের মনোভাব ছিলো সিংহের মতো একদিন বাঁচবো, কিন্তু শৃগালের মতো হাজার দিন বাঁচবো না। তাঁরা ধীরে ধীরে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে এগুলেন। তাঁর এ আন্দোলন সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের চেতনা যোগায়। তাই এ দেশের জাতীয় চেতনাই সারা ভারতবর্ষে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়।

তিতুমীর ও তাঁর সহযোগীরা আন্দোলনের পূর্ণ প্রস্তুতি নিলেন। গোলাম মাসুম নামক জনৈক সামরিক অভিজ্ঞ ব্যক্তি ইতোপূর্বেই তাঁর দলবলসহ তিতুমীরের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি তিতুমীরের নির্দেশেই নারিকেল বাড়িয়ায় একটি মজবুত বাঁশের কেল্লা গড়ে তোলেন। ইংরেজদের রাজশক্তি ও হিন্দু জমিদারদের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে এ প্রতিরোধ-ব্যুহ ছিলো নিতান্তই ক্ষুদ্র। তবুও দৃঢ় মনোবলে তিতুমীর ও তাঁর সাথীরা বলীয়ান হলেন। প্রায়ই হিন্দু জমিদারদের সাথে তাঁদের লড়াই সংঘটিত হতে থাকে। আর তাতে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে থাকে হিন্দু জমিদাররা। ইংরেজদের মদগর্বিত রাজশক্তি এতে দিন দিন রুষ্ট হয়ে ওঠে। তাই ইংরেজ সরকার তিতুমীরের বিরুদ্ধে বারাসাতের ম্যাজিষ্ট্রেট আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র বাহিনী প্রেরণ করে। ফলে নারিকেলবাড়িয়ায় তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ইংরেজদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এ পরাজয়ের ফলে ইংরেজ সরকার ক্ষেপে গিয়ে তিতুমীরের বিরুদ্ধে লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে এক দুর্ধর্ষ সামরিক বাহিনী প্রেরণ করে। তাদের তোপ কামানের মুখে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ভেঙে পড়ে। শেষে বীরবিক্রমে লড়াই করে ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর তিতুমীর তাঁর বহু অনুগামীসহ শাহাদাতবরণ করেন।

মুক্তির সংগ্রামে তিতুমীর (রহ.) ও তাঁর সাথীদের এ গৌরবদীপ্ত আত্মদান বাংলার কোটি কোটি মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। আত্মার বলে বলীয়ান হয়ে তিতুমীর ও তাঁর সাথীরা বীরত্বের যে মহান আদর্শ রেখে গেছেন, তা আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে চিরদিন।

লেখক: মহাপরিচালক, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।