পৃথিবীতে একমাত্র যে দেশটি জাতীয়ভাবে ভাষার মাস উদযাপন করে, সেটা হলো বাংলাদেশ। ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের ভাষার মাস। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে রক্তের আখরে আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে নতুন ইতিহাস রচনা করেছি, যা বিশ্ব দরবারে আজও দেদীপ্যমান এবং আমাদের জাতীয় জীবনে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা। বায়ান্ন সালে উর্দুকে একতরফা রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদে এবং বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে আন্দোলনে নেমে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের নির্মম গুলিতে শহিদ হন এদেশের সাহসী বীরসন্তান সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, শফিউরসহ আরো অনেকে। কিন্তু বায়ান্নর এই চেতনাকে আজ এদেশের ইসলামবিরোধী সেকুলার প্রগতিশীলরা উর্দু ভাষার প্রতি জাতিগত ঘৃণায় পর্যবসিত করেছে। কোনো নির্দিষ্ট ভাষা ও জাতির প্রতি ঘৃণার চর্চা নিছক সঙ্কীর্ণতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার পরিচায়ক।
এছাড়া, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাভাষার রাজনৈতিক মুক্তি ঘটেছে বাঙালি মুসলমানের হাতেই: সর্বশেষ বায়ান্ন সালে আর তার আগে ১২০৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত মুসলমানি শাসনকালে। এই মৌলিক ইতিহাস আমাদের জানা জরুরি। বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের আগে এখানে কুখ্যাত সেন বংশের শাসনামল চলছিল। খ্রিস্টীয় ১২শ’ শতাব্দীতে বৌদ্ধপন্থি পাল বংশের পতনের পর বাংলায় শুরু হয় ভারতের দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে আগত ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন রাজাদের দুঃশাসন। তাদের শাসনামলে তারা বাংলা ভাষার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। প্রজাদের মুখের ভাষা বাংলার পরিবর্তে সংস্কৃত ভাষাকে তারা সাম্রাজ্যের রাজভাষা হিসেবে প্রবর্তন করে। এর ফলে বাংলা ভাষার প্রতি শুরু হয় বৈষম্য ও ঘৃণার চর্চা। প্রবীণ ভাষাসৈনিক মুহাম্মদ আবদুল গফুরের লেখায় জানা যায়, সেনদের শাসনামলে অভিজাত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের প্রোপাগান্ডা অনুসারে ‘সংস্কৃত’কে দেবতার ভাষা হিসেবে জ্ঞান করা হতো এবং বাংলাকে নিম্ন শ্রেণির ভাষারূপে দেখা হতো।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
এ নিয়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের একটি শ্লোকও ছিল এমন: অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানিচ / ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ। এর অর্থ হলো-মনুষ্য রচিত বাংলা ভাষায় আঠারোটি পুরাণ ও রামায়ণ শ্রবণকারীরা রৌরব নরকে পতিত হবে। বাংলা ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করার নিমিত্তেই ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন রাজারা নানা ষড়যন্ত্রসহ নিবর্তনমূলক কালাকানুন আরোপ করতো।
কিন্তু বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গবিজয়ের পর থেকে ছয়শ বছরের মুসলমানি শাসনামলে (ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত) বাংলা ভাষা পুনরুজ্জীবন লাভ করে। মুসলিম শাসকদের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার অবিস্মরণীয় বিকাশ ঘটে। এ বিষয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন তার ‘বাংলা ভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেন, ‘মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোন কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীনবেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতে ছিল। ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পণ্ডিতমণ্ডলী ‘দূর দূর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাঙক্তেয় ছিল, তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল। কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরির আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভেতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরিরা অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতে ছিল। মুসলমান বিজয় বাংলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল’। অথচ নৃতাত্ত্বিকভাবে বাংলাভাষী হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের বাঙালি বলে স্বীকার করা হতো না। উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র- এমন নামজাদা হিন্দু সাহিত্যিকরাও বাঙালি মুসলমানদের ‘ভিনদেশি’ বা ‘আগন্তুক’ হিসেবে ডেমোনাইজ করেছেন। বাঙালি মানেই যেন হিন্দু। আর বাঙালি মুসলমানকে ভিন্ন জাতি হিসেবে বলা হতো ‘মোহামেডান’ (মানে, মোহম্মদী জাতি)।
সোজা কথা, বাঙালি পরিচয় পাওয়ার যোগ্য হতে হলে মুসলমানি কালচার ও মূল্যবোধ বাদ দিয়ে কলকাতার উচ্চ বর্ণহিন্দুদের নির্ধারিত তথাকথিত ‘অসাম্প্রদায়িক’ বাঙালি জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ ধারণ করতে হবে। নইলে বাঙালি পরিচয় কপালে জুটবে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে অন্যায্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধাভোগী হিন্দু সামন্তবাদী শোষক জমিদারশ্রেণির অস্তিত্ব আজ আর না থাকলেও তাদের প্রেতাত্মারা আজও কথিত ‘অসাম্প্রদায়িকতা’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’র ধুয়া তুলে আমাদেরকে হিন্দুত্ববাদ ও আধিপত্যবাদের গোলাম বানাতে চায়। কিন্তু এদেশের চাষাভূষা মুসলিম জনগোষ্ঠী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগ দিয়ে সেই আগ্রাসী জমিদারতন্ত্রের গোলামির জিঞ্জির ভেঙে নিজ কৃষিজমির মালিকানা পুনরুদ্ধার করে। এরই পথ ধরে বায়ান্ন’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের দীর্ঘ নয় মাসের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি, আলহামদুলিল্লাহ।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/