।। জহির উদ্দিন বাবর ।।
১৯৮৪ সাল। মুফাক্কিরে ইসলাম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন। বিশ^বিখ্যাত এই মুসলিম স্কলার পাশের দেশ ভারতের বাসিন্দা হলেও বাংলাদেশ সফরে আসেন জীবনের প্রায় শেষ বেলায়। তিনি জীবনে দুবার বাংলাদেশ সফর করেন। দ্বিতীয়বার এসেছিলেন ১৯৯৪ সালে। প্রথমবার বাংলাদেশে এসে এখানকার আলেম-উলামার সঙ্গে কথা বলে তিনি এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতিতে আলেমদের পিছিয়ে থাকার বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করেন। এজন্য সেই সফরে তিনি যেখানে যেখানে বক্তব্য দিয়েছেন সবখানেই মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। এদেশের আলেমরা যেন মাতৃভাষা বাংলাকে অস্পৃশ্য মনে না করেন; শুধু আরবি-উর্দু চর্চায় ফজিলত বাংলা চর্চায় কোনোই ফজিলত নেই এমন মানসিকতা যেন পরিহার করেন সেই আহ্বান জানিয়েছেন। ঠিক ১০ বছর পর দ্বিতীয় ও শেষবার বাংলাদেশে এসে তিনি আলেমদের উদ্দেশে প্রায় একই আহ্বান জানান।
যুগের সংস্কারক এই মনীষীর আহ্বান দ্বারাই অনুমান করা যায় বাংলাভাষা ও সাহিত্য চর্চায় আলেম-উলামার কী করুণ হাল ছিল সে সময়! বাংলা ভাষার প্রায় হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসও প্রায় দু’শো বছরের। অথচ গত চার-পাঁচ দশক আগেও বাংলা ভাষায় ইসলামি পঠনপাঠন সামগ্রী খুব একটা ছিল না। মানুষ ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তেমন কোনো উপকরণ পেতো না। ইসলামি পঠনপাঠন সামগ্রী পরিমাণে যেমন কম ছিল তেমনি তার প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থাও ছিল না বললেই চলে। মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা নূর মুহাম্মদ আজমী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রাহিমাহুমুল্লাহ) এ ধরনের যুগসচেতন হাতেগোনা কয়েকজন আলেম প্রথমে বাংলাভাষা চর্চায় মনোযোগ দেন। সাধারণ মানুষের দ্বীন শেখার ন্যূনতম পঠনপাঠন সামগ্রী যোগানে তাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস ও হিন্দিবাদী রবীন্দ্রনাথ
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
মাতৃভাষা চর্চার ভঙ্গুর একটি অবস্থার মধ্যে সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)এর হৃদয়ছোঁয়া আহ্বান এদেশের আলেম-উলামাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। বিগত শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে অনেক আলেম মাতৃভাষা চর্চায় মনোযোগ দেন। তাঁদের অব্যাহত চর্চার ফলে ইসলামি ধারার লেখালেখির অঙ্গনে যে শূন্যতাটুকু ছিল তা আস্তে আস্তে কেটে যেতে থাকে। এরপর থেকে কলমধারী আলেম-উলামার সংখ্যা দিন দিন শুধু বেড়েছেই। নবীন আলেমদের মধ্যে মাতৃভাষা চর্চার একটা জোয়ার লক্ষ করা যায় গত দুই দশক ধরে। বাংলা ভাষার সাড়ে নয়শ বছরের ইতিহাসে ইসলামি ধারার যে পরিমাণ পঠনপাঠন সামগ্রী লিখিত হয়েছে এর চেয়ে বহুগুণে রচিত হয়েছে গত পঞ্চাশ বছরে। এজন্য গত কয়েকটি দশককে ইসলামি ধারার সাহিত্য চর্চা কিংবা লেখালেখির স্বর্ণযুগ বলা যায়।
গত দুই দশকে ইসলামি অঙ্গনে কয়েক শ’ লেখক তৈরি হয়েছেন। বেশ শক্তিশালী গদ্য লেখার যোগ্যতা রাখেন বর্তমানে এমন আলেমের সংখ্যা অনেক। শিল্প ও মানের বিচারে সাধারণ ধারার যেকোনো লেখার সঙ্গে তুলনা করার মতো শক্তিশালী কলম সৈনিকের সংখ্যাটা ইসলামি অঙ্গনে খুব কম নয়। একটা সময় ইসলামকে জানার জন্য পঠনপাঠন সামগ্রীর যে নিদারুণ অভাব লক্ষ করা যেতো এখন অন্তত সেটা নেই। এখন বাংলা ভাষায় কেউ ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরূপে জানতে চাইলে অন্তত উপাত্তের কোনো কমতি অনুভব করবে না। ইসলামি ধারার পত্রপত্রিকা ও বইপত্রের পরিমাণ এখন সাধারণ ধারার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী একুশে বইমেলায় প্রায় চার হাজার বই প্রকাশিত হয়। এসব বইয়ের মধ্যে বেশির ভাগই মানের দিক থেকে উত্তীর্ণ নয়। সাধারণ ধারার প্রকাশনীগুলো মূলত ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক বইপত্র প্রকাশ করে থাকে। সারা বছর তাদের বইপত্র খুব একটা বের হয় না এবং বেচাবিক্রিও তেমন হয় না। কিন্তু ইসলামি ধারার প্রকাশনা জগত এখন এতোটাই সমৃদ্ধ যে, প্রতি মাসে কয়েকশ বই প্রকাশিত হয়। সারা বছর যে পরিমাণ বই প্রকাশিত হয় সেটা ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক সাধারণ ধারার প্রকাশিত বইয়ের চেয়ে সংখ্যায় কম হবে না, বরং বেশিই হবে। সার্বিক বিচারে মানের দিক থেকেও এসব বই কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হলো, ইসলামি ধারার বইপত্রের কাটতি সারা বছরই রয়েছে। বছরজুড়েই পাঠকেরা বই কিনেন। দেশের প্রতিটি জেলা এমনকি থানা-ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যন্ত ইসলামি বইপত্রের বাজার গড়ে ওঠেছে। সেখানে প্রতি মাসে হাজার হাজার বইপত্র বিক্রি হয়। সে হিসেবে বাণিজ্যিক দিক থেকেও ইসলামি ধারার প্রকাশনা জগত অনেকটা সমৃদ্ধ।
বেশ কিছু পত্রপত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে ইসলামি অঙ্গন থেকে। প্রতি মাসে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে শতাধিক পত্রপত্রিকা বের হচ্ছে। বিভিন্ন মাদরাসা থেকে নিয়মিত পত্রিকা বের হচ্ছে। অন্তত বছরে একটা বাংলা স্মরণিকা বের হয় না এমন মাদরাসা খুব কম আছে। আর দেয়ালিকা প্রকাশিত হয় না এমন মাদরাসা নেই বললেই চলে। একটা সময় কওমি মাদরাসায় বাংলা চর্চায় নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এখন আর তা নেই। বরং কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষায় যোগ্য করে গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ চোখে পড়ে।
গত পাঁচ দশ বছরে ইসলামি ধারার লেখালেখির অঙ্গনে মোটামুটি একটা বিপ্লব ঘটেছে। মাদরাসায়পড়–য়াদের মধ্যে লেখালেখি চর্চার হিড়িক লেগেছে। প্রতিটি মাদরাসায় বেশ কিছু ছাত্র পাওয়া যাবে যারা ক্লাসের কিতাবাদির বাইরে বাংলা সাহিত্যের বইপত্র নিয়মিত পড়ে, রোজনামচা লেখে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় টুকটাক লেখার চেষ্টা করে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখে নিজের মনের ভাবটুকু প্রকাশের চেষ্টা করে। কর্তৃপক্ষের উৎসাহ ও আনুকূল্য পাওয়ার কারণে দিন দিন মাদরাসাপড়–য়ারা লেখালেখি ও সাহিত্য চর্চার দিকে ঝুঁকছে। বিভিন্ন জায়গায় এ জাতীয় আয়োজনগুলোতে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি দেখেই তা আঁচ করা যায়। মাদরাসা শিক্ষিতদের মধ্যে শিল্প-সাহিত্য চর্চার যে জোয়ার লক্ষ করা যাচ্ছে সেটা সঠিকভাবে প্রবাহিত হলে আশা করা যায় অতীতের ঘাটতি পোষানো তেমন কঠিন কিছু হবে না।
ইসলামি ধারার লেখালেখির অঙ্গনে বর্তমানে যে পরিমাণ লেখক তৈরি হয়েছেন এই সংখ্যাটা খুব বেশি বাড়ার আর প্রয়োজন নেই। কারণ এটি একটি সৃজনশীল কাজ, এখানে পাইকারি হারে সমাগম ঘটলে সৃজনশীলতা রক্ষা করা মুশকিল হয়ে যাবে। এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে জিনিসটির সেটা হলো মানের দিকে মনোযোগ দেওয়া। আমাদের অঙ্গনে ব্যাপকহারে যে কাজ হচ্ছে সেগুলোর বেশির ভাগই অনুবাদনির্ভর। দীর্ঘ সময়ের ঘাটতি ও শূন্যতা পূরণে এটা দরকারিও ছিল। এখন যেহেতু ঘাটতি অনেকটা পূরণ হয়ে গেছে, পঠনপাঠন সামগ্রীর অভাবও দূর হয়েছে, সুতরাং মানের দিকে জোর দেয়ার প্রয়োজনটাই বেশি। আমরা কী পরিমাণ লিখলাম সেটা বিবেচনা না করে কতটা মানসম্পন্ন লিখলাম সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। শিল্পমানের বিচারে আমার লেখাটি কতটা উত্তীর্ণ হলো সেদিকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে সৃজনশীল ধারার লেখালেখির পরিমাণ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনীয় এই দিকটির প্রতি সবাই মিলে মনোযোগী হলে আশা করা যায় বাংলা ভাষার নেতৃত্বে একদিন সত্যি সত্যিই আলেমদের হাতে চলে আসবে।
পাশের দেশ ভারত-পাকিস্তানের আলেমরা মাতৃভাষার নেতৃত্ব নিজেদের হাতে রেখেছেন। কারণ তারা মাতৃভাষা চর্চায় কখনোই উদাসীন ছিলেন না। যেকোনো কারণেই হোক অনেকটা পরে এসে আমাদের মধ্যে বোধোদয় হয়েছে। অনেক বিলম্বে আমরা মাতৃভাষা চর্চার দিকে মনোযোগী হয়েছি। তবে দেরিতে শুরু করলেও আমাদের মাতৃভাষা চর্চার গতিধারা খুবই আশা জাগানিয়া। গত কয়েক দশকে এই অঙ্গনে আমাদের অভাবনীয় উন্নতি আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার মতো ঘটনা। যে দেশে আমাদের জন্ম, যেখানে আমরা বেড়ে উঠছি, যেখানকার মাটি ও মানুষের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক সেই দেশের ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে না সেটা হতে পারে না। তাই আসুন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্বদানের জন্য নিজেদের যোগ্য করে তোলার প্রয়াসে সবাই যুক্ত হই।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, ঢাকা টাইমস; সম্পাদক, লেখকপত্র।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/