।। মুহাম্মদ নুরুন্নবী ।।
১৯৩৭-১৯৪৭ পর্যন্ত অখ- বাংলার যেই তিনজন প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনজনই ছিলেন মুসলমান, যেটা ‘ভদ্রলোক বাঙালি’রা সহজভাবে নিতে পারেনি। যারা এতদিন ছিল জমিদারের প্রজা এবং পূর্ববঙ্গের চাষাভূষা, তারাই এখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী! এটাতো মেনে নেয়া যায় না! ফলে বাংলার পশ্চিমাংশে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলো নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ নামে আলাদা প্রদেশের দাবি উঠল। ১৯৩৭-এর আগে সর্বজনীন ভোটাধিকার ছিল না, নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা যারা দিতে পারত তারাই কেবল ভোট দিতে পারত। ফলে ক্ষমতা ছিল জমিদারদের হাতে। কিন্তু ১৯৩৭ সালে এসে সবার ভোটারধিকার চালু হওয়ার পর বাংলার ক্ষমতা চলে আসে মুসলমানদের হাতে। উল্লেখ্য, অখ- বাংলার ৫২% ছিল মুসলিম জনগোষ্ঠী আর বাকি ৪৮% ছিল মোটাদাগে হিন্দু জনগোষ্ঠী।
একসময় বলা হতো, মুসলমানদের কারণে তথা মুসলিম লীগের কারণে বাংলা ভাগ হয়েছে। অথচ ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জয়া চ্যাটার্জি তার গবেষণায় দেখাচ্ছেন, ‘বাংলা ভাগের দাবিতে ৪৭ সালের মে মাসে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা যৌথভাবে কলকাতায় এক বিরাট জনসভার আয়োজন করে। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার’ (জয়া চ্যাটার্জি, বাঙলা ভাগ হল, পৃষ্ঠা ২৮৭)।
‘বাংলা ভাগের দাবিতে ৭৬টি জনসভার আয়োজন করা হয় বলে জানা যায়। এর মধ্যে কংগ্রেস একাই কমপক্ষে ৫৯টি জনসভার আয়োজন করে। ১২টা জনসভা হয় হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে। আর ৫টা জনসভা হয় কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার যৌথ উদ্যোগে’। (জয়া চ্যাটার্জি, বাঙলা ভাগ হল, পৃষ্ঠা-২৮৮)।
আরও পড়তে পারেন- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
বেঙ্গল কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বাংলা ভাগের জন্য আন্দোলন করতে থাকলেও হিন্দু নেতৃবৃন্দের একটা ছোট অংশ অখ- বাংলার পক্ষে ছিলেন। অখ- বাংলার পক্ষে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কিরণ শংকর রায় এবং শরৎ বোস অন্যতম। শরৎ বোস সোহরাওয়ার্দীর সাথে অখ- বাংলার ক্ষমতাকাঠামো কী রকম হবে সেটা নিয়ে একটা চুক্তিও করেন। পরবর্তীতে মুসলিম নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য জিন্নাহর কাছে যান আর হিন্দু নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে কিরণ শংকর রায় এবং শরৎ বোস গান্ধীর কাছে যান। জিন্নাহ অখ- বাংলা রাষ্ট্রের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করলেও গান্ধী হিন্দু নেতৃবৃন্দকে অখ- বাংলা রাষ্ট্রের বিষয়ে আলোচনার জন্য নেহেরু এবং প্যাটেলের কাছে পাঠান। নেহেরু এবং প্যাটেল অখ- বাংলা রাষ্ট্রের প্রস্তাবকে নাকচ করে দেন।
প্যাটেল বাংলা ভাগের দাবিতে আন্দোলনরত বাঙালি হিন্দুদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন-
‘ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বাঙলা পৃথক হতে পারে না। স্বাধীন বাঙলা সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের ধারণা হল বোকার মতো মুসলিম লীগের খপ্পরে পড়ার জন্য অপ্রত্যাশিত প্ররোচণাপূর্ণ একটা ফাঁদ। বাঙলার এই অবস্থা সম্পর্কে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সম্পূর্ণ সচেতন এবং আপনাদের ভয় পাওয়ার আদৌ প্রয়োজন নেই। অ-মুসলিম জনগণের বেঁচে থাকার জন্য বাঙলাকে অবশ্যই বিভক্ত হতে হবে’। (বাঙলা ভাগ হল: জয়া চ্যাটার্জি, পৃষ্ঠা-২৯৭)।
একদিকে কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার আন্দোলন অন্যদিকে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেহেরু এবং প্যাটেলের তাতে সমর্থন দানের ফলে শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলার পশ্চিমাংশের হিন্দু মেজরিটি জেলাগুলোর আইনপ্রণেতাদের নিয়ে একটা ভোটাভুটি হবে, আর পূর্ব দিকের মুসলিম মেজরিটি জেলাগুলোর আইনপ্রণেতাদের নিয়ে আরেকটা ভোটাভুটি হবে। এই ভোটাভুটিতে যদি কোন একটা অংশ বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দেয়, তখন বাংলা ভাগ হবে। আর যদি উভয় অংশ বাংলা ভাগের বিপক্ষে ভোট দেয় তখন বাংলা ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
বাংলার পশ্চিমাংশের হিন্দু মেজরিটি জেলাগুলোর সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৫৮ জন বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দেন এবং বাকি মুসলিম লীগের ২১ জন বিপক্ষে ভোট দেন। ৫৮ জনের সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষ আরো সিদ্ধান্ত নেয় যে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো ভারতে যোগদান করবে।
আরও পড়তে পারেন-
পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
অন্যদিকে, পূর্ববঙ্গের মুসলিমপ্রধান জেলাগুলোর সংসদ সদস্যদের মধ্যে ১০৬ জন (যার ১০০ জনই মুসলিম লীগের) বাঙলা ভাগের বিপক্ষে ভোট দেন। বাকি ৩৫ জন পক্ষে ভোট দেন। একপর্যায়ে হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলোর আইনপ্রণেতাদের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে ১০৭-৩৪ ভোটে মুসলিমপ্রধান এলাকার আইনপ্রণেতারা প্রস্তাবিত পাকিস্তানে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের প্রতিনিধি পাঁচ আইনপ্রণেতা এবং খ্রিস্টানদের প্রতিনিধিত্বকারী একজন মুসলিম লীগের পক্ষে ভোট দেন।
(নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির ২০১৩ সালে Colonialism, politics of language and partition of Bengal নামে ৩৫ পর্বের একটা ধারাবাহিক সিরিজ লেখেন। ভোটাভুটির এই তথ্যটা সেই সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে আলোচিত হয়েছে)।
এখানে দুটো বিষয় দেখা যাচ্ছে, ১. পশ্চিমবঙ্গের সংসদ সদস্যদের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাগের বিষয়টা চূড়ান্ত হয়। ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ যদি অখ- বাংলা রাষ্ট্রের পক্ষে ভোট দিত তাহলে আমরা অখ- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র পেতাম। ২. পশ্চিমবঙ্গ বাংলাকে খ-িত করে ভারতে যোগদানের সিদ্ধান্তের পরই পূর্ববঙ্গ বাংলাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের চিন্তা বাদ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
মূলত কলকাতার মত বড় শহর এবং সমুদ্রবন্দর হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর পূর্ববঙ্গ নিজেদের অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে আর বাংলাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র নিয়ে না এগিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পূর্ববঙ্গের অবকাঠামোগত অবস্থা তখন এতটাই নাজুক ছিল যে, ৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পর ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য আবেদন জানায় পূর্ব পাকিস্তান সরকার। জবাবে তারা জানান, ৬ মাস কেন, ৬ দিনও কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। পরবর্তীতে মংলা বন্দর করা হয় এবং চট্টগ্রাম বন্দরেরও আধুনিকায়ন করা হয়।
অবশেষে আমরা বাংলা নামে দেশ করতে পেরেছি ১৯৭১ সালে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। তবে অখ- বাংলাদেশ করতে পারিনি, কারণ, বাংলার পশ্চিমাংশ বাঙালিত্বের মায়া ত্যাগ করে ভারতে চলে গেছে ৪৭ সালেই।
লেখক: লন্ডনপ্রবাসী গবেষক।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/