বার্মার ‘অন্য’ মুসলমানরা কেমন আছে?

।। আলতাফ পারভেজ ।।

মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে এমন এলাকা বিরল নয় যেখানে গির্জা, মন্দির ও প্যাগোডার পাশাপাশি মসজিদও শহরটির বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির গৌরব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ এই শহরেরই পাশে এমন গ্রাম আছে, যেখানে সাইনবোর্ড লাগিয়ে ‘মুসলমানমুক্ত’ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছিল একসময়। ‘বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক’ (বিএইচআরএন) ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ রকম ২১টি গ্রামের বিবরণ দিয়েছিল। এসব গ্রামের বাসিন্দারা বলছে, তারা ‘কর্তৃপক্ষের’ অনুমতি নিয়েই সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। এটা দেশটিতে পদ্ধতিগতভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষের প্রাতিষ্ঠানিকতার ইঙ্গিত দেয়। অথচ ‘বার্মা ইউনিয়নের’ প্রতিষ্ঠাতা আং সাংয়ের প্রধান কয়েকজন রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন মুসলমান এবং দেশটির সব শহর-উপশহরেই অল্পবিস্তর মুসলমান কয়েক শতাব্দী ধরে বাস করে আসছে।

তবে আশার কথা, গত কয়েক মাস থেকে বার্মাজুড়ে অমুসলমান সাধারণ মানুষের মাঝে- বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মাঝে মুসলমান বিদ্বেষ কমছে। তারা গণতন্ত্রের লড়াইয়ে সবাইকে এককাতারে শামিল করতে চাইছে।

তারপরও বহির্বিশ্ব এখনও মিয়ানমারের মুসলমান বিদ্বেষের কথা চূড়ান্তভাবেই অবহিত। কিন্তু শুধু রোহিঙ্গা নয়, সংখ্যায় বড় না হলেও মিয়ানমারজুড়ে আরও এমন মুসলমান জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা বিভিন্ন সময় চরম অস্তিত্বের সংকটে পড়েছিল। যেমন মিয়ানমারের ওপরের অংশে ‘পানথে’ মুসলমানদের কথাই ধরা যাক। মান্দালে ও শান রাজ্যে এদের বসতির ইতিহাস কয়েক শ বছরের। মিয়ানমারের প্রাচীন রাজধানী মান্দালেতে পানথেদের এমন মসজিদও আছে, যা ১৮৬৮ সালে নির্মিত। ব্রিটিশদের ১৯০০-০১ সালের গেজেটেও ব্যবসায়ী জনগোষ্ঠী হিসেবে পানথেদের উল্লেখ আছে। কিন্তু ১৯৮২ সালে সামরিক সরকার নতুন নাগরিকত্ব আইনে ‘মিয়ানমারের জাতিসত্তাসমূহের’ যে তালিকা করে, তাতে ১৩৫টি জাতিসত্তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের মতো পানথেদেরও ঠাঁই হয়নি। ‘পরিচয়’হীন জনগোষ্ঠী হিসেবে হানাফি মাজহাবের প্রায় এক লাখ পানথে মুসলমান এখনও চেষ্টা করছে এটা প্রমাণ করতে যে, তারা রোহিঙ্গা নয়। চীনা ধাঁচের মুখাবয়বের কারণে শারীরিকভাবে এটা প্রমাণ করা তাদের জন্য কঠিন হয় না। কিন্তু মুসলমান ‘পরিচয়’জনিত অন্যান্য বঞ্চনা এড়ানো সামান্যই সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন সময়।

পানথেদের চেয়েও করুণ অবস্থা ‘কামিয়ান’দের, যদিও তারা ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী ১৩৫টি ‘ন্যাশনাল রেইস’-এর একটি। মিয়ানমার সরকার একমাত্র যে মুসলমান সম্প্রদায়কে আইনগতভাবে ওই দেশের জাতিসত্তা হিসেবে স্বীকার করে তারাই ‘কামিয়ান’ বা ‘কামান’। নৃতাত্ত্বিকভাবে এরা মূলত ১৬৬০-এ আরাকানে আশ্রয় নেয়া মোগল স¤্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা ও তাঁর সহযোগীদের বংশধর। চরম ধর্মীয় উগ্রতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কামিয়ানরাও এখন ‘আমরা রোহিঙ্গা নই’ প্রমাণ করতে সচেষ্ট, যা কার্যত একধরনের স্বপ্রণোদিত ‘বামারাইজেশন’-এর জন্ম দিয়ে চলেছে। কামিয়ানদের অন্তত দুটি রাজনৈতিক দলও রয়েছে- কামিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পার্টি এবং কামিয়ান ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টি নামে। মাঝে মাঝে সরকারের চাপের মুখে উভয় দলের নেতৃত্বকেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে হয়। অথচ প্রায় একই জনপদে উভয়ের বসতি। ধর্মীয় বিশ্বাসে তারা এক।

১৯৩১-এর শুমারিতে কামিয়ানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ হাজার। বর্তমানে সমগ্র দেশে এই সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৫০ হাজারের মতো হবে বলে মনে করা হয়। তাদের ২০ হাজারই রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা। এর তিন-চতুর্থাংশই আবার ২০১২ সালের দাঙ্গার পর থেকে থাকছে উদ্বাস্তু শিবিরে। রোহিঙ্গাদের মতো এদেরও নিজ এলাকায় ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না। বস্তুত ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের আগেই রাখাইনের কামিয়ানদের অধিকাংশই উদ্বাস্তু।

আরও পড়তে পারেন-

সরকারের আইনগত অবস্থান অনুযায়ী কামিয়ানদের স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু কার্যত মূল সমাজ ও প্রশাসন রোহিঙ্গাদের মতো তাদেরও ‘বাঙালি’ প্রমাণ করতে সচেষ্ট। ফলে তাদের নাগরিকত্ব সনদ পেতে চরম হয়রানি পোহাতে হয়। উদ্বাস্তু শিবিরের বাইরের কামিয়ানদেরও রাখাইন রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার উপায় নেই। রাখাইন বা আরাকান ছেড়ে যাওয়া সব যানবাহন সব সময় নজরদারিতে রাখা হয়- রোহিঙ্গা বা কামিয়ান কেউ দেশের অন্যত্র যাচ্ছে কি না, সেটা দেখতে। কামিয়ানরা দেখতে রোহিঙ্গাদের মতোই। ফলে তাদের নাগরিকত্বের আইনগত অধিকার থাকলেও বাস্তব স্বীকৃতি নেই।

কামিয়ানদের পুনর্বাসন নিয়ে ২০১৮ সালের ৫ মার্চ মিয়ানমারের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে (প্লিথু হুলুথ) একটি বিতর্ক উঠেছিল। বিতর্কে অংশ নিয়ে দেশটির সাগাইন অঞ্চলের একজন সংসদ সদস্য মুসলমানদের ‘ক্যানসার’ হিসেবে অভিহিত করে তাদের পুনর্বাসনের বিরোধিতা করেন। কিন্তু পার্লামেন্টের স্পিকার বা অন্য সদস্যরা আইনগতভাবে বৈধ একটা জাতিসত্তা সম্পর্কে এমন বিদ্বেষী ভাষণের বিরোধিতা করেননি।

২০১২ সালের ‘রাখাইন দাঙ্গা’র দুই বছর পর মিয়ানমারের মান্দালেতে আরেকটি যে বড় দাঙ্গা হয়, তার শিকার ‘পাথি’ মুসলমানরা। পাথিরা বহু শতাব্দী ধরে ওই অঞ্চলের বাসিন্দা এবং দেশটির ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রামে এরা খুবই সক্রিয় জনগোষ্ঠী ছিল। তবে স্বাধীনতার পর তারাও রোহিঙ্গাদের মতোই ‘ন্যাশনাল রেইস’-এ ঠাঁই পায়নি এবং যথারীতি যাবতীয় বৈরিতার মুখোমুখি হয়। একই ভাগ্যলিখন ঘটেছে দেশটির সর্বদক্ষিণের ‘পাসু’ নামে পরিচিত মালয়ভাষী প্রায় ৩০ হাজার মুসলমানের ক্ষেত্রেও। এরাও মিয়ানমারের ১৩৫ জাতিসত্তার তালিকায় ঢুকতে পারেনি। মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গাদের পক্ষে অতি সোচ্চার থাকায় পাসুদের ব্যাপারেও বামার বৌদ্ধদের মনোভাব অনেক রক্ষণশীল এখন।

আইনগত স্বীকৃতি থাকলেও এ রকম বহুমুখী সামাজিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষের পরিবেশে স্বস্তিতে বসবাস যে কঠিন, সেটাই দেখা যায় জারবেদি ও তামিল মুসলমানদের ক্ষেত্রে। জারবেদিদের একরকম ‘বামার মুসলমান’ই বলা যায়। ঔপনিবেশিক শাসনামলে বা তারও আগে কর্মসূত্রে আসা যেসব বিদেশি মুসলমান পুরুষদের সঙ্গে স্থানীয় ‘বামার’ নারীদের বিয়ে হয়েছিল, তাদের বংশধর মুসলমানরাই মিয়ানমারে ‘জারবেদি’ নামে পরিচিত। মূলতঃ তাদের হাতেই ১৯০৯ সালে ‘বার্মা মুসলিম সোসাইটি’ নামের সংগঠনের জন্ম। মিয়ানমারে প্রায় একশ’ বছর ধরে জারবেদিরা নিজেদের ‘বার্মিজ মুসলমান’ হিসেবে আলাদা জাতিগত পরিচয়কে আইনসিদ্ধ করতে লড়ছে। প্রাণপণে চেষ্টাও করে যাচ্ছে ‘মূলধারা’য় মিশে থাকতে। কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতিতে এরা অন্য সব বামারের মতো হলেও পৃথক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতির সংগ্রামে সফলতা আসেনি। উপরন্তু সেনাবাহিনীর মদদে সৃষ্ট মুসলমান বৈরিতায় তারাও আক্রান্ত। তাদেরও ‘কা-লা’ ডাক শুনতে হয়। যে শব্দটি মিয়ানমারে মূলত মুসলমানদের জন্য অপমানসূচক সম্বোধন হিসেবে ব্যবহৃত। বামার জাতীয়তাবাদীদের একাংশ বলছে, বামার জাতির অন্তর্ভুক্ত হতে হলে কেবল বৌদ্ধই হতে হবে। এভাবেই জারবেদিরাও বিভেদরেখা পেরোতে পারছে না।

মিয়ানমারের আরেক বিড়ম্বিত মুসলমান জনগোষ্ঠী ‘ব্ল্যাক কারেন’। স্বাধিকারের দাবিতে কারেনদের সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বিশ্ব জানে। কিন্তু সেই জানাশোনার মধ্যে কারেন জনপদের মুসলমানরা কীভাবে বিড়ম্বিত, সেটা চাপা পড়ে গেছে। কারেনদের মূল সংগঠন ‘কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন’ ঐতিহাসিকভাবে সেক্যুলার আদর্শের অনুসারী হলেও একে দুর্বল করতে সেনাবাহিনীর মদদে বৌদ্ধপন্থী কারেনরা ‘ডেমোক্রেটিক কারেন বুড্ডিস্ট আর্মি (ডিকেবিএ)’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে। তাদের প্রভাবিত এলাকা থেকে মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা বিতাড়িত ২০০১-এর সেপ্টেম্বর থেকে। কারেন রাজ্যের এসব এলাকায় সেনা স্থাপনা নির্মাণের জন্য মুখ্যত ব্ল্যাক কারেনদের গ্রামগুলোই বেছে নেয়া হয়।

মিয়ানমারজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বহুমুখী নিপীড়নের শিকার মুসলমানের প্রকৃত সংখ্যার নির্ভরযোগ্য কোনো শুমারি নেই। ২০১৪ সালে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে শুমারি কার্যক্রমে বাদ রেখেই জনসংখ্যার যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, তাতে দেশটিতে মুসলমান জনসংখ্যা ১১ লাখ ৪৭ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়। এই সংখ্যাকে অনেকে ‘বাস্তবতার থেকে কম’ বলেই মনে করেন। তবে এ থেকে অনুমান করা যায়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ছাড়া অন্যান্য মুসলমান জনগোষ্ঠী প্রায় ১০ লাখের ওপরে। দশকের পর দশক এদের বিড়ম্বিত জীবনকাহিনী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘উন্নয়ন সংবাদ’গুলোর আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব রোহিঙ্গাদের সংকটের কথা যতটা জানে, ততটা জানে না পানথে, জারবেদি ও ব্ল্যাক কারেনদের কথা। এমনকি বাংলাদেশেও বার্মার রোহিঙ্গা ব্যতীত অন্যান্য মুসলমানদের খবরাখবর কম।

মিয়ানমারের মুসলমান সম্প্রদায়গুলোর আরেক সমস্যা হলো, তারা পরস্পর থেকে সামাজিক ও সাংগঠনিকভাবে বিচ্ছিন্ন। তাদের কোনো একক সংগঠন নেই। তাদের সবার অবস্থানও নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় সীমাবদ্ধ নয়। ফলে মূল জাতিগোষ্ঠী বামারদের সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদের সামনে তারা কার্যত অতীতের সাজানো জীবনযাপন থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ছে। বর্তমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাছে তাই বার্মার সকল মুসলমান জাতিসত্তার প্রত্যাশা হলো নতুন এমন এক সরকার আসুক- যারা মুসলমান-বিদ্বেষ পরিহার করবে।

– আলতাফ পারভেজ, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।