।। মাওলানা সাঈদ আহমদ ।।
আল্লাহ তাআলা তাঁর চিরন্তন ধারা অনুযায়ী এক স্থানকে অন্য স্থানের উপর, নির্দিষ্ট সময়কে অন্য সময়ের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ত্ব্য দান করেছেন। মাহে রমযান সকল মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সুমহান। জুমার দিন অন্য দিনের তুলনায় মর্যাদাবান। অন্যান্য স্থানের উপর মক্কা-মদীনার অধিক সম্মান। অনুরূপ শবে কদরের পরে অন্যান্য রজনীর চেয়ে শবে বরাতের স্থান। কিন্তু ইদানিং শবে-বরাত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কেউ এর গুরুত্ব বর্ণনা করছেন। আবার কেউ এর অস্তিত্বকেই পুরোদমে অস্বীকার করছেন। আবার কেউ আমলের নামে এমন সব কাজও করছেন, যা কুরআন-হাদীসের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়।
এতদিন পর্যন্ত শবে বরাতকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির মানুষ বাড়াবাড়িতে লিপ্ত ছিল। তারা এ রাতটি উপলক্ষে নানা অনুচিত কাজকর্ম এবং রসম-রেওয়াজের অনুগামী হচ্ছিল। উলামায়ে কেরাম সবসময়ই এসবের প্রতিবাদ করেছেন এবং এখনও করছেন। ইদানিং আবার এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছাড়াছাড়ির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাদের দাবি হলো, ‘ইসলামে শবে বরাতের কোন ধারণা নেই। এ ব্যাপারে যত বর্ণনা আছে সব জাল বা দুর্বল’। তারা এসব বক্তব্যসম্বলিত ছোট ছোট পুস্তিকা ও লিফলেট তৈরি করে মানুষের মধ্যে বিলি করছে। বাস্তব কথা হলো, আগেকার সেই বাড়াবাড়ির পথটিও যেমন সঠিক ছিল না, এখনকার এই ছাড়াছাড়ির মতটিও শুদ্ধ নয়। কেননা, শরীয়তে ছাড়াছাড়ির যেমন অবকাশ নেই, তেমনি বাড়াবাড়িরও কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। ইসলাম ভারসাম্যতার দ্বীন এবং এর সকল শিক্ষাই প্রান্তিকতা মুক্ত সরল পথের নির্দেশনা দেয়। কাজেই কুরআন-সুন্নাহর সঠিক বুঝের অভাবে কেউ যেন কোন আমল ছেড়ে না দেন কিংবা আমলের নামে বিদআতে লিপ্ত না হন, সেদিকে খেয়াল রাখাও জরুরি। কারণ, আল্লাহ পাক আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। তাই ইবাদতে যাতে কম না হয় কিংবা ইবাদতে যাতে শরীয়ত বিরোধী কিছু না হয় এজন্য আমাদেরকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
শবে বরাতের ব্যাপারে সঠিক ও ভারসাম্যতাপূর্ণ অবস্থান হলো, এ রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোন রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদযাপনের বিশেষ কোন পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মতো মনে করা এবং এ রাতের ফযীলতের ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে তার সবগুলো ‘জাল বা দুর্বল’ মনে করা যেমন ভুল, তেমনি এ রাতকে শবে কদরের মতো বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করাও ভিত্তিহীন ধারণা।
শবে বরাতের প্রামাণ্যতা
মুসলিম উম্মাহর মাঝে এ রাতটির গুরুত্ব ও মহত্ত্ব না আজকের, না বছর কয়েক পূর্বের। বরং ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে যুগ যুগ ধরেই এর ধারা চলে আসছে। এ রাতের ফযীলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে দশজন সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণিত, যা সমষ্টিগত দিক থেকে সন্দেহাতীতভাবে সহীহ এর মানে উন্নীত। মুহাদ্দিসীনে কেরাম স্বীয় হাদীসগ্রন্থসমূহে বিভিন্ন শিরোনামে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। তাদের কেউ কেউ এগুলো থেকে প্রমাণও গ্রহণ করেছেন। ফুকাহাগণ এ বিষয়ে ফিকহের কিতাবসমূহে মুবাহ-মুস্তাহাবের বর্ণনা দিয়েছেন। শবে বরাতের ফযীলতকে ভিত্তিহীন বলা অজ্ঞতা বা ভ্রষ্টতা ছাড়া কিছুই নয়। নিম্নে এ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা হলো।
হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাযি.) বর্ণনা করেন, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন-
يَطْلُعُ اللهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ
আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে (শবে বরাতে) সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে মাফ করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হা. ৫৬৬৫)।
অন্য হাদীসে আয়েশা (রাযি.) বলেন-
فَقَدْتُ رَسُولَ اللهِ لَيْلَةً فَخَرَجْتُ، فَإِذَا هُوَ بِالبَقِيعِ، فَقَالَ: أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ؟ قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ! إِنِّي ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ، فَقَالَ: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، فَيَغْفِرُ لأَكْثَرَمِنْ عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ
এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বিছানায় না পেয়ে খুঁজতে বের হয়ে জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে তাঁকে পেলাম। তখন রাসূল (সা.) ইরশাদ করলেন- আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং কাল্ব গোত্রের ছাগলসমূহের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক গুনাহগারকে ক্ষমা করে দেন। (মুসনাদে আহমদ ২৬০১৮ ও তিরমিযী ৭৩৯)।
সূত্রদ্বয়ে যদিও বিচ্ছিন্নতার কারণে স্বল্প দুর্বলতা রয়েছে, তবে হাদীসটির মূল বক্তব্য সম্বলিত আরো আটজন সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণনা পাওয়া যায়। তাঁরা হলেনÑ হযরত আবু বকর, আবু সা’লাবা, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর, আবু মুসা আশআরী, আবু হুরায়রা, আউফ ইবনে মালিক, উসমান ইবনে আবীল-আস ও আবু দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহুম প্রমূখ। (প্রথম থেকে অষ্টম পর্যন্ত হাদীসসমূহ জানতে দেখুন- শায়খ আলবানীর “সিলসিলাতুল আহাদীসিস-সহীহা” ৩/১৩৫-১৩৮ হা. ১১৪৪। নবম ও দশম হাদীস রয়েছে “শুয়াবুল ঈমান” হা. ৩৫৫৫ ও “আহাদীসুল জামায়ীলী” নামক গ্রন্থে হা. ৩৭)।
শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রাহ., মৃত ৭২৮ হি.) বলেন, অর্ধ শাবানের রাতের ফযীলত সম্পর্কে বেশ কিছু মারফু’ হাদীস ও আছার বর্ণিত হয়েছে। যার দাবি হচ্ছে, এটি একটি ফযীলতপূর্ণ রাত। পূর্ববর্তীদের কেউ কেউ এ রাতে নামায আদায় করতেন। অতঃপর তিনি যারা ‘উক্ত হাদীসসমূহকে গ্রহণযোগ্য নয় এবং এ রাত ও অন্য রাতের মাঝে কোন ফরক নেই বলেছেন’ এর খ-ন করে বলেনÑ অনেক আলেম, বরং অধিকাংশই এ রাত ফযীলতপূর্ণ হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। কেননা, এ রাত সম্পর্কীয় হাদীসসমূহ একাধিক সূত্রে বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে। (ইকতিযাউস সীরাতিল মুস্তাকীম পৃ. ২৫৮)।
শবে বরাতের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিভ্রান্তি
কেউ কেউ উপর্যুক্ত হাদীসসমূহ মেনে নেন, তবে ভিন্ন আঙ্গিকে শবে বরাতের ফযীলতকে অস্বীকারের অপপ্রয়াস চালান। আর তা এভাবে যে, এ রাতের ফযীলত অন্যান্য রাতের চেয়ে ব্যতিক্রম নয়। কেননা, এ রাতে যেভাবে আল্লাহ পাক নিচের আসমানে আসেন এবং বহু সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করেন, তেমনিভাবে প্রতি রাতের শেষভাগেও তিনি দুনিয়ার আসমানে এসে অনেক বান্দাকে ক্ষমা করেন, যা বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ হাদীসে এসেছে। কাজেই এ রাতকে বছরের অন্যান্য রাত থেকে বিশেষভাবে ফযীলতপূর্ণ মনে করার কোন যৌক্তিকতা নেই!
এ প্রসঙ্গে সঠিক কথা হলো, যদিও অগভীর চিন্তার কারণে বাহ্যিকভাবে মনে হয় এ রাত এবং বছরের অন্য রাতের মাঝে তেমন কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু হাদীস বিশারদদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে এ রাতের আরো বৈশিষ্ট্য জানা যায়। যেমন হাফেজ ইরাকী (রাহ. মৃ. ৮০৬ হি.) বলেন, বছরের প্রতি রাতে আল্লাহ পাক অবতরণ করলেও ভিন্ন দু’টি কারণে অর্ধ শাবানের রাতটি অন্যান্য রাত থেকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এক. অধিক সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, যা অন্যান্য রাতে হয় না। দুই. এ রাতে সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে অবতরণ করেন, যা অন্যান্য রাতে রাত্রির শেষাংশে বা তৃতীয়াংশে হয়। (ফয়যুল কাদীর, মুনাবী ২/৩১৭)।
এভাবে মোল্লা আলী কারী (রাহ., মৃত ১০১৪ হি.) বলেন, হাদীসের ভাষ্য থেকে এ কথা প্রকাশ পায় যে, এ রাতে আল্লাহ পাক নিচের আসমানে অবতীর্ণ হওয়াটা অন্যান্য রাত থেকে ভিন্ন। কেননা, অন্যান্য রাতে অবতীর্ণ হওয়াটা রাতের তৃতীয়াংশে হয়। আর এখানে পুরো রাত জুড়েই হয়। ফলে এর মাধ্যমে রাতটি অন্যান্য রাত থেকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৩/৩৭৫)।
শবে বরাতের আমল ও করণীয়
হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেনÑ হে আয়েশা অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা! তোমরা কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম- না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি ইনতিকাল করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম- আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন ইরশাদ করলেন- “এটা হলো শবে বরাত। আল্লাহ তাআলা এ রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থনাকারীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।” (শু’আবুল ঈমান ৩৫৫৪, হাদীসটি আমলযোগ্য)।
এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সেজদাও দীর্ঘ হবে শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য। তবে মনে রাখতে হবে যে, কতিপয় অনির্ভরযোগ্য ওযীফা বা বই-পুস্তকে ‘শবে বরাতের নামায’ এর নামে যে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন লেখা আছে। অর্থাৎ বার কিংবা ষোল রাকআত অথবা এত রাকআত হতে হবে, প্রতি রাকআতে সূরা ইখলাস বা এই এই সূরা এতবার পড়তে হবে এগুলো ঠিক নয়, হাদীস শরীফে এসব নেই; এ সংক্রান্ত যে সমস্ত বর্ণনা রয়েছে, সেগুলোকে মুহাদ্দিসগণ জাল ও বানোয়াট বলেছেন। কাজেই এগুলো মানুষের মনগড়া পন্থা। সঠিক পদ্ধতি হলো, নফল নামাযের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দুই রাকআত করে যত রাকআত সম্ভব হয় এবং যেই সূরা দিয়ে সম্ভব হয় পড়তে থাকা।
চার মাযহাবের একাধিক গ্রন্থসমূহে রয়েছে, শবে বরাতে রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত করা মুস্তাহাব। এমনকি আহলে হাদীস আলেম শাইখ ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরীও বলেনÑ শবে বরাতে আল্লাহ পাকের যিকির-ফিকির ও দু’আ-ইবাদতে লিপ্ত থেকে রাত্রি জাগরণ করা মুস্তাহাব। (মিরআতুল মাফাতীহ, ৪/৩৪২)।
আর রাত্রি জাগরণের অর্থ হলো, রাতের অধিকাংশ সময়ে, কারো কারো মতে- কিছু অংশে কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা ব্যতীত একাকী নফল নামায আদায় করা, কুরআন-হাদীস তিলাওয়াত করা বা শোনা, তাসবীহ পাঠ করা এবং নবীজি (সা.)এর উপর দরূদ ও সালাম পেশ করা। (ফাতাওয়ায়ে শামী, ২/৪৬৯)।
এ রাতের নফল আমলসমূহ সম্মিলিত নয়, ব্যক্তিগত
এ রাতের নফল আমলসমূহ বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। ফরয় নামায তো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোন প্রমাণ হাদীস শরীফেও নেই। আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। তবে কোন আহ্বান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিতেই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায়, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবে, একে অন্যের আমলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হবে না। কোন কোন জায়গায় এই রেওয়াজ আছে যে, এ রাতে মাগরিব বা ইশার পর থেকেই ওয়াজ-নসীহত আরম্ভ হয়। আবার কোথাও ওয়াজের পর মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান হয়। কোথাও তো সারা রাত ‘খতমে-শবীনা’ হতে থাকে। তাছাড়া এসব কিছুই করা হয় মাইকে এবং বাইরের মাইকও ছেড়ে দেয়া হয়। মনে রাখতে হবে, এসব কিছুই ভুল রেওয়াজ। শবে বরাতের ফাযায়েল ও মাসায়েল আগেই আলোচনা করা যায়। এ রাতে মাইক ছেড়ে দিয়ে বক্তৃতা-ওয়াজের আয়োজন করা ঠিক নয়। এতে না ইবাদতে আগ্রহী মানুষের পক্ষে ঘরে বসে একাগ্রতার সাথে ইবাদত করা সম্ভব হয়, আর না মসজিদে। অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় আরামেরও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। আল্লাহ তাআলা আমাদের এইসব ভুল কাজকর্ম পরিহার করার তাওফীক দিন।
এ রাতেও যারা হতভাগা
শবে বরাতে আল্লাহ পাকের রহমত ও মাগফিরাতের দ্বার ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত হয়। ফলে সর্বস্তরের মুসলমান ক্ষমাপ্রাপ্ত হন। কিন্তু কয়েক শ্রেণির হতভাগা এমন রয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ পাক রহমতপূর্ণ রজনীতেও ক্ষমা করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজ কৃতকর্ম থেকে খালেস নিয়তে তাওবা করে ফিরে আসবে। তন্মধ্যে মুশরিক, হিংসুক, খুনি ও ব্যভিচারিনী সর্বাগ্রে। আরো দু’টি বর্ণনায় আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, টাখনুর নীচে পায়জামা-প্যান্ট, বা লুঙ্গি পরিধানকারী, মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান, মদ পানকারী, যাদু-টোনার পেশাগ্রহণকারী, গনক ও বাদ্য-বাজনাকারীর কথাও এসেছে। সুতরাং মুসলমানদের জন্য জরুরি ওই সমস্ত গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, যা শবে বরাতের মতো ফযীলতপূর্ণ রাতে ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া থেকে এবং দু’আ কবুল হওয়া থেকে বঞ্চিত রাখে। আর কেউ যদি উল্লিখিত গুনাহসমূহের সাথে জড়িত থাকে, তাহলে এ রাতের পূর্বেই ইখলাসের সাথে তাওবা করে নিবে।
শবে বরাতে কবর যিয়ারত
আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ হয়েছে যে, রাসূল (সা.) এ রাতে ‘জান্নাতুল বাকী’ নামক কবরস্থানে তাশরীফ নিয়ে গেছেন। আর এটি ছিল তাঁর হুজরা মুবারকের নিকটবর্তী। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, মুসলমানদের জন্য এ রাতের আরেকটি আমল হলো- প্রত্যেকে নিজ নিজ নিকটবর্তী কবরস্থানে গিয়ে যিয়ারত করা এবং কবরবাসীদের জন্য দু’আ করা। মুফতী শফী সাহেব (রাহ., মৃত ১৩৯৬ হি.) বলেন, “প্রতি শবে বরাতে নিয়মিত কবরস্থানে যাওয়া সুন্নাত নয়, যদিও তা জায়েয। তবে মাঝে মাঝে যাওয়া সুন্নাত। কেননা, হাদীসের সুবিশাল ভাণ্ডার থেকে তাঁর জীবনে এ রাতে একবারই কবরস্থানে যাওয়া প্রমাণিত। এটাকে সর্বদা করেছেন এমন কোন প্রমাণ নেই। এভাবে সাহাবায়ে কেরাম থেকেও এটাকে সব সময় করারও প্রমাণ পাওয়া যায় না।” (আকাবিরে দেওবন্দ কেয়া থে? তকী ওসমানী পৃ. ১৫-১৬) সুতরাং প্রত্যেক শবে বরাতে কবর যিয়ারত সুন্নাত নয়, বরং কখনো যাবে কখনো এ থেকে বিরত থাকবে। এভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ নিকটবর্তী কবরস্থানে যাবে, দূরবর্তী কোন স্থান বা কোন মাযারে যাবে না। একাকী যাবে, দলবদ্ধভাবে নয়। কেননা, রাসূল (সা.) জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে একাকী গিয়েছিলেন। অথচ সে রাতে তাঁর পাশে শায়িত হযরত আয়েশা (রাযি.) পর্যন্ত এ খবর জানতে পারেননি। আর উক্ত কবরস্থান ছিল হুজরা মুবারকের নিকটবর্তী।
শবে বরাত ও শাবান মাসের রোযা
এখানে দু’টি বিষয়। একটি হচ্ছে শবে বরাতের পরের দিন রোযা রাখা। আরেকটি হলো শাবান মাসে রোযা রাখা। দ্বিতীয় বিষয় সম্পর্কে সহীহ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়, শাবান মাসে বেশি বেশি রোযা রাখা চাই এবং শাবানের ২৮-৩০ তারিখ ব্যতীত যে কোন দিন রোযা রাখা উত্তম। আর প্রথম বিষয় তথা শবে বরাতের পরের দিন রোযা রাখা সম্পর্কে হযরত আলী (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন- শবে বরাত আগত হলে, তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও। আর পরের দিন রোযা রাখো। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হন এবং বলেন- কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দিব। কে আছো মুসিবতগ্রস্ত? আমি তাকে মুসিবত থেকে মুক্তি দিব। এভাবে সকাল পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদেরকে ডাকতে থাকেন। (ইবনে মাজা ১৩৮৮, বর্ণনাটির সূত্র দুর্বল)।
এ হাদীস থেকে প্রমাণ গ্রহণ করে অনেকে বলেছেন, শবে বরাতের পরের দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। আবার কেউ কেউ এই একটিমাত্র দুর্বল হাদীসের দিকে তাকিয়ে মুস্তাহাব বলা অনুচিত বলেছেন। তবে হ্যাঁ, ১ লা শাবান থেকে ২৭ শাবান পর্যন্ত রোযা রাখার যথেষ্ট ফযীলত রয়েছে। তাই ২৭ শাবান পর্যন্ত প্রতিদিনের রোযাই অত্যন্ত বরকতপূর্ণ। তাছাড়া শাবানের ১৫ তারিখটি ‘আইয়্যামে বীযের’ অন্তর্ভুক্ত। আর ‘আইয়্যামে বীয’ তথা প্রতি আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোযা রাখা মুস্তাহাব। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি এই দু’টি বিষয়কে সামনে রেখে (অর্থাৎ এটা শাবান মাসের একটি দিন এবং এই ১৫ তারিখ আইয়্যামে বীযেরও অন্তর্ভুক্ত)। ১৫ ই শাবান রোযা রাখে, তাহলে ইনশাআল্লাহ সাওয়াবের অধিকারী হবে। (সবিস্তারে জানতে দেখুন, অধমের লিখিত ‘বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত’ রেসালাটি)।
উল্লেখ্য, শবে বরাতের ব্যাপারে সঠিক ও ভারসাম্যতাপূর্ণ অবস্থান হলো এটুকুই, যা এ পর্যন্ত আলোচনা করা হয়েছে। আর লোক মুখে প্রসিদ্ধ “এ রাতে পুরো বছরের মানুষের হায়াত-মউত ও রিযিক তথা বার্ষিক বাজেটের ফায়সালা হয়।” সম্পর্কে যে বর্ণনাটি রয়েছে, তা নিতান্তই দুর্বল। এছাড়া কিছু ভ্রান্ত আকীদা যেমন “এ রাতে মৃত ব্যক্তি ঘরে আগমন করে” ইত্যাদি অনেকে পোষণ করে থাকেন। এর কোন ভিত্তিই শরীয়তে নেই।
শবে বরাতে বিদআত ও কুসংস্কার
শবে বরাতের শুভমুহূর্তে যখন আল্লাহর রহমতের বারিধারা বর্ষণ হতে থাকে, পাপীষ্ট বান্দাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা হয়ে থাকে এমন মুহূর্তেও বনি আদমকে আল্লাহর ইবাদত থেকে বিমুখ এবং আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত করার জন্য শয়তানের চেষ্টা-সাধনার অন্ত থাকে না। আর তাই সে মানুষকে শবে বরাতের মতো বরকতময় রাতেও আতশবাজি পোড়ানো, হালুয়া-রুটি বা রুটি-গোস্তের বিশেষ আয়োজন, ঘরে বা মসজিদসমূহে প্রয়োজনাতিরিক্ত আলোকসজ্জা, গোরস্থানে বা মাযারে মেলা ও উৎসব, মাইক দ্বারা খতমে শবীনা বা আমলের নামে শরীয়তের নির্ধারিত পথ ও পন্থার বিপরীত ইবাদত করা যেমন ইবাদতের জন্য বিশেষ কোন পন্থা উদ্ভাবন করা বা দলবদ্ধতার সাথে ইবাদত করা এবং রাতটি উদযাপনের জন্য মসজিদে মসজিদে বা বিভিন্ন মাযারে সমবেত হওয়া ইত্যাদি যাবতীয় বিদআত ও কুসংস্কারে মশগুল করে দেয়। যাতে এ রাতে রহমতের পরিবর্তে আযাবই তার ভাগ্যে জোটে। অতএব শয়তানের এসব চক্রান্ত থেকে সতর্ক থাকা একান্ত প্রয়োজন। কেননা, এ সবই বিদআত ও নাজায়েয। (আল-বাহরুর রায়েক ২/৫৬, ৫/৩৩২; আল-ইবদা’ ২৬৭; মা ছাবাতা বিস-সুন্নাহ ২১৪)।
আল্লাহ পাক শবে বরাত বিষয়ে বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ির পথ ছেড়ে সঠিক আকীদা পোষণ ও আমল পালনের তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখক: ইসলামী গবেষক, গ্রন্থকার ও উস্তাদ- দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/