বিশ্বে শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)

।। খন্দকার মনসুর আহমদ ।।

পৃথিবী তখন অশান্তির চরম দুঃসময় পার করছিলো। অধীর প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছিল একজন মুক্তিকামী মহামানবের জন্য। যিনি অশান্ত পৃথিবীকে বদলে দিয়ে মানবতাসমৃদ্ধ শান্তিময় একটি নতুন পৃথিবী গড়ে তুলবেন। তখন শান্তি ও মুক্তির চিরন্তন সওগাত নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর আগমনে পৃথিবী প্রাণ ফিরে পায় এবং মানবতার নব জাগরণ ঘটে। সৃষ্টি হয় এক কালজয়ী ইতিহাস।

হযরত (সা.)এর সংগ্রামী জীবনের প্রথম ধাপ থেকেই লক্ষ করা যাক। তিনি তখন কেবল কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছেন। তদানীন্তন আরবের অশান্তি ও নৈরাজ্য তখনই তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি সমমনাদের নিয়ে গঠন করেন ‘হিলফুল ফুযুল’। পরস্পর প্রতিজ্ঞা নেনÑ ‘আমরা দুর্বলের প্রতি সবলের যুলুম প্রতিরোধ করবো, দেশের অশান্তি দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাবো, দরিদ্র ও অসহায় লোকদের সাহায্য করতে আমরা কখনও কুণ্ঠিত হবো না’।

তখন থেকেই শুরু হয় ইসলাম ও শান্তি-প্রতিষ্ঠার পথে হযরতের গৌরবদীপ্ত অভিযাত্রা। যতই সামনে অগ্রসর হন ততই বেড়ে যায় তাঁর দায়িত্বের পরিধি। সময়ের ব্যবধানে স্কন্ধে অর্পিত হলো নবুওয়াতের মহান দায়িত্ব। তারপর ওহীর আলোকে শুরু হলো নতুন দাওয়াত, নতুন পথচলা। জানা কথা- শান্তিময় সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী গড়ে তুলতে হলে আগে মানবতার ব্যক্তিজীবনে ঈমান ও নৈতিকতার বিকাশ ঘটাতে হবে। কারণ, ব্যক্তিজীবনের পরিশুদ্ধিই পর্যায়ক্রমে সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে শান্তির ভিত রচনা করে। প্রিয়নবী (সা.) তাই সে পথেই অগ্রসর হলেন। মানুষকে এক আল্লাহর একত্ববাদের মাধ্যমে বিশ^ভ্রাতৃত্বের বার্তা দিলেন। হত্যা-প্রতিহত্যা, কলহ-বিবাদ, মিথ্যা-অনাচার, অন্যায়-ব্যভিচার, হিংসা-বিদ্বেষসহ যাবতীয় পাপকর্মের পরিণতি জানিয়ে পরিশোধিত শুভ্র জীবনের দিকে আহ্বান জানালেন।

কিন্তু মক্কার বর্বর মানুষগুলো শান্তি ও মুক্তির এই মহাপয়গাম মেনে নিতে পারলো না। রহমাতুল্লিল আলামীনের শান্তিবিপ্লব তাই মক্কার জীবনে প্রবল বাধার সম্মুখীন হলো। এরপর দ্বীন ও ঈমানের বৃহত্তর কর্মসূচি নিয়ে মহানবী (সা.) তাঁর নিবেদিতপ্রাণ সাহাবীদের নিয়ে মদীনায় হিজরত করলেন। ইসলামের শান্তিময় জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ব্যাপক কর্মসূচি নিয়ে মদীনায় গড়ে তুললেন মানবেতিহাসের সর্বোত্তম কল্যাণরাষ্ট্র, আর এখান থেকেই মহানবী (সা.)এর শান্তি ও দীন প্রতিষ্ঠার পরিম-ল বিস্তৃত হলো। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে গেলো সত্য ও সুন্দরের সংগ্রাম।

এ সময় মহানবী (সা.) ভাবলেন যে, আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামের কল্যাণময়তা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রমাণ করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে মদীনার সার্বিক পরিস্থিতি শান্ত হওয়া প্রয়োজন। আবার ইসলামও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের মুসলমান, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের নিয়ে সর্বজাতীয় সভা আহ্বান করেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মানবিক ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে সকল সম্প্রদায়ের মাঝে সংঘটিত হয় একটি আন্তর্জাতিক মানের শান্তি চুক্তি, যা আমাদের নিকট ঐতিহাসিক ‘মদীনা সনদ’ হিসেবে পরিচিত। বাহ্যদৃষ্টে এটি একটি সর্বজাতীয় সাধারণতন্ত্র হলেও এর ভিত্তি ছিলো ইসলামী নীতিমালার ওপর। এরই মধ্য দিয়ে ইসলামের ব্যাপক ও আন্তর্জাতিক কল্যাণময়তার রূপায়ণ ঘটেছে। তাই এ সনদ পরোক্ষভাবে ইসলামেরই বিকাশের পথ উন্মুক্ত করেছে।

মদীনার সনদ মদীনার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনে। মহানবী (সা.)এর মহান নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের নৈরাজ্য ও সংঘাতের অবসান ঘটে। যে সম্প্রদায়গুলো পরস্পরে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিলো, তারা শান্তিময় নিরাপদ জীবনযাপনের সুযোগ লাভ করে। মদীনার শক্তিশালী যুদ্ধপ্রিয় গোত্রগুলোর মাঝে সংঘাতের পরিবর্তে গড়ে ওঠে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মনোভাব। এভাবে মহানবী (সা.) বিশ^শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান ব্রতে ক্রমেই এগিয়ে যান।

মহানবী (সা.) মদীনায় প্রতিষ্ঠিত সে সফল কল্যাণরাষ্ট্রের মাধ্যমে মানবতার সার্বিক শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে ইসলামের আন্তর্জাতিক উপযোগিতা, কল্যাণময়তা ও শান্তিময়তার কথা সুস্পষ্টভাবে বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার অবিরাম সংগ্রামে অনন্যোপায় হয়ে বিদ্বেষী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের পথ বেছে নিতে হয়েছে কখনও কখনও। রাহমাতুল্লিল আলামীন (সা.) যদিও অনর্থ যুদ্ধ ও রক্তারক্তি পছন্দ করতেন না, কিন্তু মানবদেহের কোনো অঙ্গে পচন ধরলে যেমন পুরো দেহ রক্ষার্থে অঙ্গটি কেটে ফেলা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনিভাবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার পথে যেসব অপশক্তি বাঁধ সেজেছিলো, মহান আল্লাহর নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধারণে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর এসকল যুদ্ধ কতোটা উদারতা আর দয়াম-িত ছিলো তা তাঁর যুদ্ধনীতি ও সার্বিক সমরপরিস্থিতির দিকে তাকালেই অনুধাবন করে নেয়া যায়। মহানবী (সা.) তাঁর যুদ্ধনীতি ঘোষণা করলেন, ‘কখনও আক্রমণের আকাক্সক্ষা পোষণ করো না, নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর শরণাপন্ন হও। আর যখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ো তখন ধৈর্য ধারণ করো।’ (বুখারী শরীফ, হাদীস নং- ২৮০৪)।

তিনি আরো ঘোষণা দেন, ‘কোনো শত্রুকে আগুন দিয়ে মারা যাবে না।’ নারী ও শিশুদের আঘাত করতেও বারণ করেন তিনি। মহানবী (সা.) ফলদার বৃক্ষ কাটতে এবং পরাজিতদের সম্পত্তি নষ্ট করতেও বারণ করেছেন। এমনিভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের কেউ নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিলে তাকে হত্যা করাও নিষিদ্ধ ছিল। একবার এক যুদ্ধে প্রতিপক্ষের এক ব্যক্তি নিজেকে মুসলমান পরিচয় দেয়ার পরও তাকে হত্যা করা হলে মহানবী (সা.) শাসিয়ে দিয়েছিলেন হত্যাকারীকে। বলেছিলেন- ‘তোমরা তার অন্তর চিরে দেখে নিলে না কেন?’ (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ২৮৭)। অর্থাৎ- তার অন্তরে ঈমান আছে কিনা তা তোমরা কী করে বুঝলে?

মহানবী (সা.) সামরিক জীবনে কতোটা শান্তিকামী ছিলেন- এ সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকেই তা মোটামুটি অনুমান করা যায়।

বিভিন্ন সময়ে শত্রুদের সাথে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শান্তিকামিতার আরেকটি উজ্জ্বল প্রমাণ। প্রতিপক্ষ সন্ধি ও আপোসের প্রস্তাব দিলে তিনি যুদ্ধের পথে অগ্রসর হতেন না। এক্ষেত্রেও প্রিয়নবীর নীতিতে কুরআনী বিধানের সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখা দেয়। পবিত্র কুরআন ঘোষণা করছে, ‘আর যদি তারা সন্ধি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে তুমিও সে দিকে আগ্রহী হও এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করো। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা’। (সূরা আনফাল- ৬১)।

আর এসকল সন্ধির অঙ্গীকারগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন মহানবী (সা.)। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর আবু জান্দাল ইসলাম গ্রহণ করে শৃঙ্খলিত অবস্থায় নবীজীর কাছে হাজির হলে উপস্থিত সকল সাহাবায়ে কেরামের চোখেমুখে এক করুণ অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিলো। আবু জন্দলও তাঁর প্রতি কাফিরদের উৎপীড়নের কথা বলে কেঁদে কেঁদে মুসলমানদের সাথে মদীনায় যাওয়ার জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মহানবী (সা.) সন্ধির অঙ্গীকার রক্ষার্থে তাঁকে সাথে নেননি; ধৈর্যধারণের উপদেশ দিয়ে তিনি তাঁকে মক্কাতেই রেখে যান।

বিশ্ব-শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান দিশারী মহানবী (সা.) প্রথমে আরব ভূখণ্ডে মানবতার সামগ্রিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গোটা বিশ্বের কাছে ইসলামের একটা শান্তিময় রূপরেখা তুলে ধরেন। মূলত এটা ছিলো গোটা বিশ্বের প্রতি ইসলামের কার্যত দাওয়াত। ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীতে সত্য ও শান্তির সে প্রদীপ্ত পয়গাম ছড়িয়ে দিতে তিনি তদানীন্তন বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়কদেরকেও দূত পাঠিয়ে পত্রযোগে ইসলামের দাওয়াত দেন। চীন, আবিসিনিয়া, রোম, পারস্য ও মিসর ইত্যাদি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কদের প্রতি তিনি পত্র প্রেরণ করেন। তাঁদের অনেকেই ধীরে ধীরে ইসলামের দাওয়াত কবুল করেন । এভাবে রাশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার দিকে দিকে শান্তির পয়গাম ছড়িয়ে দিলেন মুক্তির নবী। তাঁর সে আহ্বানে তিনটি মহাদেশেই এক অপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হলো।

আরও পড়তে পারেন-

৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদায়বিয়ার সন্ধির ঘটনা ঘটে। তারপর অষ্টম হিজরীতে যখন মক্কার কুরাইশগণ হুদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে মুসলমানদের সাথে মিত্রতা রক্ষাকারী একটি গোত্রের ওপর হামলা করে তখন মহানবী (সা.) মক্কা-জয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। কিন্তু সে সময় রণ-প্রস্তুতির সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করেন এই ভেবে যে, অভিযানের সংবাদ মক্কাবাসী জানতে পারলে নিশ্চয় তারাও বিপুল সমরায়োজন করবে। আর এতে একটা তুমুল হত্যাযজ্ঞ ও রক্তারক্তি ঘটবে। কুরাইশগণ এতে নির্মূল হয়ে যাবে, কিন্তু শান্তির নবী রণপ্রান্তে দাঁড়িয়েও তো সে ধ্বংসমূলক বিজয় চাননি। বরং তিনি মায়া-মমতা আর প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে অনায়াসে জয় করে নিতে চেয়েছিলেন মক্কা আর মক্কার হৃদয়গুলোকে। আর এ জন্যই তিনি তাদের রণপ্রস্তুতির কোনো সুযোগই দেননি।

এরপর তো মক্কা বিজিত হলো। মক্কাবাসী ভাবলো ‘আজ আর কারোর রক্ষা নেই। যাঁর প্রতি এতদিন আমরা সীমাহীন অত্যাচার করেছি, আজ এ মহাবিজয়ের মহাক্ষণে তিনি আর আমাদের কিছুতেই রেহাই দিবেন না।’ কিন্তু রাহমাতুল্লিল আলামীন শান্তির নবী সে দিনও মক্কায় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। নিরাপত্তা দিলেন সুদীর্ঘ দুই দশক ধরে জ্বালাতনকারী মানুষগুলোকে। বিশ্ববিবেক এখানে স্তম্ভিত বিমূঢ়। এও কি কোনো মানুষের দ্বারা সম্ভব? মানুষের আত্মা কী করে এতো বিশাল হয়? মনুষ্য বিবেক যা কল্পনা করতে পারে না, প্রিয়নবী (সা.) তাই করলেন। বিশ্ব ইতিহাসে যার কোনো নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। আবহমানকাল ধরেই যুদ্ধ চলে আসছে এই পৃথিবীতে, যুদ্ধ চলছে আজও এবং চলতে থাকবে। কিন্তু এর মাঝেও যে মানবিক চেতনার প্রতিফলন ঘটতে পারে এবং মানবিকতার পথ উন্মুক্ত হতে পারে মহানবী (সা.) মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে সে সবক দিয়ে গেলেন গোটা মানবজাতিকে। একবিংশ শতকের পৃথিবীতে বিশে^র মানুষ আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে বিগত ১৫ই আগষ্ট মহানবী (সা.)এর সে অসাধারণ উদারতার আদশের্র একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত দেখতে পেয়েছে।

ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জের ভাষণেও ধ্বনিত হয়েছিল শান্তির মহা আহ্বান। সে আহ্বান ছিল আঁধার যুগের সকল ধ্যান-ধারণা ভুলে নতুন আলোকে পথ চলার জন্য এবং সর্বপ্রকার হত্যা-প্রতিহত্যার লীলা বন্ধের জন্য। সে আহ্বান মানবতার হৃদয়কে নতুনভাবে নাড়া দিয়েছিলো। নতুন প্রত্যয়ে জেগে উঠেছিলো মানব বিবেক। আর তাতে শান্তি ও মুক্তির সোনালি সরণির সন্ধান পেলো বিশ্ব মানবতা।

বিদায় হজ্জের ভাষণ বিশ্ব মানবেতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ। বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার এবং সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের মূল সনদ হচ্ছে এই ভাষণ। এই ভাষণে মানবতার ইহকালীন ও পরকালীন শান্তি ও মুক্তির যে মহান বার্তা উচ্চারিত হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন তুলনা নেই। বিশ্ব মুসলিমের সমবেত সভায় ইসলামের বিশ্বজনীন বার্তাসমূহ প্রচারের এটাই ছিল সর্বশেষ সুযোগ। তাই এই ভাষণ যে দীর্ঘ ছিল তা সহজেই অনুমেয়। সে কারণেই শ্রোতাবর্গ পূর্ণ ভাষণ আদ্যোপান্ত মনে রাখতে পারেননি। হাদীসের সিহাহ সিত্তাহ ও মুসনাদ গ্রন্থসমূহে সে ভাষণসমূহের বিভিন্ন মূল অংশ বিক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত রয়েছে। আমরা নিম্নে বিশ্ব ইতিহাসের এই স্মরণীয় ভাষণটির মূল কয়েকটি অংশ তুলে ধরার প্রয়াস পাবো। এই ভাষণে মানবতার নবী ইরশাদ করেন- হে মুসলমানগণ! আমার মনে হয়- আমি এবং তোমরা এরপর এই মজলিসে আর কখনও সমবেত হবো না। অন্ধযুগের সমস্ত নিয়ম-পদ্ধতি আমার পদতলে। হে মানবগণ! নিশ্চয় তোমাদের প্রভু এক। তোমাদের পিতা (হযরত আদম) এক। সাবধান! অনারবের ওপর আরবের কিংবা আরবের ওপর অনারবের, কালো মানুষের ওপর লাল মানুষের কিংবা লাল মানুষের ওপর কালো মানুষের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নাই। যার মধ্যে আল্লাহভীতি আছে সে-ই শ্রেষ্ঠ। (শিবলী নু’মানী প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৪)।

প্রত্যেক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সুতরাং সমস্ত মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। (হাকিম আবু আবদিল্লাহ নিশাপুরী, আল-মুসতাদরিক, খ. ১, পৃ. ৯৩)।

তিনি আরও ইরশাদ করেনÑ তোমাদের দাসগণ তোমাদেরই দাস। সুতরাং তোমরা যা খাও তাদেরকে তাই খেতে দাও! তোমরা যেরূপ কাপড় পরিধান কর তাদেরকেও তদ্রূপ কাপড়ই পরিধান করতে দাও। (শিবলী নু’মানী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৫)।

তিনি আরও ইরশাদ করেনÑ অন্ধযুগের সমস্ত খুন অর্থাৎ প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার বাতিল করা হলো। আমি সর্বপ্রথম (আমার নিজ গোত্রের) রবী’আ ইবনে হারেস এর পুত্রের খুন অর্থাৎ তার খুনের প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার বাতিল করলাম। (সহীহ মুসলিম খ. ১, পৃ. ৩৯৭)।

অন্ধ যুগের সমস্ত সুদ বাতিল করা হল। সর্বপ্রথম স্বগোত্রীয় মহাজনের সুদ অর্থাৎ (আমার চাচা) আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ বাতিল করলাম। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯৭)।

নারীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহর ভয় রেখো। নিশ্চয় তোমাদের যেমন নারীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমন নারীদেরও তোমাদের ওপর অধিকার রয়েছে। (ইবনে হিশাম, খ. ২, পৃ. ৬০৪)।

তিনি আরও ইরশাদ করেন- হে মানবগণ! তোমাদের এই পবিত্র শহরে অর্থাৎ মক্কায় বর্তমান যিলহজ্জ মাসের আজকের পবিত্র দিনটি যেমন মর্যাদাপূর্ণ, তেমনিভাবে কেয়ামত পর্যন্ত তোমাদের একের প্রাণ ও ধন-সম্পদ অপরের নিকট এরূপ মর্যাদাপূর্ণ। সুতরাং কেয়ামত পর্যন্ত কারো প্রাণ কিংবা ধন-সম্পদ হানি করা তোমাদের জন্য কঠোর হারাম। (সহীহুল বুখারী, খ. ১, পৃ. ২৩৪)।

আমি তোমাদের নিকট এমন এক বস্তু রেখে যাচ্ছি, যার অনুসরণ করে চললে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর পবিত্র কিতাব আল-কুরআন। (সহীহ মুসলিম, খ. ১, পৃ. ৩৯৭)।

তিনি আরও ইরশাদ করেনÑ হে মানবগণ! আমার পরে আর কোন পয়গাম্বরের আবির্ভাব হবে না। তোমাদের পরও আর কোন উম্মত আসবে না। অর্থাৎ আমি শেষ পয়গাম্বর এবং তোমরা শেষ উম্মত। স্মরণ রেখো, তোমরা আপন প্রভুর ইবাদত করবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে। বৎসরে এক মাস রমযানের রোযা রাখবে। সন্তুষ্ট মনে মালের যাকাত আদায় করবে। আল্লাহর ঘর পবিত্র কা’বা শরীফের হজ্জ করবে। শাসকদের আদেশ মেনে চলবে। তবেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (মা’দানুল আমাল, পৃ. ১১০৮-১১০৯)।

এক পর্যায়ে রাসূল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেন- আল্লাহ তাআলার দরবারে আমার সম্বন্ধে তোমাদের প্রশ্ন করা হলে তোমরা কী উত্তর দিবে? সাহাবায়ে কেরাম জবাব দিলেন, আমরা বলব যে, আপনি আল্লাহর পয়গাম আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এবং আপনার কর্তব্য আপনি সমাধা করেছেন। এই উত্তর শুনে তিনি আকাশের দিকে তিনবার অঙ্গুলি নির্দেশ করে তিনবার বললেন- ‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো’। (সহীহ মুসলিম, খ. ১, পৃ. ৩৯৭)।

সবশেষে তিনি উপস্থিত জনম-লীকে লক্ষ্য করে বললেন-যারা এ সভায় উপস্থিত আছ তারা অনুপস্থিত লোকদেরকে সকল কথা পৌঁছে দিবে’।

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: শাইখুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মদ তফাজ্জল হোসাইন রচিত এবং এ.এইচ.এম মুজতবা হোসাইন কর্তৃক সম্পাদিত গ্রন্থ ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) সমকালীন জীবন ও পরিবেশ’ থেকে)। ভাষণটি গৃহীত ও সংক্ষেপিত]

এভাবে একটি স্বপ্নীল শান্তিময় পৃথিবী গড়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন আল্লাহর রাসূল (সা.)। সেই পথে হাল ধরে প্রতিষ্ঠিত সত্য ও শান্তিকে ধরে রাখতে এগিয়ে এলেন একের পর এক খোলাফায়ে রাশেদীন।

পরবর্তী যুগে বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে এগিয়ে এসেছেন উমর ইবনে আবদুল আযিয (রহ.) প্রমুখ। উমর ইবনে আবদুল আযিযের সোনালি যুগের বেহেশতি শান্তিময়তার কথা উপমহাদেশের প্রখ্যাত মনীষী মাওলানা আযাদের ভাষায় শুনুন-

‘হযরত উমর ইবনে আবদুল আযিয (রহ.) মাত্র আড়াই বছর খলীফা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে মানুষ মনে করেছিলো, আসমান-জমিনের মাঝে যেনো ইনসাফের খোদায়ী দ- প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানুষের খোদা যেনো আসমান হতে হাত বাড়িয়ে সকল শ্রেণির মানুষ ও তার মানবতাকে প্রিয় স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির জয়মুকুট পরাতে এগিয়ে এসেছেন। সুখী মানুষ দান হাতে নিয়ে পথে বের হতেন। কোথাও কোনো গ্রহণকারী পাওয়া যেতো না’।

রাসূল (সা.)এর শিক্ষা ও নীতিমালার পথ ধরে তাঁরা শান্তি ও মুক্তির পথ খুঁজে নেন যুগে যুগে। আজকের বিশ্বেও মহান রাসূলের সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি শক্তি আল্লাহর সাহায্যে বিশ্বের ইসলামবিরোধী সম্মিলিত জোট ও তাদের অনুচরদেরকে পরাজিত করে আফগানিস্তানে একটি খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের সাহসী প্রয়াসে নিবেদিত রয়েছেন। উলামায়ে কেরাম ও মাদ্রাসা ছাত্রদের নেতৃত্বে আজকের আফগানিস্তান ইসলামের শান্তিময় সোনালি শাসনব্যবস্থার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববাসী দেখতে পাবে ইসলামী শাসনের শান্তি, নিরাপত্তা, নীতিপরায়ণতা ও স্বচ্ছতার অসাধারণ একটি উজ্জ্বল রূপ। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ নিরাপত্তা ও শান্তির স্বার্থেই উদ্বুদ্ধ হবে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার প্রতি। আর এ কারণেই মানবাধিকার ও বিশ্বশান্তির স্বঘোষিত মোড়লদের আজ ঘুম হারাম হয়ে গেছে। শান্তি ও মানবাধিকারের নামে দুই দশক ধরে যারা আফগানিস্তানের ওপর বোমা বর্ষণ করে অগণিত নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে, তারা আজও কথিত মানবাধিকার ও নারী অধিকারের নামে দিন রাত নির্লজ্জ চিৎকার করছে।

শেষ কথা, আজও আমাদের সামনে রাহমাতুল লিল আলামীন (সা.)এর আদর্শের অবিকল চিত্র রয়েছে। আজকের অশান্ত বিশ্বে মানবাধিকারসমৃদ্ধ শান্তিময় আবাস গড়ে তুলতে হলে প্রিয়নবী (সা.)এর মহান আদর্শ গ্রহণের বিকল্প কিছু নেই। তাই আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে সে আদর্শের অপরিহার্যতার বিষয়টি আমরা যত দ্রুত উপলব্ধি করবো, আমাদের জীবনেও ততো দ্রুত বয়ে আসবে কাক্সিক্ষত শান্তি, মুক্তি ও সফলতা।

– খন্দকার মনসুর আহমদ, ইসলামী গবেষক ও মুহাদ্দিস- জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালাম, উত্তরা ঢাকা।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।