বোধোদয়ের গল্পঃ পরিবর্তন

বোধোদয়ের গল্পঃ পরিবর্তন

 – স্বাধীন পারভেজ

শুধু আমি একা কেন? আমাদের গ্রামের অতি পরিচিত মুখ রেজাউল করিম ওরফে রাজ এর পূর্বপরিচিত জনদের যে কেউই তাকে এ অবস্থায় দেখলে আমার মতোই অবাক হতো। আমিও ভীষণ আশ্চর্য্য হয়েছিলাম। বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখছিলাম তার পরনের পাঞ্জাবী, ট্রাউজার, মাথার টুপি, আর মুখে কদম ছাঁটের মতো করে ছেঁটে রাখা আধ ইঞ্চি সাইজের দাড়ির দিকে। এ কোন রাজ কে দেখছি আমি? বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে চন্দ্রদিঘী গ্রামের আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের চেয়ে আলাদা পরিচয়েই চিনতাম রাজ কে। তখন অবশ্য রেজাউল নামেই  চিনতাম। পাড়ার পাঁজি ছেলেদের নেতা  ছিলো সে। সারাক্ষণ কোথাও না কোথাও অঘটন ঘটিয়ে বেড়াতো, আর বড়দের হাতে মার খেতো। বয়সে আমার চেয়ে দুই বছরের বড় ছিলো। কিন্তু বেশি বয়সে স্কুলে যাওয়ায় পড়তাম একই ক্লাশে।

প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে বড় আপার সাথে শহরে চলে যাওয়ায় আমরা আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু স্কুলের ছুটিতে গ্রামের বাড়ী গেলেই কোন না কোনভাবে রেজাউলের নাম কানে আসতোই!। কারো গাছের ডাব চুরি, পুকুর থেকে মাছ তুলে পিকনিক করা, ছোট বাচ্চাদের আচমকা কাপড় খুলে নিয়ে মজা করা, এমনকি বয়সে বড়দের গায়ে ঢিল ছুড়ে দৌড়ে পালানোতেও অরুচি ছিলো না তার!। ক্লাশ এইটে ওঠার পর নিজেই নিজের নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলো- ‘রাজ’।

সেই মহা দুষ্টু ছেলেটাকে মাত্র চার পাঁচ বছরের ব্যবধানে শহরের ঘিঞ্জি গলিতে আচমকা এভাবে, এই চেহারায় দেখে চমকে না উঠে উপায় আছে?। আমি তো প্রথমে চিনতেই পারিনি তাকে। সে-ই আমাকে পেছন থেকে ডেকে দাঁড় করিয়ে তারপর কথা বলেছিলো। জানালো এখানেই একটা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে তৃতীয় বর্ষে পড়ছে সে। থাকে কলেজেরই হোস্টেলে। আমাকে তার রুমেও নিয়ে গিয়েছিলো সেদিন। সারাটা বিকাল  আড্ডা দেয়ার পর সন্ধ্যার দিকে সেখান থেকে বের হলাম। তারপর যে কাজের উদ্দেশ্যে জেলা শহরে গিয়েছিলাম সেটা শেষ করে আমাদের মফস্বলের বাসায় ফিরে এলাম। তবে ফিরে আসার আগে আড্ডার এক ফাঁকে রেজাউলের কাছ থেকে জেনে নিলাম ওর এই দৃশ্যঃত পরিবর্তনের মূল কারণ। আর সেটা জেনে আমাকে আরেক দফা আশ্চর্য্য হতে হলো।

কারণ, রেজাউল আসলে নিজের নিরাপত্তার জন্যই এই বেশ ধারণ করেছে। তার কলেজ ও হোস্টেলে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র আছে যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে কারণে অকারণে সাধারণ ছাত্রদের উত্যক্ত করতো। তাদের হাত থেকে বাঁচতেই রেজাউলের এই অভিনব কৌশল। ওর ভাষ্যে, হুজুর টাইপের ছাত্রদের নাকি কেউ অপমান করে না। সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম ওর কথা শুনে। এতোদিন জানতাম যে, ইভটিজিংসহ নানা বিড়ম্বনা থেকে বাঁচার জন্যে অনেক মেয়ে অনৈসলামিক মতাদর্শে থেকেও নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বোরকা পরে চলা ফেরা করে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। তবে সেদিনই প্রথম কোন ছেলেকে নিরাপত্তার স্বার্থে দাড়ি-টুপির আশ্রয় নিতে দেখেছিলাম। আবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার।

এই ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর এক গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামের বাড়ী বেড়াতে যাই। রাতের খাবারের সময় মা আমাকে বলতে লাগলেন- বারেক শেখের ছেলে রেজাউলের কথা মনে আছে তোর? ঐ যে নদীর ওপাড়ে বাড়ী। ছেলেটা তো আগে খুব বখাটে ছিলো, কিন্তু এখন একেবারেই পাল্টে গেছে। কি সুন্দর হাসি মুখে সবার সাথে কথা বলে, মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, পাঁচ ওয়াক্ত নামায কালাম পড়ে। ভাবাই যায় না, এতটাই পরিবর্তন হয়ে যাবে ছেলেটার! বগুড়া শহরে পড়তে গিয়ে ছেলেটা একদম বদলে গেল। ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। বলেছে তিন বছরের মধ্যে বাপকে হজ্ব করিয়ে আনবে…।

মায়ের কথায় মনে মনে হাসছিলাম আমি। আপন মনে বললাম, সে যে কিসের কারণে ভং ধরেছে তা তো আমি খুব ভালো করেই জানি। আর কেউ না জানলেও আমি জানি আসলে এসবই তার ভন্ডামি!। তবে একটা ব্যাপার ভেবে বেশ অবাক হলাম। চিন্তা করলাম, বগুড়াতে না হয় বখাটে ছেলেদের ভয়ে ও ছুরত বদলেছিলো। কিন্তু এখানে, এই গ্রামে, যেখানকার বাতাসে এখনো ওর দুষ্টোমিপনার কথা ভেসে বেড়ায়, সেখানে এসেও এই ভং ধরে থাকার কারণটা কী?

এই কৌতুহল থেকেই পরদিন বিকালের দিকে ওদের বাড়িতে গেলাম। কিন্তু তাকে দেখে আবারো অবাক হতে হলো আমাকে। কারণ, দেড় বছর আগে শহরের ব্যস্ত রাস্তায় দেখা সেই রেজাউলের থেকেও আরো বদলে গিয়েছিলো সে। দাড়ি হয়ে গেছে একমুষ্টিরও বেশি লম্বা, চোখের নিচে সুরমা, দৃষ্টিও অনেক অবনত। মুখটাও দেখতে কেমন যেন খুব নিষ্পাপ নিষ্পাপ লাগছিলো। ওর বেশ কাছের বন্ধু হওয়ায় এবং জন্মগত ভাবেই আমার সামাজিক জ্ঞান বুদ্ধি একটু কম থাকায় বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর এক পর্যায়ে হাবলার মতো সরাসরিই রেজাউলকে বলে বসলাম, কিরে দোস্ত, ভং তো দেখছি আরো বাড়িয়ে দিয়েছিস। তা নিজের গ্রামে এসেও এই ভাব ধরে থাকার কি দরকার বল?

আমার কথায় সে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখের পানি মুছে বলতে লাগলো- “আমি এখন আর কোন অভিনয় করছি না স্বাধীন! যা করছি মন থেকেই করছি। মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতেই আমি নিজ দায়িত্বে দাড়ি রেখেছি। এই সুন্নাতি পোষাক পরেছি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। দেখ, তুই আমাকে যেমনটি দেখে এসেছিলি তেমনটি করতে করতে একদিন আমি ভাবলাম, যেই মহান ¯্রষ্টার পছন্দের পোষাক পরলেই এতোটা নিরাপত্তা পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর বিধান মেনে চললে না জানি আরো কতো কল্যাণ পাওয়া যায়? সেই ভাবনা থেকেই আমি ধর্মীয় বই পুস্তক পড়তে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে আলেম ওলামাদের সহচর্যে যেতে লাগলাম। কয়েকবার তাবলীগেও গিয়েছিলাম। তুই বুঝতেও পারবি না, আমি একটু একটু করে যতোই ইসলামের ভেতর প্রবেশ করছিলাম ততই আমার ভেতরটা শান্তিতে শীতল হয়ে আসছিলো। এখন আমি এই পোষাক, এই বোধ, এই সংস্কৃতির জন্য আমার জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি। দেরিতে হলেও যে আল্লাহ তায়ালা আমাকে সঠিক বুঝ দান করেছেন, সেজন্যে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই”।

কথা বলতে বলতে রেজাউল হাঁফিয়ে উঠেছিলো। আর আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ছিলাম। মনে হচ্ছিলো যেন ওর জীবনের ঘটে চলা  কাহিনী আমার চোখের সামনেই ঘটে চলেছে। আর আমি বিমুগ্ধ চোখে অপার বিস্ময়ে দেখছি সেসব!।

বলাবাহুল্য, তখন দু’জনের চোখই অশ্রুতে ভিজে উঠেছিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে গলা খাকারি দিয়েও আবার বলতে শুরু করলো- “স্বাধীন, অতীতের দিনগুলোর জন্য আমি অনুতপ্ত। চলে যাওয়া দিনগুলোর পাপ তো আমি শোধরাতে পারবো না। তাওবা করে ও ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। আর সামনের সময়টা তো আমার হাতেই আছে। বাকী জীবনটা যেন আল্লাহ তায়ালার বিধান অনুযায়ী চলতে পারি, সেই দোয়া চাই তোদের কাছে….”।

আবেগে আপ্লুত হয়ে সে মুখ লুকোতে আড়াল খোঁজে। এর মধ্যে আসরের আযানের সুমধুর সুর ভেসে আসে। ছাড়া পাওয়ার অজুহাত পেয়ে রেজাউল ব্যস্ত হয়ে পড়ে- ‘ভাই! মসজিদে যেতে হবে। আজ তাহলে আসি, পরে কথা হবে কেমন!’

– একটু দাঁড়া, আমি নদী থেকে অজু করে আসছি।

সপ্তাহে একদিন, শুধু জুম্মার নামাযে যাওয়া মুসল্লিকে এভাবে চোখ মুছতে মুছতে ঘাটলায় যেতে দেখে সে বোধ হয় খুবই অবাক হয়েছিলো। কিন্তু আমার ভাবনার জগতে তখন ঝড় বয়ে চলেছে- সামনে আর কতোটা হায়াত বাকী আছে আমার, নিজেকে শোধরানোর সুযোগ কতটা পাব…?