ভালবাসার সর্বোচ্চতায় প্রিয় রাসূল (সা.)

।। বিনতে এন, এম, জাহাঙ্গীর ।।

একজন মুসলিমের দিলের ঐকান্তিক কামনা প্রিয় নবীজির সান্নিধ্য। কারণ, নবীজিকে সে প্রাণাধিক ভালবাসে। নবীজির স্মরণে আকুল হয় তাঁর মন! জীবনের সবটুকু বিসর্জন দিয়েও সে পেতে চায় নবীজির দর্শনলাভের মহা সৌভাগ্য! আর ভালবাসবেইনা কেন! কী নেই তাঁর মাঝে! সৌন্দর্য, উত্তম গুণাবলী, উম্মতের উপর তাঁর দয়া-অনুগ্রহ ও পিতৃতুল্য দিকনির্দেশনা দিয়ে তিনি হয়ে আছেন জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘আলোর দিশারী’!

কারো প্রতি মুগ্ধতার পরিণাম ভালবাসা। যে যাকে ভালবাসে, সে প্রতিটি কাজেই তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণে সচেষ্ট হয়। একজন মানবের প্রতি ভালবাসার মৌলিক ৪টি কারণ রয়েছে। ১. জামাল বা সৌন্দর্য। ২. কামাল বা সমগ্র উত্তম গুণাবলীর সমন্বয় ৩. ইহসান বা অনুগ্রহ। অর্থাৎ তাঁর দ্বারা যদি আমি উপকৃত হয়ে থাকি। ৪. কুরবত বা নৈকট্য। আত্মীয়-আপনজন হলেও স্বভাবজাতভাবেই তাঁর প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। যেমন সন্তানের প্রতি পিতামাতার ভালবাসা। অর্থাৎ- এই চারটি কারণে অন্যের প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। আর নবীজি ছিলেন উক্ত চারগুণেই পূর্ণ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত!

নবীজির সৌন্দর্য: হযরত আবু হুরাইরাহ (রাযি.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) এত স্বচ্ছ ও সৌন্দর্য্যময় ছিলেন যে, মনে হত তাঁর দেহ রূপার দ্বারা গঠিত। (শামায়েল- ১১)।

নবীজির আখলাক: রব্বে কারীম কুরআনে পাকে স্বীয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসায় বলেন-

وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ – ‘আর আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’। (সূরা ক্বলাম- ৪)।

স্বয়ং নবীজি ইরশাদ করেন- ‘নিশ্চয় আমি উত্তম চরিত্র পূর্ণতা দানের নিমিত্তে প্রেরিত হয়েছি’। (সুনানে বায়হাকী- ২০৫৭১, ২০৫৭২, আদাবুল মুফরাদ- ২৭৩)।

নবীজির ইহসান: উম্মাহর প্রতি নবীজির দিলের দরদ ও তড়প সর্বদা নবীজিকে চিন্তামগ্ন করে রাখত। উম্মাহর ফিকিরে নবীজি অনেক সময় (প্রবল আগ্রহ সত্ত্বেও) নফল ইবাদত (মাঝে মাঝে) ছেড়ে দিতেন। এই ভয়ে যে, মানুষ তা বরাবর আমল করতে থাকবে, তা তাদের জন্য ফরয হয়ে যাবে’। (বুখারী)।

উম্মাহর মায়া-দরদ: নবীজি ইরশাদ করেন- ‘আর আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি’। (সুনানে দারেমী- ৩৪৯, সুনানে ইবনে মাজাহ- ২২৯)।

‘নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য এরূপ, যেমন সন্তানের জন্য তার পিতা। আমি তোমাদের (দ্বীনের সর্ববিষয়) শিক্ষা দেই’। (সহীহ ইবনে খুযাইমা- ৮০, সহীহ ইবনে হিব্বান- ১৪৪০, সুনানে ইবনে মাজাহ- ৩১৩)।

উম্মতের প্রতি এত দরদ মায়া যেই নবীর, সেই উম্মত আজ তাঁর আহ্বায়িত পথ ছেড়ে লক্ষ্যহীন এক পথের যাত্রী!

প্রায় দুমাস আগে স্যোসাল মিডিয়ার একটি সংবাদ। ‘মাদারগঞ্জের একগৃহবধু স্বামীর সাথে অভিমান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কারণ, বেশ পীড়াপীড়িতেও বিখ্যাত এক অভিনেতার নাটকের শুটিং দেখতে নিয়ে যেতে চাননি স্বামী। স্যোসাল মিডিয়ায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় সাংসদের মাধ্যমে ‘প্রিয় অভিনেতা’ এর সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ পান সেই নারী’।

বড় দুঃখ ও পরিতাপের সাথে আজ মিডিয়ায় এমন সংবাদও দেখতে হচ্ছে। একজন অভিনেতার নৈতিকতার বিষয়টি সকলেরই জানা থাকার কথা। তাহলে তাদের প্রতি ভালবাসার মূল কারণ কি? সৌন্দর্য ও গুণাবলী? ইহসান বা আপনত্ব?!

গায়রে মাহরাম পুরুষের সৌন্দর্য অবলোকনের ব্যাপারে রব্বে কারীমের সুস্পষ্ট নির্দেশনা-
وّ قُلْ لِلْمُؤمنات يغضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ অর্থ- ‘হে নবী! আপনি মুমিনা নারীদের বলুন, তাঁরা যেন তাঁদের দৃষ্টিকে (গায়রে মাহরাম বা পরপুরুষ থেকে) ফিরিয়ে রাখে’। (সূরা নূর- ৩১)।

কৃত্রিমতা অবলম্বন করা, অবৈধ গান, গায়রে মাহরাম নারীদের সাথে অভিনয় ইত্যাদি নাজায়েয কাজ করা কি উত্তম গুণাবলীর মধ্যে পড়ে?! পাপাচারে আয়োজিত এসব নাটক সিনেমা উপহার দিয়েই তারা আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করছে নাকি জাহান্নামের পথে এগিয়ে নেয়ার আয়োজন করছে! সুতরাং কিসের ভিত্তিতে তাদের প্রতি আমাদের এত অনুরাগ!

সেদিন এক বোন বেশ প্রফুল্লতার সাথে বলছিলেন, ‘এমন কোন নাটক নেই, যা আমি দেখিনি’! কথাটি বলার সময় তাকে বেশ গর্বিত দেখাচ্ছিল! আমি অত্যন্ত ব্যথিত নির্বাক নয়নে তাকিয়ে ছিলাম। ক্ষণিকের জন্য আমি কেমন যেন স্তব্ধ হয়েছিলাম। এটাই আজ আমাদের সমাজের করুণ চিত্র। আচার-আচরণ হতে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা হয়ে যাচ্ছি আজনাবি! নামটি শোনেও বোঝার উপায় নেই আমি ‘ইসলামের ধারক’। আজ কিতাবের পাতা ও আমাদের জীবনের পাতায় হয়ে গেছে দ্বিমুখী চলন! তাই এক নওমুসলিমা বলেছিলেন, ‘আমি তো আজকের মুসলিমদের দেখে ইসলাম কবুল করিনি, কবুল করেছি আয়েশা, খাদিজা (রাযি.)দের জীবনী অধ্যয়ন করে’। হ্যাঁ, এটা একজন নওমুসলিমা বোনের কথা। তিনি তা বলতে পেরেছিলেন, আমাদেরই অধঃপতনের কারণে।

আরও পড়তে পারেন-

এসব বললেই ‘সংকীর্ণমনা’ তকমা এঁটে দিতে দেরি করেন না ‘মডারেট ইসলাম’ এ বিশ্বাসীরা! আওড়াতে থাকেন তাদের চিরপরিচিত স্লোগান ‘সব জায়গায় ইসলাম টেনে আনতে যান কেন!’ কিংবা ‘এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার’!

হে আমার মুসলিমা বোন! আজ বিধর্মীরা নবীজির জীবন নিয়ে অধ্যয়ন, গবেষণা করছে। নবীজির সীরাতের গুণাবলী দিয়ে নিজেদের জীবন সাজিয়ে তুলছে। ফলশ্রুতিতে দুনিয়ার জীবনে ক্ষণিকের জন্য তাঁরা লাভবান হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কী হলো! নবীজির সীরাতের কয়যটি কিতাবের নাম আমাদের জানা আছে? কয়টি সীরাতের কিতাব আমাদের অধ্যয়ন করা হয়েছে, নিজের জীবনেই কতটুকু এসেছে সীরাতের সুবাস! প্রিয় নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন- “যার সাথে যার মুহাব্বত, তার সাথে সে (কিয়ামতের দিন) থাকবে”। (সহীহ বুখারী- ৫৮১৬, সহীহ মুসলিম- ৬৮৮৮, সুনানে আবূ দাঊদ- ৫১২৯)।

উহুদের যুদ্ধ চলছে তখন। নবীজির নির্দেশ অমান্যের সামান্য ভুলে দ্রুতই পাল্টে যায় প্রেক্ষাপট। শাহাদাতের অমীয় সুধা পানে ধন্য হন অনেক সাহাবী (রাযি.)। মহিলাদের তাবুতেও পৌঁছে যায় এই শোকাবহ সংবাদ। মহিলারা খবর জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে বেরিয়ে পড়েন। এক আনসারী মহিলা একটি দলের কাছে এসে বললেন, নবীজি (সা.) কেমন আছেন? কেউ বলল, তোমার বাবা ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ইন্নালিল্লাহি.. পাঠ করে পুনরায় নবীজির হালত জানতে ব্যাকুল হলেন। ইতোমধ্যে কেউ তাঁর স্বামীর, কেউ ছেলের ও কেউ ভাইয়ের শাহাদাতের কথা জানাল। কিন্তু তিনি বারবার জানতে চাইলেন নবীজি কেমন আছেন?

সাহাবীরা বললেন, নবীজি (সা.) ভাল আছেন এবং এদিকে আসছেন। তবুও মন প্রবোধ মানলো না, ব্যগ্র কণ্ঠে বললেন, আমাকে বলুন পেয়ারা হাবীব কোথায় আছেন? সাহাবীরা বললেন, ঐ দলের মধ্যে আছেন। তিনি দৌঁড়ে সেদিকে গেলেন এবং নবীজি (সা.)এর পবিত্র চেহারা দেখে প্রশান্ত হৃদয়ে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনাকে দেখার পর আমার সব মুসীবত হালকা হয়ে গেছে। আরেক রেওয়ায়েতে আছে, তিনি নবীজির কাপড় (এর প্রান্ত) ধরে আরজ করেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আমার মা-বাবা উৎসর্গিত হোক আপনার তরে; আপনি যখন জীবিত ও সুস্থ আছেন, তখন অন্য কারো ইন্তেকালের পরোয়া করি না। (খামীস)।

আম্মাজান হযরত আয়িশা (রাযি.)এর কাছে একজন নারী এলেন। বড় আবেগ ও ভালবাসা নিয়ে বললেন, আমাকে নবীজি সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবর যিয়ারত করিয়ে দিন। আয়িশা (রাযি.) হুজরা শরীফ খুললেন। সেই নারী যিয়ারতে নবীজির স্মরণ ও ভালবাসায় কাঁদতে লাগলেন। ক্রন্দনরত হালতেই তিনি ইন্তেকাল করলেন। (শিফা)।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব। দ্বীনের ব্যাপারে তিনি এতটাই কঠোর ছিলেন যে, শয়তানও তাঁকে ভয় করতো। অর্ধ পৃথিবীর খলিফা হয়ে তিনি শাসক নয়, বরং সেবকের ভূমিকা পালন করতেন। তাই গভীর রাতে ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়তের মদীনার পথে-ঘাটে, জনগণের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। প্রয়োজনে এগিয়ে যেতেন সাহায্যে। ঠিক তেমনি এক রাতে তিনি বের হয়েছেন। একটি ঘরে আলো দেখা যাচ্ছিল। উমর (রাযি.) এক বৃদ্ধার আাওয়াজ শুনতে পেলেন। যিনি পশম বুনছিলেন আর কবিতা পাঠ করছিলেন, যার অর্থ-

‘মুহাম্মাদ (সা.)এর প্রতি নেক, পাক-পবিত্র ও পূণ্যবান মানবের দরূদ পৌঁছুক। নিশ্চয় ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি রাতে ইবাদাতকারী ছিলেন এবং রাতের শেষ প্রহরে ক্রন্দনকারী ছিলেন। হায় আমি যদি জানতে পারতাম যে, আমি ও আমার হাবীব কখনো একত্র হতে পারব কি না! কারণ, মৃত্যু তো বিভিন্ন হালতে এসে থাকে। জানি না আমার মৃত্যু কেমন হালতে হবে, আর মৃত্যুর পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মুলাকাত হবে কি না!’ হযরত উমর (রাযি.)ও নবীপ্রেমের পংক্তিসমূহ শ্রবণে কাঁদতে লাগলেন। (হিকায়াতুস সাহাবা)।

আখিরাতের জীবনে নবীজির সান্নিধ্য তো সকলেরই কাম্য। তাই আসুন নববী আদর্শে গড়ে তুলি আমাদের জীবন। সিনেমা নয়, সীরাতই হোক আমাদের অতি প্রিয়! মডেলরা নয়, বরং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ হোক আমাদের প্রাণের চেয়েও আপন! তবেই হব আমরা প্রকৃত মুমিনা! আখিরাতে হব নবীজির সান্নিধ্যপ্রাপ্তা। তাই তো বলেছেন প্রিয় রাসূল- ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ (পূর্ণাঙ্গ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, পুত্র (সন্তান) ও সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিকতর প্রিয় না হই’। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত)।

লেখক: আলেমা, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ। ইমেইল- jahangirbwdb63@gmail.com

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।