।। ড. হাসান মাহমুদ ।।
পূর্ববাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিভিত্তিক পল্লীসমাজের ভৌগলিক ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ১৪ ও ১৫ শতকে গঙ্গানদের গতি পরিবর্তন করে পদ্মা হয়ে পূর্ববাংলায় সরে আসার পর। সেই সময়ে মুঘলরা বাংলার স্বাধীন সুলতান এবং বারো ভুঁইয়াদের পরাজিত করে এ অঞ্চলকে ভারতীয় মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। মুঘলদের সাথে পূর্ববাংলায় প্রবেশ করে বিশাল সেনাবাহিনী, প্রশাসনিক কর্মচারীবহর এবং হিন্দু অর্থলগ্নিকারীগণ। মুঘলদের কৃষিভূমি সম্প্রসারণনীতি ও মুসলমান ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মিলিত প্রয়াস এবং আদিবাসী শ্রমিকদের সহায়তায় পাললিক ভূমি থেকে জঙ্গল পরিষ্কার করে ধানচাষের আবাদ শুরু হয়। সেই সাথে মসজিদকে (এবং মাজার) কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কৃষিজীবীদের গ্রামসমাজ।
মসজিদের পৃষ্ঠপোষক এবং নেতৃত্ব হয়ে ওঠে এই কৃষক সমাজের নেতা। এদের উপরে জমিদার হিসেবে আবির্ভূত হয় মুসলমান ও হিন্দু সেনাকর্মকর্তা, রাজকর্মচারী এবং হিন্দু ব্যবসায়ীগণ। আর সকলের নিচে থাকে আধা-জঙ্গলি জীবন ছেড়ে কৃষিকাজকে জীবিকা হিসেবে নেয়া বাংলার আদিবাসী সম্প্রদায়সমূহ।
নতুন পল্লীসমাজের আর্থ-সামাজিক গঠন প্রভাবিত করে এর সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা, যা গ্রামবাসীর ধর্মে সবথেকে বেশি দৃশ্যমান। মাঠ পর্যায়ে সমাজের কেন্দ্র মসজিদ এবং নেতৃত্বে মুসলমানরা থাকার ফলে কালক্রমে ইসলাম এই সমাজের প্রধান ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই সমাজ নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ার মধ্য দিয়ে ইসলামকে আত্মস্থ করেছে। অর্থাৎ, বাংলার পল্লীসমাজ নিজের স্বাতন্ত্র্য পরিচয় (identity) নির্মাণ করতে গিয়ে ইসলামকে অবলম্বন করে।
এই জন্যই ইসলাম ধর্মের সংস্কারবাদী আন্দোলনগুলোও শেষপর্যন্ত পল্লীসমাজের আর্থ-সামাজিক অধিকার আদায়ের দাবিতে গিয়ে ঠেকে। যেমন, ফরায়েজী আন্দোলন ইসলামের ফরজ পালন নিয়ে শুরু হলেও এটি জমির উপর আল্লাহর মালিকানার বিশ্বাসের ভিত্তিতে জমিদারের কর আরোপের অধিকারকে অবৈধ ঘোষণা করে। ইংরেজ আমলে গণতান্ত্রিক শাসন সূচনার প্রাক্কালেও এই পল্লীসমাজ নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ইসলামের ভিত্তিতেই নিজেদেরকে সংগঠিত করে।
এদেশে বসবাসকারী মুসলমান জনগোষ্ঠী কি বাঙালি, নাকি মুসলমান? আমাদের জাতীয় পরিচয় নিয়ে এই যে বিতর্ক, এর মূলে আছে দীর্ঘদিন ধরে ভুল ইতিহাসের চর্চা। মূলধারার ইতিহাস আমাদেরকে জানায় যে, বাঙালি হচ্ছে স্থানীয় আর মুসলমান বহিরাগত। ইতিহাসের এই যে বয়ান, এইটা ভুল, মনগড়া; এর পক্ষে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নাই। এই বয়ানের পক্ষে যত তত্ত্ব বা মতবাদ প্রচলিত আছে, সবগুলোই ভুল। কীভাবে ভুল, আসুন দেখা যাক।
১। তত্ত্বগুলোর মধ্যে সবথেকে দুর্বলটি হলো বাংলার বাইরে থেকে মুসলমানদের মাইগ্রেশন (আগমন)। বাইরে থেকে মুসলমানরা অবশ্যই এসেছে: যেমন, ইরান থেকে, মধ্য-এশিয়া থেকে, আরবের কিছু কিছু অঞ্চল থেকেও। কিন্তু তারা কতজন? আর তারা কোথায়ইবা স্থায়ী হয়েছে? কোন ঐতিহাসিক তথ্যও নেই হাজারে হাজারে মুসলমানের বাইরে থেকে ভারতবর্ষে মাইগ্রেট করার, বাংলায় তো নয়ই। সেসময় তো আর আজকের মতো সহজ, দ্রুত ও পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক চলাচলের মাধ্যম ছিল না।
দীর্ঘ কয়েক শতকব্যাপী মুসলমান শাসনামলে বাংলায় যে সামান্য সংখ্যক মুসলমান ধর্মপ্রচারক, বণিক ও প্রশাসক এসেছিলেন, তারা খুব সম্ভবত ব্যবসাকেন্দ্র ও শাসনকেন্দ্র তথা নগরে ও বন্দরে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। কিন্তু সমগ্র ভারতবর্ষেই এমন কোনো নগর বা বন্দর নেই যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু। বরং, এর উল্টোটিই সর্বত্র দেখা যায়। অর্থাৎ, মাইগ্রেশনের মধ্য দিয়ে ভারতে বা বাংলার কতিপয় অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেনি।
২। শাসনক্ষমতা দখলের মাধ্যমে বলপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তর করার তত্ত্বের উৎস হলো আরব বিশ্বে তলোয়ারের মাধ্যমে ইসলাম প্রসারের বিতর্কিত ওরিয়েন্টালিস্ট বয়ান। এই তত্ত্বের প্রস্তাবনা হলো, ইসলাম ধর্মের জন্মলগ্নে আরব বিশ্ব ছিল কতগুলো যুদ্ধবাজ গোত্রের আবাসভূমি; আর সেই গোত্রগুলোর মধ্যে একটা গোত্র (কুরাইশ) যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমগ্র আরব বিশ্বকে পদানত করে সবাইকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেছে। একইভাবে মূলত ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে ইসলাম প্রসারকেও তলোয়ারের মাধ্যমে হয়েছে বলে অনুমান করত। উপমহাদেশে ইসলাম বিস্তার তলোয়ারের মাধ্যমে হওয়ার ধারণার আরেকটা উৎস হলো, ফার্সী ভাষায় লেখা মুসলমানদের বিজয় কাহিনী।
ভারতবর্ষে আগত মুসলমান বিজেতারা ছিল প্রধানত ফার্সী ভাষাভাষী তুর্কী। কিন্তু তাদের সেনাবাহিনীকে তারা বলত ‘লস্কর-ই-ইসলাম’ বা ইসলামি সেনাদল। একইভাবে তারা বিজিত জনগোষ্ঠীর পরাজয় মেনে নেয়াকে বলত ইসলামের অধীনে আসা। ফার্সী থেকে আক্ষরিক অনুবাদ করতে গিয়ে মুসলমান বিজেতাদের ভারত বিজয়কে ইসলাম ধর্মের বিজয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, তুর্কীদের বিজয়গাঁথায় নিজেদের ‘মুসলিম’ আর বিজিতদের ‘কাফির’ বলে অভিহিত করার কারণ এই যে, সেসময় এখনকার মতো দেশ, জাতি বা এথনিক গোষ্ঠীর ধারণা ছিল না। মানুষ ছোট পরিসরে গোত্রের মধ্যে নিজেদের পরিচয় নির্ণয় করতো, আর বৃহত্তর পরিসরে সাম্রাজ্য বা রাজ্যের প্রজা হিসেবে। আর সেই সা¤্রাজ্যগুলোর পরিচয়ে রাজবংশের পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় পরিচয়ও চলে আসত।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস ও হিন্দিবাদী রবীন্দ্রনাথ
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
সাধারণজ্ঞানেও এ কথা বোঝা কঠিন নয় যে, গলায় ছুরি ধরলেই একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বাপদাদার ধর্ম ত্যাগ করে বহিরাগত একটা নতুন ধর্ম গ্রহণ করে নেয় না। এর উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই আছে: চীনের উইঘুর মুসলমান জনগোষ্ঠী আর মিশরের কপটিক খ্রিস্টান জনগোষ্ঠী। ইউরোপে ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের উপর চরম নিষ্পেষণের মধ্যেও তাদের স্বধর্ম ত্যাগ না করার উদাহরণ তো আছেই। আর ভারতবর্ষে মুসলিম বিজেতাদের ইতিহাসে এমন কোন যুদ্ধের ঘটনাও নেই যেখানে বিজিত জনগোষ্ঠীকে ব্যাপকহারে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল।
এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে সবথেকে জোরালো যুক্তি হলো ধর্মের ভিত্তিতে জনগোষ্ঠীর ভৌগলিক অবস্থান। তলোয়ারের মাধ্যমেই যদি ভারতবর্ষে ইসলামের প্রসার ঘটে থাকে, তাহলে সবথেকে বেশি মুসলমান থাকার কথা যেসব অঞ্চলে যেখানে মুসলমানদের শাসন বেশি শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিল। এই হিসেবে দিল্লী ও এর আশেপাশের অঞ্চল এবং সাধারণভাবে বর্তমান উত্তর প্রদেশ মুসলমানপ্রধান হওয়ার কথা। অথচ দেখা যাচ্ছে, মুসলমানপ্রধান এলাকা হলো বাংলা যেখানে মুসলমানদের শাসন ছিল তুলনামূলকভাবে সবথেকে দুর্বল এবং স্থানীয়দের (তথা অমুসলিমদের) উপর অধিক নির্ভরশীল। অতএব, তলোয়ারের ভয়ে স্থানীয় অমুসলিম জনসংখ্যার ব্যাপক হারে মুসলমান হয়ে যাওয়ার ধারণা ভ্রান্ত।
৩। সামাজিক মুক্তির তত্ত্ব। এর মূল কথা হলো, বর্ণবৈষম্যমূলক হিন্দু সমাজের নিম্নবর্ণের লোকেরা সাম্যবাদী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে সামাজিক মুক্তির আশায়। এই তত্ত্বের জন্ম বৃটিশ এথনোগ্রাফার আর ঐতিহাসিকদের হাতে; এর বিকাশ হয়েছে বাঙালি আর পাকিস্তানি মুসলমান গবেষক ও লেখকদের হাতে। আর এটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে অসংখ্য জার্নাল, বই ও নানান প্রকাশনার পাশাপাশি জাতীয় টেক্সট বুক বোর্ডের মাধ্যমে। এই তত্ত্ব বেশ কয়েকটা অনৈতিহাসিক এবং অযৌক্তিক অনুমানের উপর গড়ে উঠেছে।
প্রথমত, সামাজিক সাম্যের ধারণা তথা “সকল মানুষের অধিকার জন্মগতভাবেই সমান” এই ধারণার জন্ম হয়েছে ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে, যা ভারতবর্ষে মুসলমানের আগমনের কয়েক শতাব্দী পরের ঘটনা। কালের প্রেক্ষিতে আগের ঘটনাকে পরের কোন ঘটনার ফলাফল হিসেবে কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, পলাশীর যুদ্ধে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে জিতেছিল তাদের উন্নত সমরাস্ত্রের কারণে, যেগুলো আমরা পলাশী-পরবর্তী বৃটিশ সেনা ও নৌবাহিনীতে দেখি।
এছাড়া হিন্দুরা বিশ্বাস করে পুনর্জন্মের যার মূলকথা হলো, বর্তমান জন্মে পুণ্য করলে পরজন্মে সমাজের উচ্চ অবস্থানে জন্ম নিবে, আর পাপ করলে পরজন্মে সমাজের নিচু অবস্থানে জন্ম নিবে। এই কারণে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়ে বিরুদ্ধাচারণ করেছে এমন নজির পাওয়া যায় না। এমন ধর্মবিশ্বাসীদের মাঝে ইসলামকে সাম্যের ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করে বাপদাদাদের হিন্দু ধর্ম বিসর্জন দেওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। (তথ্যসূত্র- ইটন, ১৯৯৩)।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নর্থইস্টার্ন ইউনিভাসিটি ইন কাতার।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/