ভ্যালেন্টাইনস ডে: ভালবাসার মোড়কে অশ্লীলতার হাতছানি

।। বিনতে এন, এম, জাহাঙ্গীর ।।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর কালামে পাকে কত সুন্দর বলেছেন- ‘আল্লাহ তাআলা একজন মানবের ভেতর দুটি কলব দেননি।’ (সূরা আহযাব, আয়াত- ৪)।

হ্যাঁ তাই তো! একটিই তো দিয়েছেন। তাই তো গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় আমরা নিরিবিলি ও একাগ্রতার অন্বেষায় থাকি। কারণ, মন তো একটি, মনযোগ বারবার বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় কোলাহল-ধ্বনিতে! রব্বে কারীমের এই একটি বাক্যে গভীরভাবে চিন্তা করলে অনেক হিদায়াত উপলব্ধি করা যায়।

আজ মানব সমাজে উপায়-উপকরণ ও আয়োজনের অভাব নেই। তবুও ভেতরে ভেতরে সকলেই কেমন যেন অস্থির! সাধারণ মুসলিম পরিবারগুলোও এর চেয়ে খুব বেশি তফাত নয়। এর কারণ কী বা সমাধান কিসে, তা নিয়ে আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। বরং রব্বে কারীমের এই আয়াতে কারীমা পাঠে আমার ভাবনার দিগন্তে এও উদ্ভাসিত হয়েছে যে, ‘আজ পালনরীতি, আর আয়োজন অনুষ্ঠানের পিছনেই আমাদের ভাবনার ঘুর্ণায়ন! থার্টি ফার্স্ট নাইট, আবার কদিন পর ভালবাসা দিবস। এরপর আবার ভাবনা-প্ল্যান চলে বৈশাখি পান্তা-ইলিশ নিয়ে, এভাবেই চলতে থাকে। এর মাঝে এসে পড়ে মালিকের দেয়া দু উপহার ‘ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা’। কিন্তু এ দুটো আর আলাদা তেমন বিশেষত্ব নিয়ে আসে না আমাদের জীবনে। আর কতক দিবসের মতোই আয়োজন স্টাইলটাই মুখ্য হয়ে যায়! ঈদের রূহানিয়াত বা দ্বীনি প্রাণ বলে কিছু উপলব্ধি করা হয় না! তো এভাবে মন সর্বদা একের পর এক আয়োজন প্ল্যানেই ব্যস্ত থাকে।

আমরা যে মুসলমান, এই পরিচয়ের যে একটা নিজস্ব দাবি রয়েছে, সেটা পালন করতে প্রায়ই ভুলে যাই এবং ধীরে ধীরে জীবন হতেই হারিয়ে যায় সেই দাবির প্রতি দায়িত্ববোধ! অন্য ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার নিষিদ্ধ হওয়ার এটাও অন্যতম এক হেকমত (বলে আমি মনে করি)। মন তো একটা! আর দুনিয়া এমন এক বস্তু, এটার ফিকিরে যতটা মগ্ন হবে, আখিরাতের নিমগ্নতা ততই কমে যাবে। সুতরাং এই নিষেধাজ্ঞাকে বৈষম্য নয়, বরং ইসলামের ‘বিশেষত্ব’ ভাবা উচিত।

সূচনা ইতিহাস

২৬৯সাল। ইতালির রোম নগরী। রোম সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস। সে রোমবাসীর জন্য খ্রিষ্টধর্ম পালন ও প্রচার নিষিদ্ধ করে। এর পরিবর্তে নির্দিষ্ট কিছু দেব-দেবীর উপাসনায় বাধ্য করে। সেসময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস নামে একজন খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন। ধর্মপ্রচারের অভিযোগে কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে ঠাঁই হয় তার। ভ্যালেন্টাইনস একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকও ছিলেন। কারারক্ষীর এক মেয়ে ছিল অন্ধ। তার চিকিৎসায় ধীরে ধীরে দৃষ্টির আলো ফিরে পায় মেয়েটি। ঘনিষ্ঠতা হয় ভ্যালেন্টাইনস এর সাথে। দৃষ্টি ফেরার সংবাদে ভ্যালেন্টাইনস এর জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়।

সম্রাট ক্রাডিয়াস এর তা সহ্য হয় না। দুশমনের প্রশংসা তাকে আরো প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। তড়িৎ ভ্যালেন্টাইনসকে মৃত্যুদ- দেন। দিনটি ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি। মৃত্যুদ-ের পূর্বে ভ্যলেন্টাইনস কারারক্ষীর সেই দৃষ্টি ফেরা মেয়েটিকে ‘ভালবাসাপূর্ণ’ একটি চিঠিও দিয়েছিল বলে লোকমুখে কথিত আছে। মেয়েটিও নাকি ভ্যালেন্টাইন্স এর সমাধির উপর লাগিয়েছিল আমন্ড গাছ। যাতে ফুটত গোলাপি ফুলের সারি। এভাবেই সে জাগরূক করে রেখেছিল ভ্যলেন্টাইনস এর ভালবাসা।

ইসলামে ‘দিবসের’ গ্রহণযোগ্যতা

ইসলাম একটি সহজ-সরল জীবন ব্যবস্থা। তাই অহেতুক কথা-কাজ ও আচরণকে রব্বে কারীম অপছন্দ করেছেন একজন মুমিনের জন্য। নতুন কোন আয়োজন সামনে এলে প্রথমে আমাদের দু’ বিষয়ে অবশ্যই যাচাই করতে হবে। এর উপরই নির্ভর করে তা পালন বা বর্জন এর বিধান।

১. এই আয়োজন তথা দিবসটির সাথে কোনো ধর্মীয় চেতনা সম্পৃক্ত কি না। হলে, তা ইসলামের পক্ষে নাকি বিপক্ষে।

২. তাতে পালনীয় নিয়ম-রীতি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কি না।

১ম: ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালবাসা দিবসের ইতিহাস হতে যা বোঝা যায় তা হলো, এক খ্রিস্টান পাদ্রী বা ধর্মগুরুর বিশ্বাসের সাথে এ দিবসের সম্পর্ক। এটা কোন ধরনের উৎসব, এ ব্যাপারে উইকিপিডিয়ায় স্পষ্ট লেখা আছে ‘সাংস্কৃতিক, খ্রিস্টান, বাণিজ্যিক’।’ এদিবসে কী কী পালনীয়, সেখানে উপহার, চিঠি আদান-প্রদানের পাশাপাশি লেখা আছে- গির্জা পরিসেবা’। খৃষ্ট ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইনস এর মৃত্যুদ-ের দিনকে জাগরূক করে রাখাই হচ্ছে এই দিবসের মুখ্য উদ্দেশ্য।

আরও পড়তে পারেন-

২য়: ‘ভালবাসা দিবসের’ নামে আমাদের দেশে যা হয়ে থাকে, তার কোনোটিই ইসলাম সমর্থিত নয়। অনেকেই একটু উদারমনা ভঙ্গিতে বলতে চান, ‘ভালবাসা দিবস পালনে সমস্যার কী আছে! মা-বাবা, সন্তান, ভাই-বোনের প্রতি ভালবাসা প্রকাশিত হবে!’ কেউ কেউ জবানে এমনটা উল্লেখ করে দিবসটির আয়োজনকে বৈধতা দানের প্রচেষ্টা চালালেও; দিবসটি নিয়ে বিশেষায়িত অফার, প্রচারণা ও নাটক-গান পরিবেশনার প্রতিপাদ্য থাকে সম্পূর্ণ বিপরীত! প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টান ভ্যালেন্টাইনস ও (কারারক্ষীর ‘দৃষ্টি ফিরে পাওয়া’) মেয়েটির ভালবাসার রূপায়নই যেন হয়ে উঠে মুখ্য!

পুঁজিবাদের অপকৌশল

বিভিন্ন অশ্লীলতায় দিবসটির চেতনা ক্ষুণ্ন হওয়ায় ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন নিষিদ্ধ করে ফ্রান্স সরকার। পরবর্তীতে হাঙ্গেরী, অষ্ট্রিয়া, জার্মানেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। তবে বর্তমানে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে তা ব্যাপকভাবে পালিত হয়ে আসছে! যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক এই দিবসটির পিছে ব্যয় করে প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড! আমাদের দেশেও এর ধারাবাহিকতা রয়েছে। এ দিন উপলক্ষে ফুলদোকান হতে শুরু করে প্রসাধনী, পোশাক, ফাস্টফুডের বেকারিতে চলে আকর্ষণীয় অফার! সচেতন ব্যক্তি পুজিঁবাদের এসব অপকৌশল সম্পর্কে বেখবর নন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন- এ সব অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে পশ্চিমা মিডিয়ার পাশাপাশি ‘অবদান’ রাখে এ দেশীয় পশ্চিমাপ্রেমী মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা। যেন এক ঢিলে দুই শিকারের মতো। প্রথমত: পশ্চিমাপ্রভুদের আনুগত্য ও বাহবাপ্রাপ্তি, দ্বিতীয়ত: পশ্চিমা দেশগুলোর মতো এ দেশেও কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মাঝে অবাধ মেলামেশার সুযোগ করে দেয়া। যা আজ হতে দুই যুগ আগেও ছিল কল্পনাতীত! অন্তত নূন্যতম শালীনতার অধিকারীরাও ছেলে-মেয়েদের প্রকাশ্যে এরূপ অবাধ মেলামেশা গর্হিত মনে করতেন (যারা তখন ছিলেন দুনিয়ায়, তাদের থেকে শোনা)।

কিন্তু আজকের পরিবেশ তো এতটাই দূষিত হয়ে গেছে যে, এ যেন তেমন বড় কোন গোনাহ নয়! আর সমাজে অবৈধ প্রেম ইত্যাদিকে স্বাভাবিক করে তোলাই হলো পশ্চিমা প্রেমিদের মূল লক্ষ্য। এভাবেই আগামীর জাতি কর্ণধারদের আত্মিক পবিত্রতা ধ্বংসের আয়োজনে ব্যস্ত পশ্চিমা সমাজ! আর এর বিশেষ সমর্থনের ভূমিকা পালন করছে তথাকথিত ‘ভালবাসা দিবস’ নামের অভিশাপ! আত্মিক পরিশুদ্ধতা, চারিত্রিক পরিচ্ছন্নতা ব্যতীত একজন মুসলিম জীবনে প্রশান্তি খুঁজে পায় না। হৃদয়ে ঈমানী নূরের ফোয়ারা দোলায়িত করে না!

পরিশেষে ছোট্ট করে আরয করতে চাই, এক সময়ের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী পপ তারকা জুনায়েদ জামশেদ (রহ.)। হঠাৎ করেই ঘুরে গেলো তার জীবনের মোড়। মাওলানা তারিক জামিলের স্বল্প সময়ের সামান্য সান্নিধ্যে! জীবনের মোড় পরিবর্তিত সেই সাক্ষাতে জুনায়েদ জামশেদ বললেন, ‘দুনিয়ার খ্যাতি, অর্থবিত্ত সব কিছু তার অঢেল; কিন্তু তবুও কেন যেন দিলটা বড় পেরেশান’!

প্রতিউত্তরে মাওলানা তারিক জামিল বলেছিলেনÑ ‘আপনার দেহ তো মাটির, হৃদয় তো আসমানি। দুনিয়ার মাটির আসবাব-নিয়ামত দ্বারা তো শুধু দুনিয়ার দেহই তৃপ্ত হতে পারে; আসমানি হৃদয় তো কেবল আসমানেই আছে আর তা হল রব ও রবের হুকুম মতো যাপিত জীবন!’ জুনায়েদ জামশেদ আজ নেই। দুনিয়ার খ্যাতি ছেড়ে আসমানওয়ালার সাথে সম্পর্কের ফলে আজও মুমিন হৃদয়ে ‘ভালবাসা’ হয়ে আছেন তিনি! রহিমাহুল্লাহু তাআলা ওয়া আফা আনহু (আল্লাহ তাঁর উপর রহমের বারি বর্ষণ করুন ও ক্ষমা করুন)।

এই হলো জীবনে সফলতার চাবিকাঠি! আসুন রবকে ভালবাসি, ভালবাসার হক আদায় করি। প্রিয় রাসূলকে ভালবাসি, ভালবাসার দাবি রক্ষা করি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসার হক ও দাবি কী? আল্লাহকে ভালবাসার হক হলো, তাঁর আনুগত্য করব নির্দ্বিধায়। নবীজিকে ভালবাসার দাবি হল তাঁর অনুসরণ আবশ্যক করে নেব নিজ পথচলায়!
পরিবারকে ভালবাসুন, স্বজন-পরিজনের সাথে সুসম্পর্ক-হৃদ্যতা বজায় রাখুন। ইসলাম এসব পবিত্রতম ভালবাসাকেই সমর্থন করে এবং তা সর্বদা-বছরজুড়েই। ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ যেই ভালবাসার কথা বলে, ইসলামে তা হারাম। সংযত থাকি, অপর মুসলিমকেও ফিরিয়ে রাখি এ দিনের অশ্লীলতা হতে।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ দিবে, খারাপ হতে ফিরিয়ে রাখবে, অন্যথায় অচিরেই আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর আযাব প্রেরণ করবেন। অতঃপর তোমরা তাঁকে ডাকবে, কিন্তু তিনি ডাক শোনবেন না (দুআ কবুল করবেন না)। (জামে তিরমিযী, ২১৬৯)।

[১৯ জমাদিউস সানি, ১৪৪৩হিজরী]

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।