।। মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রহমানী ।।
বিদায় মসজিদে আকসা!
৯ জানুয়ারি আমাদের ফেরার সফর শুরু হল। আমাদের অনুরোধে মূল সফরসূচির অতিরিক্ত হিসেবে গাইড আজকে আবারো মসজিদে আকসায় ইবাদত-বন্দেগী পালনের সুযোগ করে দিতে সম্মত হলেন। আমরা সকালের নাশতা সেরে মসজিদে আকসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। গাইড আমাদেরকে সংক্ষিপ্ত একটি পথ দিয়ে মসজিদে আকসায় নিয়ে এলেন। আমরা সোজা মূল মসজিদে আকসায় প্রবেশ করলাম। দুই ঘণ্টা পর্যন্ত নিয়ম অনুযায়ী নামায, দুআ, যিকির এবং কুরআন তিলাওয়াত করলাম। ফেরার পথে মসজিদে আকসায় ইবাদত করার যে সুযোগটা হল, এতে আমাদের হৃদয়ে বড় ধরনের প্রশান্তি অনুভূত হল।
মৃত সাগর এবং অন্যান্য নিদর্শন
এখান থেকে আমাদের সফর মিসরের বর্ডার এলাকার দিকে। যেটা তাবা শহরে অবস্থিত। বলা হয়ে থাকে, এটা ঐ রাস্তা যা দিয়ে হযরত মূসা (আ.) ফিরআউনের যুলুমের কবল থেকে নিরাপদে থাকতে বাইতুল মুকাদ্দাসে এসেছিলেন। এই পথে সাদুম এবং আমুরার সেইসব স্থানগুলো পড়ে, যেখানে হযরত লূত (আ.)এর জাতির আবাদি ছিল। আল্লাহ তাআলা আযাব হিসেবে তাদের উপর আকাশ থেকে পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলেন, অতঃপর যমীনকে তাদের উপর উল্টে দিয়েছিলেন। (সূরা আরাফ- ৮৪)।
যে স্থানটি বর্তমানে মৃত সাগর নামে পরিচিত। এই সাগরের পানি ৩৩ শতাংশ লবণাক্ত, যে কারণে এই সাগরে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব নেই।
এই এলাকার অধিকাংশ ভূমি পাহাড়-পর্বতে ঘেরা। পাহাড়গুলোর দৃশ্য খুবই ভয়ঙ্কররূপে দৃষ্টিগোচর হয়। ইঁদুর যেভাবে মাটি খুঁড়ে যমীনে গর্ত এবং ছিদ্র তৈরি করে, পাহাড়গুলোতেও এ ধরনের ছোট ছোট ছিদ্র দেখা যায়। সাথীদেরকে হযরত লূত (আ.)এর জাতির ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশনা দিয়েছেন যে, আযাবপ্রাপ্ত জাতির এলাকা যদি অতিক্রম করো তাহলে খুব দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে যাবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ৪৭০২)।
কিন্তু যখন দেখলাম, অনেক লোক মৃত সাগরে সাঁতরানোর জন্য পাকাপোক্ত ইচ্ছা করল তখন এতটুকু বললাম যে, কমপক্ষে এই এলাকায় যতক্ষণ অবস্থান করবেন, ততক্ষণ বেশি বেশি ইস্তেগফার করবেন। পানিতে লবণের পরিমাণ বেশি হওয়ায় মৃত সাগরের পানির ঘনত্ব বেশি। এখানে কোনো জিনিস নিক্ষেপ করলে তা ডুবে যায় না। যে সমস্ত মানুষ সাঁতার জানে না তারাও এখানে ডুবে না। অনায়াসে পানির উপর শুয়ে থাকতে পারে। যেন নিজ বিছানায় শুয়ে আছে।
মোটকথা অনেক মানুষ এখানে গোসল করেছে। অতঃপর এখানেই সকলে মিলে আসরের নামায আদায় করলাম। আর্শ্চযের বিষয় হচ্ছে, কওমে লূতের উপর আযাবের আলোচনা পবিত্র কুরআনে আছে এবং তাওরাতেও আছে। কিন্তু এখন এখানে খুবই লজ্জাজনক দৃশ্য দেখা যায়। ইসরাইল এবং পশ্চিমা দেশসমূহ থেকে আগত অনেক মহিলা সংক্ষিপ্ত এবং সংকীর্ণ পোশাক পরিধান করে সমগ্র দেহে সাগরের মাটি লেপন করে দৌড়াদৌড়ি করে। এর কারণ, লোকমুখে প্রসিদ্ধ যে, এই অঞ্চলের মাটি লাগানোর দ্বারা শরীরের চামড়ায় যে সমস্ত রোগ-ব্যাধি হয় সেগুলো থেকে সুস্থতা লাভ করা যায়। মোটকথা যে জায়গাটা মানুষের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করার ছিল, এখন সেটা মানুষের বিলাসিতা ও পাপাচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
তাবা শহরে
এখান থেকে রওয়ানা দিয়ে আমরা সন্ধ্যায় তাবা শহরে পৌঁছলাম। এখানকার ইমিগ্রেশন ভবনটি ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইসহাক রবিন (আইজ্যাক রবিন) এর নামে। আমরা ভেবেছিলাম যেহেতু এখন ইসরাইল থেকে চলে যাচ্ছি, সেজন্য তারা খুশি খুশি এবং দ্রুত ইমিগ্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করে দিবে এবং ইসরাইলে প্রবেশ করার সময় যেভাবে হয়রানি করা হয়েছিল তেমন হয়রানি করা হবে না। কিন্তু যে জাতির স্বভাব দুষ্টুমি এবং দুর্বৃত্তপনায় ভরা, তারা প্রত্যেক জায়গায়, প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের শয়তানি চরিত্র প্রদর্শন করে। প্রথমে দূর থেকে সামানাপত্র উঠিয়ে ইমিগ্রেশন এলাকায় আসতে হল। এরপর সমস্ত সামানা ইমিগ্রেশনের স্ক্যান মেশিনে প্রবেশ করানো হল। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক যাত্রীর দেহ তল্লাশি করা হলো। এরপর জিজ্ঞেস করা হল, কারো কাছে অস্ত্রশস্ত্র আছে কিনা? সবাই ‘না’ সূচক উত্তর দিলেন। সকল কার্যক্রম শেষ হলে হঠাৎ এলার্ম বেজে উঠল। এটা বিপদ সঙ্কেত। এটা শোনার পর নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন দৌঁড়ঝাপ শুরু করে দিল। তাদের মধ্যে নারী পুরুষ উভয়ে রয়েছেন। প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র ছিল। আমরা সকলে ইমিগ্রেশন এলাকা ত্যাগ করলাম, কিন্তু এখনো ইসরাইলের সীমানাতেই রয়ে গেছি। আমাদেরকে বলা হল, আপনারা দ্রুত ভেতরে ফিরে আসুন! আমাদের সবাইকে লম্বা সারিবদ্ধ চেয়ারে বসানো হল। যদিও চেয়ারের উপর একটা ছাউনি ছিল, কিন্তু প্রচ- ঠান্ডা এবং তীব্র বাতাসও ছিল। চতুর্দিক থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তারা এমন ভাব নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেন আমরা সকলে সন্ত্রাসী বা বড় কোন অপরাধী। অস্ত্রশস্ত্র তারা এমনভাবে তাক করেছে, মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীকে তারা মুহূর্তেই মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছিয়ে দিবে।
আরও পড়তে পারেন-
আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
মুমিন জীবনে নামাযের গুরুত্ব
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
গাইড শুরুতেই বলে দিয়েছিল যে, ইসরাইলী ইমিগ্রেশনে ভয় পাওয়ার জন্য শুরুতেই মানসিকভাবে চাপে রাখা হয়। মানুষকে এভাবে আতঙ্কিত করা হয়। এ ধরনের হলে চুপচাপ বসে থাকতে হবে। যা ধারণা করলাম, আমাদের সাথে এমনই আচরণ করা হয়েছে। প্রায় এক/দেড় ঘণ্টা বসিয়ে রাখার পর কোনরূপ তল্লাশি এবং জিজ্ঞাসবাদ ছাড়াই আমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হল।
দুনিয়াতে হয়তো এটিই একমাত্র ইমিগ্রেশন, যেখানে এত বড় বদ চরিত্র এবং বদ স্বভাবের মানুষ পাওয়া যায়। এতদসত্ত্বেও তাদের নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কেননা, যে জাতি নবীগণের সাথে, এমনকি তাদের নবী হযরত মূসা (আ.)এর সাথে খারাপ আচরণ করেছে, তাদের কাছ থেকে এর চাইতে আর ভালো কিছু কী আশা করা যায়!
মসজিদে আকসা এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে আমাদের কর্তব্য
বাইতুল মুকাদ্দাস সফর করার পর যে অনুভূতি নিজের ভেতর তৈরি হল, তার সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি-
১. ফিলিস্তিনের মুসলমানদের জন্য বড় ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন। তাদেরকে গৃহহীন করা হচ্ছে। তাদের উপর প্রকাশ্যে এবং সীমাহীন যুলুম করা হচ্ছে। আমরা যে হোটেলে ছিলাম, তার সন্নিকটে এক ফিলিস্তিনি যুবকের দোকান ছিল। তিনি আমাদেরকে বললেন, আমরা জীবনে মাত্র একবার মসজিদে আকসায় নামায পড়তে পেরেছি। আমাদেরকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না। আমরা সেই দেয়ালও দেখেছি যেটা গাজাকে একটা বড় জেলখানায় রূপান্তরিত করে রেখেছে। এ ছাড়াও জায়গায় জায়গায় ফিলিস্তিনি মুসলমানদের বাড়িগুলোকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে তারা না ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে, না কোথাও উপার্জনের জন্য যোগ দিতে পারে। এই অল্প-স্বল্প ফিলিস্তিনিরাও যদি বাইরে চলে যায়, তাহলে তো ইসরাইলের উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাবে। সমগ্র ফিলিস্তিনি ভূখ- তারা গ্রাস করে নিবে।
সুতরাং সমগ্র বিশ্বের মুসলিম ভাইদের উচিত, তারা যেন ফিলিস্তিনিদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে। মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের মযলুম অবস্থা এবং ইসরাইলের যুলুম-বর্বরতাকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে। যেসব ফিলিস্তিনি সেখানে বসবাস করছেন, তাদের সাহস এবং হিম্মতও বাড়াতে হবে। তারা বাস্তবেই মিল্লাতে ইসলামিয়ার ভূখ-ের পাহারাদার।
২. ইসরাইল চাচ্ছে মসজিদে আকসা যিয়ারতের জন্য মুসলমানগণ কমই আসুক। মাঝেমধ্যে কিছু বিশৃঙ্খলার ঘটনা সামনে আসলেও বাস্তব পরিস্থিতি এতই খারাপ না যে, সেখানে যাওয়া যাবে না। বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করার পর ইবাদত-বন্দেগি করার পুরোপুরি স্বাধীনতা পাওয়া যায়। তাই হৃদয়ে সাহস; বরং দুঃসাহস নিয়ে মুসলমানদের জন্য উচিত বেশি বেশি ফিলিস্তিন সফর করা। না হয় ইসরাইলের এই দাবি শক্তিশালী রূপ ধারণ করবে যে, মুসলমানের কাছে মক্কা-মদীনা আছে। বাইতুল মুকাদ্দাসের সাথে তাদের সম্পর্ক নেই। সুতরাং তাদেরকে এ বিষয় (বাইতুল মুকাদ্দাস) থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া উচিত।
৩. মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে বিশেষভাবে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদেরকে ব্যাপকভাবে এ বিষয়ে চেষ্টা করতে হবে যে, তারা যেন সুসংহতভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে আসে। এ বিষয়ে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ সম্মিলিতভাবে সহজেই ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নিতে পারে। তারপরও হিন্দুস্তানের মুসলমানরা এ ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারে। কেননা, হিন্দুস্তান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে উর্বর একটি রাষ্ট্র। তার এই যোগ্যতা এবং প্রবৃদ্ধিকে বৈশ্বিকভাবে সমর্থন করা হয়। কিন্তু আফসোস, আমরা তো প্রথমে শিক্ষার দিক দিয়েই পিছিয়ে আছি। যা কিছু আমরা শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করি, তা শুধুমাত্র রুটিরুজি এবং জীবনের অর্থসংশ্লিষ্ট দিকগুলোকে সামনে রেখে অর্জন করি। তার ফলশ্রুতি এই যে, দেশে খুব অল্প সংখ্যক মুসলমান আছেন, যাদেরকে বিজ্ঞানী হিসেবে গণনা করা হয়। যেসব মানুষ আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তির ময়দানে দক্ষতার সাথে কাজ করছেন, তাদের এ বিষয়ে ভূমিকা রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। [সমাপ্ত]
[সফর নামা বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে অনূদিত]
অনুবাদ: আবু আবদির রহমান
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/