।। মুফতী নূর আহমদ ।।
প্রতি বছরের ন্যায় নতুন সৌকর্যের সওগাত নিয়ে এবারো এসেছে নব-দিন। উদিত হয়েছে নব-বর্ষের নতুন হিলাল। এই হিলালের নকীব হল মুহাররম। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেল সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না বিজড়িত কতগুলো দিন। দিনগুলো বছর বছর প্রতিটি ঋতুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আবার ফিরে এলো নিজ কক্ষে; যেখান থেকে শুরু হয়েছিল। এ চলার নেই কোন অন্ত। যে কারণে মুহাররম মাস কখনো আসছে শীত কালে, কখনো হেমন্ত কালে, কখনো শরৎ কালে, কখনো আবার বর্ষা কালে। লুকিয়ে আছে এ মাসে বিশেষ একটি দিন মুর্হারামের দশম তারিখ। যে দিনটি বিভিন্ন কারণে বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় বরণীয়। এ দিনটি মুসলমান জাতির ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। কারণ পৃথিবীর বয়সে বহু বড় বড় ঘটনা এ দিনেই সংঘটিত হয়েছে।
মুহাররম মাসের এ দিনটিরই নামকরণ করা হয়েছে আশূরা নামে। আশূরার দিনটি বড় মহৎ ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। উম্মতে মুহাম্মদীর পূর্ব আমল হতেই এর মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত। হযরত মূসা (আ.) দীর্ঘদিন পর্যন্ত বনী ইসরাঈলকে আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দিচ্ছিলেন। তাঁর দাওয়াতে একটা বৃহৎ জনপদ আল্লাহর একত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠে এবং হযরত মূসা (আ.)এর অনুসরণ করে আল্লাহ তায়ালার প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়।
কিন্তু গদিনশীন সরকার ছিল আত্মম্ভরিতার তুঙ্গে। নাম ছিল তার অলিদ ইব্নে মাসআব ইব্নে রাইহান। নিয়ামতে ইলাহীর সপ্তডিঙ্গায় আরোহী এ নরাধম। এ নাফরমান নিজেকে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করে প্রভুত্ব ফলাচ্ছিল সাধারণ প্রজাদের উপর। আকাশ তলে যমীন চরে আরো প্রভু আছে বটে, তবে তার মত এত বড় কেউ নেই বলে দাবী করেছিল সে। কুরআনুল কারীমের ভাষায়- “আনা রাব্বুকুমুল আ’লা” ছিল তার দাবী যার অর্থ- আমি তোমাদের সব চেয়ে বড় প্রভু।
আল্লাহর প্রিয় বান্দা বনী ইসরাঈল ছিল তার ও তার অনুসারীদের চাকর-চাকরানীর কাতারে। বাধ্যবাধকতা ছিল তাদের উপর কঠিনভাবে চাপানো। অত্যাচার, অনাচারের ষ্ট্রিম রোলার ছিল সর্বদাই গতিশীল। প্রত্যাখাত ছিল তাদের সকল আবদার আবেদন। বালকদের করেছিল হত্যা, আর মহিলাদের করে রেখেছিল দাসী।
তরমুজ বিক্রেতা চাষীর ছেলে যেখানে বড় প্রভু (?) আর আল্লাহর অনুগত বান্দারা যেখানে সাধারণ মযলুম প্রজা, সেখানে কি বিষাক্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
বনী ইসরাঈল গোত্র যালিম ফিরাঊন আর কিবতীদের মার খেতে খেতে কুকুরে শামিল হচ্ছিল, আর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে পরিত্রাণের আশায় প্রহর গুণছিল। ঠিক এমনি সময় একদিন আল্লাহ তায়ালা হুকুম করলেন- “ফাআস্রি বি ইবাদী লাইলান …।” হে মূসা (আ.) আমার প্রিয় বান্দাদের নিয়ে রাতের আঁধারে মিশর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে প্রস্থান কর। যে রজনীতে এ শুভ সূচনার পথ উদঘাটিত হয়েছিল, সমুদ্র চিড়ে আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাঈলকে যেদিন মুক্তির পথ করে দিয়েছিলেন সে দিনটি ছিল পবিত্র আশূরার দিন।
ধর্মসংশ্লিষ্ট প্রশ্নোত্তর বিভাগ “জিজ্ঞাসা-সমাধান” পড়ুন
বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ উমদাতুল ক্বারীর লিখক আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (রাহ্.)এর ভাষ্য অনুযায়ী দুর্বল সূত্রে বর্ণিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও আশূরা নাম করণের কারণ হিসেবে নিম্নরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। এদিনে আল্লাহ তায়ালা দশ জন নবীকে সম্মান দান করেছেন বলে এ দিনকে আশূরা বলা হয়।
এ পৃথিবীর অস্তিত্ব লাভের সঙ্গেও ১০ তারিখের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কেননা, এদিনেই আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন আসমান, যমীন, লওহ-কলম। শুধু যে পৃথিবীর সৃষ্টির সাথেই এ দিনের সম্পর্ক রয়েছে তা নয়, বরং পৃথিবীর লয়ের সঙ্গেও রয়েছে এদিনের সম্পর্ক। কেনা, ক্বিয়ামত এদিনেই সংঘটিত হবে। অতএব, মুহাররমের দশম দিনটি মুসলিম জাতির কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয়।
- নূহ (আ.)-এর কিশ্তী এদিন জুদী পর্বতে অবতরণ করে।
- ইউনূস (আ.)কে এদিন মাছের পেট থেকে মুক্ত করেছেন।
- হযরত ইকরামা (রাহ্.)-এর বর্ণনা মতে আল্লাহ তায়ালা এদিন হযরত আদম (আ.)এর তাওবা কবুল করেছেন।
- হযরত ইউসুফ (আ.)কে কূপ থেকে মুক্ত করেছেন।
- ঈসা (আ.) এদিন জন্ম লাভ করেন এবং এদিনেই তাকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়।
- এদিন দাঊদ (আ.)এর তাওবা কবুল করা হয়।
- এদিন ইব্রাহীম (আ.) জন্ম লাভ করেন।
- ইয়াকূব (আ.)কে দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের অগ্র-পশ্চাতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয় এদিনেই। তিনি বলেন, আইউব (আ.)কে রোগ মুক্তি দেওয়া হয় এবং সুলাইমান (আ.)কে বাদশাহী দান করা হয়। (উমদাতুল ক্বারী- ১১/১১৭-১৮)।
ইমাম আহমদ (রাহ্.) ইবনে আব্বাস (রাযি.) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় উপনীত হয়ে দেখলেন, পবিত্র আশূরার দিনে ইহুদীরা রোযা রাখছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এদিন তোমরা রোযা রেখেছ কেন? তারা বল্ল, এটি অত্যন্ত পবিত্র দিন। এদিন আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাঈলকে তাদের দুশমন ফিরাঊনের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। ফিরাঊন ও তার দলবলকে নীল নদে ডুবিয়ে চিরতরে খতম করে দিয়েছিলেন। এজন্য হযরত মূসা (আ.) এদিন রোযা রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মূসা (আ.)-এর সাথে তোমাদের চেয়ে আমরা অধিকতর হকদার। অতঃপর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম রোযা রাখলেন এবং সকলকে রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন। এ হাদীসটি বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, ইব্নে মাজাহ প্রভৃতি কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে। (তাফ্সীরে ইব্নে কাসীর-১/৫৭)।
এদিন দু’টো রোযা রাখা বিধেয়। এহেন নির্দেশের ব্যতিক্রম তথা একটি রোযা রাখাকে ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ মাকরূহ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। আদি যুগের বিদ্আত প্রথা এড়িয়ে মাকরূহ থেকে মুক্ত হওয়ার লক্ষ্যেই এ নির্দেশ জারি করা হয়েছে। যার উপকার ও ফযীলত সর্বজনের অন্তরে বিদ্যমান। আমাদের ইচ্ছানুযায়ী আমরা দশম দিনের সাথে নবম বা একাদশ এ দু’দিনের যে কোন একটি দিন যোগ করে রোযা রাখতে পারি। এক্ষেত্রে আমাদের মর্জিই বিধিসম্মত।
আবু হুরাইরা (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “রমযানের পর শ্রেষ্ঠতম রোযা হচ্ছে মুহাররম মাসের রোযা (অর্থাৎ আশূরার দিন)।” (মুসলিম থেকে মিশকাত শরীফ-১/১৭৮)।
ইব্নে আব্বাস (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, আশূরার রোযা ব্যতীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামকে কোন দিনের রোযার উপর অন্য কোন দিনের রোযাকে অধিকতর ফযীলতপূর্ণ বলে তালাশ করতে দেখিনি। (বুখারী, মুসলিম থেকে মিশকাত-১/১৭৮)।
ইব্নে আব্বাস (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম আশূরার রোযা রাখলেন এবং সকলকে রোযা রাখতে নির্দেশ দিলেন। সকলে বল্ল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এ দিনটিকে ইহুদী-নাসারারা সম্মান প্রদর্শন করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি আমি আগামী বৎসর জীবিত থাকি তাহলে ৯ই মুহাররমেও রোযা রাখব। (মুসলিম থেকে মিশকাত-১/১৭৯)।
আবু কাতাদাহ (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, এক দীর্ঘ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি আশাকরি আশূরার এক দিনের রোযা বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ করিয়ে দিবে। (মুসলিম থেকে মিশকাত-১/১৭৯)।
যাবের ইবনে সামুরাহ (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম আশূরার দিন রোযা রাখার জন্য নির্দেশ দিতেন, উৎসাহ দিতেন এবং খোঁজ খবর নিতেন। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পর আর কখনো আশূরার রোযা রাখার জন্য আমাদের নির্দেশ দিতেন না, উৎসাহ দিতেন না, খোঁজ খবরও নিতেন না। (মুসলিম, মিশকাত- ১/১৮০)।
আশুরার দিনের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বক্ষমান নিবন্ধে আলোচিত হাদীস ও ঘটনাবলী দ্বারা অতি সহজেই অনুমেয়। এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য কারবালার ঘটনার বহু পূর্ব যামানা থেকেই বিদ্যমান। কিন্তু রূঢ় হলেও সত্য, ঐতিহাসিক এ ঘটনাবলী না জানার কারণে শিয়া মতানুসারীদের ন্যায় অজ্ঞ লোকেরা আশূরার দিনকে কেবলমাত্র কারবালার ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত করে থাকে, অথচ এটা সম্পূর্ণ ভুল।
হ্যাঁ, ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনাও এ দিনেই সংঘটিত হয়েছিল; এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই বলে কারবালার ঘটনার সাথেই আশূরাকে শোভিত-সজ্জিত মনে করা নিছক অজ্ঞতা বৈকি?
এদিনের বর্জনীয় আমলসমূহ
কতিপয় প্রচলিত কু-সংস্কার ও শরীয়তে ইসলামিয়ায় নবাবিস্কৃত বিষয়; যা শিয়া ও নাসেবী সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত, তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা বক্ষমান নিবন্ধে স্থান দিতে প্রয়াস পাচ্ছি। দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায় যে, ইমাম হাসান-হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুমাকে উপলক্ষ করে হরেক রকম অমানবিক ও অযৌক্তিক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়ে থাকে। অথচ এ সবের অনুমোদন ইসলামী শরীয়তে কোনভাবেই খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং এসবের প্রতি নিন্দা-ধিক্কার আর অপছন্দই প্রকাশ পেয়েছে।
আশূরাকে উপলক্ষ করে সারা দেশে প্রচলিত জারিগান, পুঁথি পাঠ, হালুয়া-রুটি বিতরণ, কৃত্রিম শোকে মুহ্যমান হয়ে কালো কাপড় পরিধান, শূন্যপদে দিন কাটানো, মাথায় টুপি ব্যবহার না করে লাল কাপড় পেঁচানো, নিরামিশ ভোজন, লাগাতার কয়েকদিন ইমাম হাসান-হুসাইন (রাযি.)এর প্রতি অতিভক্তি দেখানোর অভিপ্রায়ে নিজ বক্ষে-পিঠে ছুরিকাঘাত করা, হায় হাসান! হায় হোসাইন! হায় আলী! ইত্যাদি বলে বিলাপ করা ও পরস্পরে রক্তারক্তির মাধ্যমে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে অলিক ও বিকৃত রূপে রূপায়িত করা।
এছাড়াও কথিত ‘হাফ্ত দানা’ পাকানো, মুরগী জবাই করে ‘ফাতিহা’ দেওয়া প্রভৃতি। এ ধরনের হাজারো প্রকার বিদ্আত ও কু-প্রথা নাসেবী শিয়াদের থেকে উদ্ভাবিত হয়ে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত হয়ে আছে। অতিব দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, আজ আমাদের আহ্লে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের দাবীদার মুসলিম সম্প্রদায় কর্তৃক অতি ধুমধাম ও গুরুত্ব সহকারে এসব কু-সংস্কার ও নবাবিস্কৃত বিষয়গুলোই পালনীয় ও বরণীয় হয়ে আসছে।
স্মর্তব্য যে, নবী দৌহিত্র হযরত হোসাইন (রাযি.) কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। ঈমানদার মাত্রই এহেন নির্মম ঘটনায় মর্মাহত হবেন এবং হওয়াটাই ঈমানের দাবী। নবীর উম্মত হয়ে নবী দৌহিত্রের নির্মম শাহাদাতে ব্যথিত হয় না, তাঁর মাগফিরাত কামনা করে না, তাঁর জন্য নবীর বাতলানো পন্থায় ঈসালে সাওয়াব করে না, সমবেদনা প্রকাশ করে না, শোকাহত হয় না এমন পাষুন্ড হৃদয়ের কল্পনাও করা যায় না। তবে যার মনে যেমন চায় তেমন করে শোক পালন করা এটা ইসলাম ও মুসলমানী নয়। বরং তা নির্ভেজাল প্রবৃত্তির দাসত্ব। আশূরা পালন, আশূরা উদযাপনের সঠিক ও নির্ভুল পদ্ধতি তো এটাই, যা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনুসৃত। এতে সংযোগ ও বিয়োগের কোন অবকাশ নেই। তা হচ্ছে ১০ তারিখে রোযা রাখা। ইহুদীদের সামঞ্জস্যতা এড়িয়ে যাবার জন্য ১০ তারিখের সাথে আরো একটি রোযা রাখা।
ইসলামের বিধান মতে আমরা এ দিনটিকে স্মরণ করি কি? মোটেই করি না। একথা আজ আমাদের দেশের হাল-অবস্থা দেখে নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়। ইসলাম যাকে অবৈধ জ্ঞানে বর্জন করতে বলেছে, আমরা তাকে বৈধ জ্ঞানে গ্রহণ করছি। এ দিনটিকে উপলক্ষ করে হাজারো কু-সংস্কার বিরাজ করছে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। নিতান্ত পরিতাপের বিষয় এ নিয়ে আমরা কখনো ভাবিনা। এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করার গরজই বোধ করিনা। অথচ খ্রীস্টান মিশনারীরা দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। এমনিভাবে কাদিয়ানী ও অন্যান্য বাতিল ফিরকার লোকেরা বিভিন্ন প্রকার প্রলোভন দিয়ে মানুষকে পথভ্রষ্ট ও আদর্শচ্যুত করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।
ইসলামের এহেন স্মরণীয় দিনগুলো মুসলমানী তরীকায় স্মরণ করার শিক্ষা জাতিকে সর্বাগ্রে দিতে হবে। সাথে সাথে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে এদিনের বর্জনীয় ও করণীয় দিকগুলোও তুলে ধরতে হবে জাতির সামনে। তবেই কু-সংস্কার মুক্ত সমাজ কায়েমে সক্ষম হব আমরা। মাহে মুহাররমের দশ তারিখকেই বলা হয় আশূরা। এ দিনের ফযীলত বিভিন্নগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। আশূরার দিন রোযা রাখা সুন্নাত, তার প্রমাণ বহন করছে হাদীসে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মুহাররমের ১০ তারিখ বহু বিস্ময়কর ঘটনাসমূহ সংঘটিত হয়েছে বলে পূর্ববর্তী সকল পয়গাম্বর ও তাঁদের উম্মতগণ মুহাররম মাসের ১০ তারিখ শুকরিয়া জ্ঞাপন স্বরূপ রোযা রাখতেন। এমন কি কোন কোন নবীর উম্মতের উপর উক্ত দিনের সিয়াম ফরযও করে দেওয়া হয়েছিল।
জ্ঞানী ও ডিগ্রীধারী বন্ধুদের বোধোদয় হোক। সাধারণ মানুষ যাই করুক না কেন, কোন জ্ঞানী ও শিক্ষিত ব্যক্তি যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশিত পথের বাইরে আমল না করে এটাই ঈমানের দাবী, এটাই ইসলামের দাবী। নিছক আনুষ্ঠানিকতা ও কৃত্রিমতা ইসলাম নয়। তা ইসলাম বহির্ভূত মনগড়া একটা রুসুম মাত্র।
পবিত্র মুার্হারাম মাস আরবী বছরের প্রথম মাস। এ মাসের নবভাস্কর নবদিগন্তের আমেজ নিয়ে উদয় হোক মুসলিম মিল্লাতের প্রতিটি জীবনে; এটা সকলেরই কামনা-বাসনা। কিন্তু গা ভাসিয়ে দিয়ে সব ধরনের প্রচলন ও কু-সংস্কারের স্রোতে ভেসে যেতে থাকলে কামনা- কামনাই থেকে যাবে। বাস্তবতার মুখ হবে ম্লান, হবে দীপ্তিহীন।
বিবেকবানদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা সারা বছর কোন নামায রোযা নেই, ইসলামী আহ্কাম নেই, মুহাররমের ১০ তারিখ ব্লেড বা ছুরি দিয়ে বুকে আঘাত করে তাতে গ্লিসারিন মেখে হায় হাসান! হায় হোসাইন! বলে বুকে চাপড় মারতে থাকলে কি নবী দৌহিত্র, আলীর দুলাল, ফাতিমার কলিজার টুকরা হযরত হাসান ও হযরত হুসাইনের প্রিয়ভাজন হওয়া যাবে? ঘন্টা কয়েক হায় হাসান! হায় হোসাইন! করা বা এ বিলাপ প্রত্যক্ষ করাই কি ঈমানের পরিচায়ক?
হযরত হোসাইন (রাযি.)এর ঘোড়া তো নেই। কাঠ, বাঁশ, কাপড় ও কাগজ দিয়ে একটা নির্জীব ঘোড়া বানিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ট্রাকের উপর চড়িয়ে ঘুরালে কি নেকীর মহড়া চলতে থাকবে? না, তা কখনই না। আচ্ছা বিলাপ করলে, জারী গাইলে এতে কি শহীদানে কারবালার আত্মার মাগফিরাত হবে? মোটেই না, তবে শিক্ষিত বিবেকবান হয়েও কেন সমূহ বাহুল্যতায় লিপ্ত হচ্ছে সমাজ? এর একটাই কারণ তা হচ্ছে, ইসলামী অনুশাসনের প্রতি উদাসিনতা ও বেপরোয়ায়ী। একটুখানি উদাসিনতার জন্য কতবড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে আজ মিল্লাতে মুহাম্মদী।
লেখক: প্রবীণ মুফতি ও মুহাদ্দিস, মুফতীয়ে আযম ফয়যুল্লাহ (রাহ.)এর শাগরিদে খাস এবং বিভাগীয় প্রধান- দারুল ইফতা, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/