দুনিয়াতে মহান আল্লাহ যুগে যুগে এমন কিছু বিশেষ ব্যক্তিত্ব প্রেরণ করেন, দ্বীনি খেদমত ও উম্মাহর কল্যাণে যাঁদের জ্ঞান, দক্ষতা, অক্লান্ত মেহনত যেমন ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে, তেমনি জগদ্বাসী যুগ যুগ ধরে উপকৃত হয়ে থাকেন। যাঁদের গৌরবময় কর্মগাঁথা প্রজন্মের পর প্রজন্ম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় হয়ে থাকে।
ফকীহুন নাফস আল্লামা আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (রহ.) ছিলেন এমনই এক মহান ব্যক্তিত্ব। গত ৮ সেপ্টেম্বর বুধবার ইলমের সূর্যতুল্য ক্ষণজন্মা এই মহান সাধক রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরকালের অন্তহীন পথে বিদায় নিয়েছেন।
এই মহামনীষী ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষার্জনের পর জামিয়া আজিজিয়া বাবুনগর ও জিরি মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। এরপর আরো উচ্চতর ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে বিখ্যাত জামিয়া আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী টাউনে ভর্তি হয়ে ইলমে হাদীস ও ফিকহের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেন। এ সময় তিনি ইসলামী আইনবিষয়ক গবেষণায় বিভিন্ন গ্রন্থের প্রায় চল্লিশ হাজার পৃষ্ঠার অধিক অধ্যয়ন করেছিলেন।
অধ্যয়ন শেষ হলে আল্লামা চাটগামী (রহ.)এর ইলমি দক্ষতা ও সৃজনশীল প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন মুফতিয়ে আযম আল্লামা ওলি হাসান টুংকি (রহ.)এর পরামর্শে আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী (রহ.) তাঁকে জামিয়া বিন্নুরী টাউনে সহকারী মুফতি পদে নিয়োগ দেন। তাঁর মেধা, দক্ষতা ও সাফল্যের ধারাবাহিকতায় অল্প দিনেই ফাতওয়া বিভাগের প্রধান নির্বাচিত হয়ে ধারাবাহিক ২৮ বছর তিনি এখানে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি করাচির বিখ্যাত শাব্বির আহমদ উসমানি (রহ.) জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্বও পালন করেছেন। মুফতি আব্দুচ্ছালাম চাটগামী প্রদত্ত বিপুল ফাতওয়া জামিয়া বিন্নুরী টাউনের ইফতা বিভাগে সংরক্ষিত আছে। জামিয়া বিন্নুরী টাউনের ইফতা বিভাগে প্রতি বছর ৮/৯ হাজারেরও অধিক ফাতওয়া জমা হতো। সে হিসাবে আড়াই লক্ষাধিক ফাতওয়া তাঁর তত্ত্বাবধানে এখানে লেখা হয়েছে।
২০০১ সালে আল্লামা আহমদ শফী (রহ.)এর আহ্বানে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করে দারুল উলূম হাটহাজারীতে মুফতি ও মুহাদ্দিস পদে যোগদান করে দারুল ইফতা, দাওরায়ে হাদীসসহ উচ্চতর শ্রেণীসমূহের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের দরস দেন। এ সময় আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) উলামায়ে কেরামের সর্বসম্মত মত নিয়ে তাঁকে মুফতিয়ে আযম বাংলাদেশ ঘোষণা দেন। দারুল উলূম হাটহাজারী থেকেও তাঁর তত্ত্বাবধানে অসংখ্য মূল্যবান ফাতওয়া প্রকাশিত হয়। তিনি বিভিন্ন দ্বীনিবিষয়ে ছোট-বড় ৩০টিরও অধিক গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর গবেষণাগ্রন্থগুলো উপমহাদেশসহ বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।
আরও পড়তে পারেন-
- পাশ্চাত্য শিক্ষা বনাম কওমী শিক্ষা
- করোনা মহামারি ও আমাদের করণীয়
- জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে
- দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা
- ইসলামে সংশয়প্রবণতা এবং সংক্রামক রোগ
২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)এর ইন্তিকালের পর দারুল উলূম হাটহাজারীর তিন সদস্যবিশিষ্ট সর্বোচ্চ পরিচালনা পরিষদের প্রধান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ইন্তিকালের অব্যবহিত পূর্বে মজলিসে শূরা তাঁকে দারুল উলূম হাটহাজারীর মহাপরিচালক নিযুক্ত করেছিলেন।
মুফতি আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (রহ.) অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইলমে নববীর শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন। আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের আরবদেশসমূহ, পাকিস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া, ব্রুনাইসহ বিশ্বের প্রায় সকল প্রান্তে তাঁর কাছে ইলম অর্জনকারী আলেমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দ্বীনি শিক্ষা এবং দাওয়াতে-দ্বীনের খেদম আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
ইলমে হাদীস ও ফিকহের মসনদে দরসদানের পাশাপাশি তিনি সারা জীবন দ্বীনের বহুমুখী অঙ্গনে খেদমত করে গেছেন। ধর্মীয় বিভিন্ন জটিল ও কঠিন বিষয়ে প্রজ্ঞাপূর্ণ সুন্দর সমাধানসহ তিনি হাজার হাজার ফাতওয়া লিখে যান। সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তি জীবনের দৈনন্দিন নানা প্রশ্ন, সঙ্কট, দাম্পত্য সমস্যা, দেনমোহর, নারী অধিকার, সুদনির্ভর ব্যবসা, ব্যাংক, বীমা, ইসলামী অর্থনীতি, হুন্ডি, এমএলএম ও শেয়ার ব্যবসা এবং মানবদেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় ও প্রতিস্থাপন প্রভৃতি আধুনিক বিষয় নিয়ে তিনি মূল্যবান ফাতওয়া, গবেষণামূলক প্রতিবেদন এবং বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। করোনা মহামারিতে মসজিদ-মাদ্রাসা বন্ধ রাখা বিষয়ে তাঁর মূল্যবান ফাতওয়া বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের আলেম সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশিকা হিসেবে সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়েছে।
বিশ্বনন্দিত হাদিসবিশারদ সিরিয়ার শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ (রহ.) চাটগামী (রহ.)এর কাছ থেকে হাদিসের ইজাযত গ্রহণ করেন। অন্যদিকে একই সময় শায়খ আবু গুদ্দাহ (রহ.)ও চাটগামী (রহ.)এর থেকে ইজাযত গ্রহণ করেন। এ থেকে যেমন শায়খ আবু গুদ্দাহ (রহ.)এর বিশালত্বের পরিচয় মেলে, তেমনি চাটগামী (রহ.)এর উচ্চ ইলমি মাকামও অনুমান করা যায়।
হযরত চাটগামী (রহ.) আধ্যাত্মিকতায় বুৎপতি অর্জনের লক্ষ্যে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে হযরত শাহ আবদুল আযীয রায়পুরী (রহ.), মাওলানা ইয়াহইয়া ভাওয়ালনগরী (রহ.), মাওলানা শাহ সুলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.) এবং মুফতিয়ে আযম আহমাদুল হক (রহ.)এর সহচর্য গ্রহণ ও খেলাফতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
আল্লামা মুফতি আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (রাহ.) ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ, সাদাসিধে চালচলন ও নিভৃতচারী উঁচুমাপের ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি সুন্নাতের কঠোর পাবন্দ ছিলেন। ইসলামী আইনের মৌলিক গবেষক ও অনুসন্ধিৎসু ফকিহ ছিলেন। শিক্ষক, কর্মকর্তা, ছাত্র ও সাধারণ মানুষসহ সকলের সাথে তিনি উত্তম আচরণ ও মাধুর্যপূর্ণভাবে কথা বলতেন। সমসাময়িক সময়ে তিনি এমন উঁচুস্তরের আলেম ও মুফতি ছিলেন যে, দ্বীনি যে কোন বিষয়ে তাঁর মতামত ও বক্তব্যের সাথে কেউই দ্বিমত করার সুযোগ ও সাহস পেতেন না। তাঁর ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইলমি অঙ্গনের এক উজ্জ্বল প্রদীপ নিভে গেল। যাঁর ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিক্বহের জ্ঞান অন্তহীন সমুদ্রের মতো গভীর ও সূর্যের মতো দ্যুতি ছড়াতো। তার শূন্যস্থান পূরণ হতে বহু দিন সময় লাগবে।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন হযরতকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদেরকে দ্বীনের বহুমুখী খিদমত আঞ্জামদান এবং তাঁর মিশন ও ভিশনকে এগিয়ে নিতে বহু যোগ্য আলেম ও দায়ী তৈরি করে দিন; আমিন।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/