[মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.)। যার নামই তাঁর পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের কৃতি সন্তান। বিশ^বিখ্যাত তাফসীর মাআরিফুল কুরআনের লেখক। হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলি থানভি (রহ.)এর খলিফা। ইমাম আনোওয়ার শাহ কাশ্মীরি (রহ.)এর হাতেগড়া ছাত্র। উপমহাদেশের অন্যতম ফিকহবিদ, বুযূর্গ ব্যক্তিত্ব। ১৮৯৭ সালে ঐতিহাসিক দেওবন্দের এক দ্বীনি ও ইলমি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা ইয়াসীন (রহ.) ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষক। দারুল উলূমের চৌহদ্দিতে তাঁর শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন অতিবাহিত হয়। মকতব থেকে নিয়ে সমাপনী পর্যন্ত দারুল উলূমের যুগশ্রেষ্ঠ আলেম-বুজুর্গদের সান্নিধ্যে থেকেছেন। পড়াশোনা শেষে দারুল উলূমের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এরপর জীবনের বড় একটি অংশ দারুল উলূমের প্রধান মুফতি এবং সিনিয়র মুহাদ্দিস হিসেবে খেদমত করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর তিনি দেওবন্দ থেকে করাচি হিজরত করেন। পাকিস্তানের সংবিধান রচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। প্রতিষ্ঠা করেন উপমহাদেশের অন্যতম দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম করাচি। তাফসীর, হাদীস এবং ফিকহ বিষয়ে তাঁর শতাধিক রচনা সামগ্রী রয়েছে। তিনি পাকিস্তানের প্রধান মুফতিও ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তাঁর ইনতেকাল হয়। আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন। তাঁর ইনতেকালের মাত্র ৩ বছর আগে ১৯৭২ইং সালে জীবনভিত্তিক এই দুর্লভ ইলমি সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পাকিস্তানের এক সাংবাদিক। কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে মূল্যবান সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন, মুফতি মোবারক হোসাইন। – সম্পাদক]
# মুফতি সাহেব, অনুগ্রহ করে আপনার প্রাথমিক শিক্ষাবিষয়ে কিছু আলোকপাত করুন। কখন থেকে লেখা পড়া শুরু করলেন এবং কোথায় কোথায় ও কোন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা অর্জন করলেন?
# বাস্তব অবস্থা হলো আমি একজন অযোগ্য ব্যক্তি, কোন ধরনের যোগ্যতা আমার মাঝে নাই, তবে আল্লাহ তাআলার অসংখ্য, অগণিত অনুগ্রহ আমার উপর হয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ হলো, আল্লাহ তাআলা আমাকে এক মুসলমান, দ্বীনদার ও ইলমি পরিবারে পাঠিয়েছেন। আমি এমন জায়গায় চোখ খুলেছি যেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দ্বীনি চর্চা চলত। দ্বীনি আলোচনা কানে আসতো। ছোটবেলায় বুযূর্গদের ঘটনা শুনতাম। আমি আমার শৈশবে খেলাধুলা করেছি দারুল উলূম দেওবন্দের চৌহদ্দিতে। যেখানে আসা-যাওয়া ও চলাফেরার সময় সবদিকেই আল্লাহর ওলীদেরকে চোখে পড়তো। এটা ছিল আমার শৈশবকাল। যেহেতু আমার আব্বাজান দারুল উলূমের শিক্ষক ছিলেন, তাই প্রায়শ তাঁর কাছে থাকতাম। অতঃপর দারুল উলূম দেওবন্দেই হাফিজ আব্দুল আজিম সাহেব (রহ.)এর কাছ থেকে আমি শিক্ষা অর্জন শুরু করলাম। তিনি একজন বুজুর্গ হাফিজ ছিল। আমার হিফজুল কুরআনের শিক্ষক ছিলেন। আমার স্মরণ আছে, আব্বাজানের কাছে হযরত (রশিদ আহমদ) গাঙ্গুহী (রহ.)এর চিঠি আসতো। এক চিঠিতে তিনি আমার সর্ম্পকে লিখেছিলেন, ‘নতুন সন্তানের আগমনে অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। তার নাম মুহাম্মদ শফী রাখবে’। এরপর আমি যখন কুরআন শিক্ষা শুরু করি আরো একটি চিঠি আসলো, ‘আমি দুআ করছি আল্লাহ তাআলা তাকে ইলম দান করবেন’।
আমার শিক্ষার সূচনা এখান থেকেই হয়েছিল। হযরত গাঙ্গুহী (রহ.)এর দুআ এবং হাফিজ আব্দুল আজিম সাহেব (রহ.)এর সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ আমার হয়েছে। তিনি একজন ফেরেশতাসূলভ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। কিছু দিনের মধ্যে তাঁর ইনতেকাল হয়ে গেলে আমি অন্য শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে চলে যাই এবং আমি কুরআন মাজিদ হিফজ শেষ করি। এরপর আমার আব্বাজানের কাছে ফার্সী ও গণিত বিষয়ের কিতাব পড়াশোনা শুরু করি এবং তাঁর কাছে থেকেই ফার্সীর ছাত্র থাকাকালীন আরবির প্রাথমিক কিতাব পড়া শুরু করি। তখন আনুমানিক ১৩৩০ হিজরী। আমার বয়স চৌদ্দ কিংবা পনেরো হবে। সে সময় আমি দারুল উলূম দেওবন্দে আরবি বিভাগে ভর্তি হই। এটা সেই সময়ের কথা যখন শাইখুল হিন্দ (রহ.) দারুল উলূম দেওবন্দে বুখারী পড়াতেন। আমি তো নিয়মতান্ত্রিক তাঁর কাছ থেকে সবক পড়ার উপযুক্ত ছিলাম না। শিশু শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষার্থী ছিলাম। কিন্তু মাদ্রাসার এরকম নিয়ম ছিল যে, যখন শাইখুল হিন্দ (রহ.) বুখারির প্রথম দরস দিতেন, তখন সকলে একত্রিত হয়ে যেতো এবং শেষ করার সময়ও একত্রিত হতো। এভাবে বুখারী শরীফের প্রথম হাদীস ও শেষ হাদীস বার বার শাইখুল হিন্দ থেকে পড়ার সুযোগ হয়েছে।
এর চেয়ে বেশি কিছু হযরত শাইখুল হিন্দ থেকে পড়ার উপযুক্ত বয়স হয়ে ওঠেনি। কিন্তু বুযূর্গদের সাহচর্য যেহেতু শিশুকাল থেকেই পেয়েছি, তাই শিশুদের সাধারণ খেলাধুলার প্রতি আমার আগ্রহ হয়নি। যখনি আমি সময় পেতাম শাইখুল হিন্দ (রহ.)এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে যেতাম। আমার শৈশবের খেলাধুলার সময় এভাবে অতিবাহিত হতো। হযরত শাইখুল হিন্দও আমার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। এটি ঐ সময়ের কথা যখন খেলাফতে উসমানিয়া বিলুপ্তির কাছাকাছি ছিল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামী খেলাফতের উপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। ঐ সময়ে আমি অনুভব করতাম যে, হযরত শাইখুল হিন্দ (রহ.) অনেক অস্থির থাকতেন এবং নিজের দরস-তাদরীসেও এতে কিছুটা ঘাটতি আসে। অধিকাংশ সময় পত্র-পত্রিকা পড়তেন এবং এ বিষয়ক আলোচনা করতেন। আমি ছোট ছিলাম বিধায় ততোটা বুঝতাম না। তবে লক্ষ করতাম যে, শাইখুল হিন্দ কোনো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত আছেন। আমার পক্ষে এর চেয়ে বেশি বুঝার যোগ্যতাও ছিল না।
শাইখুল হিন্দ (রহ.) কিছু দিন পর আমাদেরকে এই বলে সফরের ইচ্ছে প্রকাশ করেন যে, আমি হজ্জে যাচ্ছি। সাধারণ ঘোষণা এটাই ছিল। আমরা সবাই এ বলে কান্নাকাটি করতেছি যে, আমাদের হযরত এ সময় হজ্জে যাচ্ছেন। তাঁর এখন বার্ধক্যের সময় চলছে। জানি না তিনি ফিরে আসবেন কিনা! এছাড়া আর কোনো খবর ছিল না। এরপর আমরা খবর পেলাম যে, পবিত্র মক্কায় শাইখুলহিন্দকে ইংরেজরা গ্রেফতার করে। গ্রেফতার করে মাল্টার জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। চার বছর পর্যন্ত তিনি মাল্টার জেলে বন্দি জীবন অতিবাহিত করেন। আল্লাহ তাআলার হাজার শুকরিয়া ও অনুগ্রহ যে, হযরত যখন ফিরে আসেন তখন আমার দরসী পড়ালেখা প্রায় শেষ পর্যায়ে। হযরত ফিরে আসার পর পূর্বের মতো হযরতের খেদমতে উপস্থিত হতাম। তবে তা খুবই অল্প সময়ের হতো। কারণ, জেল থেকে ফিরে আসার পর বেশির ভাগ সময় হযরত অসুস্থ থাকতেন। অত্যন্ত দুর্বল ছিল। তারপরও যতটা সময় পাওয়া যেতো হযরতের খেদমতেই উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতাম।
নিয়মতান্ত্রিক আমার পড়ালেখা দেওবন্দে অন্যান্য উস্তাদ থেকে হয়েছে। যার মধ্যে তখনকার সদরুল মুদাররিসীন হযরত আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.), মাওলানা সাইয়েদ আসগর হোসাইন সাহেব (রহ.), মুফতি আজিজুর রহমান সাহেব (রহ.), মাওলানা ইজাজ আলী সাহেব (রহ.), মাওলানা মুহাম্মদ ইব্রাহিম সাহেব (রহ.), মাওলানা রসূল খান সাহেব (রহ.)। তাঁরা আমার উস্তাদ, যাদের থেকে আমার ধারাবাহিক শিক্ষা লাভ হয়েছে। হযরত মাওলানা আসগর হোসাইন সাহেব রহ. যিনি জন্মগত ওলী ছিলেন। আমার প্রতি তাঁর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। তাঁর থেকে আমার অনেক সবক পড়ার সুযোগ হয়েছে। শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.) আমার ফুফাতো ভাই ছিল, আবার আমার উস্তাদও। তাঁর কাছে অনেক কিতাব পড়ার সুযোগ হয়েছে। পরে যখন তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নেন, তখন তাঁর সাথে অনেক সফর করার ও বিভিন্ন কাজে অংশ গ্রহণের সুযোগ হয়। আল্লাহ তাআলা এসকল বুজুর্গদের সুনজরে আমার পড়ালেখা সমাপ্ত করার তাওফিক দান করেন।
১৩৩৬ হিজরীতে আমি সকল বিষয়ে পড়াশোনা সমাপ্ত করে দারুল উলূমেই আমাকে কিছু প্রাথমিক কিতাব পড়ানোর জন্য দেয়া হয়েছে। ১৩৩৬ হিজরী থেকে আমি লাগাতার শিক্ষকতার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। নিজের উস্তাদদের সান্নিধ্যে থেকে শিক্ষকতার কাজ আঞ্জাম দিয়েছি। ঐ সময়ে হযরতুল উস্তাদ মুফতি আজিজুর রহমান সাহেব ইনতেকাল করেন। তখন দারুল উলূমে দারুল ইফতার প্রধানের পদ খালি হলে তার জন্য প্রাথমিকভাবে অন্য কয়েকজন উস্তাদ নির্বাচন করা হল। কিন্তু এক দুই বছর পরে বুজুর্গানে দেওবন্দ বিশেষ করে মাওলানা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) যার ঐ সময় কাজের ময়দানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল। আবার তিনিই তখন সদরুল মুদাররিসীন ছিলেন। তাঁরা সকলে পরামর্শ করে আমাকে দারুল ইফতার প্রধান মুফতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ১৩৪৯ হিজরী থেকে ইফতার খেদমতে নিয়োজিত হলাম এবং তার সাথে সাথে হাদীসের কিতাব আবুদাউদ শরীফও আমার জিম্মায় ছিল, তা পড়াচ্ছিলাম। এভাবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হল, যেখানে আমার বেশিরভাগ সময় ফতোয়ার কাজে অতিবাহিত হয়েছে। যতটা মনে পড়ে, প্রায় চল্লিশ হাজার ফতোয়া আমি নিজেই লিখেছি। যেগুলো দারুল উলূমের রেজিস্টারে সংরক্ষিত আছে।
এরপর নতুনভাবে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হল। এবং ঘটনাক্রমে দারুল উলূম দেওবন্দে রাজনৈতিক চিন্তাধারার ধাক্কা লাগে। উলামায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কংগ্রেসের রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। আমি এবং মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানীসহ আরো কিছু উলামায়ে কেরাম হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ.)এর তত্ত্বাবধানে মুসলিম লীগ তথা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলাম। যখন দুই রাজনৈতিক চিন্তাধারা দারুল উলূমে সংঘর্ষ বাঁধে তখন শেষ পর্যন্ত আমরা দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে বিদায় নেওয়া ভালো মনে করলাম। দারুল উলূম থেকে অব্যাহতি নিয়ে স্থায়ীভাবে পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হই। হিন্দুস্থানের মাদ্রাজ থেকে করাচী পর্যন্ত লাগাতার সফর করতাম। বিভিন্ন শহরে সভা সমাবেশ চলছিল। শেষ পর্যন্ত সীমান্ত প্রদেশের রিফরান্ডামে মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.)এর সাথে ছয় জেলা শহরে ব্যাপকভাবে সফর করি। অবশেষে কাক্সিক্ষত সফলতা আসে এবং আল্লাহ তাআলা নতুন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান দান করেন।
যেদিন পাকিস্তানের জন্ম হয়, সেই রাত্রেই মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.) পাকিস্তান পৌঁছে যান। এদিকে আমি সে সময় দেওবন্দে রয়ে গেলাম। আমার বিছানা-পত্র বাঁধা ছিল। আমার খেয়াল ছিল, আমি পাকিস্তান পৌঁছে যাবো। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথে পূর্ব পাঞ্জাবে যে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, তার কারণে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং আসা যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আট মাস পর হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী সাহেবের আগ্রহে আমি পাকিস্তান চলে আসি।
ঐ সময় আমাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল, ইসলামী হুকুমতের একটি নকশা তৈরি করা। যার জন্য হিন্দুস্থান থেকে আমাকে, মাওলানা সাইয়েদ সুলাইমান সাহেব নদভী, ড. হামিদুল্লাহ সাহেব হায়দরাবাদ এবং মাওলানা মুনাজির আহসান গিলানীকে ডেকে আনা হয়। তাদের মধ্যে মাওলানা মুনাজিরে আহসান গিলানি, ড. হামিদুল্লাহ আর আমি অধম এক সাথে পাকিস্তান পৌঁছি। অন্যদিকে মাওলানা সাইয়েদ সুলাইমান সাহেব নদভী কিছুদিন পরে এসে পৌঁছান। যাহোক আমরা সবাই একত্রিত হয়ে সংবিধানের একটা খসড়া তৈরি করলাম। তবে তা নিয়মতান্ত্রিকভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ হয়নি। এভাবে সম্ভবত ১৩৪৯ হিজরী সনে যখন সংবিধান রচনার এসেম্ব্যালি তৈরি হল এবং তার সাথে ‘তালিমাতে ইসলামী’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর জন্য মাওলানা উসমানী সাহেবকে সদস্য নির্বাচনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি তাতে আমার নামও প্রস্তাব করলেন এবং উপরে উল্লিখিত ব্যক্তিগণের নামও। তাদের মধ্যে অধিকাংশ হযরতই উপস্থিত ছিলেন। তারা চার বছর লাগাতার চেষ্টা করে একটি সংবিধান তৈরি করলেন, যা পরিষদ সদস্যদেরকে দেওয়া হল। ঐ সংবিধানের প্রথম অংশ Ñযা মৌলিক উদ্দেশ্য শিরোনামে প্রসিদ্ধ- শাইখুল ইসলাম হযরত শাব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.) নিজেই উপস্থাপন করেন। তা এমনই মৌলিক সংবিধান ছিল যে, তা ঐক্যবদ্ধভাবে পরিষদ সদস্যরা গ্রহণ করে নিয়েছেন এবং আজ পর্যন্ত তা অন্তর্ভুক্ত আছে। তবে আমাদের আরো কিছু প্রস্তাবনা যা মরহুম লিয়াকত আলী সাহেবের ইনতেকালের পরে কিছু রাজনৈতিক সমস্যার মুখে পড়ে। আমাদের জানা নেই, তা পরবর্তীতে অটূট ছিল কি না। যাহোক আমরা পাকিস্তান এসে প্রথমে এই উদ্দেশ্যে অগ্রসর হই যে, এখানে ইসলামী সংবিধান ও নিয়মনীতি চালু হোক, সেজন্য নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
দ্বিতীয় কাজ আমাদের সামনে এটা ছিল যে, এখানে রাজনৈতিকভাবে যে দলগুলো কাজ করছে ‘জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম’ নামে পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার সভাপতি মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.) ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এই সংগঠনের অনেক বড় ভূমিকা ছিল। একটি উদ্দেশ্য এটাও ছিল যে, এই দলটি যেকোনভাবে সচল থাকুক এবং ভবিষ্যতে পাকিস্তান পুনর্গঠনে তা কাজ করে যাবে। তার জন্য এক সময় অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তবে এই মেহনত কোন কাজে আসেনি।
আরও পড়তে পারেন-
- কওমি মাদ্রাসা: সামাজিক পুঁজি ও দারিদ্র্য বিমোচন
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
- সুখময় দাম্পত্য জীবনের নববী রূপরেখা
তৃতীয় আরেকটি উদ্দেশ্য এ ছিল যে, যখন আমরা দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে চলে আসি, তখন আমাদের সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয় ছিল এই যে, এমন একটি ইলমের কেন্দ্র আমরা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, যার মতো প্রতিষ্ঠান শুধু হিন্দুস্থান কেন, সারা পৃথিবীতেও বিরল। তার মতো বা কাছাকাছি কোন দরসগাহ নাই। বিশেষ করে আমরা যে এলাকায় চলে আসলাম তথা করাচীতে, এখানে একটি ছোট্ট মাদ্রাসা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ঐ সময় আমাদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল যে, পাকিস্তানের অবস্থা অনুযায়ী করাচীর মতো কেন্দ্রীয় স্থানে এখানকার পরিবেশ ও অবস্থার প্রতি খেয়াল রেখে আরেকটি কেন্দ্রীয় দারুল উলূম প্রতিষ্ঠা করা হোক। এ প্রচেষ্টা হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.) নিজের জীবদ্দশায় শুরু করেছিলেন। আমিও তাতে উপস্থিত থাকতাম। কিন্তু সময়ের নির্মম পরিহাস, মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.) খুব দ্রুত সময়ে ইনতেকাল করেন। কিছুদিন পর আমরা নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানে রয়ে গেলাম। তবে হযরতের ইনতেকালের পরে আমাদের এ সম্ভাবনা আরো শক্তিশালী হতে লাগলো যে, এখানে একটি কেন্দ্রীয় দারুল উলূম প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে কিছু কাজ করা হয়েছে, যাতে আলহামদুলিল্লাহ সফল হয়েছি। আল্লাহর শুকরিয়া যে, আজ বাইশ বছর হয়ে গেল, এ দারুল উলূম (করাচি) প্রতিষ্ঠার। যা দিন দিন উন্নতি লাভ করে চলেছে।
# মুফতি সাহেব! আমি আপনার কাছে শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান (রহ.) সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চাই, যা আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান পাথেয় হবে। কেননা, তিনি বড় আলেমে-দ্বীন ও মুজাহিদ ছিলেন। তার সম্পর্কে আরো দুই চার বাক্যে কিছু বললে আমাদের জন্য অনেক উপকার হতো।
# তাঁর জিবনী নিয়ে অবশ্য দুটি বই লেখা হয়েছে। একটি মাওলানা সাইয়েদ আসগর হোসাইন সাহেবের লিখিত “হায়াতে শাইখুলহিন্দ রহ.”। দ্বিতীয়টি মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী সাহেব রহ. এর লিখিত “আসিরে মাল্টা”। আমি ঐ সময় যেহেতু একেবারে অল্প বয়সের ছিলাম, তাই বেশি কিছু বুঝার উপযুক্ত হইনি। তবে আপনি যে বলেছিলেন, তিনি একজন মুজাহিদ, তার একটি ঘটনা আমার এখন মনে পড়ল। আমি যেহেতু ছোট্ট ছিলাম, তাই আমার জন্য কোন বাঁধা ছিল না। আমি একদিন দুপুরে শাইখুলহিন্দ (রহ.)এর রুমে ঢুকে পড়ি। তখন আমি এক আশ্চর্য অবস্থা দেখলাম যে, শাইখুলহিন্দ (রহ.) একা একা খাটের উপর বসে আছেন, আর তরবারি হাতের মধ্যে নিয়ে তা ঘুরাচ্ছেন। আমাকে দেখে হযরত হেসে দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হযরত কী হচ্ছে? তখন তিনি বললেন, ‘ভাই তরবারিটি পুরনো হয়ে গিয়েছিল। আজ তা ঘঁষে পরিস্কার ও ধারালো করে আনলাম। ভাবলাম একটু চালিয়ে দেখি। এর মধ্যে অনেক আগ্রহ ও মজা লাগে। যখন তা হাতে নিই তখন এক ধরনের আবেগ সৃষ্টি হয়’।
এই দৃশ্য আমি দেখলাম একাকীত্ব অবস্থায়। এটি ঐ সময়ের কথা- যখন হযরত শাইখুল হিন্দ এর অন্তরে জিহাদের চেতনা অনেক বেড়ে যায় এবং তিনি চাইতেন যে, এখানে ইংরেজদের ক্ষমতা ধ্বংস করে দিয়ে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হোক। এ উপলক্ষে তিনি কাবুল থেকে তুর্কি পর্যন্ত ময়দান করায়ত্ত করে নিয়েছেন। গোপনে তার গোয়েন্দা তুর্কি পর্যন্ত এবং কাবুল পৌঁছে যায়। ময়দান সম্পূর্ণ তাঁর আয়ত্তে নিয়ে আসেন। বিস্তারিত আলোচনার দিকে যাওয়ার তো সময় নেই। তবে এ কথা ইংরেজরাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যা এ বিষয়ে প্রকাশিত বইয়ে উল্লেখ আছে। যখন ইংরেজ প্রতিনিধি তাঁর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেয়ার জন্য মাল্টা জেলে তার জিজ্ঞাসাবাদে গিয়েছিল, তার প্রতিবেদনে এ কথা ছিল যে, আমি আশ্চর্য ও হতবাক হয়ে অনুভব করি, এই সাধারণ লোক, যিনি তার জীবনের সম্পূর্ণ সময় মাদ্রাসার চার দেয়ালের ভেতরে অতিবাহিত করেছেন, তার মাথায় বৈশ্বিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার এই প্লান কীভাবে আসলো! এবং এটি শতভাগ সত্য যে, যদি তার এ পরিকল্পনা আমাদের হাতে না আসতো, তাহলে হিন্দুস্থান আমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতো। এটি ঐ ইংরেজ জওয়ানের বর্ণনা। আর বাস্তবতাও এমন ছিল যে, হযরত শাইখুল হিন্দ (রহ.) তুরস্ক থেকে কাবুলের রাস্তা পর্যন্ত সমস্ত ইসলামি রাষ্ট্রগুলো এক রশিতে নিয়ে এসেছিলেন। তার খবর গোয়েন্দারা পেয়ে যায়। যার দরুন শাইখুল হিন্দকে গ্রেফতার করা হয় এবং সেই আন্দোলন থেমে যায়।
#আমি যদি বলি, এই আন্দোলন জামালুদ্দিন আফগানির আন্দোলনকে বেগবান করার আন্দোলন ছিল, তাহলে আপনি কি বলবেন?
# কোন সন্দেহ নেই। যেহেতু এই বুজুর্গদের লক্ষ্যবস্তু ছিল কুরআন ও সুন্নাহ কায়েম। সুতরাং এটি মূলত কুরআনের আন্দোলন। যার ঝান্ডা কখনো জামালুদ্দিন আফগানি, আবার কখনো শাহ ইসমাইল শহিদ, কখনো হযরত শাইখুলহিন্দ (রহ.) উঠিয়েছেন এবং তাঁর পরে সর্বশেষ শাইখুল ইসলাম হযরত শাব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.) কায়েদে আজমের নেতৃত্ব উঠিয়েছেন।
# মুফতী সাহেব, সর্বশেষ প্রশ্ন লেখালেখি প্রসঙ্গে। আপনার লেখালেখি সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
# আমি শুরু থেকেই যে সকল উস্তাদদের কাছে বড় হয়েছি, তাদেরকে আমি দেখেছি। তারা শুধু দরসের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন না; বরং কিছু লেখালেখির কাজও করতেন। তাদের দেখাদেখি আমারও লেখালেখির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে এবং পড়াপড়ির ফাঁকে ফাঁকে কিছু ছোট ছোট পুস্তক লিখা শুরু করি। এরপর এ ধারাবাহিকতা অনেক বড় হতে লাগলো। বর্তমানে আমার লিখিত বইয়ের সংখ্যা দেড়শোর মতো হবে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় রচনা- যা এইমাত্র তৈরি হয়েছে- তা হলো তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন। এই তাফসীরের একটি বিশেষ এবং বিস্ময়কর দিক হল, এর সূচনা হয়েছিল রেডিওর দরস থেকে। কিন্তু রেডিওর মধ্যে ধারাবাহিক কুরআন ছিল না; বরং কিছু নির্বাচিত আয়াত পড়া হতো। অতপর যখন তা গ্রন্থ আকারে বের করার ইচ্ছা হলো, তখন আমার অবস্থা এমন ছিল যে, বিছানা থেকে উঠা সম্ভবপর হচ্ছিলো না। আমার আফসোস হচ্ছিল, যে পৃষ্ঠাগুলো লেখা হলো, সেগুলো এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে মনে হয়! যদি মাঝে মাঝে রেখে যাওয়া আয়াতগুলোসহ লেখা হয়ে যেতো তাহলে প্রকাশিত হয়ে যেতো!
ঐ অসুস্থতার সময়ে আল্লাহ তাআলা অন্তরে এ খেয়াল ঢেলে দিলেন যে, অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে শুয়ে কিছু কাজ আরম্ভ করা যাক। সে সময়ে এ কাজ শুরু হলো এবং আলহামদুলিল্লাহ পাঁচ বছর সময়ে -যা সবচেয়ে বেশি অসুস্থতার সময় ছিল আবার দেশে বিভিন্ন ধরনের ফিতনার সময় ছিল, এমনই অবস্থায় আল্লাহ তাআলা এর রচনা পরিপূর্ণ করিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ সর্বমোট আট খন্ডে ছেপে প্রস্তুত হয়ে গেছে। এ ছাড়াও আরও কিছু ছোট বড় বই লেখালেখি হচ্ছিল, যার বিস্তারিত আলোচনা লম্বা সময়ের ব্যাপার।
শ্রুতিলিখন ও অনুবাদ (সংক্ষেপিত): মুফতি মোবারক হোসাইন
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/