মুফতী আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (রহ.): ফিকহে ইসলামীর নিভৃতচারী এক মহান সাধকের বিদায়

।। মাওলানা ইসহাক ওমর কাসেমী ।।

কিয়ামতের অন্যতম একটি আলামত হচ্ছে ইলম উঠে যাওয়া। কিয়ামতের পূর্বে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া থেকে ইলম উঠিয়ে নিবেন। আর এই ইলমকে উঠিয়ে নিবেন উলামায়ে কেরামকে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إن الله لا يقبض العلم انتزاعا ينتزعه من العباد، ولكن يقبض العلم بقبض العلماء

আল্লাহ তাআলা ইলমকে ছিনিয়ে নিবেন না; বরং উলামায়ে কেরামকে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলম উঠিয়ে নিবেন…”। (সহীহ বুখারী. হাদীস- ১০০)।

অন্য এক হাদীসে বর্ণিত আছে, যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

يذهب الصالحون، الأول فالأول، ويبقى حفالة كحفالة الشعير، أو التمر، لا يباليهم الله بالة.

সালেহীন নেককার বান্দাগণ একের পর এক চলে যাবেন। আর অবশিষ্টরা যব ও খেজুরের অব্যবহার্য অংশের মতো পড়ে থাকবে। আল্লাহ এদের প্রতি গ্রাহ্যও করবেন না”। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ৬৪৩৪)।

নবীজী (সা.)এর এসব হাদীসকে সামনে রেখে আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হবে, এই হাদীসসমূহ বুঝি আমাদের যমানার জন্যই নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন। বিগত এক-দেড় বছরে উপমহাদেশে আমরা যে হারে উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং মূল্যবান সম্পদÑউলামায়ে কেরামকে হারিয়েছি, ইলমি মসনদগুলো যে হারে তার যোগ্য উত্তরসূরীদেরকে হারিয়েছে, তা ভাবতেই নিজেদের নিঃস ও এতিম মনে হয়। জানি না কোন বিপর্যয় আমাদের পিছু নিয়েছে। বিগত দেড় বছরে আমরা যেসব শীর্ষ উলামায়ে কেরামকে হারিয়েছি, তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ আখেরাতের পথে মুসাফির হলেন, উপমহাদেশের বিখ্যাত ইসলামী আইন বিশারদ, ফকীহুন নাফস, দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর সম্মানিত মহাপরিচালক, মুফতিয়ে আযম বাংলাদেশ আল্লামা আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (রহ.)।

মুফতী আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (রহ.) সেসব মনীষীদের অন্যতম, উপমহাদেশে ইসলামী আইনশাস্ত্রের নেতৃত্ব যাদের হাতে ন্যস্ত ছিল। হযরত (রহ.) ছিলেন সাদাসিধে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত নিভৃতচারী একজন সাধক, যাঁকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হতো। যাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল নববী সুন্নাত অনুসরণের এক অনুপম নিদর্শন। যাঁর তাকওয়া ও খাশিয়াত আমাদেরকে সালাফের যুগ স্মরণ করিয়ে দেয়।

গত ২৯ মুহাররম ১৪৪৩ হিজরী (৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ খ্রিস্টাব্দ) রোজ বুধবার বেলা ১১টায় সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে তিনি প্রিয় রবের সান্নিধ্যে চলে যান। ইন্তিকালের সময় হযরত (রহ.)এর বয়স ছিল প্রায় ৭৮ বছর। ইন্তিকালের মাত্র কয়েক মিনিট পূর্বে জামিয়ার সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম (মজলিশে শূরা) কর্তৃক তিনি মহাপরিচালক নিযুক্ত হয়েছিলেন। আল্লাহর কী শান! জামিয়া দারুল উলূম হাটহাজারীর মহাপরিচালক নিযুক্ত হওয়ার কয়েক মিনিটের মাথায় তিনি মহান রবের দরবারে হাজির হয়ে গেলেন। তাঁর ইন্তিকালের মধ্য দিয়ে ফিকহে ইসলামির অঙ্গন যে বিরাট ক্ষতি ও শূন্যতার সম্মুখীন হয়েছে, তা কবির ভাষায় এভাবেই ব্যক্ত করা যায়-

وما كان قيس هلكه هلك واحد + ولكنه بنيان قوم تهدما

কায়েসের মৃত্যু শুধু এক ব্যক্তির বিদায় নয়, এ যেন পুরো একটা জাতির ভিত্তিকে ধসিয়ে দিল”।
তদ্রুপ হযরত মুফতী আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (রহ.)এর ইন্তিকাল যেন উপমহাদেশের ফিকহি জগতটাকে অনেকটা বিরান করে দিল।

জন্ম ও বংশ পরিক্রমা
মুফতী আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (রহ.) আনুমানিক ১৩৬৩ হিজরী সনে (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে) চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কর্ণফুলী নদীর অদূরে আনোয়ারা থানার নলদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হযরতের বংশ ছিল এলাকার সুপ্রসিদ্ধ, সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশ। তাঁর দাদা শায়খ আব্দুল খালেক ছিলেন একজন দ্বীনদার, নেককার ও আলেমপ্রিয় মানুষ। হযরতের আব্বাজান মরহুম হযরত খলীলুর রহমান ছিলেন তাঁর পিতার প্রথম ঘরের দ্বিতীয় পুত্র। শৈশবকাল থেকেই তিনি ছিলেন দ্বীনদার এবং আলেমপ্রিয় মানুষ। পেশাগতভাবে ছিলেন একজন জমিদার। হযরত খলীলুর রহমান (রহ.) আপন চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন। যিনি ছিলেন একজন দ্বীনদার ও পরহেযগার সতিসাধ্বী নারী। তাঁদের পবিত্র ঔরশ থেকে জন্মগ্রহণ করেন হযরত মুফতী আব্দুচ্ছালাম চাটগামী (রহ.)।

শিক্ষা-দীক্ষা
আনুমানিক ১৩৬৭ হিজরী সনে পাঁচ বছর বয়সে হযরতকে স্থানীয় দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদরাসায়ে আযীযিয়াহ কাসেমিয়াতে ভর্তি করা হয়। এই মাদ্রাসায় তিন বছর পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। কায়দায়ে বোগদাদী, পবিত্র কুরআনের নাযেরা এবং উর্দু ভাষার প্রাথমিক কিতাবগুলোর অধ্যয়ন তিনি এখানে সমাপ্ত করেন। প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি আপন চাচা হাফেয হামীদ উদ্দীন (রহ.)এর কাছে পবিত্র কুরআন হিফয শুরু করেন। কিন্তু শারীরিক দুর্বলতার কারণে কুরআন হিফয অসম্পূর্ণ রাখেন। এরপর হযরতের পিতা সাধারণ শিক্ষা অর্জনের জন্য হযরতকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করান। কিন্তু স্কুল শিক্ষার প্রতি হযরতের আগ্রহ না থাকায় তিনি স্কুল ছেড়ে ঘরে ফিরে আসেন। এরপর দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত হযরত আপন পিতাকে কৃষিকাজে সহযোগিতা করেন।

১৩৭৪ হিজরীতে হযরত তাঁর বাল্যকালের সহপাঠী মাওলানা ইয়াকুব সাহেবের সাথে চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ মাদরাসায়ে হোসাইনিয়া বোয়ালিয়া আনোয়ারায় ভর্তি হন। বোয়ালিয়া মাদরাসায় দীর্ঘ তিন বছর তিনি পড়াশোনা করেন। যেখানে তিনি নূরুল ইযাহ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন।

বোয়ালিয়া মাদ্রাসা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর সে বছর রমাযান মাসে তিনি চট্টগ্রামের অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া আজিজুল উলূম বাবুনগর মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা পরিচালক মাওলানা হারুন বাবুনগরী (রহ.)এর পরামর্শে বাবুনগর মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৩৭৮ হিজরী থেকে ১৩৮২ হিজরী পর্যন্ত মোট চার বছর তিনি বাবুনগর মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। সেখানে শরহে বেক্বায়া ও শরহে জামী ইত্যাদি কিতাব পড়েন। বাবুনগর মাদ্রাসায় তাঁর উল্লেখযোগ্য উস্তাদগণের মধ্যে আল্লামা হারুন বাবুনগরী (রহ.), মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী (দা.বা.), মাওলানা মুহাম্মদ ইউনুস (রহ.), মাওলানা উবাইদুর রহমান ইমামনগরী (রহ.), মাওলানা মূসা বাবুনগরী (রহ.), মাওলানা নূরুল ইসলাম জাদীদ (রহ.) এবং মাওলানা সুলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.) ছিলেন অন্যতম। এদের প্রায় সকলেই দারুল উলূম দেওবন্দের ফারেগ এবং হযরত মাদানী (রহ.)এর ছাত্র ছিলেন।

জামিয়া আজিজিয়া বাবুনগর মাদ্রাসায় শরহে জামী পর্যন্ত অধ্যয়ন শেষ করার পর পারিবারিক কারণে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া জিরিতে ভর্তি হয়ে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত এখানে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। জিরি মাদ্রাসায় হযরত (রহ.)এর উস্তাদগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- ১। মাওলানা আবুল খাইর দৌলতপুরী (রহ.); যিনি হযরত মাওলান খলীল আহমদ সাহারানপুরী ও শায়খুল হাদীস যাকারিয়া (রহ.)এর ছাত্র ছিলেন। ২। মাওলানা মুফতী নূরুল হক সাহেব জিরি (রহ.); যিনি হযরত মাদানী (রহ.)এর ছাত্র এবং কর্মজীবনে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ফকীহ ও আদিব ছিলেন। আত্মীয়তার সর্ম্পকে তিনি হযরত (রহ.)এর শ্বশুরও হন। ৩। হযরত মাওলানা সালেহ আহমদ (রহ.); যিনি দারুল উলূম দেওবন্দ ও ঢাবেলের ফারেগ এবং হযরত মাদানী ও কাশ্মিরী (রহ.)এর ছাত্র ছিলেন। ৪। হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াদুদ সন্দীপী (রহ.); যিনি হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.)এর শেষ সময়ের এবং হযরত কাশ্মিরী (রহ.)এর শুরুর দিকের ছাত্র ছিলেন। পাশাপাশি তিনি জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়াহ জিরির শায়খুল হাদীসও ছিলেন। তাঁর কাছে হযরত সহীহ বুখারী এবং সুনান তিরমিযীর সম্পূর্ণ দরস গ্রহণ করেন।

বোয়ালিয়া, বাবুনগর এবং জিরি মাদ্রাসায় পড়াশোনাকালীন হযরত (রহ.) অত্যন্ত মেধাবী ও মেহনতী ছাত্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। প্রত্যেক জামাতের প্রতিটি কিতাবে তিনি পূর্ণ নাম্বারে উত্তীর্ণ হতেন এবং প্রতি বছর তিনি মেধা তালিকায় প্রথম স্থান লাভের গৌরব অর্জন করতেন।

উচ্চতর ইলমে দ্বীন অর্জনের জন্য করাচী সফর
১৩৮৭ হিজরীতে জিরি মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদীসের পরীক্ষা দেন। এরপর পুরো রমাযান মাস বাড়িতে অবস্থান করেন। রমাযানের পর ৮ই শাওয়াল ১৩৮৭ হিজরীতে সমুদ্রপথে তিনি পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। দীর্ঘ আট দিনের সমুদ্রপথের সফর শেষে করাচী পৌঁছান। করাচীর জামেয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া আল্লামা বানূরী টাউনে উপস্থিত হয়ে বিশ^বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বানূরী (রহ.)এর সাথে সাক্ষাত করেন। হযরত সম্পর্কিত একটি চিঠি মুফতী নূরুল হক সাহেব (রহ.) আল্লামা বানূরীর উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন। সেই চিঠি তিনি হযরত বানূরী (রহ.)এর খেদমতে উপস্থাপন করেন। আল্লামা ইউসূফ বানূরী (রহ.) চিঠি পড়ার পর হযরতকে উচ্চতর হাদীস বিভাগে অধ্যয়নের পরামর্শ দেন। কিন্তু হযরত (রহ.) পুনরায় দাওরায়ে হাদীস এবং হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ অধ্যয়নের আগ্রহ প্রকাশ করে অনুমতি প্রার্থনা করলে হযরত বানূরী (রহ.) দাওরায়ে হাদীস পড়ার অনুমতি দেন। ১৩৮৭ হিজরীতে হযরত (রহ.) বানূরী টাউনে ভর্তি হন এবং ১৩৮৮ হিজরীতে বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অর্জন করেন। উচ্চতর বিভাগ পড়ার উদ্দেশ্যে রমাযান মাস বানূরী টাউনে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সময় কাটান। বানূরী টাউনে তিনি যেসকল শিক্ষকবৃন্দের কাছে হাদীস পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে- ১। আল্লামা ইউসুফ বানূরী (রহ.); হযরতের কাছে তিনি সহীহ বুখারী পড়েন। ২। মুফতী ওলী হাসান টুঙ্কী (রহ.); হযরতের কাছে তিনি তিরমিযি শরীফ পরিপূর্ণ পড়েন। ৩। হযরত মাওলানা হামেদ মিয়া (রহ.); মাওলানা বদরে আলম মিরাঠী (রহ.)এর ভাই। ৪। হযরত মাওলানা ফযল মুহাম্মদ সাওয়াতী (রহ.)। ৫। হযরত মাওলানা ইদরীস মিরাঠী (রহ.) ৬। হযরত মাওলানা মিসবাহুল্লাহ শাহ সাহেব (রহ.) ৭। হযরত মাওলানা বদিউয যামান কাম্মেলপুরী (রহ.) প্রমুখ।

উচ্চতর ইসলামী আইন গবেষণা বিভাগে (ফিকহে ইসলামী)
১৩৮৮ হিজরীতে বানূরী টাউনে সর্বপ্রথম উচ্চতর ইসলামী আইন গবেষণা বিভাগ চালু করা হয়। আল্লামা ইউসূফ বানূরী (রহ.)এর পরামর্শে হযরত উচ্চতর ফিকহে ইসলামী বিভাগে ভর্তি হন। এ বছর দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামার সাবেক প্রধান মুফতী এবং শায়খুল হাদীস আল্লামা মুফতী ইসহাক সিন্ধিলভী (রহ.)কে বানূরী টাউনে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করা হয়। মুফতী ইসহাক সিন্ধিলভী এবং মুফতী ওলী হাসান টুংকী (রহ.)কে উচ্চতর ফিকহ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। উভয় হযরাতের তত্ত্বাবধানে হযরত (রহ.) উচ্চতর ফিকহ বিভাগের পাঠ্যসূচী পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়ন করেন। পাঠ্যসূচীর কিতাবগুলো পরিপূর্ণ অধ্যয়নের পাশাপাশি হযরত (রহ.) ফিকহ এবং উসূলে ফিকহের আরো অসংখ্য কিতাব অধ্যয়ন করেন। হযরত (রহ.) নিজেই তাখাসসুসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তাখাসসুসের দুই বছরে আমি চল্লিশ হাজারেরও অধিক পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করেছি।

উচ্চতর ফিকহ বিভাগের দুই বছরের কোর্স সম্পন্নের শেষ তিন মাসে তিনি بيع الحقوق في التجارة الرائجة اليوم وتحقيقها শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেন। যার উপর উক্ত বিভাগের উভয় তত্ত্বাবধায়ক বিশেষ সনদ প্রদান করেন।

কর্মজীবন
১৩৯০ হিজরীতে হযরত (রহ.) উচ্চতর ইসলামী আইন গবেষণা বিভাগের পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশে) ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁর সম্মানিত উস্তাদ মুফতী ওলী হাসান টুংকি (রহ.) ও মাওলানা ইদরিস মিরাঠী (রহ.) জামিয়া বানূরী টাউনে শিক্ষকতার জন্য দরখাস্ত দিতে বলেন। সে সময় উভয় পাকিস্তানের মাঝে বিভিন্ন রাজনৈতিক সঙ্কটও শুরু হয়ে যায়। পরবর্তীতে যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। হযরত (রহ.) এই পরামর্শকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে মাত্র দুই লাইনের একটি দরখাস্ত লিখেন। যেখানে মুফতী ওলী হাসান টুংকি এবং মাওলানা ইদরীস মিরাঠী (রহ.)এর সুপারিশও ছিল। দরখাস্ত নিয়ে আল্লামা বানূরী (রহ.)এর খেদমতে গেলেন। বানূরী (রহ.) দরখাস্ত পড়ে হাসলেন এবং বললেন, কিছুদিন ধরে আমিও এ বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলাম। যাক এখন অন্যান্য উস্তাদগণের মতামতও পেয়ে গেলাম। আজ থেকে আপনি দারুল ইফতায় কাজ শুরু করে দেন। দরসের ব্যাপারে পরে আলোচনা করা যাবে।

জুমাদাল ঊলা মাসের ১৫ তারিখ ১৩৯১ হিজরীতে জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া বানূরী টাউনে শিক্ষক হিসেবে হযরত নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৩৯৯ হিজরীতে জামেয়ার প্রধান মুফতী আল্লামা আহমদুর রহমান (রহ.) মুহতামিমের দায়িত্ব গ্রহণ করলে হযরতের উপর সহকারী প্রধান মুফতীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এরপর মুফতী ওলী হাসান টুংকি (রহ.) পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলে জামিয়ার সকল শিক্ষকের পরামর্শক্রমে হযরতের উপর ভারপ্রাপ্ত প্রধান মুফতির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। মুফতী ওলী হাসান (রহ.)এর ইনতিকাল হয়ে গেলে সকলের সম্মতিক্রমে তিনি জামেয়ার সদর মুফতীর দায়িত্ব পালন করেন এবং বাংলাদেশে আসার আগ পর্যন্ত জামিয়া বানূরী টাউনের প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিসের দায়িত্ব আনজাম দেন। ১৪১৪ হিজরীতে হযরত (রহ.) পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলে বাধ্য হয়ে সবকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এবং কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর পুনরায় ফাতওয়া প্রদান ও সত্যায়নের কাজ শুরু করেন।

জামিয়া বানূরী টাউনে হযরত (রহ.) তিরমিযী শরীফ ছানী, মুসলিম শরীফ ছানী, হিদায়া রাবে, জালালাইন শরীফ প্রথম ও দ্বিতীয় খ-সহ ফিকহ এবং উসূলুল ফিকহের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবসমূহের দরস প্রদান করেন। এবং দীর্ঘ ২৭ বছর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে উক্ত জামেয়ায় ইলমে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দেন।

বানূরী টাউনে থাকাকালীন সময়ে তিনি উসমানীয়া মসজিদে (হযরত মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী (রহ.)এর মাকবারার পাশে অবস্থিত মসজিদ) দীর্ঘ ২৬ বছর পর্যন্ত ইমামত এবং খেতাবতের দায়িত্বও পালন করেন। উক্ত মসজিদে হযরত (রহ.) প্রতিদিন ইশার নামাযের পর সাধারণ মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরআনের তাফসীরও করতেন। যা ক্রমান্বয়ে অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

দারুল উলূম হাটহাজারীতে যোগদান
শারীরিক অসুস্থতার কারণে ১৪২০ হিজরীতে তিনি বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে পুরোপুরি মনস্থির করেন। এবং জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া বানূরী টাউন কর্তৃপক্ষের নিকট অব্যাহতি পত্র জমা দেন। যে বছর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যাপারে পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন, সে বছরই দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুহতামিম শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি (রহ.) উমরা আদায়ের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব সফর করেন এবং পথিমধ্যে কয়েকদিন করাচিতে অবস্থান করেন। সে সময় শায়খুল ইসলাম (রহ.) হযরত চাটগামী (রহ.)কে বলেন, “মুফতী সাহেব! আপনিতো সারা জীবন পাকিস্তানে কাটিয়ে দিলেন। এখানে দ্বীনি খেদমত অনেক করেছেন। কিন্ত বাংলাদেশে আপনি কোনো খেদমত করেননি। এখন তো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এখন দেশে গিয়ে কিছু খেদমত কারার চিন্তা-ভাবনা করুন।”

হযরত বললেন, আপনার কথা তো সঠিক। কিন্তু এই অপারগ অবস্থায় কোন মাদ্রাসা আমাকে গ্রহণ করার উপর রাজি হবে? হযরত মুহতামিম সাহেব বললেন, আপনি বানূরী টাউনে বর্তমানে যা খেদমত করছেন, হাটহাজারীতে এসে তাই করবেন। আপনি হাটহাজারী চলে আসুন। আমরা ইনশাআল্লাহ যতটুকু সম্ভব আপনার খেদমত করবো। হযরত বললেন, এক/দেড় ঘণ্টার খেদমতের বিনিময়ে আমাকে অতটুকু বিনিময় কে দিবে যা দ্বারা আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজন পূরণ হবে? আপনি নিজে রাজি হবেন, তবে অন্যান্য শিক্ষকগণ কি রাজি হবেন? তারা তো প্রশ্ন করবেন যে, এই বেকার মানুষ এবং অসুস্থ মানুষকে কেন নিয়ে আসা হল? এরপর আল্লামা আহমদ শফি (রহ.) বললেন, আপনি এখানে দারুল ইফতায় যতটুকু খেদমত আনজাম দিচ্ছেন, হাটহাজারীতেও ততটুকু খেদমত করবেন। আমার জীবদ্দশায় কেউ আপনার উপর অভিযোগ করতে পারবে না। আর আমার পরে কেউ যদি অভিযোগ করে, তাহলে বিষয়টা তখন আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। আপনি চাইলে তখন হাটহাজারীতে থাকবেন আর চাইলে অন্য কোথাও চলে যাবেন।

অতঃপর হযরত (রহ.) বললেন, যদি আপনারা এটার উপর রাযি থাকেন, তাহলে আমি হাটহাজারী যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। হযরত মুহতামিম সাহেব (রহ.) তখন বললেন, তাহলে আপনি রমাযানে বাংলাদেশে চলে যাবেন এবং শাওয়াল মাসে হাটহাজারী মাদ্রাসায় চলে আসবেন। আমরা আপনার জন্য সবকিছুর ব্যবস্থা করে রাখবো, ইনশাআল্লাহ। সিনিয়র শিক্ষকগণের সাথে পরামর্শ করে নিবো। তারা সকলেই ইনশাআল্লাহ রাজি হয়ে যাবেন। এ কথা বলে হযরত মুহতামিম সাহেব (রহ.) জামিয়া বানূরী টাউনে বিশ্রামের জন্য চলে গেলেন এবং পরের দিন উমরাহ আদায়ের নিয়তে সাউদিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

আরও পড়তে পারেন-

করাচী থেকে আসার পর হযরত চাটগামী (রহ.) ইন্তিকালের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। এখানে তিনি আবু দাউদ ২য় খন্ড, তাহাভী শরীফ, নাসাঈ শরীফ, মুওয়াত্বা মুহাম্মদ এবং ইবনে মাজাহ শরীফের দরস প্রদান করেন। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে মুফতীয়ে আযম বাংলাদেশ আল্লামা মুফতী আহমাদুল হক (রহ.)এর ইন্তিকালের পর হযরত মুফতী আব্দুচ্ছালাম (রহ.) বাংলাদেশের মুফতীয়ে আযম পদে ভূষিত হন। গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফি (রহ.) ইন্তিকালের পর জামেয়ার মজলিশে শূরা হযরত (রহ.)কে তিন সদস্য বিশিষ্ট মজলিশে ইদারির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করেন।

ইলমে হাদীসের সনদ ও আত্মশুদ্ধির জগতে
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হযরত চাটগামী (রহ.) জিরি মাদ্রাসা এবং বানূরী টাউনে দাওরায়ে হাদীস পড়েন। যে সকল মুহাদ্দিসগণ থেকে তিনি ইলমে হাদীসের দরস এবং সনদ অর্জন করেছেন তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক দরসের বাইরে তিনি উপমহাদেশের আরো অনেক প্রখ্যাত মুহাদ্দিসের কাছ থেকে ইলমে হাদীসের সনদ অর্জন করেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- ১) শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া (রহ.), ২) হযরত মাওলানা শামসুল হক আফগানী (রহ.), ৩) হযরত মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী (রহ.), ৪) মাওলানা মুফতী ইসহাক সিন্ধলভী (রহ.), ৫) সিরিয়ার বিখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আল্লামা আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দা (রহ.) প্রমুখ।

ইলমে হাদীস ও ইলমে ফিকহ চর্চার পাশাপাশি তৎকালীন সময়ের বড় বড় উলামায়ে কেরাম ও ওলীগণের হাতে আত্মশুদ্ধি ও সুলূকের মেহনত করে তাঁদের কাছ থেকে সনদ অর্জন করেন। যেসকল উলামা-মাশায়েখের কাছ থেকে হযরত (রহ.) বাইআত গ্রহণ এবং খেলাফত লাভে ধন্য হন, তাঁদের মধ্যে- ১) হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল আযীয রায়পুরী (রহ.); যিনি হযরত মাওলানা আব্দুল কাদের রায়পুরী (রহ.)এর খলীফা ছিলেন। ২) হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ভাওয়ালনগরী (রহ.)। ৩) হযরত মাওলানা শাহ সুলতান আহমদ নানুপুরী (রহ.)এর কাছ থেকে তিনি তালিবুল ইলমীর যামানাতেই বাইআত গ্রহণ করেন এবং কয়েক বছর পর খেলাফত প্রাপ্ত হন। ৪) বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তৎকালীন মুফতীয়ে আযম হযরত মুফতী আহমাদুল হক (রহ.)এর কাছে বাইআত গ্রহণ করেন এবং মুফতী সাহেব (রহ.) হযরতকে চার তরীকায় খেলাফত প্রদান করেন।

ফিক্বহে ইসলামীর অনন্য কিংবদন্তি
ইলমে হাদীস, কেরাত এবং ফিকহে ইসলামী’সহ ইলমের প্রত্যেক স্তরে হযরত (রহ.) সমান পরদর্শীতার স্বাক্ষর রাখলেও জীবনের সিংহভাগ সময় তিনি হাদীস এবং ফিকহের খেদমতে ব্যয় করেছেন। বানূরী টাউনে তিনি দীর্ঘ ২৭ বছর খেদমত করেন, যেখানে ইলমে হাদীসের দরসের পাশাপাশি প্রধান মুফতির দায়িত্ব পালন করেন। দারুল উলূম হাটহাজারীতে আসার পর দীর্ঘ ১৭ বছর পর্যন্ত ইলমে হাদীসের খেদমতের পাশাপাশি মুফতিয়ে আযমের দায়িত্ব পালন করেন। ফাতওয়া লেখা এবং দলীল উল্লেখ করার ক্ষেত্রে হযরত (রহ.)এর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। যার স্বীকৃতি বানূরী টাউনের প্রধান মুফতী এবং পরিচালক মুফতী আহমদুর রহমান (রহ.) নিজেই দিয়েছেন। হযরতের পবিত্র যবান এবং কলম দিয়ে অসংখ্য ফাতওয়া প্রদানের মাধ্যমে তিনি উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের দ্বীনি তৃষ্ণা নিবারণ করেছেন। ফিকহে ইসলামীর জগতে হযরত চাটগামী (রহ.) ছিলেন একজন উঁচুস্তরের ফকীহুন নফস। সমসাময়িক এবং আধুনিক যেকোনো সমস্যার ফিকহী সমাধানের জন্য উলামায়ে কেরাম এবং সাধারণ মানুষ হযরতের দিকেই ফিরে আসত। ফিকহী মতামতগুলোতে প্রায় সময়ই হযরতের মতকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে সবাই মেনে নিত। দলীলের আলোকে যে মতটি হযরতের কাছে বিশুদ্ধ মনে হতো তিনি তাই গ্রহণ করতেন। এ ক্ষেত্রে কারো চাপে কিংবা পরিস্থিতির কারণে তিনি নতি স্বীকার করতেন না।

জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বানূরী টাউনে দীর্ঘদিন পর্যন্ত হযরত (রহ.) যেসব ফাতওয়া নিজ হাতে লিখেছেন এবং যেসব ফাতওয়া তিনি সত্যায়ন করেছেন রেজিস্টারের রেকর্ড অনুযায়ী তা একত্রিত করলে প্রায় ৬০ খন্ডের মত হবে। এছাড়া অসংখ্য ফাতওয়া তিনি মৌখিক ও ফোনের মাধ্যমে দিয়েছেন, যেগুলোর হিসেব করা অসম্ভব। বানূরী টাউনে হযরতের সত্যায়নকৃত ফাতওয়া দৈনিক ২০-৩০ পর্যন্ত বের হত। মাসে যার পরিমাণ হত সাড়ে সাতশো এবং বছরে নব্বই হাজারের কোটায় গিয়ে পৌঁছাত। এছাড়া দারুল উলূম হাটহাজারীতে হযরত (রহ.) দৈনিক ৩০-৪০টি ফাতওয়া সত্যায়ন করতেন। মোটকথা, হযরত (রহ.) সারা জীবন যেসকল ফাতওয়া নিজে লিখেছেন এবং যেসকল ফাতওয়া নিজে সত্যায়ন করেছেন, তার সংখ্যা সব মিলিয়ে কয়েক লক্ষের অধিক হবে।

ব্যক্তিগত জীবন- ইখলাস, তাকওয়া এবং দুনিয়া বিমুখতার এক অনন্য মিশ্রণ
ব্যক্তিগত জীবনে হযরতের জীবন ছিল সুন্নাতে নববী অনুসরণের এক অনন্য উপমা। লেবাস-পোশাক, আচার-আচরণ, চলাফেরাসহ সকল ক্ষেত্রে হযরত (রহ.) ছিলেন সুন্নাতে নববীর এক উত্তম নমুনা। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে হযরতের মূল পাথেয় ছিল ইখলাস, তাকওয়া এবং বিনয়। বড়-ছোট, আলেম-সাধারণ যে কারোর সাথেই হযরত (রহ.) সমানভাবে মিলিত হতেন। হাসিমুখে কথা বলতেন। সময় দিতেন। পেরেশানী এবং কোনো কিছু ছুটে যাওয়ার আফসোস হযরতের জীবন-অভিধানে ছিল না। কোনো মেহমান হযরতের জন্য হাদিয়া নিয়ে আসলে হযরত তাদেরকে উত্তম প্রতিদান হিসেবে দুআ দিতেন এবং নিজ রচিত মূল্যবান গ্রন্থগুলো হাদিয়া দিতেন। এমনকি কেউ নিছক দুআর জন্য আসলেও তাদেরকে স্বরচিত কিতাব হাদিয়া দিতেন। দু’হাত ভরে অসহায় মানুষকে সাহায্য করতেন। কারো কাছ থেকে কোনো প্রতিদান পাওয়ার আশা করতে না। হালাল-হারামের ক্ষেত্রে হযরত (রহ.) ছিলেন খুবই সচেতন এবং কঠোর। হারাম তো দূরের কথা, সন্দেহজনক বস্তুও তিনি পরিত্যাগ করতেন। দরস-তাদরীসের সময় ব্যতীত বাকি সময়ে হযরত (রহ.) লেখালেখি এবং ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যয় করতেন।

রেখে যাওয়া ইলমী সম্পদ
হযরত চাটগামী (রহ.) ৩০টিরও অধিক বিষয়ভিত্তিক গ্রন্থ রচনা করেছেন; যা উর্দূ এবং বাংলা ভাষায় বেশ সমাদৃত। যা থেকে উপমহাদেশের লাখো আলেম ও সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত উপকৃত হচ্ছেন। হযরতের প্রত্যেক গ্রন্থ উর্দূ ভাষায় রচিত; পরবর্তীতে যা বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। তন্মধ্যে ১। জাওয়াহিরুল ফাতওয়া ৫ খন্ড, ২। আপ কে সাওয়ালাত আওর উন কা জাওয়াব আহাদীস কি রোশনী মে, ৩। ইসলামী মাঈশত কে বুনয়াদি উসূল (ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মূলনীতি), ৪। ইসলামের দৃষ্টিতে মানব অঙ্গের ক্রয়-বিক্রয় এবং প্রতিস্থাপন, ৫। করোনাকালীন সমস্যা ও তার শরয়ী সমাধান, ৬। রহমতে আলম (সা.) এর মকবুল দুআ সমূহ অন্যতম।

পরিবারিক জীবন
পারিবারিক জীবনে হযরত (রহ.) দুই শাদি করেন। হযরতের উভয় সংসারে আল্লাহ ত্আালা ভরপুর বরকত দান করেছেন। হযরতের সাত সন্তান সকলেই মাশাআল্লাহ হাফেযে কুরআন এবং যোগ্য আলেমে-দ্বীন। তারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন মাদারিসে দ্বীনিয়ায় খেদমতে নিয়োজিত আছেন। হযরতের কন্যাদের মধ্যে প্রত্যেকেই দ্বীনদার, মুত্তাকি এবং পরহেযগার।

ইন্তিকাল ও দাফন
এমনিতে বানূরী টাউনে থাকাকালীন সময়ে হযরত পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। যে কারণে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত স্বাভাবিক দরস-তাদরীস থেকে অপারগ ছিলেন। পরবর্তীতে সুস্থ হলেও দুর্বলতা আগের মতই শরীরে লেগে ছিল। এরপর করাচী থেকে হাটহাজারী আসেন। এখানে দীর্ঘ ১৭ বছর ইলমী খেদমত আঞ্জাম দেন। এই দীর্ঘ সময়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছিলেন। বিশেষভাবে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রেইন স্ট্রোক করেন। সেসময় সফল অস্ত্রোপাচার এবং চিকিৎসার মাধ্যমে আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি পূর্ণ সুস্থ হয়ে জামিয়াতে ফিরে আসেন। বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা এবং শারীরিক কিছু সমস্যা থাকলেও হযরত (রহ.) ডায়াবেটিক, হার্ট এবং কিডনি সমস্যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। এবং ইন্তিকালের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি স্বাভাবিক ও সুস্থ ছিলেন। ইন্তিকালের আগের দিন নাজিরহাট মাদ্রাসার শূরার বৈঠকেও অংশগ্রহণ করেন। রাত্রে স্বাভাবিকভাবে খাবারও গ্রহণ করেন। ঘুমানোর আগে নিজ অপারগতা প্রকাশ করে শুধুমাত্র ফাতওয়া তসদিকের দায়িত্ব ছাড়া জামেয়ার অন্য সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য একটি ইসতিফানামা (অব্যাহতিপত্র) লেখেন। যার ১২টি অনুলিপি তৈরি করে পরদিন সকালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছিয়ে দেন। সকাল ৮টার দিকে স্বাভাবিক নাস্তা গ্রহণ করেন এবং বিশ্রামে যান।

সকাল ৯টায় মজলিসে শূরা আরম্ভ হয়। দশটার দিকে যখন শূরা বৈঠক থেকে হযরতের উপর অর্পিত দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বৈঠকে হযরতকে স্মরণ করা হয়, ততক্ষণে হযরতে শারীরিক অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ে। দ্রুত এম্বুলেন্সযোগে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক হযরতকে মৃত ঘোষণা করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

জামেয়ার এতবড় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে হযরত (রহ.) সব সময় শারীরিক অসুস্থতা এবং অপারগতার কথা প্রকাশ করতেন। বার বার এসব দায়িত্ব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন এবং দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে সব সময় অনাগ্রহ প্রকাশ করতেন। শূরার পূর্বে একবার কোনো এক মজলিসে তিনি বলেছিলেন, যদি আমাকে মুহতামিমের দায়িত্ব প্রদান করা হয়, তাহলে আমি সব ছেড়ে বাড়ি চলে যাবো। হযরতের কথাই সত্যি হল। তাঁকে মুহতামিমের দায়িত্ব প্রদান করা হল, আর তিনি সব ছেড়ে আসল বাড়িতে চলে গেলেন।

হযরতের ইন্তিকালের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই পুরো উপমহাদেশের ইলমি অঙ্গন জুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। জামেয়া প্রাঙ্গণে হযরতের লাশবাহী এম্বুলেন্স আসতেই ছাত্র-শিক্ষক সকলের মাঝেই হু হু করে কান্নার রোল পড়ে যায়। মৃত্যু সংবাদ শোনামাত্রই সারা দেশ থেকে হযরতের ভক্তবৃন্দ এবং ছাত্রগণ হযরতকে এক নযর দেখার জন্য এবং জানাযায় অংশগ্রহণ করার জন্য জামিয়া অভিমুখে ছুটেন। রাত ১১টায় লক্ষাধিক মুসল্লীর উপস্থিতিতে নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযার ইমামতি করেন হযরতে সম্মানিত উস্তাদ বাবুনগর মাদ্রাসার মুহতামিম আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী (হাফিযাহুল্লাহ)। জানাযা শেষে হযরত (রহ.)কে মাকবারায়ে জামেয়ায় শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) ও শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)এর কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন। আল্লাহ তাআলা হযরতের সকল ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করুন এবং হযরতকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।

লেখক: শিক্ষক- জামিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী, ও সহকারী সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম।

মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।