মুমিন জীবনে নামাযের গুরুত্ব


।। আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ।।

মহান আল্লাহ ইসলামকে মানব জাতির জন্য একমাত্র মনোনীত জীবন বিধান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। মোট পাঁচটি স্তম্ভের উপর এই দ্বীন ইসলামের ভিত্তি। তন্মধ্যে ঈমানের পরে দ্বিতীয় ভিত্তিই হচ্ছে নামায। আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহ.) ‘ফয়যুল বারী’ গ্রন্থে লিখেছেন, পাঁচ বিষয়ের সাথে দ্বীন-ইসলাম সংশ্লিষ্ট। আকীদা, ইবাদত, মুআমালা, দ-বিধি ও আখ্লাক। ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে নামায।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, ইবাদতের মধ্যে সর্বোত্তম হল নামায। নামায রাসূলুল্লাহ (সা.)এর চোখের শীতলতা। নামায মু’মিনের মি’রাজ। নামায মু’মিনের নূর, নামায শ্রেষ্ঠ জিহাদ। নামাযের দ্বারা শয়তানের মুখ কালো হয়ে যায়। নামায দ্বীনের অন্যতম স্তম্ভ। নামায বেহেস্তের চাবি। কিয়ামতের দিবসে সর্বপ্রথম নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।

আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন কুরআন মাজীদে নামায কায়েমের প্রতি যে পরিমাণ তাগিদ দিয়েছেন, অন্য কোন ইবাদত সম্পর্কে এত বেশি তাগিদ দেননি। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে প্রায় ৮২ বার প্রত্যক্ষভাবে নামায কায়েমের হুকুম দিয়েছেন। নামাযের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য আল্লাহ্ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা.)কে আরশে আযিমে আমন্ত্রণ করে নামায হাদিয়া দিয়েছেন। পক্ষান্তরে অন্য সব ইবাদতের হুকুম জিব্রাঈল (আ.)এর মাধ্যমেই নাযিল করেছেন।

নামায আল্লাহর সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। নামায দ্বীনের খুঁটি। যে নামায প্রতিষ্ঠা করল, বস্তুত সে যেন দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করল। আর যে নামাযকে ছেড়ে দিল, প্রকৃতপক্ষে সে যেন দ্বীনকে বরবাদ করল। ঈমান এবং শিরকের মধ্যে নামাযই একমাত্র প্রতিবন্ধক। নামায ইসলামের নিদর্শন। যে ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে নামায আদায় করে, সেই মু’মিন রূপে পরিচিত হয়।

নামাযের ফযীলত বর্ণনায় আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন-
قَدْ اَفْلَحَ الْمُؤْمِنُوْنَ ۙ﴿۱﴾ الَّذِیْنَ هُمْ فِیْ صَلَاتِهِمْ خٰشِعُوْنَ ۙ﴿۲﴾ وَالَّذِیْنَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُوْنَ ﴿ۙ۳﴾ وَالَّذِیْنَ هُمْ لِلزَّکٰوۃِ فٰعِلُوْنَ ۙ﴿۴﴾ وَالَّذِیْنَ هُمْ لِفُرُوْجِهِمْ حٰفِظُوْنَ ۙ﴿۵﴾

“মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে- যারা নিজেদের নামাযে বিনয়ী-নম্র, যারা অনর্থক কথা-বার্তায় নির্লিপ্ত, যারা যাকাত দান করে থাকে এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে”। (সুরায়ে মুমিন, ১-৫)।

اِنَّ الصَّلٰوۃَ کَانَتۡ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ کِتٰبًا مَّوۡقُوۡتًا

‘নিশ্চয়ই নির্ধারিত সময়ে নামায আদায় করা মুমিনদের উপর ফরয করা হয়েছে’। (সূরা নিসা- ১০৩)।
হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, নামায দ্বীনের খুঁটি সদৃশ। নামায দ্বারা দশটি বরকত হাসিল হয়। যথা-

(১) নামাযীর চেহারা উজ্জ্বল-দীপ্তিময় ও নূরানী হয়। (২) নামাযীর ক্বলব ইয়াকীন ও ঈমানের নূরে আলোকিত হয়। (৩) নামাযির দৈহিক এতমিনান বা প্রশান্তি হাসিল হয়। (৪) নামায রহমত বর্ষণের কারণ হয়। (৫) নামায আসমানের বন্ধ দরজা সমূহ খোলার চাবি। (৬) নামায কবরের শান্তি। (৭) নামায আমলের পাল্লাকে ভারী করবে। (৮) নামায আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের কারণ হয়। (৯) নামায বেহেস্তের ধার্যকৃত মূল্য (১০) নামায জাহান্নামের আগুনের পর্দা। (মুনাব্বিহাত)।

হযরত উসমান (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতে পাবন্দির সাথে খুশু-খুজু বজায় রেখে আদায় করবে, আল্লাহ্ পাক তাঁকে নয়টি বিনিময় দান করবেন। যথা-

(১) স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে ভালবাসবেন; একজন মু’মিনের জন্য এরচেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় আর কি হতে পারে! (২) আল্লাহ তাআলা তাঁর দৈহিক ও আত্মিক পরিচ্ছন্নতা দান করবেন (এতে তার মন-মানসিকতা ও স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। বস্তুত দৈহিক ও আত্মিক পরিচ্ছন্নতা ছাড়া মানুষ কস্মিণকালেও কোন ভাল কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না)। (৩) ফেরেস্তাগণ সার্বক্ষণিক নামাযির হিফাযতে নিয়োজিত থাকবে (৪) তাঁর ঘরে রহমত নাযিল হবে; ফলে তিনি শান্তি ও নিরাপত্তার এক সুখময় জীবন লাভ করবেন। (৫) তাঁর চেহারায় নিষ্পাপতা ও উজ্জ্বলতা প্রকাশ পাবে। (৬) আল্লাহ তাআলা তাঁর অন্তরে দয়া ও মায়া-মমতার ভান্ডার সৃষ্টি করবেন। (৭) হাশরের ময়দানে পুলসিরাত বিজলীর ন্যায় দ্রুতগতিতে পার করিয়ে দিবেন। (৮) দোযখের আগুন থেকে হিফাযত করবেন। (৯) হাশরের ময়দানে নাজাতপ্রাপ্তদের কাতারে শামিল করবেন। যাঁদের সম্পর্কে আয়াত নাযিল হয়েছে-
وَ یُنَجِّی اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا بِمَفَازَتِهِمۡ ۫ لَا یَمَسُّهُمُ السُّوۡٓءُ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ

“আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে (কিয়ামতের দিন) তাদের সাফল্যসহ নাজাত দেবেন। কোন অমঙ্গল তাদেরকে স্পর্শ করবে না। আর তারা চিন্তিতও হবে না”। (সূরা যুমার, ৬১)।

নামাযের শুধু পরকালীন নয়, দুনিয়াবী ফায়দাও অনেক। একথা আজ বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত এবং সর্বজন স্বীকৃত যে, নামায শারীরিক সুস্থতার জন্যও সহায়ক। নামায অনেক রোগের প্রতিষেধক। নামাযের জন্য অযূ অপরিহার্য। চিকিৎসাবিদগণ বলেন, অযূ ও নামায দ্বারা মস্তিষ্ক সতেজ হয়, ক্লান্তি দূর হয়, শরীরের বর্ধিত তাপ সেরে যায়, স্নায়ু ও চুলের গোড়া শক্তিশালী হয়, হৃদপিন্ডের শক্তি বৃদ্ধি পায়, রোগ-জীবাণু ও ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে।

আরও পড়তে পারেন-

সেজন্যই নিয়মিত নামায আদায়কারী লোকেরা সাধারণত হৃদরোগ, রক্তচাপ জনিত ব্যাধি ও বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয় না। নামাযে ঊর্ধ্বে হাত উঠাতে হয়, এতে ফুসফুস প্রশস্ত হয়। নামাযে রুকু করতে হয়; রুকু পাকস্থলীকে সবল করে হযমী শক্তি বৃদ্ধি করে। সিজদা মস্তিষ্ক, ঘাড় ও মুখমন্ডলে যথাযথ রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য করে। নামাযে শরীরের সকল অঙ্গপ্রতঙ্গের স্বাস্থ্যকর ব্যায়ামের কাজ হয়। নামাযে মনের জোর বাড়ে, সাহস বৃদ্ধি পায়। নামায গাফলত দূর করে। নামাযী লোক বিপদ আপদে ধৈর্য ধারণ করতে সক্ষম হয়। নামাযে মানুষকে নিয়ম মেনে চলতে সহায়তা করে এবং এতে কাজকর্মে বরকত হয়। নামাযে লোক-সমাজে মান-মর্যাদা বাড়ে।

অন্যদিকে নামায তরককারীদের সম্পর্কে কঠিন আযাব ও শাস্তির হুঁশিয়ারী বহু আয়াত ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতিটি কাজের হিসাব নিবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন বান্দার আমলসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম যে বিষয়ের হিসাব নেয়া হবে তা হচ্ছে নামায।

দুনিয়াতে যেমন সাজাপ্রাপ্ত মানুষকে তাদের অপরাধের কথা জিজ্ঞেস করা হয়, তেমনি পরকালেও সাজাপ্রাপ্তদেরকে অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার কথা কুরআনে এভাবে এসেছে-
مَا سَلَکَکُمۡ فِیۡ سَقَرَ.قَالُوۡا لَمۡ نَکُ مِنَ الۡمُصَلِّیۡنَ

‘কিসে তোমাদেরকে (সাকার) জাহান্নামে নিয়ে এল? তারা বলবে, আমরা নামাযীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। (সূরা আল-মুদ্দাচ্ছির, আয়াত ৪২-৪৩)।

দুনিয়াতে লোক দেখানো ও উদাসীন নামাযী প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে হুঁশিয়ারি এসেছে, “সুতরাং দুর্ভোগ (ওয়াইল নামক জাহান্নামের কঠিন শাস্তি) সেসব নামায আদায়কারীদের জন্য, যারা তাদের নামায সম্পর্কে উদাসীন থাকবে”। (সূরা মাউন, আয়াত ৪-৫)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন – নামায ত্যাগ করা মানুষকে কুফরের সাথে মিলিয়ে দেয়। (মুসনাদে আহ্মদ)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে নামায ছেড়ে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার উপর থেকে নিজের জিম্মাদারি উঠিয়ে নেন’। (বুখারী- ১৮, ইবনে মাজাহ- ৪০৩৪, মুসনাদে আহমদ)।

হাদীসে আরও এসেছে, ইচ্ছাকৃতভাবে নামায ছেড়ে দেয়া শিরকের পর সবচেয়ে বড় গুনাহ। এমনকি এটি হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যাভিচার, চুরি ও মদ্যপানের চেয়েও মারাত্মক গুনাহ। যার শাস্তি দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই ভোগ করতে হবে। (কিতাবুস সালাত লি-ইবনিল কাইয়্যিম, ১৬)।

হযরত উবাদা ইবনে সাবিত (রাযি.) বর্ণনা করেন, “আমাকে আমার হাবীব নবী কারীম (সা.) সাতটি উপদেশ দিয়েছেন। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, তিনি ইরশাদ করেছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে নামায ত্যাগ করিও না। কেননা, যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করল, সে যেন ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে গেল”।” (তবরানী)।

হযরত আবু দারদা (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে অসিয়ত করেছেন, “আল্লাহ্র সঙ্গে কাউকে শরীক করো না, যদিও তোমাকে টুকরো টুকরো করা হয় অথবা অগ্নিদগ্ধ করা হয় এবং জেনেশুনে নামায ত্যাগ করো না”।

হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাযি.) বলেন, আমার প্রাণাধিক প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দশটি বিষয়ে অসিয়ত করেছেন। তন্মধ্যে দু’টি হচ্ছে, “আল্লাহ তাআলার সাথে কাউকে শরীক করো না; যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় অথবা অগ্নিদগ্ধ করা হয় এবং কোন অবস্থাতেই ফরয নামায ত্যাগ করো না। কেননা, যে ফরয নামায ছেড়ে দেয়, তার উপর থেকে আল্লাহ তাআলা নিজ জিম্মাদারী তুলে নেন”। (মিশকাত)।

সহীহ ইবনে হিব্বান গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তির এক ওয়াক্ত নামায তরক হল, তার এতই ক্ষতি হল যে, যে পরিমাণ ক্ষতি হয়ে থাকে সন্তান-সন্ততি এবং সমস্ত ধন-সম্পদ চোখের পলকে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দ্বারা। (সহীহ ইবনে হিব্বান)।

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে। নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন, যে কেউ জেনেশুনে নামায ত্যাগ করে, কিয়ামতের দিবসে আল্লাহ তাআলা তার সামনে কঠোর রাগান্বিত অবস্থায় উপস্থিত হবেন।

প্রিয় পাঠক! চিন্তা করুন কিয়ামতের কঠিন দিবসে যেদিন আল্লাহ্র ছায়া ব্যতীত ছায়া থাকবে না, সেদিন যদি আল্লাহ্ পাক কারো সামনে রাগান্বিত হয়ে উপস্থিত হন তাহলে তার নাজাতের কোন উপায় থাকবে কি?

লেখক: মহাপরিচালক, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।