।। আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (দা.বা.) ।।
দুনিয়াব্যাপী বর্তমানে প্রায় দেড় শতাধিক কোটি মুসলমান। তাদের হাতে পর্যাপ্ত ধন-সম্পদ, সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার মহাগ্রন্থ কুরআনুল কারীম ও অমূল্য হাদীস গ্রন্থসমূহ থাকা সত্ত্বেও মুসলমানরা আজ বিধর্মীদের হাতে অপমানিত-লাঞ্ছিত হচ্ছে এবং কেনই বা তাদের ভাগ্যে পরাজয়ের গ্লানি নেমে এসেছে?
যে জাতি এককালে শৌর্য-বীর্যে সমগ্র বিশ্বের শীর্ষে আরোহণ করেছিল, অর্ধ পৃথিবী যাদের করতলগত হয়েছিল, যাদের এক অঙুলি হেলনে সারা বিশ্ব থরথর করে কেঁপে উঠতো। যেসব দেশ এককালে মূল ইসলামী ধারার কেন্দ্রভূমি বলে গর্ববোধ করতো, তাদের কেন আজ এ দৈন্য দশা?
এ পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত যা ঘটে যাচ্ছে তার প্রতিটির পেছনেই কোন না কোন কারণ রয়েছে। মুসলমানদের এই অধঃপতনের পেছনেও অবশ্যই কোন কারণ আছে। কাজেই সময় এসেছে এর কারণ উদঘাটনের। বস্তুতঃ আত্মজিজ্ঞাসা ও নিরপেক্ষ বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্ঘাটন করতে হবে এর মূল কারণ।
মুসলমানরা আজ আল্লাহর দেয়া বিধান থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তারা আজ নানা মত-পথে দ্বিধা বিভক্ত। এমনকি মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, খুনোখুনি, সামাজিক ও ধর্মীয় দলাদলি এমন মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে, যা কল্পনা করা যায় না। প্রত্যেকেই নিজেদেরকে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালী মনে করছে। নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মনে করছে। সর্বোপরি মুসলমানদের যে মূল কাজ তথা দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে তৎপরতা থাকার কথা, তা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছে। ফলশ্রুতিতে দূর অতীতে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর যামানায় তথা জাহিলিয়্যাতের যুগে আরবের মানুষের যে নৈতিক পতন-অবক্ষয় ও ধ্বংস নেমে এসেছিল, তার চেয়ে অবর্ণনীয় ও ভয়াবহ চিত্র আমাদের সমাজ জীবনে পরিস্ফূট হয়ে উঠছে দিন দিন।
আল্লাহ তাআলার মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য তো এই যে, মানুষ আল্লাহর যমীনে একমাত্র আল্লাহর দ্বীন তথা বিধান প্রতিষ্ঠা করবে। সেই লক্ষ্যে মানুষ কালেমার দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে মানুষকে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করবে। একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার দ্বারা একটি সুখী সমাজ গড়ে তুলবে এবং পরম স্রষ্টার মাহাত্ম ঘোষণা করবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আল্লাহর সেই মহান উদ্দেশ্য আধুনিক জড়বাদী-ভোগবাদী, ধনতান্ত্রিক ও স্বার্থসর্বস্ব দুনিয়ায় ফলপ্রসূ হচ্ছে না। স্বার্থের বশবর্তী হয়ে মুসলমানরা আজ ইসলামের মূল লক্ষ্য, আদর্শ ও ঐতিহ্য পদদলিত করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। নিজ স্বার্থের তাকিদে এক মুসলমান অপর মুসলমানকে হত্যা করতেও হাত কাঁপছে না। এমনকি স্বীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য নাগরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি অধিকার কেড়ে নিতেও সংকোচ করছে না।
আধুনিক বস্তুবাদী, ভোগবাদী ও জড়বাদী সভ্যতার বিনাসি ভাইরাস আমাদের মুসলমানদের জীবনকে প্রতিনিয়ত সংক্রামক রোগের ন্যায় সংক্রমিত করছে। ফলশ্রুতিতে সংক্রামিত মানুষগুলো আচার-আচরণে পশুকেও ছাড়িয়ে গেছে।
আমরা এক আল্লাহর বান্দা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবীজির উম্মত, দ্বীনের যিম্মাদার ও মেহনতকারী, এ বোধ বিশ্বাসে কমজোরি আসার কারণেই এসব অধোগতি। ইসলামে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল তথা দাওয়াত ও তাবলীগের মুবারক মেহনত ও ইলমের চর্চা ও প্রয়োগ ভুলে গেছি। আর তাই সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা নানাভাবে মার খাাচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে। নানা অত্যাচার, যুলুম ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দেশের ভেতরে বাইরে ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে পড়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। অথচ কয়েকশ বছর আগেও শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, মানবতা ও আদর্শিকতায় বিশ^ব্যাপী মুসলমানরা নেতৃত্বের আসনে ছিল।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
পর্যাপ্ত দাওয়াত ও দ্বীনের মেহনত না থাকা, জ্ঞান-গবেষণা থেকে সরে আসা, আমলে কমজোরি এবং পুঁজিবাদি প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে আত্মকেন্দ্রিকতায় ডুবতে থাকার কারণে বিশ্বময় আজ দ্বীনহীন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মুসলমানদের ঘরে ঘরে জাহিল, বেদ্বীন, নাস্তিক, মুরতাদ ও ইসলাম বিদ্বেষের প্রসার ঘটছে। ঘরে ঘরে ইসলামী তা’লীম না থাকায় ইসলামী শিক্ষার উপর দুনিয়ার জ্ঞান আহরণ ও শিক্ষাগ্রহণ প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে মানুষ আল্লাহমুখী না হয়ে গোমরাহীর পথে ধাবিত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই যে মুসলমানদের পতন, অবক্ষয় ও আদর্শচ্যুতি প্রভৃতি থেকে কি উত্তরণের কোন পথ নেই? নিশ্চিত ধ্বংস থেকে এসব অগণিত মানব সন্তানকে রক্ষা করবে কে? মুসলিম উম্মাহর এই নৈরাশ্যকর পরিস্থিতি দেখে কি আমরা নিশ্চুপ থাকবো? নাকি এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবে অপেক্ষায় বসে থাকবো?
আসলে কোন চেষ্টা, সাধনা ও আত্মসংশোধনের চিন্তা বাদ দিয়ে এমন আশাবাদী হয়ে হাত-পা গুটিয়ে থাকাটা নেহায়েত একটা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কী হতে পারে? প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি কখনও নিশ্চুপ থাকতে পারে না। বস্তুতঃ আমরা যদি এ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করি, তবে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এ থেকে উত্তরণের একটি মাত্রই পথ খোলা আছে। আর তা হলো, আমাদের প্রিয়নবী (সা.) যে পথ আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন সেই পথে চলা। স্মর্তব্য, নবী কারীম (সা.) আরবের অন্ধকার ও বর্বরতার যুগে চরম অধঃপতিত মানুষদেরকে মহান এক শাশ্বত কালেমার দাওয়াত ও দ্বীনের মেহনতের মাধ্যমে এক অখ- ও ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ তৈরি করেছিলেন।
বস্তুতঃ হুযূর (সা.) যে মহান কালেমার দাওয়াত ও দ্বীনের যবরদস্ত মেহনতের দ্বারা সাহাবায়ে কিরামের গাফেল অন্তরকে পরিবর্তন করেছিলেন এবং এক্বীন, ইখলাস, মুআমালা ও মুআশারা (পারস্পরিক লেন-দেন ও সামাজিকতা) ঠিক করেছিলেন, সেই মেহনত আজকে সবচেয়ে বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এই মেহনতকে এগিয়ে নিতে হলে সবার আগে দরকার দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ ও এর অনুশীলনের উপর গুরুত্ব দেয়ার। কারণ, প্রকৃত ইলম ও তার অনুশীলন ছাড়া যোগ্য দায়ী তৈরি হবে না। আর ইলম ছাড়া বা আলেমদের তত্ত্বাবধান ছাড়া যারা দাওয়াত ও তাবলীগের উপর কাজ করবে, বাতিলের নানা ধোঁকা তারা দক্ষতার সাথে মোকাবেলা তো করতে পারবেই না, বরং নিজেরাও গোমরাহীতে প্রবিষ্ট হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা থাকবে।
তাই প্রতিটি মুসলমানের হকের উপর অটল থাকার জন্য যেমন দ্বীনি ইলম অর্জন করা জরুরি। আর তখন মজবুত ঈমান-এক্বীন, সুন্দর আখলাক ও আমল আয়ত্ব এবং শান্তি ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন-যাপন সহজতর হয়ে যাবে। ঈমান ও ইসলামের উপর যে অটল থাকতে পারে, সে-ই দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবী হাসিল করতে পারে। সুতরাং দ্বীনি ইলম অর্জন এবং আল্লাহর দেয়া জানমাল ও সময় নিয়ে মানুষের ময়দানে দ্বীনের মেহনত অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে।
উল্লেখ্য, এ ক্ষেত্রে একমাত্র হুযূর (সা.)এর তরীকায় সাহাবা আজমাঈনের নকশায় মেহনত, যিকির-ফিকির করতে হবে।
মূলতঃ দ্বীনি ইলমের প্রচার-প্রসার এবং নবী কারীম (সা.)এর সেই কালেমার দাওয়াত ও মেহনত ছাড়া যেভাবেই আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রচেষ্টা চালানো হোক না কেন, বর্তমান নৈতিক অবক্ষয় তথা দ্বীনহীন গাফেল পরিবেশ থেকে উত্তরণের কোন পথই নেই।
স্মরণ রাখা দরকার যে, ইলমে-দ্বীনের প্রচার-প্রসার এবং দ্বীনি দাওয়াতের যতো বিস্তার হবে, তাতে দ্বীন ততোই যিন্দা হতে থাকবে, গাফেল ও গোমরাহী শক্তি ততই খতম হবে এবং সমাজে ইনসাফ, সহমর্মিতা, মানবিকতাবোধ ও শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করবে। মেহেরবান আল্লাহ আমাদের সকলকে দ্বীনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার ও সহীহ বুঝ দান করুন। আমিন।
লেখক: মহাপরিচালক, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/