।। শায়খুল হাদীস আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক ।।
[পূর্ব প্রকাশিতের পর-শেষপর্ব]
৫. খেদমতে খালক: এ প্রসঙ্গে হযরত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
والله في عون العبد ما كان العبد في عون اخيه
“যতক্ষণ কেউ তার ভাইয়ের সহযোগিতায় ব্যস্ত থাকে, ততক্ষণ আল্লাহ তাআলা তার সহযোগীতা করেন”। (তিরমিযী, হাদীস নং- ২৯৪৫)। কুরআনে কারীমে মুমিনীনদের গুণাবলির আলোচনায় বর্ণিত হয়েছে-
“এবং যাদের ধন-সম্পদে নির্ধারিত হক আছে; সাহায্যপ্রার্থী ও বঞ্চিতের”। (সূরা মাআরিজ- ২৪-২৫)।
“তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দিকে আহার্য দান করে”। (আদ-দাহর- ৮)।
“অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সে ঘাঁটি কি? তা হচ্ছে দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্য দান। এতীম আত্মীয়কে অথবা ধুলি-মলীন মিসকীনকে, অতঃপর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবরের ও উপদেশ দেয় দয়ার। তারাই সৌভাগ্যশালী”। (আল-বালাদ- ১১-১৮)।
আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদেরকে আল্লাহর রাস্তায় মাল খরচ করতে উদ্ভুদ্ধ করেন এভাবে-
অর্থাৎ- “যারা আল্লাহর রাস্তায় স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।
যারা স্বীয় ধন সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, এরপর ব্যয় করার পর সে অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে না এবং কষ্টও দেয় না, তাদেরই জন্য তাদের পালনকর্তার কাছে রয়েছে পুরস্কার এবং তাদের কোনো আশঙ্কা নেই, তারা চিন্তিতও হবে না।
নম্র কথা বলে দেয়া এবং ক্ষমা প্রদর্শন করা ওই দান খয়রাত অপেক্ষা উত্তম, যার পরে কষ্ট দেয়া হয়। আল্লাহ তাআলা সম্পদশালী, সহিষ্ণু।
হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান খয়রাত বরবাদ করো না সে ব্যক্তির মতো- যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ¡াস রাখে না। অতএব, এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মতো, যার উপর কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর উপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল। তারা ওই বস্তুর কোনো সাওয়াব পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।
যারা আল্লাহর রাস্তায় স¡ীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এবং নিজের মনকে সুদৃঢ় করার জন্য তাদের উদাহরণ টিলায় অবস্থিত বাগানের মতো, যাতে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়; অতঃপর দ্বিগুণ ফসল দান করে। যদি এমন প্রবল বৃষ্টিপাত নাও হয়, তবে হালকা বর্ষণই যথেষ্ট। আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম যথার্থই প্রত্যক্ষ করেন”। (সূরা বাকারাহ- ২৬১-২৬৫)।
সদকা করতে হয় নিজে মুহতাজ ও নিরীহ হয়ে। সদকা করতে যদি মনোভাব থাকে যে, আমি তাদের উপর এহসান করছি বা সদকার পরে নিজের দয়া ও এহসানের আলোচনা করা হয়, তাহলে সদকা নষ্ট হয়ে যায়। আখেরাতে তার বিনিময় পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তাআলা মাল খরচ করতে আহ্বান করেন-
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَنفِقُواْ مِمَّا رَزَقۡنَٰكُم مِّن قَبۡلِ أَن يَأۡتِيَ يَوۡم لَّا بَيۡع فِيهِ وَلَا خُلَّة وَلَا شَفَٰعَةۗ وَٱلۡكَٰفِرُونَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ
হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় করো, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত যালেম। (সূরা বাক্বারাহ- ২৫৪)।
পবিত্র কুরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে, অর্থাৎ- “এমন কে আছে যে আল্লাহকে কর্জ দেবে, উত্তম কর্জ; অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহই সংকোচিত করেন এবং তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে”। (বাকারাহ- ২৪৫)।
কর্জে হাসানা বলা হয় আল্লাহর রাস্তায় মাল খরচ করাকে, যে মালের কোনো বিনিময় নেওয়া হয় না।
খেদমতে খালক ও জনসেবার ময়দানে প্রত্যেক মুসলমানকে অংশ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে উলামায়ে কেরামের এ বিষয়ে খুবই মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এতে মুসলমানদের মধ্যে মায়া-মমতা গড়ে উঠবে। ফলে অনেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যাবে এবং এনজিওদের অনেক প্রোগ্রাম ভেস্তে যাবে।
খিদমতে খলকের ব্যাপারে আমরা নিম্নোক্ত প্রোগ্রামসমূহ নিতে পারি-
১. প্রত্যেকে নিজের ভাই-বোন, গোষ্ঠি-আত্মীয় ও পাড়া-প্রতিবেশীর দিকে লক্ষ রাখবো, যার যে সমস্যা অন্ন-বস্ত্র, চিকিৎসা ইত্যাদি দেখা দেয়- সাধ্যমতো তার সহযোগিতা করবো।
২. গ্রামে কারো ঘরের প্রয়োজন হলে উলামারা উদ্যোগ নিয়ে গ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে ঘরের ব্যবস্থা করা।
৩. কোনো গরিবের ছেলে-মেয়ে বিয়ের যোগ্য হলে পাত্র/পাত্রী সংগ্রহ করতে সহযোগীতা করা এবং গ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে আর্থিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিয়ের সমাধা করা।
৪. মহল্লার গরিব সন্তানদের ফ্রি পড়া লেখার ব্যবস্থা করা।
৫. সম্ভব হলে স্থানীয় কোনো মাদরাসায় নিজ উদ্যোগে অথবা এলাকার উলামাদের উদ্যোগে কখনও চোখের ছানি অপারেশন, আবার কখনও খতনা দেয়ার ফ্রি ব্যবস্থা করা।
৬. রাজনীতি: রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারা জনগণের মানবিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার। এই মৌলিক অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা ডাকাতি করে সম্পদ নিয়ে যাওয়ার মতো অপরাধ। যে সরকার বা সংস্থা মানুষকে তার এই অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখবে, তারা মানুষ নামের কলঙ্ক অসৎ ও যালিম। উলামায়ে কেরামের মধ্যে যারা রাজনীতির আগ্রহ রাখেন, তাঁদের জন্য রাজনীতি অতি প্রয়োজন। তার কারণ-
১. আল্লাহ তাআলা উলামাদের আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার করতে বলেছেন। রাজনীতি রাষ্ট্রীয় আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারকে বলা হয়। অর্থাৎ- রাষ্ট্রকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। তাই তা করতে হবে।
২. যে কারণে পাবলিক জনতাকে আদেশ-নিষেধ জরুরি, একই কারণে রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা আছেন তাদেরকে আদেশ-নিষেধ অনেক বেশি জরুরি।
৩. ইসলাম হিন্দু, ইহুদী ও নাসারাদের ধর্মের মতো কোনো আংশিক ধর্ম নয়। এটা এক পরিপূর্ণ ধর্ম। রাষ্ট্রীয় আহকামাতও ইসলামের অংশ বিশেষ। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়ারিস সূত্রে সার্বিক দ্বীনের আদেশ-নিষেধ উলামায়ে কেরামের দায়িত্ব।
৪. ইসলামবিরোধী কাজ দেখে যে চুপ থাকে, তাকে বোবা শয়তান বলা হয়েছে। হাদীসে ওই এলাকাকে ধ্বংস করার হুমকি আসছে- যেখানে গুনাহের কাজ সংগঠিত হচ্ছে, আর মুসলমান নীরবে তা দেখছে। (মুজমাউয যাওয়াইদ- ১২১৪৪)।
৫. রাষ্ট্রীয় আমর বিল মারূফকে হাদীসে আফযলে জিহাদ বলা হয়েছে-
عن ابي سعيد الخدري ؓ قال قال رسول الله ﷺ افضل الجهاد كلمة عدل عند سلطان جائر
অর্থাৎ- হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাযি.) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সব চেয়ে বড় জিহাদ হল অত্যাচারী কর্তৃপক্ষের সামনে ন্যায় কথা বলা। (ইবনে মাজাহ- ২১৭৭)।
وعن أبي أمامة ؓ قال عرض لرسول الله ﷺ رجل عند الجمرة الأولى فقال يا رسول الله أي الجهاد أفضل؟ …. قال كلمة حق عند سلطان جائر. (رواه ابن ماجه)
অর্থাৎ- ইসলামবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত বাদশাহের প্রতি হক কথা বলা। (তিরমিযী- ৪০১২)।
৬. যে ময়দানে উলামাদের উপস্থিতি না থাকে এই ময়দান পুরোটাই কুফুরের দখলে চলে যায়। তাই রাজনীতিতে উলামাদের উপস্থিতি যদি না থাকে, তবে সরকার ও বিরোধী দল কেউই রাজ্য পরিচালনায় ইসলামের মুখাপেক্ষী হবে না।
৭. উলামায়ে কেরাম সরকারকে দ্বীনদ্রোহী কর্মকান্ডে যদি বাধা প্রদান না করেন, তবে দ্বিধাহীনভাবে সরকার হরদম বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশ চালাতে থাকবে। তাতে মাত্র কয় বছরের মধ্যে এক মুসলিম রাষ্ট্র কুফরি স্থানে পরিণত হবে।
৮. সরকার যতই শক্তিশালী হোক উলামাদের প্রতিবাদ তাদের জন্য বড় বাধা। এই বাধার মুখে সরকার কোনো কাজ করতে অন্তত: চিন্তা ভাবনা করবে, যেন সরাসরি ইসলাম বিরোধীতা না হয়।
৯. ভারত ও পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম বাংলাদেশের তুলনায় অনেক সংরক্ষিত। তার কারণ, ওই খানের উলামারা রাজপথে বেশ সরব উপস্থিত। আর আমরা রাজপথে উপস্থিত মাত্র পাঁচ ভাগ।
১০. আমাদের আকাবির ও পূর্বসূরীরা জান দিয়ে, জেল খেটে দেশান্তর হয়ে ১৯০ বছরের কুরবানীর পর ইংরেজদের গোলামী থেকে দেশ আযাদ করলেন। আজ আমরা রাজপথ ছেড়ে দিয়ে হাত পা গুটিয়ে মসজিদ মাদরাসায় বসে থাকবো? এর চেয়ে হতাশার কী হতে পারে?
১১. দেশের সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ। এই অজ্ঞতার সাইক্লোন দেশে চলতে থাকবে। আর বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবেন- এটা কি ইসলাম সমর্থন করে? না কোনো বিবেকের আওতায় পড়ে? বরং এটা দায়িত্বহীনতা বটে।
১২. রাজনীতি করলে সমাজিক সহনশীলতার মানসিকতা তৈরি হয়। আজ রাজনীতি না করার কারণে উলামারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। ফলে ইসলামবিমুখ মানুষ সমাজের নেতৃত্বে এসেছে। এজন্যই সমাজ দ্রুতগতীতে বে-দ্বীনির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটা উপলব্ধী করার ক্ষমতাও অনেক আলেম হারিয়ে ফেলেছেন।
১৩. রাজনীতি করলে মানুষ সাহসী ও অধিকার সচেতন হয়। এই সাহস ও সচেতনতার ফলে অনেক বে-দ্বীনি প্রোগ্রাম সংগঠিত হতে পারে না এবং দেশের লোকজন নিয়ে দেশ ও জাতির ক্ষতিকর ও গুনাহের কাজে বাধা দেওয়ার সাহস পায়।
১৪. রাজনীতিতে বুদ্ধি-বিবেক প্রখর হয়, অরাজনৈতিক লোক সরল হয়।
১৫. রাজনীতিতে অংশিদারিত্ব না থাকলে নিজ দেশে ভীনদেশী মানুষের মতো থাকতে হয়। কারণ, দেশের মালিক দেশ নিয়ে ভাবে, মেহমানরা দেশ নিয়ে ভাবে না। তাই দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে।
১৬. যারা উলামাদের রাজনীতিকে পছন্দ করে না, তারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলাম বিরোধীতাকে কোনো সমস্যা মনে করে না। এ থেকে পরিত্রান খুবই জরুরি।
আরও পড়তে পারেন-
- কওমি মাদ্রাসা: সামাজিক পুঁজি ও দারিদ্র্য বিমোচন
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
- সুখময় দাম্পত্য জীবনের নববী রূপরেখা
১৭. পাঁচ-সাত জনের পরিবারের নীতিতে ইসলাম প্রয়োজন। দেড়শত-দুইশত জনের সমাজনীতিতে ইসলাম প্রয়োজন। তাই ১৭-১৮ কোটি জনগণের নীতিতেও ইসলাম খুবই প্রয়োজন। মুসলমানদের পারিবারিক জীবন ইসলামী হোক। মুসলমানদের সামাজিক জীবন ইসলামী হোক। তার জন্য উলামায়ে কেরামের প্রচেষ্টা করা দ্বীনি দায়িত্ব বটে। তদ্রুপ মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলাম হোক, তার জন্য উলামাদের প্রচেষ্টা করাও দ্বীনি দায়িত্ব।
আমাদের দেশ পরিচালনা করার ক্ষমতা নেই। আমাদের রাজনীতি হলো সরকারকে গঠণমূলক পরামর্শ দেওয়া এবং দেশ, জাতি ও ধর্মদ্রোহী কাজে বাধা প্রধান করা (অর্থাৎ প্রতিবাদ করা), এটা উলামা ও জনগণের দ্বীনি দায়িত্ব। এটা আমাদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার।
রাজনীতি সরকার বিরোধীতায় হৈ-হল্লার নাম নয়। রাজনীতি হলো জনপ্রিয়তা ও জনগণের আস্থাশীল হওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করা, যাতে করে এই শক্তিটাকে দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্যবহার করা যায়। রাজনীতি হলো যুক্তিসঙ্গত শান্ত প্রতিবাদ ও সরকারকে সুপরামর্শ দেয়ার নাম। রাজনীতির ময়দানে চলতে হবে বিবেকের গাড়ীতে, আবেগের গাড়ীতে নয়। রাজনীতির রাস্তা অতিক্রম করতে হবে ধৈর্যের সাথে, উত্তেজনার সাথে নয়।
ধৈর্যধারণ করা
আমাদের প্রোগ্রামে অর্থাৎ- ব্যক্তিগঠন, দাওয়াত ও তালীম, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ এবং রাজনীতিতে অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। তাই ধৈর্যধারণ করে ইস্তেকামাতের সাথে প্রোগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে রাজনীতিতে সরকারি-বেসরকারি মাস্তানদের যুলুম নির্যাতনে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কারণ, প্রতিশোধের রাস্তা ভয়ংকর, তাই এই রাস্তা পরিহার করতে হবে এবং সবরের রাস্তা অবলম্ভন করতে হবে। সবর করলে অনেক লাভ-
১. সবরে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন।
২. সবর করলে জান্নাতে যাওয়া যায়।
৩. সবর করলে ফিতনা বৃদ্ধি পায় না।
৪. সবর করলে আল্লাহ খায়র ও বরকত দান করেন এবং সম্মান বৃদ্ধি করেন।
৫. সবর করলে আল্লাহ প্রতিশোধ নেন।
৬. সবর করলে অনেক সময় যালিম অনুতপ্ত হয়।
সবরের অনেক ফযীলত কুরআনে মাজীদে বর্ণিত হয়েছে। যথা-
وَ الَّذِیْنَ صَبَرُوا ابْتِغَآءَ وَجْهِ رَبِّهِمْ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اَنْفَقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ سِرًّا وَّ عَلَانِیَةً وَّ یَدْرَءُوْنَ بِالْحَسَنَةِ السَّیِّئَةَ اُولٰٓىِٕكَ لَهُمْ عُقْبَی الدَّارِۙ۲۲ جَنّٰتُ عَدْنٍ یَّدْخُلُوْنَهَا وَ مَنْ صَلَحَ مِنْ اٰبَآىِٕهِمْ وَ اَزْوَاجِهِمْ وَ ذُرِّیّٰتِهِمْ وَ الْمَلٰٓىِٕكَةُ یَدْخُلُوْنَ عَلَیْهِمْ مِّنْ كُلِّ بَابٍۚ۲۳ سَلٰمٌ عَلَیْكُمْ بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَی الدَّارِؕ۲۴ الرعد ২২-২৪
“এবং যারা স্বীয় পালনকর্তার সন্তুষ্টির জন্য সবর করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে, আর আমি তাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং যারা মন্দের উত্তর ভালো দ্বারা দেয়, তাদের জন্যে রয়েছে পরকালের গৃহ। তা হচ্ছে বসবাসের বাগান। তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের সৎকর্মশীল বাপ-দাদা, স¡ামী-স্ত্রী ও সন্তানেরা। ফেরেশতারা তাদের কাছে আসবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে। বলবে- তোমাদের সবরের কারণে তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আর তোমাদের এ পরিণাম-গৃহ কতই না চমৎকার”। (সূরা রা’দ- ২২-২৪)।
পবিত্র কুরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে- “আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহ্বান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দ যুক্ত পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তাই ওই ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভালো জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথে আছে। আর যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ওই পরিমাণ প্রতিশোধ গ্রহণ করবে, যে পরিমাণ তোমাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়। আর যদি সবর কর, তবে তা সবরকারীদের জন্য উত্তম। আপনি সবর করবেন। আপনার সবর আল্লাহর জন্যই, তাদের জন্য দুঃখ করবেন না এবং তাদের চক্রান্তের কারণে মন ছোট করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন, যারা পরহেযগার এবং যারা সৎকর্ম করে”। (সূরা নাহল- ১২৫-১২৮)।
হযরত ইউসুফ (আ.) সবরের কারণে বাদশাহীর আসনে আসীন হন। ইরশাদ হয়েছে- “তারা বলল, তবে কি তুমিই ইউসুফ! বললেন- আমিই ইউসুফ এবং এ হলো আমার সহোদর ভাই। আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। নিশ্চয় যে তাকওয়া অবলম্বন করে এবং সবর করে, আল্লাহ এহেন সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না”। (সূরা ইউসুফ- ৯০ আয়াত)।
এভাবে প্রচুর আয়াতে ও হাদীসে সবরের ফযীলত বর্ণিত রয়েছে, এসব আয়াত শুধু তিলাওয়াতের জন্য নয়, বরং তার উপর আমল করে যেন মুসলমানরা জান্নাতের নিয়ামত হাছিল করতে পারেন। যদি কোনো যুলুম-নির্যাতন না হয়, তবে সবর করবেন কীভাবে? আল্লাহ আমাদেরকে যেন আফিয়াতে রাখেন। তবে কখনো যদি যুলুমের স্বীকার হই, তাহলে যেন সবরের উপর আমল করে কুরআন-হাদীসে উল্লিখিত নিয়ামত হাসিল করতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ যেন তাওফীক দান করেন, যেভাবে পূর্বেকার উম্মতদেরকে তাওফীক দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন-
وَمَا لَنَآ أَلَّا نَتَوَكَّلَ عَلَى ٱللَّهِ وَقَدۡ هَدَىٰنَا سُبُلَنَاۚ وَلَنَصۡبِرَنَّ عَلَىٰ مَآ ءَاذَيۡتُمُونَاۚ وَعَلَى ٱللَّهِ فَلۡيَتَوَكَّلِ ٱلۡمُتَوَكِّلُونَ
“আমাদের আল্লাহর উপর ভরসা না করার কি কারণ থাকতে পারে, অথচ তিনি আমাদেরকে আমাদের পথ বলে দিয়েছেন। তোমরা আমাদেরকে যে পীড়ন করেছ, তজ্জন্য আমরা সবর করব। ভরসাকারিগণের আল্লাহর উপরই ভরসা করা উচিত। (সূরা ইবরাহীম- ১২)।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমরা নিজে জীবন নষ্ট করতেছি। তাহলো আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ لَنُذِیْقَنَّهُمْ مِّنَ الْعَذَابِ الْاَدْنٰی دُوْنَ الْعَذَابِ الْاَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ یَرْجِعُوْنَ
অর্থাৎ- “গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস¡াদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে”। (সিজদা- ২১)।
দুনিয়াতে কোনো বিপদ-আপদ আসে শাস্তির জন্য নয় বরং সতর্কের জন্য। তাই আসমানী বা দুনিয়াবী কোনো বিপদ আসলে প্রথমে চিন্তা করতে হবে- কেন আল্লাহ তাআলা আমাকে এই বিপদে ফেললেন? নিশ্চয় আমার কোনো এক বা একাধিক আচরণে আল্লাহ আমার উপর অসন্তুষ্ট।
এই অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে- আমার নামায ও তিলাওয়াতের গাফিলতি, পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও মহল্লার লোকজনের সাথে অসদাচরণ, মালি খিয়ানত, শক্তির অপব্যবহার, দুর্বলের উপর যুলুম নিপীড়ন, হারাম মাল উপার্জন, ফাসাদ সৃষ্টি ও গুনাহের কাজে সহযোগিতা ইত্যাদি হতে পারে। যদি আমি চিন্তা করে বিপদের কারণ বের করে তাওবা করি এবং আগামীর জন্য সতর্ক হই, তাহলে এই বিপদ আমার জন্য রহমত হবে। আর যদি আমি অনুতপ্ত না হই এবং নিজের ইলাহের দিকে মনোযোগী না হই, তাহলে তো আমি এক উন্মাদ- যার দুনিয়ায় লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে, আখেরাতের আযাব থেকে রক্ষাও পাব না।
লেখক: শায়খুল হাদীস, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/