।। মাওলানা আহমদ মুমশাদ আলী নদভী ।।
পৃথিবীর যেখানেই মুসলমানরা বসবাস করছে সেখানে তারা নিজস্ব স্বকীয়তা, নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে প্রহসনের শিকার। মুসলমানদের মধ্যে বৃহত্তর একটি অংশ এর জন্য আমাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাহীনতাকে দায়ী করেন। তারা মনে করেন, যদি মুসলমানদের হাতে ক্ষমতা ও নেতৃত্ব থাকতো, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের এই অধঃপতন হতো না। আমরা এত সমস্যায় জর্জরিত হতাম না। তাদের দৃষ্টিতে, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আমাদের শক্তিশালী অবস্থানই এ সমস্যা নিরসনের পথ খুলতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা কি আসলে এমনই? রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাই কি সব সমস্যা সমাধানের মূলমন্ত্র? নাকি ভিন্ন কোনো উপায়ও আছে?
আমাদের চিন্তা ও চেতনায়, ভাব ও ভাবনায় সৃজনশীল, মননশীল এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য হিন্দুস্তান, স্পেন, তুরস্ক ও মিশরের ইতিহাসে অনেক উপাদান আছে। যদিও এটা স্বতন্ত্র চিন্তা ও গবেষণার বিষয় যে, ইসলামী সমাজ-ব্যবস্থা প্রবর্তনের পথ ও পন্থা কী হবে, কিন্তু সেই ব্যবস্থা আমাদের হাতে নেই বলে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব, ভিন্ন কোনো উপায় খুঁজব না; তা কী করে হয়! আমরা যদি বর্তমানে বিভিন্ন উন্নত দেশ ও জাতির অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করি কিংবা একটু পেছনে গিয়ে মুসলিম ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় দেখি, সেখানে আমরা আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য উত্তম পথ ও পাথেয় খুঁজে পাব। এ কাজটা আরো আগে করতে পারলে অতীত নিয়ে আফসোস করে আজ আমাদেরকে এভাবে কপাল ঠুকতে হতো না। ‘আমার বাবা বাদশাহ ছিলেন’ এ জাতীয় ডায়ালগ মেরে মিথ্যা সান্ত¡না খোঁজার অপপ্রয়াস চালাতে হতো না। ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে পদে পদে আমরা এভাবে বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত হতাম না।
কথা হলো, একটি জাতির হাত থেকে ক্ষমতার লাগাম ছুটে গেলে অথবা তারা তাদের রাজনৈতিক স্বকীয়তা ও কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেললে তারা কি একেবারেই ধ্বংস হয়ে যায়? এর জন্য কি তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়? তাদের কি আর কিছুই করার থাকে না? সুইজারল্যান্ড এমন একটি রাষ্ট্র যারা কখনও কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি। উপনিবেশিক শক্তি হিসেবে নিজেদের জাহির করেনি। অন্যের সম্পদ কুক্ষিগত করে কখনও নিজেদের কোষাগার সমৃদ্ধ করেনি। তারপরও তো সুখ, স্বাচ্ছন্দ, বিলাসিতা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে সুইজারল্যান্ড পৃথিবীর অন্যতম একটি সুখি রাষ্ট্র। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাশাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার পর কেউ কি ভেবেছিল যে, জাপান আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে! অথচ সেই বিধ্বস্ত ও পর্যুদস্ত জাপানিরাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে নিজেদেরকে উন্নতির স্বর্ণশিখরে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরাইল ও ইহুদি জাতি সারা বিশ্ব থেকে একঘরে হয়ে যায়। কারও সাথে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু তারাও এটার ওপর হায় আফসোস করে হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। এই সম্পর্কহীনতাকে কাজে লাগিয়ে তারা তাদের আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছে। তারপর সেগুলোর সমাধান করে আজ তারা সারা বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে। মাত্র ৬০ লাখ ইহুদি ৭০০ কোটি মানুষের ওপর নিজেদের আধিপত্যের ছড়ি ঘুরাচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অসংখ্য নজির আছে, যেখানে একটি অধঃপতিত জাতি স্বমহিমায় ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিয়েছে। তারা অতীত নিয়ে পড়ে থাকেনি। কিন্তু আমরা কি সেখান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পেরেছি!
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
যদি ক্ষমতায় আরোহণই মুসলমানদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতো, তাহলে পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ ভূখন্ড শাসন করার পর মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা ছুটে যাওয়ার পর অদ্যাবধি পৃথিবীর বুকে তাদের টিকে থাকার কথা ছিল না। ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে এত ঘাত-প্রতিঘাত ও ষড়যন্ত্রের পরও তারা যে আজও একটি জাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, এটা কোনো মামুলি ব্যাপার নয়। মুসলমানরা খেলাফত-বঞ্চিত হওয়ার পরও তাদের নির্মূল করতে কোনো কূটকৌশল কাজে আসেনি। একথা মনে রাখা উচিত, আমরা যদি রাজনীতির মাঠের পাকা খেলোয়াড় নাও হই তবুও আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য এতটাই সতেজ ও সমৃদ্ধ যে, ইচ্ছা করলে আমরা আবারও মৃতপ্রায় মানবতাকে জাগিয়ে তুলতে পারি। তাতে প্রাণ সঞ্চার করতে পারি। কিন্তু এর জন্য পূর্বশর্ত হলো, আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে আগে প্রাধান্য দিতে হবে। সেটা কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না। যদি ক্ষমতাই সবকিছু হতো, তাহলে স্পেন, তুরস্ক, মিশর এবং আমাদের হিন্দুস্তানে মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর আমাদের নাম-নিশানা এবং অস্তিত্বও টিকে থাকত না। ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করার জন্য মুদ্রার দুই পিঠই আমাদের সামনে আছে। সারা বিশ্বকে উন্নতি, অগ্রগতি এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির পথ দেখানো বিভিন্ন দেশ ও জাতির অধঃপতনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে, খুব সহজেই এর সমাধান বের হয়ে আসবে।
পৃথিবীতে সাধারণত উন্নত দেশ ও জাতিগুলোর মূল্যায়ন করা হয়। বিশেষ করে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈশ্বিক উন্নয়নে ইতিবাচক অবদান রাখে, অন্যরা তাদেরকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে। জাপান, জার্মানি এবং ইসরাইল যুদ্ধ-বিগ্রহে পর্যুদস্ত হওয়ার পরও তারা পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়ে বিশ্বের সামনে নিজেদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গায় তারা সবার কাছে নিজেদের গ্রহণীয় ও বরণীয় করে তুলেছে। অথচ এর বিপরীতে আমরা রাজনৈতিক ব্যর্থতার ওপর আফসোস করেই কয়েক শতাব্দি কাটিয়ে দিয়েছি। এখনও এখানে সেখানে এই মাতম চলে। যে উম্মতকে তাদের নবী ‘ওপরের হাত উত্তম’ হওয়ার সবক শিখিয়েছেন তারা আজ রিক্তহস্ত হয়ে ভিক্ষার থলে নিয়ে ধারে ধারে ঘুরে বেড়ায়। আমরা সামনে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে আত্মরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছি। কারণ, পরনির্ভরতা আত্মরক্ষার মানসিকতাই তৈরি করে। এর মাধ্যমে নিজ পায়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস ও আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় না। অন্যদিকে দাওয়াত ইলাল্লাহ স্বনির্ভর ও অগ্রগামী হওয়ার শক্তি যোগায়। নিজ পায়ে ঘুরে দাঁড়ানো শেখায়। যে উম্মতকে পৃথিবীতে দাঈ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে, তারা আজ অন্যের দাওয়াতের পাত্র হতে লজ্জাবোধ করে না। যাদেরকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে, তারাই কিনা আজ ছাত্র সেজে বসে আছে! এর চেয়ে আত্মহননকারী নির্বোধ আর কে হতে পারে! যাদেরকে অন্যের পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে, তারা আজ পথিক হয়েও চলতে পারছে না।
আমাদের হাত থেকে এত বড় শাসন ব্যবস্থা ছুটে যাওয়ার এটাই কারণ যে, আমরা আমাদের কর্তব্য ভুলে গেছি। আমরা রাজপ্রাসাদ ও অট্টালিকা সাজাতে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, মানুষকে সাজাতে আমরা সময় পাইনি। আমরা প্রাসাদের অন্দরমহল রাঙিয়েছি ঠিকই, কিন্তু মানুষের ভেতরের মনুষ্যত্বকে রাঙাইনি। আমাদের প্রতি নির্দেশ ছিল মানুষের চিন্তা-চেতনা ও হৃদয়রাজ্য জয় করার, কিন্তু আমরা ব্যস্ত ছিলাম রাজ্যের সীমানা বিস্তৃতিতে। ফলাফল এটাই দাঁড়িয়েছে, স্পেনের যে আলহামরার মিনারচূড়া থেকে আল্লাহু আকবারের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসত সেই আলহামরায় আমাদের শাসন ব্যবস্থার কবর রচিত হয়েছে।
জার্মানী, জাপান, চীন এবং ইসরাইলের ইতিহাস থেকে আমাদের কি কিছুই শেখার নেই, যারা একবার সর্বস্ব হারিয়ে পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে? পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যান্য জাতির ভাগ্যেও কি উত্থান-পতন আসেনি? তারা কি এমন প্রতিকূল পরিবেশে লাঞ্ছনা, বঞ্ছনা ও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বসে ছিল, নাকি অতীত ব্যর্থতা ও পরাজয় পেছনে ফেলে স্বমহিমায় নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিয়েছে?
মহান আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতির চেষ্টা, সাধনা, শ্রম-কুরবানী ও আগ্রহের ভিত্তিতেই তাদেরকে সফলতা ও ব্যর্থতা দান করেন। এ নিয়ম তিনি কখনও পরিবর্তন করেননি এবং এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেননি। কথা হলো, অন্যান্য জাতি যদি চেষ্টা-সাধনা ও শ্রম দিয়ে সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহণ করতে পারে, তাহলে আমরা কুরআন-হাদিসের ধারক-বাহকরা কেন আমাদের সফলতার পথ ও পন্থা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি না? সৌভাগ্যক্রমে আমরা কখনও কোনো পথ খুঁজে পেলেও আমাদের গন্তব্যস্থল কোথায় তা বলতে পারি না।
আসল কথা হেেলা, মুসলমানদের সফলতা ও ব্যর্থতা আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর বুকে তাঁর কালেমার আওয়াজ ছড়িয়ে দেয়ার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। ‘ইলায়ে কালিমাতুল্লাহ’র এই মহান জিম্মাদারি থেকে যখনই আমরা পেছনে সরে গেছি, তখনই আমাদের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, স্বকীয়তা, সফলতা ও মর্যাদা অন্যের হাতে কুক্ষিগত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের হাতে যদি ইসলামি খেলাফত চলেও আসে, তবুও আমরা দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও কালিমার দাওয়াত দেয়া ছাড়া সেটা বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারব না। রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আমাদের শক্তিশালী অবস্থানই সব সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় নয়। হ্যাঁ, এটা সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে। হিন্দুস্তানের মুঘল সম্রাটগণ এবং অন্যান্য দেশের মুসলিম শাসকরা যদি নিজ নিজ খেলাফতকালে দাওয়াতের ফরয দায়িত্ব গ্রহণ করে মানুষকে সত্যের পথে ধরে রাখতে পারত, তাহলে হয়তো আজ আমাদেরকে এমন বৈরি পরিস্থিতির শিকার হতে হতো না।
এই মুহূর্তে মুসলমানদের জন্য খুবই জরুরি হলো, প্রত্যেক মুসলমান নিজেকে দ্বীনের একজন সৈনিকরূপে সাজিয়ে যামানার কান্ডারী হিসেবে আবির্ভুত হওয়া। ক্লান্ত-শ্রান্ত তৃষ্ণার্ত মানবতা অতীতে যেমন ইসলাম ও মুসলমানদের মাধ্যমে শান্ত ও সিক্ত হয়েছে, আজও ঠিক একইভাবে শান্ত ও সিক্ত হবে। এছাড়া ভিন্ন কোনো উপায় নেই। মারামারি ও হানাহানি শুধু ঘৃণার পথই প্রশস্ত করে। এর মাধ্যমে কাজের কাজ কিছুই হয় না, বরং দাওয়াতের পথ রুদ্ধ হয়। আমাদের উচিত, অন্যের কাছে হাতপাতার মানসিকতা ছেড়ে গঠনমূলক এবং ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে অন্যকে কিছু দেয়ার চেষ্টা করা। এই নিয়তেই একজন দাঈ ও শিক্ষক দাওয়াতের ময়দানে আসবে যে, আমাদের হাত ধরেই তৃষ্ণার্ত মানবতা আবার সিক্ত হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চরিত্র ও উন্নতির ক্ষেত্রে অতীতে অবদান রেখে আমরা যেভাবে মানবতাকে সভ্যতা ও মনুষ্যত্বের পথ দেখিয়েছি, ঠিক একইভাবে সে কাজ আমরা এখনও করব। তৃষ্ণার্ত মানবতার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরিয়ে যায়নি, কিন্তু শর্ত হলো আমাদের নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে।
[উর্দূ মাসিক আরমোগান থেকে অনূদিত]
অনুবাদ- মুহাম্মাদুল্লাহ আরমান
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/