যুগে যুগে তারাবীহ: বিশ রাকআতের প্রামাণ্যতা

।। মাওলানা সাঈদ আহমদ ।।

নবী কারীম (সা.)এর যুগে তারাবীহ
নবী কারীম (সা.) রমযানের এক রাতে মসজিদে তারাবীহ পড়লেন। সাহাবায়ে কেরামও তাঁর সাথে নামাযে শরীক হলেন। এ বিষয়ে লোকদের মাঝে আলোচনা হলো। ফলে (দ্বিতীয় রাতে) মুক্তাদির সংখ্যা বেড়ে গেল। আরো আলোচনার ফলে তৃতীয় রাতে মসজিদ ভর্তি মুক্তাদি হলো। চতুর্থ রাতে মসজিদের ধারণ-ক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক হলো। (তবে এ রাতে তারাবীর জন্য তিনি মসজিদে আসলেন না)। ফজরের নামাযের জন্য মসজিদে এসে নামায শেষে বললেন, রাতে আমার জন্য তোমাদের অপেক্ষার বিষয়ে আমি অবগত। কিন্তু (না আসার কারণ হলো) আমার আশঙ্কা হয়েছে যে, তোমাদের উপর তারাবীহ ফরয হয়ে যাবে। আর তোমরা তা পালনে অক্ষম হবে। (বুখারী- ২০১২, মুসলিম- ১৭৮)।

২. সা’লাবা বিন আবু মালেক কুরাযী (রহ.) বলেন, রাসূল (সা.) রমযানের এক রাতে বের হয়ে কিছু সাহাবাকে মসজিদের এক কর্ণারে নামায পড়তে দেখলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তারা কী করছে? একজন উত্তর দিলেন, হে আল্লাহর রাসূল ! তাদের কুরআন বেশি মুখস্থ নেই। আর উবাই ইবনে কা’ব (রাযি.) ভাল কারী ও হাফেজ। তাই তাঁর পিছনে তারা তারাবীহ পড়ছেন। রাসূল বললেন, তারা ভালো কাজ করেছে বা সঠিক করেছে। (আস-সুনানুল কুবরা, বায়হাকী ৪৬১১, ৪৬১২; হাদীসটি প্রমাণযোগ্য)।

এভাবে আরো কিছু হাদীস থেকে রাসূল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের তারাবীর নামায জামাআতের সাথে আদায় করার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে একেবারে বিশুদ্ধ সনদ দ্বারা তিনি বিশ রাকআত বা কোন নির্দিষ্ট সংখ্যায় তারাবীহ পড়ার কথা প্রমাণিত নয়।

হযরত আবু বকর (রাযি.)এর যুগে তারাবীহ
হযরত আবু বকর (রাযি.)এর খিলাফতকাল মাত্র দু’বছর। এ স্বল্পতম সময়ে বিভিন্ন ফিতনা মুকাবালায় বেশি ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তারাবীর বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ হয়ে উঠেনি বা এ বিষয়ে কোন চিন্তা তাঁর মনে আসেনি। কাজেই তাঁর খিলাফতকালেও বিষয়টি আগের মতোই থেকে যায়। (বুখারী ২০০৯)।

হযরত উমর (রাযি.)এর যুগে তারাবীহ
এভাবে হযরত উমর (রাযি.)এর সাড়ে দশ বছর খিলাফতকালের শুরুর দিকে (এক রমযান) পূর্বের অবস্থায়ই ছিল। (প্রাগুক্ত)। অতঃপর হযরত উমর (রাযি.) ১৪ হিজরীতে অসংখ্য সাহাবায়ে কেরামের জীবদ্দশায় তারাবীর বিষয়ে দু’টি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

এক. ফরয নামাযের মতো এক ইমামের পিছনে তারাবীর নামায জামাআতের সাথে আদায় করার ব্যবস্থা। যেমন- সহীহ বুখারীতে এসেছে, রমযানের এক রাতে উমর (রাযি.) মসজিদে তাশরীফ নিয়ে যান এবং দেখতে পান যে, মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট জামাআত হচ্ছে। তিনি চিন্তা করলেন সকল নামাযীকে এক ইমামের পিছনে একত্র করে দেয়া উচিত। অতঃপর তিনি এই আদেশ জারি করে দেন এবং উবাই ইবনে কা’ব (রাযি.)কে ইমাম বানিয়ে দেন। (বুখারী, ২০১০)।

দুই. তারাবীর রাকআত সংখ্যা বিশ নির্ধারণ। যেমন ইমাম বুখারী (মৃত্যু ২৫৬ হি.) (রহ.)এর শায়খ আলী ইবনুল জা’দ (রহ., মৃত্যু ২৩০ হি.) স্বীয় ‘মুসনাদে’ সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেন-

عَنِ السَّائِبِ كَانُوا يَقُومُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً

হযরত সাইব ইবনে ইয়াযীদ (রাযি.) বলেন, তাঁরা (সাহাবা ও তাবেয়ীন) উমর (রাযি.)এর যুগে রমযান মাসে বিশ রাকআত (তারাবীহ) পড়তেন (মুসনাদে ইবনুল জা’দ ২৯২৬; আস-সুনানুল কুবরা, বায়হাকী- ৪৬৭৯)।

বর্ণনাটির সূত্র সহীহ। বেশ কয়েকজন মুহাদ্দিস সুস্পষ্টভাবে এটাকে সহীহ বলেছেন। (দেখুন- আল-মাজমূ’, নববী ৩/৫২৭, আল-বদরুল মুনীর ১০/২৭৪, ইবনুল মুলাক্কিন, উমদাতুল কারী, আইনী ৫/৩৮৯, ফাতাওয়া আজীজী পৃ. ৪৮৪)।

কাজেই বারো-তেরশো বছর পরে এসে আহলে হাদীস আলেম মাওলানা মুবারকপুরী (মৃত্যু ১৩৫৩ হি.) ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ গ্রন্থে ও শায়খ আলবানী (মৃত্যু ১৪২০ হি.) ‘সালাতুত তারাবীহ’তে যা বলেছেন, তা কর্ণপাতের অনুপযুক্ত।

বিগত শতাব্দির হিন্দুস্তানের বড় মুহাদ্দিস হাবীবুর রহমান আযমী (রহ. মৃত্যু ১৪১২ হি.) ‘রাকঅতে তারাবীহ’ কিতাবে মুবারকপুরীর স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। আর শায়খ আলবানী যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতির শিকার হয়েছেন, তার মধ্যে বেশ কিছু বিষয় ধরে দিয়েছেন সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় ইফতা বিভাগের সাবেক গবেষক মুহাদ্দিস ইসমাঈল ইবনে মুহাম্মদ আনসারী তাঁর ‘তাসহীহু সালাতিত তারাবীহ ইশরীনা রাকআতান ওয়ার রদ্দু আলাল আলবানী ফী তাযয়ীফিহী’ কিতাবে।

এছাড়াও তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে রুমান (মৃত্যু ১৩০ হি.), আব্দুল আজীজ ইবনে রুফাই (১৩০ হি.), হাসান বসরী (১১০হি.), ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ (১৯৮হি.) ও মুহাম্মদ ইবনে কা’ব কুরাযী (রহ., ১২০হি.) প্রমূখ থেকে হযরত উমর (রাযি.)এর যুগে রমযান মাসে বিশ রাকআত তারাবীহ পড়ার কথা প্রমাণিত হয়। (মারিফাতুস সুনান, বায়হাকী ৫৪১১; ইবনে আবী শায়বাহ ৭৭৬৪, ৭৭৬৬; আবু দাউদ ১৪২৯; সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী ১/৪০০)।

উসমান (রাযি.)এর যুগে তারাবীহ
হযরত উসমান (রাযি.)এর খিলাফতকাল বারো বছর। এ বারো বছরে কীভাবে তারাবীহ পড়া হতো, সে সম্পর্কে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে হ্যাঁ, হিজরী ১৪ সাল থেকে হযরত উমর (রাযি.)এর শাহাদাত পর্যন্ত মোট দশ বছর হযরত উসমান (রাযি.)এর উপস্থিতিতেই বিশ রাকআত তারাবীহ হয়েছে। তিনি এর উপর কোন আপত্তি করেননি। আর তিনি যদি তাঁর খিলাফতকালে নতুন কোন ফরমান জারি করতেন, তাহলে অবশ্যই ইতিহাসের পাতায় তা সংরক্ষিত থাকত।

হযরত আলী (রাযি.)এর যুগে তারাবীহ
হযরত আলী (রাযি.)এর পাঁচ বছর খেলাফতকালেও তারাবীহ বিশ রাকআত পড়া হতো। বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু আব্দুর রহমান আস-সুলামী (রাহ.) বলেন-

আলী (রাযি.) রমযানে কারীগণকে ডাকলেন এবং তাঁদের একজনকে লোকদের নিয়ে বিশ রাকআত তারাবীহ পড়তে আদেশ করলেন। আর তিনি বিতর পড়াতেন। (আস-সুনানুল কুবরা, বায়হাকী- ৪২৯১)।

এছাড়াও হযরত আলী (রাযি.)এর বিশেষ ছাত্র শুতাইর ইবনে শাকাল, আলী ইবনে রাবীআহ, আব্দুর রহমান ইবনে আবী বাকরাহ, সাঈদ ইবনে আবীল হাসান ও সুয়াইদ ইবনে গাফালাহ (রহ.) প্রমুখ স্ব স্ব স্থানে তারাবীহ বিশ রাকআত পড়তেন। (ইবনে আবী শায়বাহ ৭৭৬২, ৭৭৬৩, ৭৭৭২; রাকআতে তারাবীহ পৃ. ৯৮)।

তারাবীহ বিশ রাকআত পড়তে হবে কেন?
প্রশ্ন: যে বিষয়টি রাসূল নির্ধারণ করেননি, তা হযরত উমর (রাযি.) বা কোন খলীফা নির্ধারণ করার কে? কেননা শরীয়ত রাসূল (সা.)এর উপরই নাযিল হয়েছে, অন্য কারো উপর নয়। আর শরীয়তে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য এবং আমরা তা মানতে বাধ্য কি না?

উত্তর: যেভাবে স্বামীর দেয়া ক্ষমতাবলে স্ত্রী তালাক দিতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ক্ষমতাবলে মন্ত্রীরা চুক্তি করতে পারে, তেমনিভাবে রাসূল (সা.)এর দেয়া ক্ষমতাবলে চার খলীফা তা করতে পারেন। আর শরীয়তে তা শুধু গ্রহণযোগ্য নয়, বরং সবার জন্য তা মানাও অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে সহীহ হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-

مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ

যে ব্যক্তি আমার পরে জীবিত থাকবে, সে অনেক মতভেদ দেখতে পাবে। তখন আমার সুন্নাত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত (চার) খলীফার সুন্নাতের অনুসরণ করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য। তোমরা একেই মজবুত করে আঁকড়ে ধরবে। (তিরমিযী ২৬৭৬, হাদীসটি সহীহ)।

সুতরাং কোন একটি বিষয় যখন চার খলীফার কোন একজনের সুন্নাত হিসেবে প্রমাণ হবে, তখন তা অনুসরণের জন্য রাসূল (সা.)এর এ নির্দেশই যথেষ্ট এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য তা আমল করা অপরিহার্য।

এ কারণেই আমাদের অনেক আমল রয়েছে, যা চার খলীফার কোন একজনের সুন্নাত হিসেবে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত। যেমন জুমার দ্বিতীয় আযান হযরত উসমান (রাযি.)এর জারি করা সুন্নাত। তাঁর যুগের পূর্বে জুমার মাত্র একটি আযান হত। উপরন্তু এটি তিনজন খলীফা থেকে প্রমাণিত।

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন- ثَبَتَ مِنْ سُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ وَعَمَلِ الْمُسْلِمِينَ .
বিশ রাকআত তারাবীহ খলীফাগণের সুন্নাত এবং মুসলিম জাতির আমল দ্বারা প্রমাণিত। (মাজমূআতুল ফাতাওয়া ২৩/১১৩)।

সন্দেহ নিরসন: আহলে হাদীস বন্ধুরা বিভ্রান্তি ছড়ান যে, উমর (রাযি.) থেকে তারাবীহ বিশ রাকআত নয়, বরং আট রাকআতই প্রমাণিত। আর তারাবীহ বিশ রাকআত পড়া, সহীহ বুখারীতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর আট রাকআত তারাবীর আমলের বিরোধিতা করা। এছাড়া তারাবীর রাকআত সম্পর্কে ৩৪, ৩৬, ৩৮ ও ৪১ সহ ইমামগণের বিভিন্ন অভিমত ও আমল পাওয়া যায়।

উত্তর: প্রথমত: এ বিষয়ে বেশ কিছু বর্ণনা উপরে উল্লেখ হয়েছে। নিম্নে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য কয়েকজন বিদ্যানের বক্তব্য তুলে ধরছি।

ইমাম শাফেয়ী (রাহ. মৃত্যু ২০৪ হি.) বলেন, আমার নিকট তারাবীহ বিশ রাকআত পড়াটা পছন্দনীয়। কেননা, তা হযরত উমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত। এভাবে মক্কা শরীফেও বিশ রাকআত তারাবীহ ও তিন রাকআত বিতর পড়া হয়। কিতাবুল উম্ম ১/৪৩৩।

ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেন, তারাবীহ বিশ রাকআত পড়ার পক্ষে অধিকাংশ আলেমের অভিমত। কেননা, উমর (রাযি.), আলী (রাযি.) ও অন্যান্য সাহাবী থেকে এ সংখ্যা বর্ণিত। (তিরমিযী- ১/১৬৬)।

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ., মৃ. ৭২৮ হি.) বলেন-
كَانَ يَقُومُ بِالنَّاسِ عِشْرِينَ رَكْعَةً فِي قِيَامِ رَمَضَانَ، وَيُوتِرُ بِثَلَاثِ. فَرَأَى كَثِيرٌ مِنْ الْعُلَمَاءِ: أَنَّ ذَلِكَ هُوَ السُّنَّةُ؛ لِأَنَّهُ أَقَامَهُ بَيْن الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ، وَلَمْ يُنْكِرْهُ مُنْكِرٌ .إِنَّهُ قَدْ ثَبَتَ: أَنَّ أبي بْنَ كَعْبٍ

এটা নিশ্চিত প্রমাণিত যে, উবাই ইবনে কা’ব (রাযি.) রমযানে লোকদের নিয়ে বিশ রাকআত তারাবীহ ও তিন রাকআত বিতর পড়তেন। তাই অনেক আলেমের সিদ্ধান্ত, এটাই সুন্নাত। কেননা, তিনি মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতিতেই বিশ রাকআত পড়িয়েছেন এবং কেউ তাতে আপত্তি করেননি। (মাজমূআতুল ফাতাওয়া ২৩/৬৮)।

দ্বিতীয়ত: বুখারীতে আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রমযান ও অন্যান্য মাসের রাতে চার রাকআত করে রাসূল (সা.)এর আট রাকআত পড়ার আমলটি তারাবীহ নয়, বরং তাহাজ্জুদ। কেননা, বুখারীতে খোদ আয়েশা (রাযি.) থেকেই বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রাতে দশ (বিতরসহ তেরো) রাকআত পড়তেন। (বুখারী, ১১৭০)।

এছাড়া অন্যান্য সহীহ হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূল (সা.)এর রাতের নফল নামায কখনো চৌদ্দ, কখনো ষোল, কখনো আঠারো রাকআত হতো। (আত-তারাবীহ আকসার মিন আলফি আম, আতিয়্যা মুহাম্মদ সালেম পৃ. ১৪) আর এ সবই হচ্ছে তাহাজ্জুদ। কেননা, তাহাজ্জুদের রাকআত সংখ্যা নির্ধারিত নয়। দুই রাকআত করে যত ইচ্ছা পড়া যায়। কাজেই প্রথম বর্ণনা থেকে যদি তারাবীহ আট রাকআত প্রমাণিত হয়, তাহলে অন্যান্য বর্ণনা থেকে তো আঠারো রাকআত প্রমাণিত হয়।

আরও পড়তে পারেন-

আহলে হাদীস বন্ধুদের প্রতি প্রশ্ন রইল, আট রাকআতের আমলটি যদি তারাবীহ-ই হয়ে থাকে, তাহলে ১৪ হিজরী থেকে তিন খলীফার যুগে আয়েশা (রাযি.)এর হুজরা সংলগ্ন মসজিদে নববীতে বিশ রাকআত তারাবীহ হয়েছে। তিনি এর প্রতিবাদ করলেন না কেন?

তাছাড়া ইমাম বুখারী (রহ.) নিজেও প্রথম রাতে তারাবীহ পড়তেন এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়তেন। তিনি তারাবীর প্রতি রাকআতে বিশ আয়াত পড়তেন এবং পুরো কুরআন খতম করতেন। (তারীখে বাগদাদ ২/১২)।
সুতরাং তাহাজ্জুদ সংক্রান্ত হাদীসকে তারাবীহ দ্বারা ব্যাখ্যা করা- এটা তাদের একান্ত নিজস্ব গবেষণা ও ইজতিহাদ, যা ইমাম বুখারীর ইজতিহাদ থেকেও আলাদা। কেননা, ইমাম বুখারী (রহ.) প্রথম রাতে তারাবীহ পড়তেন এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়তেন।

তৃতীয়ত: ৩৪-৪১ বিভিন্ন মত থাকলেও সব মতই বিশ সংখ্যার ঊর্ধ্বে। আর চার মাযহাবের সম্মানিত ইমামগণের মধ্যে ইমাম মালেক (রহ.)এর একটি মতসহ সবার পছন্দনীয় অভিমত হচ্ছে বিশ রাকাআত। এমনকি আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন-

فَالْقِيَامُ بِعِشْرِينَ هُوَ الْأَفْضَلُ وَهُوَ الَّذِي يَعْمَلُ بِهِ أَكْثَرُ الْمُسْلِمِينَ.

যদি দীর্ঘ কেয়ামের সাথে তারাবীহ দশ রাকাআত পড়া না যায়, তবে বিশ রাকাআত পড়াই উত্তম। আর এটাই অধিকাংশ মুসলমানের আমল। (আল-মুদাওওনাতুল কুবরা ১/২২২; বিদায়াতুল মুজতাহিদ- ১/২১৯; আল-মুগনী- ১/৭৯৮; মাজমুআতুল ফাতাওয়া- ২২/১৬৪)

তারাবীহ বিশ রাকআত আদায়কারীদের প্রতি কিছু অনুরোধ
১. যারা বিশ রাকাআত তারাবীহ আদায় করি, আমরা আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করি। কেননা, তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে সঠিক মাসআলা বুঝার ও আমল করার তাওফীক দিয়েছেন। আর শোকর আদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, নেয়ামতের সঠিক ও যথার্থ ব্যবহার। এর অপব্যবহার কিংবা তার আসল রূপ বিকৃত না করা। তাই আমাদের জন্য পূর্ণ খুশু-খুযু ও একাগ্রতার সাথে নামায আদায় করা জরুরি। এবং রুকু, রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানো, সিজদা ও দুই সিজদার মাঝের বৈঠকসহ সকল রুকন ধীর-স্থিরতার সাথে আদায় করাও জরুরি।

অথচ অনেক মসজিদেই দেখা যায়, নামায তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য রুকু-সিজদা ইত্যাদিতে তাড়াহুড়ো করে নামাযকেই বিকৃত করা হয়। এটা অবশ্যই সংশোধন করা চাই। কেননা, ফরয নামাযের মতো সকল নামাযেই রুকু-সিজদা ইত্যাদি সঠিকভাবে আদায় করা ওয়াজিব। অন্যথায় নামায সহীহ-শুদ্ধ হবে না।

২. তারাবীর নামাযেও শুরুতে সানা, আউযুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ ও শেষে দুআ পড়া। অথচ অনেক ইমাম সাহেব শুরুতে সানা পড়েন বলে মনে হয় না। (আল-আযকার, ইমাম নববী রাহ. পৃ. ৩১০)।

৩. তারতীলের সাথে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা। তারতীলের ব্যাখ্যায় হযরত আলী (রাযি.) বলেছেন-
تَجْوِيدُ الْحُرُوفِ وَمَعْرِفَةُ الْوُقُوفِ.

অর্থাৎ- হরফগুলো মাখরাজ ও সিফাতের সাথে আদায় করা এবং ওয়াকফগুলোর স্থান ও পদ্ধতি জানা। এটাই হচ্ছে তাজবীদের সারকথা। আর তাজবীদের বিধানসমূহ প্রয়োগের প্রকৃত ক্ষেত্রে হচ্ছে পবিত্র কুরআন। বিশেষত যখন তা আল্লাহ পাকের সামনে নামাযে তিলাওয়াত করা হয়।

তারাবীতে কুরআন মজীদ খতম করা সুন্নাতের আমল তারাই পালন করবেন, যারা কমপক্ষে হরফের মাখরাজ ও অপরিহার্য সিফাতগুলোর প্রতি লক্ষ রাখেন এবং জরুরি ওয়াকফগুলো পালন করেন। অথচ এত তাড়াতাড়ি কুরআন তিলাওয়াত করা হয় যে, হরফগুলোর সঠিক উচ্চারণ হয় না এবং ঠিকমতো বুঝা যায় না। এক্ষেত্রে কেউ কেউ মুসল্লীদের অজুহাত দেখান। কিন্তু ‘মারাকীল ফালাহ’ গ্রন্থে স্পষ্ট লেখা আছে, মুসল্লীরা বিরক্তিবোধ করলেও তারতীল ছাড়া যাবে না। বরং তাদেরকে পরিষ্কার বলে দিবেন, এত দ্রুত পড়ে খতম করার চেয়ে শান্তভাবে সূরা তারাবীহ পড়াই উত্তম।

৪. অনেকে সূরা তারাবীহও এত দ্রুত পড়েন যে, পঁচিশ-তিরিশ মিনিটের মধ্যে সব নামায শেষ হয়ে যায়। আবার বিশেষ এমন কিছু মুসল্লীও দেখা যায়, যারা কোথায় তাড়াতাড়ি ও বেশি দ্রুত পড়া হয়- এর তালাশে থাকেন!

এ যেন তাড়াতাড়ি পড়ার ও পড়ানোর প্রতিযোগিতা। এটা তো সবাই বুঝেন যে, বিশ রাকআত তারাবীহ একটু কষ্ট তো হবেই। এ জন্যই তো হাদীসে তারাবীর নামায আদায়কারীর অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।

৫. কিছু মুসল্লী এমন আছেন, যারা রমযানের প্রথম ৫/৬ দিন বা ১০ দিনের মধ্যে কুরআন মজীদ খতম করে তাদের সব আগ্রহ-উৎসাহ শেষ করে ফেলেন। এরপর তারাবীর প্রতি তেমন গুরুত্ব দেন না; এসব ঠিক না। কেননা, পুরো রমযান মাসে প্রতিদিন তারাবীহ আদায় করা সুন্নাত।

আল্লাহ পাক সবাইকে সঠিক পন্থায় পুরো রমযান মাসে আমলের তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: শিক্ষক, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।