।। ডা. তানজিনা রহমান ।।
“দরিদ্র শ্রেণির লোকেরা ধনবানদের চাইতে আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে”। (সহিহ মুসলিম)।
অর্থাৎ দরিদ্র ব্যক্তির দায়িত্ব কম, তার যাকাত নেই, হজ্জ নেই, বিলাসিতা নেই, তার হিসাবও নেই। কাজেই সে আগে ভাগে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
সেই দরিদ্র ব্যক্তিটি যদি মু’মিন, মুত্তাকী না হয়? সালাত, সাওম, মুআমালাত-মুআশারাত ঠিক না থাকে তাও কি সে জান্নাতবাসী হবে, কেবল সম্পদ না থাকার জন্য?
আবার আরও একটি দোয়াও তো আছে যেখানে আল্লাহর রাসূল জাহান্নামের আযাব, দরিদ্রতা এবং একই সাথে সম্পদের অনিষ্টতা থেকে হিফাজত চাইতে বলেছেন। (সুনান আবু দাউদ, তিরমিযী)।
দরিদ্ররা যদি আগেই যায়, তবে আল্লাহর রাসূল (সা.) দরিদ্রতা থেকে থেকে পানাহ চাইতে বললেন কেন?
দরিদ্রতা আদতে কোন ভালো বিষয় নয়। এটি একটি কঠিন পরীক্ষা। এই দরিদ্রতা থেকে মানুষের মনে লোভ জন্ম নেয়, যারা প্রিভিলেইজড তাদের প্রতি ক্ষোভ জন্ম নেয়, না পেতে পেতে চাওয়া পাওয়ার আকাক্সক্ষা সীমা অতিক্রম করে। এর সাথে যুক্ত হয় অভিযোগ! কেন আল্লাহ তাকে দিলেন না, যাকে দিয়েছেন সে কেন তাকে যথেষ্ট দিল না, মনটা ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে।
মনোভাব হয় এমন, সে যেহেতু দুনিয়ায় ‘কিছুই পায়নি’ চুরি-ডাকাতি, মানুষ ঠকানো, মিথ্যা বলে উপার্জন, যাই করুক জান্নাত তার প্রাপ্য! আল্লাহ তাকে কিছুই দেননি তাই জান্নাত দিতে বাধ্য! নাউজুবিল্লাহ।
অভাবে বড় হওয়া মানুষ যদি পরবর্তী জীবনে সম্পদশালী হয় প্রচণ্ড অহঙ্কারী হয়ে ওঠে।
খেয়াল করলে দেখা যায় রিক্সাওয়ালা, ভিখারী, খাদিমা বা দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরা বেশির ভাগ সময়ে শোকরগুজার হয় না। উলটো অভিযোগপ্রবণ হয়। খুব কম সংখ্যকই পর্দা, নামায, রোযা ঠিক রাখে। মসজিদের বাইরে বসে ভিক্ষা করে অথচ ভেতরে ঢুকে নামায আদায়ের নসীব হয় না। অর্থাৎ এই সকল ব্যক্তির জন্য ইবলিসের সিলেবাস বানানো খুবই সহজ। গুনাহের চৌরাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া, ব্যাস। বাকী কাজ আপনা আপনি হয়ে যাবে।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
অপরদিকে সম্পদশালী ব্যক্তি ভোগ বিলাসেই মত্ত হয়ে যায়। দুনিয়ার মোহ তাদের আখিরাতকে ভুলিয়ে দেয়। তবে এ কোন দরিদ্র ব্যক্তির কথা আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন যারা ধনীদের আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে?
এরা সেই, যারা দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও অভিযোগ করেনি, সম্পদের আকাক্সক্ষা যাদের গাফেল করেনি, ফরয, সুন্নাহ, ওয়াজিব পালনে যাদের ঘাটতি হয়নি।
সাহাবাদের দিকে দৃষ্টি ফেরান, আবু বকর (রাযি.), উমার (রাযি.), উসমান (রাযি.) প্রত্যেকেই ধনী ছিলেন। কিন্তু ইসলামে আসবার পর পুরো সম্পদ দান করে দিতেও দ্বিধান্বিত হননি। আবু বকর (রাযি.) ব্যবসা করতেন। কিন্তু যখন দেখলেন ব্যবসা এবং দ্বীনের মধ্যে কোন একটি বেছে নিতে হবে তিনি দ্বীনকেই বেছে নিলেন।
উমার (রাযি.) স্বেচ্ছায় ঘি বা তেল যেকোন একটি তরকারী দিয়ে রুটি খাওয়া, তালি দেওয়া পোশাক পরাকে বেছে নিয়েছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন আমীরুল মু’মিনীন। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও মন চাইলেই তারা মাংস কিনে খাননি। কারণ তারা মানতেন “অপচয়কারী হবার জন্য এটাই যথেষ্ট, যখন যা মন চায় তখন তা খায়”। (মুসনাদে আহমাদ)।
আহলুস সুফফা, দরিদ্র সাহাবীগণ, যারা প্রিয় মক্কা থেকে তাদের ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদ ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করেন। যাদের পরার মতো পর্যাপ্ত কাপড় পর্যন্ত ছিল না।
প্রকৃতপক্ষে আপনি ধনী না গরিব সেটা মুখ্য নয়। সম্পদের প্রতি লোভ আছে কি না- সেটাই বিবেচ্য। সম্পদের প্রতি নির্লিপ্ততা না আসা পর্যন্ত দুনিয়া বিমুখ হওয়া অসম্ভব। এ আমল আসলে খুব সহজ নয়।
ধনী পরিবারের সন্তান হলে, আপনি নেয়ামতপ্রাপ্ত। আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেন। গাড়ি থাকলেও মাঝে মাঝে হাঁটতে চেষ্টা করেন। প্রচুর কাপড়, জুতো কেনার সামর্থ্য থাকলেও দুটো দিয়েই কাজ চালান। ১০ পদ রান্নার সামর্থ্য থাকলেও দুই এক তরকারী দিয়েই খেয়ে উঠুন। ডায়েটের জন্য নয়, দ্বীনের জন্য ২ বেলা খাওয়ার অভ্যাস করেন।
মা বোনেরা যারা রান্না করতে ভালোবাসেন তারা অপচয়ের বিষয়টি মাথায় রাখুন। নানা পদ রাঁধতে মন চাইলেও নিজের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করুন।
যাহিদ হতে গেলে সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে হয়। মানুষ পেছনে লাগবে, কৃপণ বলবে, সমালোচনা করবে। সবই শয়তানের ওয়াসওয়াসা। পাত্তা না দিলেই হলো।
ইসলামে মনোজগত বা চিন্তাজগত খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাহ্যিকভাবে আমল দেখতে নেক বা মুনকার যাই হোক না কেন নিয়্যাতের উপরই তার ফলাফল নির্ভর করে। প্রতিটা বিষয়ই আসলে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত। সম্পর্ক খুঁজে বের করার জন্যই তাদাব্বুর প্রয়োজন।
লেখক: কন্সালটেন্ট, সনোলজিস্ট।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/