যেমন ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পবিত্র জীবনচরিত

।। শায়খুল হাদীস আল্লামা শেখ আহমদ ।।

সর্বযুগের মানুষের কান্ডারী হিসেবে মহান রাব্বুল আলামীন উম্মতের প্রিয় খাতামুন নাবিয়্যীন হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)কে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। আমরা তাঁর উম্মত হতে পেরে আল্লাহ পাকের দরবারে লক্ষ কোটি শুকরিয়া আদায় করছি, আলহামদুলিল্লাহ। সাধারণ উম্মতের মধ্যে সিংহ ভাগই রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পবিত্র অবয়ব আকৃতি স্বভাব ইত্যাদি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিফহাল নয়। তাই তো আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মোবারক আদর্শ অনুসরণে পুরোপুরি সক্ষম হচ্ছি না। আমরা সকলে যাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মোবারক অবয়ব, রুচি ও আখলাকসহ সার্বিক জীবনধারা সম্বন্ধে সম্যক অবগত হয়ে সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনায় মনোযোগী হতে পারি, সে মানসেই প্রবন্ধটি নিবেদন করছি।

বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থের বর্ণনা মোতাবেক রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন মধ্যম অবয়ব, উজ্জ্বল গৌরকান্তি, সাদা ও লাল মিশ্রিত রং, প্রশস্ত ললাট, যুগল ভ্রু, পটলচেরা চোখ, মাংস বিরল মার্জিত চেহারা বিশিষ্ট, দাঁত মোবারক খুব ঘন সন্নিবিষ্ট ছিল। উচ্চ গ্রীবা, মাথা বড় এবং বক্ষস্থল ছিল সুপ্রশস্ত। মাথার চুল মোবারক বেশি কোঁকড়ানো বা একেবারে সোজা ছিল না। ঘন দাড়ি, সুরমা রং এর গভীর কালো চোখ, ঘন লম্বা পলক, মাসল বাহুমূল, সুলম্বিত বাহু, বক্ষদেশ থেকে নাভি পর্যন্ত হাল্কা চুলের রেখা এবং দু’বাহুতেও হালকা পশম ছিল। দু’হাত চওড়া এবং মাসলবহুল ছিল। সুগঠিত পদযুগলের গুচ্ছদেশ ছিল হাল্কা ধরনের। পায়ের পাতার মধ্যভাগে কিছুটা খালি ছিল। উদাহরণত পায়ের নিচ দিয়ে এক দিকের পানি অন্য দিকে চলে যেতে পারত। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ)।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুঠাম, অপূর্ব কান্তিময় দেহাবয়ব প্রথম দৃষ্টিতেই লোকের অন্তরে গভীর প্রভাব বিস্তার করত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাযি.) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইহুদি ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)এর গঠিত চেহারার দিকে দেখেই বলে উঠেছিলেন আল্লাহর কসম, এ চেহারা কোন মিথ্যাবাদীর হতে পারে না। (তিরমিযী)।

হযরত জাবের ইবনে সামুরা (রাযি.) নামক জনৈক সাহাবিকে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিল, রাসূলুল্লাহ (সা.)এর চেহারা কি তরবারীর মত চমকাত? সাহাবী (রাযি.) জবাব দিলেন, না; বরং পূর্ণিমা চাঁদের মত ছিল। (মিশকাত)।

এ সাহাবী (রাযি.)ই অন্যত্র বর্ণনা করেছেন, মেঘের লেশচিহ্ন হীন এক শুক্ল পক্ষের রাত্রিতে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর চেহারা মোবারকের দিকে একবার, আরেকবার আকাশের পূর্ণ চন্দ্রের দিকে তাকাচ্ছিলাম। আমার দৃষ্টিতে তাঁর পবিত্র চেহারা চাঁদ অপেক্ষা উজ্জ্বলতর প্রতিভাত হচ্ছিল। (মিশকাত, তিরমিযী)।

হযরত বারা (রাযি.) বলেন, আমি উত্তম পোশাক পরিহিত বহু সৌখিন লোক দেখেছি। কিন্তু হুযূর (সা.)এর চাইতে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন চেহারার কোন লোক আজ পর্যন্ত আমার দৃষ্টি গোচর হয়নি। (মুসলিম)।


রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পবিত্র দেহ থেকে নির্গত ঘামের মধ্যেও এক প্রকার সুগন্ধ অনুভূত হত। (মুসলিম)।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর শরীর মোবারক অত্যন্ত মসৃন এবং চামড়া খুব কোমল ছিল। হযরত আনাস (রাযি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)এর গায়ের রং অত্যন্ত সুন্দর এবং শরীর মসৃন ছিল। গায়ের মধ্যে ঘর্মবিন্দু যেন মোতির ন্যায় চমকাতে থাকত। তাঁর পবিত্র বদন ছিল রেশমের চাইতেও মসৃন এবং গন্ধ ছিল মেশক আম্বরের চাইতেও সুগন্ধময়। (মিশকাত, বুখারী, মুসলিম)।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মোবারক পিঠে দু’বাহুমূলের মধ্যবর্তী স্থানে মোহরে নবুওয়াত ছিল। তা সাধারণত কবুতরের ডিমের আকৃতি বিশিষ্ট লাল রং এর সামান্য উত্থিত এক টুকরো মাংস বলেই মনে হত। (মুসলিম)।


শামায়েলে তিরমিযীতে হযরত জাবের ইবনে সামুরা (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে যে, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মোহরে নবুওয়াত দেখেছি। সেটি তাঁর মোবারক পিঠের উপরিভাগের দু’বাহুমূলের মধ্যস্থলে কবুতরের ডিম্বাকৃতি বিশিষ্ট একটি লাল রং এর ভাসা মাংস পি-ের মত ছিল।

আরও পড়তে পারেন-

বিভিন্ন সহীহ বর্ণনা একত্রিত করে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, গর্দানের নিচে দু’বাহুমূলের মধ্যভাগে ঈষৎ লম্বা ডিম্বাকৃতি বিশিষ্ট তিলের মত লাল রং-এর একটু স্থান ছিল। এ বিশেষ চিহ্নটিকেই মোহরে নবুওয়াত বলে অভিহিত করা হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মোবারক মাথার কেশ অধিকাংশ সময় গর্দান পর্যন্ত প্রলম্বিত থাকত। মক্কা বিজয়ের সময় যারা তাঁকে লক্ষ করেছেন, তারা দেখেছেন যে, মাথার মোবারক কেশ চারভাগে বিভক্ত হয়ে গর্দান পর্যন্ত ঝুলে আছে।

আরবের মুশরিক পৌত্তলিকেরা মাথার চুলে সিঁথি কাটত। রাসূলুল্লাহ (সা.) যেহেতু প্রথম থেকেই মুশরিকদের যাবতীয় আচার-আচরণের বিরোধীতা করে আহলে কিতাবদের মত আচার অবলম্বন করতেন, তাই প্রথম প্রথম তিনি চুলে সিঁথি কাটতেন না। মক্কা বিজয়ের পর যখন পৌত্তলিকদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকল না, তখন থেকে তিনি সিঁথি কাটতে থাকেন।

মাঝে মাঝে রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় মোবারক চুলে তেল ব্যবহার করতেন, অন্তত একদিন অন্তর চিরুনী ব্যবহার করতেন। ইন্তিকালের সময় দাড়ি মোবারকের কয়েকখানা কেশ সাদা দেখা গিয়েছিল।

রাসূলুল্লাহ (সা.) পথ চলার সময় দ্রুত চলতেন। সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটতেন, মনে হত যেন উঁচু ভূমি থেকে নিচের দিকে অবতরণ করছেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর কথাবার্তা অত্যন্ত মধুর এবং হৃদয়গ্রাহী ছিল। মুচকি হাসির সাথে প্রত্যেকটি শব্দ ও বাক্য পৃথক পৃথকভাবে সুস্পষ্ট উচ্চারণ করতেন। এত সহজ ও সাবলীল ভাষায় কথা বলতেন যে, শ্রোতা মাত্রই তা অতি সহজে অনুধাবন করতে এবং স্মরণ রাখতে পারত। কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা হলে তা তিনবার পর্যন্ত উচ্চারণ করতেন। ভাষণ দান করার সময় সাধারণত আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে গুরুগম্ভীর স্বরে বলতেন।


হযরত উম্মে হানী (রাযি.) বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন কা’বা শরীফে কুরআন পাঠ করতেন, তখন আমরা বাড়িতে শুয়ে শুয়ে সুস্পষ্ট শুনতে পেতাম। (ইবনে মাজাহ)।

হযরত খাদীজা (রাযি.)এর পূর্ববর্তী স্বামীর পক্ষে হিন্দ নামে এক পুত্র ছিলেন। তিনি কথোপকথনে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। কথোপকথনের মাধ্যমেই তিনি যে কোন বিষয়ে জীবন্ত আওয়াজ তুলে ধরতে সমর্থ ছিলেন। হযরত ইমাম হোসাইন (রাযি.) একদিন তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর বক্তৃতা রীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে, তিনি বলেছিলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) অধিকাংশ সময় চুপচাপ থাকতেন। প্রয়োজন ছাড়া সচরাচর কথা বলতেন না। দেখলে মনে হত যে, এক গভীর ভাবনায় যেন তিনি ডুবে আছেন। কথা বলার সময় প্রত্যেকটি শব্দ পৃথক পৃথকভাবে অত্যন্ত সুস্পষ্ট উচ্চারণ করতেন। কথার মধ্যে কোন ইশারা করতে হলে সম্পূর্ণ হাত তুলে ইশারা করতেন। কোন বিস্ময়সূচক কথা বলার সময় হাত উল্টে নিতেন। বক্তৃতার সময় কখনও কখনও মোবারক এক হাতের উপর আর এক হাত রাখতেন। কথায় কথায় কোথাও হাসির কথা এসে গেলে দৃষ্টি নীচের দিকে নামিয়ে নিতেন। তিনি কদাচিৎ মুচকি হাসতেন। এটাই ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মোবারক হাসি। (শামায়েলে তিরমিযী)।

হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযি.) বর্ণনা করেন যে, যখনই আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর খেদমতে হাযির হতাম, তিনি আমাকে দেখেই মুচকি হাসতেন। কোনদিন এমন হয়নি, যখন তিনি আমাকে দেখে হাসেননি।


কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, অধিক হাসি পেলে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর উপরিভাগের একপাটি দাঁত মোবারক কখনও কখনও প্রকাশ হয়ে পড়ত। কিন্তু হযরত ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.)এর মতে এ বর্ণনা ঠিক নয়। কেননা দন্তপাটি প্রকাশ পেতে পারে এমনভাবে তিনি কখনও হাসতেন না।

উম্মাহাতুল মুমিনীনগণের মধ্যে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাযি.)এর চেয়ে আর কেউ রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মহান চরিত্র ও গুণাবলীর বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করতে পারেননি। তিনি বলেছেন, কখনও কাউকে কটূ কথা বলার স্বভাব রাসূলুল্লাহ (সা.)এর ছিল না। কটূ কথার পরিবর্তে কখনও মন্দ ব্যবহারও করতেন না; বরং তা পরিত্যাগ অথবা ক্ষমা করে দিতেন। (তিরমিযী)।

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)কে দু’টি বিষয়ের যে কোন একটি গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হলে যা সহজ হত তাই গ্রহণ করতেন, অবশ্য তা যদি কোন পাপ কাজ না হত। নতুবা তা থেকে দূরে থাকতেন। কখনও নিজের কোন ব্যাপারে কারও কাছ থেকে কোন প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কিন্তু যদি কেউ আল্লাহ পাকের আদেশের বিরোধিতা করত, তাহলে স্বয়ং তার উপর ব্যবস্থা নিতেন। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে আল্লাহপাকের নির্দেশানুযায়ী তিনি তাদের শাস্তির বিধান প্রয়োগ করতেন। (বুখারী, মুসলিম)।


রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনও চিহ্নিত করে কোন মুসলমানকে অভিশাপ দেননি। কখনও কোন দাস-দাসী, কোন নারী এমনকি পশুকেও নিজের মোবারক হাতে মারধর করেননি। কারও কোন আবেদন কখনও প্রত্যাখ্যান করেননি। তবে তা যদি নাজায়েয কিছু না হত।

রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন ঘরে প্রবেশ করতেন, তখন মোবারক সুন্দর হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় মুচকি হেসে হেসে প্রবেশ করতেন। বন্ধুজনের মধ্যে কখনও পা ছড়িয়ে বসতেন না। (ইবনে সা’আদ)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) কথাবার্তা ধীরে ধীরে এমনভাবে বলতেন, যদি কেউ মনে রাখতে চাইত, তবে সহজেই তা করতে পারত। (বুখারী, মুসলিম)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় মোবারক জীবন থেকে তিনটি বিষয়কে সম্পূর্ণ রূপে দূর করে দিয়েছিলেন। যেমন- পরস্পরে কূটতর্ক করা, প্রয়োজনাতিরিক্ত কথা বলা এবং লক্ষ্যহীন কোন কিছুর পেছনে লেগে থাকা। অপর লোকদের ক্ষেত্রেও রাসূলুল্লাহ (সা.) তিনটি বিষয়ে সংযমী ছিলেন। কাউকে মন্দ বলতেন না, কাউকে দোষারোপ করতেন না এবং কারো আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অনুসন্ধানে লিপ্ত থাকতেন না। যে কথা মানুষের জন্য কল্যাণকর, তাই বলতেন। (শামায়েলে তিরমিযী)।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পূণ্যবান জীবনের বরকতময় স্বভাবের বর্ণনা এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। তাঁর পূণ্যবান জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এবং প্রতিটি কর্ম উম্মতদের জন্য শিক্ষনীয় ও বরকতময় বটে। বক্ষমান প্রবন্ধে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মোবারক স্বভাবের যে সামান্য বর্ণনা আমরা জানতে পারলাম, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ তথা অনুসরণ অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মোবারক স্বভাবের অনুসারী হতে পারলে নিশ্চিত তার জীবন সার্থক, তা বলাবাহুল্য।

তাই আসুন, আমরা সকলে নিজেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মোবারক স্বভাবের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে গড়তে সাধ্যমত চেষ্টা করি। আল্লাহ পাক মেহেরবাণী করে আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সফল অনুসারী হয়ে নিজেদের জীবনকে প্রকৃত সুন্নাহ তথা নববী আদর্শে সাজিয়ে তোলার তাওফীক দান করুন।

লেখক: প্রখ্যাত আলেম-দ্বীন ও শায়খুল হাদীস, আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।