।। মুফতি ইসহাক ওমর কাসেমী ।।
ইসলামের মৌলিক পাঁচটি ভিত্তির অন্যতম হচ্ছে রমযানের রোযা। হিজরী সনের অন্যান্য মাসের তুলনায় মাহে রমযান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। রহমতের বারিধারা, বরকতের সমৃদ্ধি এবং ক্ষমার অপূর্ব সমাহার নিয়ে মাহে রমযান মুমিনের জীবনে প্রতি বছর উপস্থিত হয়। ঈমানদারের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের গুরুত্বপূর্ণ ও সুবর্ণ এক সুযোগ এ মাস। হাদীসের অসংখ্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত, ক্ষমা এবং নাজাতের নির্মল সুসংবাদ পবিত্র এই মাসে ঈমানদারগণের অভিমুখী হয়।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাযি.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “রমযানের আগমন উপলক্ষে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা হয় এবং শয়তানকে বন্দী রাখা হয়” (সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং- ২০৮৮)।
হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তাআলা রমযানের প্রতি রাত্রে তার অনেক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন”। (মুসনাদে আহমদ, ১৮৪৩৮)।
এমনিতে রমযান মাস পুরোটাই রহমত এবং বরকতের মাস, সেই সাথে রমযানের শেষ দশক আল্লাহর বান্দাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই শেষ দশকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য হাদীসের ভাষায় নবীজি কোমর বেঁধে নামতেন। এই শেষ দশকেই নবীজি ইতিকাফ করতেন এবং এই শেষ দশকেই হাজারো মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং উত্তম রাত- লাইলাতুল কদর (শবে কদর) মুমিনের জীবনে হাতছানি দিয়ে যায়।
শেষ দশকে নবীজী (সা.)এর আমল
রাসূলুল্লাহ (সা.) রমযানের শেষ দশকে ইবাদাত-বন্দেগী, রাত্রি জাগরণ এবং যিকির-ফিকিরে বেশি নিমগ্ন হতেন। বছরের অন্যান্য সময়ে তো ইবাদত বন্দেগী করতেন-ই, কিন্তু রমযানের শেষ দশকে নবীজি নিজেও ইবাদাতের জন্য খুব মেহনত করতেন এবং নিজের পরিবারকেও অধিক ইবাদত করার প্রতি বেশি বেশি উৎসাহ দিতেন।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রমযানের শেষ দশকে (ইবাদাত-বন্দেগীর জন্য) এত বেশি মেহনত করতেন, যা অন্য কোনো সময় করতেন না। (সহীহ মুসলিম, ১১৭৫)।
অন্য হাদীসে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাযি.) বলেন, রমযানের শেষ দশকে রাসূলুল্লাহ (সা.) (ইবাদাত বন্দেগীর জন্য) কোমর বাঁধতেন, রাত্রি জাগরণ করতেন এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে (ইবাদত বন্দেগী করার জন্য) জাগ্রত করে দিতেন। (সহীহ বুখারি, হাদীস নং- ২০২৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১১৭৪)।
এ ছিলো রাসূলুল্লাহ (সা.)এর শেষ দশকের আমলের চিত্র। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন নিষ্পাপ, সমস্ত ত্রুটি থেকে মুক্ত। আল্লাহ তাআলা যার পূর্ব এবং ভবিষ্যতের সমস্ত ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাঁর শেষ দশকের আমলের চিত্র যদি এমন হয়, তাহলে আমাদের আমল কেমন হওয়া উচিত, অনুভব করা দরকার। নবীজি এখানে আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রেখে গিয়েছেন। যদি আমরা আখেরাতের অফুরন্ত সফলতা এবং রমযানের মহান সৌভাগ্য অর্জন করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে এভাবেই নবীজির রেখে যাওয়া সুন্নাত অনুযায়ী আমল করতে হবে।
রমযান মাসের শেষ দশকে বিশেষ দুটি আমল আছে। তার মধ্যে-
এক. ইতিকাফ
মাহে রমযানের শেষ দশকের অনন্য একটি আমল হচ্ছে ইতিকাফ। রমযানের শেষ দশকের ইতিকাফ নবীজির নিয়মিত আমল ছিলো।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। (সহীহ মুসলিম, ১১৭১)।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত নবীজি রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। (সহীহ বুখারী, ২০২৬)।
হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক রমযানে দশ দিন ইতিকাফ করতেন। যে বছর নবীজি (সা.) ইন্তেকাল করেন সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেছেন। (সহীহ বুখারী, ২০৪৪)।
ইতিকাফ মহান আল্লাহর দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করার অনন্য এক চিত্র। আল্লাহ তাআলার অসীম ক্ষমতার সামনে বান্দার বিনয় এবং অপারগতার নির্মল প্রকাশ হচ্ছে ইতিকাফ। এ সময় ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য এবং ক্ষমা লাভ করবে। বিখ্যাত তাবেঈ ইমাম আতা (রহ.) বলেন, “ইতিকাফকারীর উদাহরণ মুহরিম (যিনি হজ্জ/উমরাহর জন্য ইহরাম বাধেঁন) ব্যক্তির মতো, যে স্বীয় সত্তাকে রহমানের দরবারে সঁপে দেয় এবং বলে আল্লাহর কসম! আমি ততক্ষণ পর্যন্ত সফল হবো না, যতক্ষণ না আপনি আমার উপর রহম করেন!” (শুআবুল ঈমান, ৩৯৭০)।
মসজিদে ইতিকাফ করার মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার পরিবেশের সমস্ত কোলাহোল থেকে নিজেকে মুক্ত করে মহান প্রভুর দরবারে একাগ্রতার সাথে অবস্থান করতে পারেন। যার মাধ্যমে বান্দার হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা, আত্মশুদ্ধি এবং ইবাদতের মধ্যে একাগ্রতা অর্জিত হয়। ইতিকাফ পবিত্র এবং শুভ্র ফেরেশতাগণের সাথে সাদৃশ্যের মনোরম একটি পথ। হাজারো মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির সুযোগ। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) রমযানের শেষ দশকে নিয়মিত ইতিকাফ করতেন। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ১৬৮)।
ইতিকাফে যা আমল করবো
উপরে আলোচনা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) রমযানের শেষ দশকে বেশি বেশি ইবাদত করতেন। পরিবার পরিজনকে ইবাদত করার জন্য জাগিয়ে দিতেন। অনুরূপভাবে আমাদের সালাফগণও রমযানের প্রতিটি মুহূর্তকে অপার্থিব সুযোগ মনে করতেন। রমযানের শেষ দশকে শুধু তাঁরা নিজেরাই ইবাদতে মগ্ন হতেন না; বরং নবীজির অনুসরণ করে তাঁরা তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরকেও ইবাদত করার জন্য জাগ্রত করে দিতেন। ইবাদত বন্দেগী এবং রাত্রি জাগরণের ব্যাপারে তাঁরা খুব মনোযোগী হতেন। ইমাম সুফিয়ান সাওরী (রহ.) বলেন, “আমি পছন্দ করি যে, রমযানের শেষ দশক প্রবেশ করলে প্রত্যেক মানুষের উচিত রাত্রি জাগরণ করা এবং ইবাদতের জন্য মেহনত করা। প্রত্যেকেই নিজ সন্তান এবং পরিবারকে নামাযের জন্য উৎসাহ দেয়া, যদি তারা সামর্থ্য রাখে”। (লাতাইফুল মাআরিফ, ৪৩০ পৃষ্ঠা)।
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, “রমযানের শেষ দশকে ইবাদাত বন্দেগী বৃদ্ধি করে দেয়া এবং রাতগুলোকে ইবাদাত করার মাধ্যমে জাগ্রত রাখা মুস্তাহাব”। (আল-মিনহাজ শারহু সহীহি মুসলিম, ৮/২৫০ পৃষ্ঠা)।
এই শেষ দশকে আমাদেরকে কিছু আমলের উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বেশি বেশি কিয়ামুল্লাইল (রাত্রে নফল নামায আদায়) করা। কারণ, দুনিয়াতে মানুষ যা আমল করে তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম আমল হচ্ছে নামায। রাত্রের নামাযের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হচ্ছে রাত্রের নামায”। (সহীহ মুসলিম- ১১৬৩)।
কিয়ামুল্লায়লের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমরা বেশি বেশি কিয়ামুল্লায়ল করো। কেননা তা তোমাদের পূর্ববর্তী নেককারগণের অভ্যাস। নিশ্চয় কিয়ামুল্লাইল আল্লাহর নৈকট্য লাভের উসীলা এবং তা বান্দাকে গুনাহ থেকে হেফাজত করে। গুনাহ সমূহকে মাফ করে দেয় এবং শারীরিক রোগ-ব্যাধি থেকে সুস্থতা দান করে”। (সুনানে তিরমিযী- ৩৫৪৯, হাফেয ইরাকী (রহ.) এই হাদিসকে হাসান বলেছেন, তাখরীজুল ইহয়া- ১/৪৬৬)।
নামায আদায়ের পাশাপাশি তাঁরা কুরআন তিলাওয়াতের উপর গুরুত্ব দিতেন। ইমাম যাহাবী (রহ.) আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি পবিত্র রমযান মাসে প্রত্যেক দুই রাত্রে কুরআন খতম করতেন। রমযান ছাড়া অন্য সময় প্রতি ছয় রাত্রে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। (সিয়ারু আলামীন নুবালা- ৪/৫১)।
হযরত কাতাদা (রহ.) রমযানের প্রত্যেক তিন রাত্রে কুরআন খতম করতেন। শেষ দশকে প্রত্যেক রাত্রে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। (লাতাইফুল মাআরিফ, ৩৯৯)।
ইমাম মালেক (রহ.) মসজিদে নববীতে নিয়মিত ইলমে হাদিসের দরস দিতেন। কিন্তু রমযান মাস এলে ইলমী মজলিস স্থগিত করে কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন হতেন। (লাতাইফুল মাআরিফ- ৪০০)।
হাফেয ইবনে আসাকির (রহ.)এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, তিনি সব সময় জামাতের সাথে নামায আদায় করা এবং কুরআন তিলাওয়াতের উপর পাবন্দি করতেন। প্রত্যেক জুমা পর্যন্ত এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তবে রমযানে প্রত্যেক দিন এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং দামেশকের জামে মসজিদের পূর্বদিকে ইতিকাফ করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ২০/৫৫৫)।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- মাহে রমযান: সিয়াম সাধনা, তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাস
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
এছাড়াও বরকতময় সময়গুলোতে বেশি বেশি দুআ, ইসতেগফার, যিকির আযকার করা উচিত। আমাদের সালাফগণ তাঁদের এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করতেন না। তাই আল্লাহ তাআলা তাদের সময়ে এবং ইবাদতে বরকত দিয়েছেন। আমরা যদি সময়ের হেফাজত করি, আমাদের ইবাদতের মধ্যেও আল্লাহ তাআলা বরকত দিবেন।
দুই. লাইলাতুল কদর
লাইলাতুল কদর অর্থ সম্মানের রাত। রমযান মাসের শেষ দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ সময়গুলোর মধ্যে এমন একটি রাত আছে, যে রাত্রটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। অর্থাৎ, এই রাত্রের ইবাদতের মূল্য এক হাজার মাসের (প্রায় ৮৩ বছর) ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এই রাত্রটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের নিকট গুরুত্বপূর্ণ একটি উপহার। এই রাতের ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সূরাতুল কদর অবতীর্ণ করেছেন। অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা এই রাতকে মুবারক রাত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এই রাত্রেই আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন লওহে মাহফুজ থেকে একত্রে দুনিয়ার আসমানে অবতীর্ণ করেছেন। পর্যায়ক্রমে তেইশ বছর সময়ে তা নবীজির উপর অবতীর্ণ হয়।
নবীজি রমযানের শেষ দশকে যে ইতিকাফ করতেন তার অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে শবে কদর তালাশ করা। আম্মাজান আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ (সা.) রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন, তোমরা লাইলাতুল কদর রমযানের শেষ দশকে তালাশ করো”। (সহীহ বুখারী- ২০২০)।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রহ.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- “… যারা আমার সাথে ইতিকাফ করেছে তাদের উচিত শেষ দশকেও ইতিকাফ করা। আমাকে এই রাত্রটির (শবে কদর) ব্যাপারে অবগত করা হয়েছিল, অতঃপর পুনরায় (এই রাত্রটি) আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। কাজেই তোমরা এই রাত্রটিকে শেষ দশকের বেজোড় রাত্রে তালাশ করো” (সহীহ বুখারী- ২০১৮)।
অসংখ্য আয়াত এবং হাদীসের মাধ্যমে এই রাতের ফযীলত প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “ যে ব্যক্তি কদরের রাত্রে ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের নিয়তে ইবাদত করবে, আল্লাহ তাআলা তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন”। (সহীহ বুখারী, ২০১৪)।
রমাযান মাস যেরকম আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত, তদ্রƒপ শবে কদর আল্লাহ তাআলার দরবারে অন্যান্য রাতের চেয়ে বেশি সম্মানিত। সাহাবায়ে কেরাম এই রাতের অনুসন্ধান করতেন। এ রাতের বরকত ও ফযীলত প্রাপ্তির চেষ্টা করতেন। এই রাতের নির্ণয় করতে গিয়ে সাহাবায়ে কেরামের বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ রাতের ব্যাপারে জানানো হয়েছিল, পরবর্তীতে যে কোনো কল্যাণে তা আবার বিস্মৃত করে দেয়া হয়। তবে এটা নিশ্চিত যে, রমাযানের শেষ দশকের যে কোনো এক রাত্রিতে, বিশেষকরে বেজোড় রাতÑ শবে কদর হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমরা রমযানের শেষ দশকে শবে কদর তালাশ করো”। (সহীহ বুখারী, ২০২০)।
অপর এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর তালাশ করো”। (সহীহ বুখারী, ২০১৭)।
অপর এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা শবে কদর শেষ সাত দিনে তালাশ করো”। (সহীহ মুসলিম, ১১৬৫)। হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনায় ২১, ২৩, ২৫, ২৭ এবং ২৯ তারিখের রাতে শবে কদর হওয়ার আলোচনা এসেছে। (দেখুন- সহীহ মুসলিম হাদিস নং ১১৬৭, ১১৬৮, লাতিফুল মাআরিফ- ৪৫০)।
অপর এক বর্ণনায় ২৭ তারিখের রাত্রে শবে কদর হওয়ার কথা আছে। হযরত মুআবিয়া (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, “লাইলাতুল কদর হচ্ছে ২৭ তারিখের রাত”। (সুনান আবি দাউদ, হাদীস নং ১৩৮৬, ইমাম ইবনে আব্দিল বার এই হাদিসকে সহীহ বলেছেন। আত-তামহিদ- ২/২০৫)।
এ বর্ণনার উপর ভিত্তি করে আমাদের অনেকেই মনে করে থাকেন যে, ২৭ তারিখের রাতই হচ্ছে শবে কদর। শবে কদরকে এভাবে নির্দিষ্ট করে ফেলা ভুল। তবে হ্যাঁ, এই রাত্রটি শবে কদর হওয়ার সম্ভাব্য রাতের অন্যতম একটি রাত। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অনেকেই এই রাতটি শবে কদর হওয়ার ব্যাপারে ধারণা করেছেন; তবে তা সুনিশ্চিত কিছু নয়, জোরালো অনুমান বলা যেতে পারে। সুতরাং ২৭ তারিখের রাত্রকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট না করে নবীজির নির্দেশনা অনুযায়ী রমযানের শেষ দশকের প্রতিটি রাত্রেই শবে কদর তালাশ করা উত্তম, বিশেষভাবে বেজোড় রাতগুলোতে। লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য অর্জনের জন্যই তো নবীজি রমযানের শেষ দশকে বেশি পরিশ্রম করতেন এবং এ রাত্রি পাওয়ার জন্যই নবীজি ইতিকাফ করতেন।
ফযীলত ও বরকতপূর্ণ এই রাত্রিকে অনির্দিষ্ট করে রাখার মধ্যে নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার অসংখ্য রহস্য ও কল্যাণ রয়েছে। বান্দার ইবাদতের আগ্রহ পরীক্ষা করার জন্যই হয়তো আল্লাহ তাআলা এই রাত্রটিকে লুকিয়ে রেখেছেন। তবে কোনো বান্দা যদি ইখলাস, একাগ্রতা এবং বিনয়ের সাথে রমযানের শেষ দশকগুলোতে ইবাদত-বন্দেগীতে নিমগ্ন থাকেন, আশা করা যায় তারা শবে কদরের সৌভ্যগ্য থেকে বঞ্চিত হবেন না; ইনশাআল্লাহ।
লাইলাতুল কদরের আমল
লাইলাতুল কদর যেহেতু শেষ দশকের যে কোনো এক রাত্রিতে হয়, সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং সালাফগণ শেষ দশকে যে আমল করতেন তাদের অনুসরণ করে আমরাও বেশি বেশি আমল করবো ইনশাল্লাহ। আম্মাজান আয়েশা (রাযি.) রাসূলুল্লাহ (সা.)কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যদি শবে কদরের ব্যাপারে অবগত হই, তাহলে আমি কোন্ দুআটি পড়বো? রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তুমি বলবে-
الّٰلهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ، فَاعْفُ عَنِّی
অর্থাৎ- হে আল্লাহ নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে তুমি ভালোবাস, অতঃপর আমাকে ক্ষমা করে দাও। (সুনানে তিরমিযী- ৩৫১৩)।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সহীহ তরীকায় অধিক পরিমাণে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক- জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী এবং সহকারী সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/