।। মুহাম্মাদ হাবীব আনওয়ার ।।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু মূসা (রাযি.)কে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আবু মূসা, তুমি যদি গত রাতে আমাকে তোমার তিলাওয়াত শুনতে দেখতে, তাহলে তোমার কেমন লাগতো? তোমাকে দাউদী সুর থেকে কিছুটা দেয়া হয়েছে’।
সুবহানাল্লাহ, কত সুন্দর ও চমৎকার অভিবাদন! রাতের নির্জনতা ভেদ করে কুরআনের প্রেমে উদ্বেলিত একজন সাহাবী যখন দো-জাহানের বাদশা কর্তৃক এমন প্রশংসা শুনলেন, তখন কেমন অনুভূতি জেগেছিল তাঁর মনে? তাঁর হৃদয় কেমন পুলক অনুভব করেছিল জানতে বড় ইচ্ছে করে।
গভীর রাত। চারদিকে নিরব স্তব্ধতা। পিনপতন নীরবতা। সবাই ক্লান্ত। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঝিঝি পোকারাও রাতের কোলে গা এলিয়ে দিয়েছে। রাতজাগা নিশিপ্রাণীরাও সুপ্তির কোলে আশ্রয় নিয়েছে। কোথাও কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই। আপনি আস্তে আস্তে আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়–ন। ঘর কিংবা মসজিদের এককোণে বসে আল্লাহর কালাম মেলে ধরুন চোখের সামনে। গুনগুনিয়ে পড়তে থাকুন, যতক্ষণ মন চায়। কলুষিত হৃদয়কে কুরআনের পবিত্র পরশে স্নিগ্ধ করতে যতটা সময় দরকার হয়, এমন নির্জন সময়ে আপনি এক ধ্যানে কুরআন পড়ুন। আপনার মনে হবে আপনি একা। কেউ নেই আপনার চারপাশে। তবে রাতের তিলাওয়াতে একটা আমেজ থাকে। একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার ছাপ থাকে। এই আমেজ যে কারো হৃদয়ে রেখাপাত করবে।
মক্কার মুশরিকরাও ছিল না এ দলের বাইরে। প্রকাশ্যে কুরআন শোনার বিরোধিতা করলেও রাতের নির্জনতা ভেদ করে ছুটে যেতেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছোট্ট কুটিরের পাশে। নিরব-নিস্তব্ধতার সুযোগে কুরআনের মজায় হৃদয়ঙ্গম করতেন গোপনে।
মক্কার মুশরিকদের মধ্যে অন্যতম ছিল আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান এবং উতবা। এরা দিনের বেলা ঠিকই অন্যদেরকে রাসূলের কাছে যেতে বাধা দিত। কিন্তু রাতের বেলা তারা খুব সন্তর্পণে কুরআন তিলাওয়াত শোনার জন্যে রাসূলের ঘরের পাশে গিয়ে লুকিয়ে থাকত। একরাতে এরা যার যার মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কুরআন তিলাওয়াত শুনলো। তিলাওয়াত শোনার পর যখন তারা বেরিয়ে এল, তখন একে অপরের সাথে দেখা হয়ে গেল। কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে গেল। ফলে পরস্পরকে তিরস্কার করে শপথ গ্রহণ করল যে, এই ঘরে আর কখনও আসবে না।
তাদের এই শপথ মুখেই সীমাবদ্ধ থাকলো। কুরআনের আকর্ষণের কাছে তাদের শপথ নিতান্তই ঠুনকো প্রমাণিত হলো। তাই পরের রাতেও তিনজনই রাসূলের নিজ মুখে আল্লাহর বাণী শোনার জন্যে বাইরে বেরিয়ে এল। এরূপ তিনদিন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। কুরআনের প্রতি তাদের আকর্ষণ সৃষ্টি হলেও ঈর্ষাপরায়ণতা ও গোঁড়ামির কারণেই তারা সত্য গ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল।
শুধু কি মানুষ? কুরআন তিলাওয়াত শুনতে অগণিত ফেরেশতা আসমান থেকে নেমে এসেছেন। এমনি এক ঘটনা আছে ইতিহাসের পাতায়। হযরত উসাইদ ইবনে হুদাইর (রাযি.) রাতের নির্জনতায় সূরা বাক্বারা তিলাওয়াতে মগ্ন ছিলেন। অদূরেই বাঁধা ছিল ঘোড়া। হঠাৎই ঘোড়াটা অস্থির আচরণ শুরু করলো! আল্লাহর নবীর সাহাবী তিলাওয়াত বন্ধ করলেন। সাথে সাথে ঘোড়া শান্ত হয়ে যায়। বার কয়েক এমন হলো। তিলাওয়াত বন্ধ করলেন। আকাশের দিকে তাকালেন। মেঘের মধ্যে বাতির মতো কিছু একটা দেখলেন। সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিস্তারিত খুলে বললেন। আল্লাহর নবী বললেন, উসাইদ! তুমি কি জান ওটা কী ছিল? জবাবে সাহাবী ‘না’ সূচক উত্তর দিলেন। আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা ছিল ফেরেশতা। তোমার তিলাওয়াত শোনে কাছে এসেছিল। তুমি যদি তিলাওয়াত করতে থাকতে, তারাও সকাল পর্যন্ত থেকে যেত, অদৃশ্য হতে পারতো না। লোকেরা তাদেরকে দেখতে পেত।
সুবহানাল্লাহ! কতবড় নিয়ামত আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন। যার তিলাওয়াত করলেও লাভ। শুনলেও লাভ। কাউকে শোনালেও লাভ। কাউকে শুনতে বললেও লাভ। এত দামি ও মহামহিম গ্রন্থ আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন। যার প্রতিটি অক্ষর তিলাওয়াতের বিনিময়ে আল্লাহ ১০টি করে নেকি দান করার ঘোষণা দিয়েছেন। মানবজাতির প্রেসক্রিপশন হিসেবে আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন। পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ। যা ঘটেছে, যা ঘটছে ও যা ঘটবে; সবকিছু আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন। সকল সমস্যার সুন্দর সমাধানের গাইড হিসেবে আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন। আপনি হতাশাগ্রস্ত, চিন্তিত, অসুস্থ, পেরেশান, বিষণœ কিংবা অবসাদে আছেন? কুরআনের কাছে আসুন। কুরআনের প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করুন। কুরআনের বাতলিয়ে দেয়া পদ্ধতি হৃদয়ে ধারণ করুন। আপনি মুক্তি পাবেন। যেকোনো সমস্যা দেখা দিলে কুরআন নিয়ে বসুন। একাগ্রতার সাথে তিলাওয়াত করুন। তিলাওয়াত শেষে রব্বে কাবার দরবারে দু’টি হাত প্রসারিত করে বিগলিত কণ্ঠে আপনার প্রয়োজন তুলে ধরুন। বিশ্বাস রাখুন। আল্লাহ আপনার সকল সমস্যার সুন্দর সমাধান করে দিবেন।
কুরআন আল্লাহ তাআলার কিতাব। মানবজাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহ প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, রমাযান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। (সূরা বাকারা- ১৮৫)।
এভাবে আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রূহ তথা আমার নির্দেশ; তুমি তো জানতে না কিতাব কী ও ঈমান কী! পক্ষান্তরে আমি একে করেছি আলো, যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ-নির্দেশ করি; তুমি তো প্রদর্শন কর শুধু সরল পথ। (সূরা শূরা, ৫২ আয়াত)।
পবিত্র কুরআনে সব কিছু আল্লাহ তাআলা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তারপরও যারা এই কুরআন থেকে গাফেল থাকে। কুরআনের অনুধাবন যাদের হৃদয়ে রেখাপাত করে না। কুরআনের এই শ্বাশত বিধানকে যারা অস্বীকার করে এবং কুরআনকে অবহেলা করে, তারা নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়। তাদের জীবনে সুখ থাকে না।
আরও পড়তে পারেন-
- পাশ্চাত্য শিক্ষা বনাম কওমী শিক্ষা
- করোনা মহামারি ও আমাদের করণীয়
- জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে
- দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা
- ইসলামে সংশয়প্রবণতা এবং সংক্রামক রোগ
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- “আর যে আমার উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবন হবে বড় সংকটময়”। (সূরা ত্ব-হা, ১২৪ আয়াত)।
‘সুতরাং ধ্বংস সেই কঠোরপ্রাণদের জন্য, যারা আল্লাহর যিকির থেকে বিমুখ!’ (সূরা যুমার- ২২)।
এটি মানবজাতির জন্য একটি সুস্পষ্ট সতর্কবাণী এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশ। (সূরা আলে ইমরান, ১৩৮ আয়াত)।
তিরমীযী শরীফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তির মধ্যে কুরআন নেই, সে বিরান ঘরের মতো।
কুরআনের সাথে সুসম্পর্ক গড়তে আল্লাহ তাআলা নানাভাবে বিভিন্ন আঙ্গিকে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তারপরও যদি আমরা কুরআনের প্রেমে উদ্বেলিত না হই, তাহলে আমরাই সবচেয়ে বড় হতভাগ্য। সারাদিন কত সময়ই তো এদিক ওদিক কাটিয়ে দেই। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো-হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, ইনস্ট্রাগ্রাম, টুইটার, কত শত উপন্যাস-ম্যাগাজিন ও পাঠ্যবই পড়ি। অথচ, মাসকে মাস না পড়ার কারণে তাকের উপর পবিত্র কুরআন ধূলোমলিন! খুব ভোরে সন্তানকে পাঠিয়েছেন কোচিং এ, তারপর স্কুল-কলেজ কিংবা ভার্সিটিতে। রাতে আবার বসিয়েছেন পাঠ্যবইয়ে। সারাবছর একবারও ছেলের হাতে মানব সভ্যতার প্রেসক্রিপশন আল্লাহর কালাম তুলে দিতে পারেননি। আপনিই বলুন আপনার মতো হতভাগ্য পিতা আর কে হতে পারে! আপনি কীভাবে এই সন্তানের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার আশা করেন! আপনিই বলুন, কীভাবে আমাদের জীবনে শান্তি আসবে! বারাকাহ আসবে! হৃদয়ে প্রশান্তি পাবো!
জীবনের প্রতিটি সেকেন্ডকে গুরুত্ব দিন। কুরআনের আলোতে আলোকিত করুন নিজেকে। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে রাতে হলেও পড়ুন মহাগ্রন্থ আল কুরআন। নিজে পড়তে না পারলে আশপাশের কেউ কারো থেকে তিলাওয়াত হলেও শুনুন। দেখবেন, রাজ্যের সকল প্রশান্তি আপনার কাছে নেমে এসেছে। সারাদিনের ব্যস্ততার রেশ কাটিয়ে আপনি এক জান্নাতি সুখে ভাসছেন।
রাতের নির্জনতা ভেদ করে যারা আল্লাহর কালাম পাঠে উদ্বুদ্ধ হয় তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, “যারা গভীর রাত পর্যন্ত আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং সিজদাহ করে। তারা আল্লাহ ও আখিরাত বিশ্বাস করে এবং সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে এবং সৎ কাজসমূহে তৎপর থাকে, আর তারাই সৎ কর্মশীলগণের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত- ১১৩, ১১৪)।
হযরত উসমান (রাযি.) বলেছেন, যদি আমাদের হৃদয়টা পবিত্র হতো, আমরা কখনোই কুরআন পাঠ করে তৃপ্ত থাকতে পারতাম না। শুধু পড়েই যেতাম। পড়েই যেতাম।
আল্লাহ আমাদের সকলকে কুরআনের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/