রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: রাষ্ট্রসমূহের লাভ-লসের খতিয়ান

।। রাকিবুল হাসান ।।

পশ্চিমাদের প্রবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা তাদের কার্যক্রমের ফলেই বারবার হুমকির মুখে পড়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উড্রো উইলসন যে অতীব আদর্শবাদী পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঢামাঢোলে তা অচিরেই হারিয়ে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরেকটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি করা হয়, যার বীজ লুকিয়ে আছে আটলান্টিক চার্টারে। কিন্তু সেটিও স্থায়ী হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের কবলে পড়ে তা উধাও হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বব্যবস্থাকে বলা হয় ILO ১.০ (ইন্টারন্যাশনাল লিবারেল অর্ডার), দ্বিতীয়টাকে বলা হয় ILO ২.০। কিন্তু ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠে।

তুমুল আশাবাদ, শান্তির প্রতিশ্রুতি আর উন্নয়নের ফুলঝুরি নিয়ে হাজির হয় তৃতীয় বিশ্বব্যবস্থা বা ILO ২.১। ভেঙে পড়তে বেশিদিন লাগেনি। শুরু থেকেই সংকটাপন্ন এই বিশ্বব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুতর পরিবর্তন আসে ২০০১ সালে। ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের মধ্য দিয়ে এর পতন শুরু হয়। এভাবে নানা উত্থান পতনের ফলে এখন খোদ পশ্চিমা চিন্তকদের মাঝেই এই বিতর্ক প্রবল যে বর্তমানে আদৌ কোন বিশ্বব্যবস্থা আছে কি না? থাকলে সেটা কী? এই ব্যবস্থার প্রবর্তক কে? নীতি ও আদর্শ কী?

এই বিতর্কে ঘৃতাহুতি দিয়েছে সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্বব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে এই যুদ্ধ কেন ব্যতিক্রম? কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ অবৈধ, জাতিসংঘের চার্টারেও একথা বলা আছে। সমস্ত আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি এটি। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেখানে স্ট্র্যাটেজিক বা সামরিক কৌশলগত একটা ব্যতিক্রম ছিল।

মার্কিনিদের ভাষায় একে বলা হয় স্ট্রাটেজিক প্রি-এম্পশন। ২০০১ সালে টুইনটাওয়ারে হামলার পর এই স্ট্র্যাটেজির জন্ম হয়। এর সারকথা হচ্ছে নিজেদের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ভিন্ন রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ করা যাবে, আগ বাড়িয়ে আক্রমণ করা যাবে। এই স্ট্র্যাটেজিক প্রি-এম্পশনের আওতায়ই ইরাকে আগ্রাসন চালানো হয়।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে স্ট্রাটেজিক প্রি-এম্পশন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের একার সম্পত্তি ছিল। পাকিস্তান চাইলে স্ট্রাটেজিক প্রি-এম্পশনের ধুয়া তুলে ভারতে আক্রমণ চালাতে পারবে না। পৃথিবীর কোন দেশ পারবে না। পারবে শুধু যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে রাশিয়া সেই অধিকারে ভাগ বসিয়েছে। যদিও রাশিয়া ইতঃপূর্বে ২০০৮ সালে জর্জিয়া এবং ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল। সেগুলোর সাথে এবারের হামলার মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে এখানে একটা দেশের রাজধানী দখলের চেষ্টা হচ্ছে। পূর্বেকার অভিযানগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল।

তো রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে কেন্দ্র করে বিশ্ব-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। যদি এই যুদ্ধে রাশিয়া বিজয়ী হয় তবে কিছু পরিবর্তন ঘটবে, কিছু পরিবর্তন আসবে রাশিয়া পরাজিত হলে। আর কিছু বিষয় যৌথ, জয়-পরাজয় মুখ্য নয়।

সর্বপ্রথম ঘরের কথা দিয়ে শুরু করা যাক। কথা ছিল রাশিয়া যদি ইউক্রেন আক্রমণ করে তবে তার উপর নজিরবিহীন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হবে। সুইফট (SWIFT; the Society of Worldwide Interbank Financial Telecommunication) থেকে বাদ দেয়া হবে। সুইফট হচ্ছে আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্লাটফর্ম। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যত দেশ ভিন্ন দেশে টাকা পাঠায়, তারা সুইফটের মাধ্যমে পাঠাতে হয়।

সুইফট সিস্টেম থেকে রাশিয়াকে বাদ দিলে রাশিয়ার সবধরনের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু রাশিয়াকে বাদ দেয়া হয়নি। বেশ সীমিত অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। এর কারণ কী? অনেক বাংলাদেশিও এতে মনক্ষুণœ; কেন রাশিয়াকে ঠিকঠাক টাইট দেয়া হলো না! বাস্তবতা হচ্ছে সুইফট থেকে রাশিয়াকে বাদ দিলে বা সর্বাত্মক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করলে অনেক নিরীহ দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মাঝে রয়েছে বাংলাদেশ।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিন্তু পুরোটাই রাশিয়ার তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। রাশিয়া অবরুদ্ধ হলে বাংলাদেশের সাথেও রাশিয়ার সব ধরনের অর্থনৈতিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে। রাশিয়ান টেকনোলোজি কিভাবে সাপ্লাই করা হবে? বাংলাদেশ মূল্য কিভাবে পরিশোধ করবে? ইতোমধ্যে আমরা যে বিশাল-বিপুল অর্থব্যয় করেছি তা অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে যাবে। অথচ ইউক্রেন-রাশিয়া কামড়াকামড়িতে আমাদের কোন অংশ নেই। কিন্তু ভিকটিম হবো আমরা। এরকম বহুদেশ বলি হবে।

আরও পড়তে পারেন-

দ্বিতীয় পরিবর্তনটাও সাউথ এশিয়াতেই এবং সেটা বেশ মজার। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর উন্নয়নশীল বহুদেশের অস্ত্রভা-ার রাশিয়ান অস্ত্রে ঠাসা। কিন্তু ভারত এক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের তথ্যমতে ভারতের অস্ত্রভা-ারের মোট ৬২ শতাংশ রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত বা রাশিয়ার ডিজাইনকৃত!

ভারত রাশিয়ার একদম শীর্ষস্থানীয় অস্ত্র আমদানিকার। রাশিয়ার মোট রপ্তানির ৩২ শতাংশই আসে ভারতে। ভারতের নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী বলা চলে মেড ইন রাশিয়া। এখন রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপিত হলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অস্ত্রের যোগান কোত্থেকে আসবে সেই চিন্তায় অস্থির। রুশ অস্ত্রবাদে তাদের সেনাবাহিনী আদৌ কর্মক্ষম থাকতে পারবে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে।

এরচেয়েও মজার বিষয় হচ্ছে ইউক্রেনে রুশ অস্ত্রশস্ত্র বেদম মার খাচ্ছে। সেগুলো কাগুজে বাঘ প্রমাণিত হচ্ছে। পশ্চিমা টেকনোলজির সামনে বিশাল-বিপুল অস্ত্রবহর নিয়েও রাশিয়া ঠিক জুত করে উঠতে পারছে না। এই ঘটনায় ভারতীয়দের কপালে ভাজ পড়ার যথেষ্ট কারণ আছে। বাস্তব যুদ্ধ শুরু হলে তাদের অস্তভা-ারও এরকম ফেইল করবে না তো? সেগুলোও জাস্ট প্রদর্শনের গজদন্ত প্রমাণিত হবে না তো? শুধু ভারত না, রাশিয়ার অস্ত্র কেনে এরকম প্রতিটা রাষ্ট্রেই কমবেশি এই চিন্তা মাথাচাড়া দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী রাশিয়ার অস্ত্রবাজার দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ এই মুহূর্তে তাদের অস্ত্রের কার্যকারিতার উপর আস্থা একদম তলানিতে।

১৯৭০ এর দশক থেকে মার্কিন ডলার টিকে আছে পেট্রোলের উপর ভিত্তি করে। সৌদির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তি হয়েছিল; সৌদি ডলার ছাড়া ভিন্ন কোন মুদ্রায় তেল বিক্রি করবে না। সৌদি যেহেতু শীর্ষস্থানীয় তেল উৎপাদনকারি দেশ, তাই তেল বিক্রেতা দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের অন্যান্য সদস্যও সৌদির নীতি অনুসরণ করেছিল। বিশ্বের সব দেশের তেল দরকার। তেল নেই মানে আধুনিক কোনকিছুই সচল নেই। গাড়িঘোড়া থেকে শুরু করে কলকারখানা, সবকিছু স্থগিত হয়ে যাবে।

তো সব দেশেরই যেহেতু তেল কিনতে হয়, এবং তেল বিক্রি হয় ডলারে, ফলে বিশ্বের প্রতিটি দেশের ডলার প্রয়োজন হয়। এভাবে ডলার পেট্রোলের উপর ভর করে বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব ধরে রেখেছে। এই ব্যবস্থাকেই বলা হয় পেট্রোডলার। এখানে উল্লেখ্য, কোন দেশ ডলার ছাড়া ভিন্ন মুদ্রায় তেল বিক্রি করতে চাইলে তার পরিণতি হয়েছে অত্যন্ত মর্মান্তিক। সাদ্দাম হোসেইনের কথা মনে আছে? সিনিয়র এবং জুনিয়র বুশ এই আরব স্বৈরশাসকের উপর ভীষণ ক্ষ্যাপা ছিল। দুজনেই তার বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধ লড়েছে। কারণ? কারণ ইরাক ডলার ছাড়াও ভিন্ন মুদ্রায় তেল বিক্রি করত।

পেট্রোডলারের পতন মানে আমেরিকার বিশ্ব-অর্থব্যবস্থার পতন, সাথে আমেরিকারও পতন। যা তারা কখনোই বরদাশত করবে না। পেট্রোডলারসহ এর পূর্বাপর অর্থনৈতিক বুজরুকি নিয়ে মার্কিন বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ জেমস রিকার্ডসের অসাধারণ একটি বই আছে; দ্য নিউ কেস ফর গোল্ড। বইটি গোল্ড ইজ মানি নামে বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহীরা অর্থনৈতিক মোড়লপনা এবং ফাঁপা অর্থব্যবস্থার ভঙ্গুরতা বুঝতে বইটি পড়তে পারেন।

কিন্তু সমস্যা বেঁধেছে অন্যত্র। পেট্রোডলার চুক্তির বিনিময়ে আমেরিকা সৌদিকে মধ্যপ্রাচ্যের বড়ভাই হিসেবে মেনে নিয়েছে, তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বারাক ওবামার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য রাষ্টগুলোর সাথে ইরানের পরমাণু অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

যা ছিল সৌদির উপর চপেটাঘাত। কারণ, এর মাধ্যমে পশ্চিমারা মূলত উদীয়মান শক্তি হিসেবে ইরানকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। ট্রাম্প এসে যুক্তরাষ্ট্রকে সেই চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে, এক্ষেত্রে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে ইসরাইল এবং সৌদি আরব। কিন্তু বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর পুনরায় সেই চুক্তি সচল করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এর চেয়েও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র ইস্যুতে সরব হয়েছেন। তার প্রশাসন মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের উপর প্রাধান্য দিবে। ফলে সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর কপালে চিন্তার ভাঁজ।পাল্টা চাপ হিসেবে সৌদি ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে তারা চীনা মুদ্রায় তেল বিক্রির কথা ভাবছে। যদি এটি সত্য হয়, পেট্রোডলারের দিন শেষ। রাশিয়ার উপর তীব্র অর্থনৈতিক অবরোধ দেয়া হলে রাশিয়া-চীন মিলে বিকল্প অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলবে। ইতোমধ্যেই তারা সে চেষ্টা করছে মর্মে জেমস রিকার্ডস বহু প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। সাথে যদি সৌদির মতো তেলসম্রাট যুক্ত হয়!

সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন হচ্ছে; আমেরিকা তখন কী করবে? একজন মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞের ভবিষ্যতবাণী ছিল মুহাম্মদ বিন সালমান যদি ক্ষমতায় বসেও, সম্ভবত সেই হবে সৌদির শেষ রাজা। এবং সৌদির পতন হবে আমেরিকার হাতে!!

লেখক: তাকমিল; মাদরাসা বাইতুল উলুম ঢালকানগর এবং শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল- rakibulhasanduir@admin_767

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।