।। আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) ।।
আমি এবং আপনারা যে স্থানে (আমিনদৌলা পার্ক, লক্ষ্মৌ) একত্রিত হয়েছি সে পার্কটি হিন্দুস্তানের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। যুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসবিদরা এটাকে ভুলতে পারবে না। খেলাফত আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন এ পার্ক রাজনৈতিক সভা-সমিতির প্রাণকেন্দ্র ছিল। আমি নিজ চোখে এখানে বড় বড় ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখেছি। আমি এখানে গান্ধীজিসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ভাষণ শুনেছি। আবার ইংরেজ সৈন্যদের বর্বর আচরণেরও সাক্ষী এ পার্কটি। যে সময়ে আমি হিন্দুস্তানে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতাম তখন বড় বড় জ্ঞানী-গুণী লোকদেরও এ কথা বিশ্বাস হতো না যে, এ স্বপ্ন কখনও বাস্তব রূপ লাভ করবে। যারা বিশ ত্রিশ বছর পূর্বে নিশ্চিত করে বলত; আজাদি অবশ্যই আসবে তাদের কথাতেও শিক্ষিত শ্রেণি আস্থা আনতে পারতো না। ৪৭ সালের আজাদির আগে এ ধরনের লোক এদেশে ছিল যারা এ কথায় হাসি-বিদ্রুপ করে বলত, এদেশ ব্রিটেনের যক্ষ্মের ধন, এর দ্বারাই তারা দুনিয়াতে টিকে আছে; তারা কীভাবে এদেশ থেকে তাদের হাত গুটিয়ে নেবে? কিন্তু এসব তাদের কথা হিসেবেই রয়ে গেছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, দুনিয়াতে অসম্ভব বলতে কোনো জিনিস নেই- শুধু মানুষের সিদ্ধান্ত ও দৃঢ়তা শর্ত। যেমনিভাবে আপনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দেশকে ইংরেজদের গোলামি থেকে মুক্ত করতেই হবে। নেতৃত্বের অধীনে চেষ্টা-তদবিরের ফলে যেমনিভাবে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, এমনিভাবে যদি এর থেকে সামনে বেড়ে কোনো একটি সংঘবদ্ধ জামাত গঠন করে এর জন্য সাধনা করতেন তবে সেটাও পূরণ হতো। কিন্তু ওই সময় স্বাধীনতাটাকেই সর্বোচ্চ ও মুখ্য মনে হতো। নিঃসন্দেহে আজাদি একটি বিশাল নেয়ামত এবং জীবনের অনিবার্য প্রয়োজন। এর জন্য যে ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করা হবে সেটাও ব্যাপক সমাদৃত। আমাদেরকে ওই সব পথপ্রদর্শকেরও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে এ কথা আরজ করতে চাই, যে সিদ্ধান্ত ও শক্তির বদৌলতে আমরা গোলামির অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছি সেই সিদ্ধান্ত ও শক্তিকে যদি এর চেয়েও বাস্তবিক ও পূর্ণাঙ্গ আজাদি অর্থাৎ মানবিকতা গঠন ও উন্নয়ন এবং মানুষকে মানুষ বানানোর কাজে ব্যয় করি তবে এটা হবে দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, সমস্যা ও সংকটের চিরস্থায়ী সমাধান।
স্বাধীনতার পূর্বে
আমি আজাদি আন্দোলনের প্রতি অবজ্ঞা বা না শোকরি করছি না, তবে এটা না বলেও পারছি না যে, দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং মানবতার সবচেয়ে বড় খেদমত হচ্ছে, মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে যাওয়া। এছাড়া স্বাধীনতা ও স্বাধীকারের পরও জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য, প্রশস্তি এবং স্বাচ্ছন্দ হাসিল হয় না। বিক্ষিপ্ততা, টানাপোড়েন এবং অস্বস্তি দূর হয় না। বিপদাপদ, ব্যতিব্যস্ততা ও অপমান শুধু অন্যের আকৃতিতেই আসে না, কখনও নিজের থেকেই এর স্ফূরণ ঘটে। জুুলুম-নির্যাতন ও লুট-তরাজের জন্য ভিনদেশী হওয়া শর্ত নয়। একই দেশে অবস্থানকারী দ্বারা কখনও এই কাজ সংঘটিত হতে পারে। গোলামির প্রতি ঘৃণা আমারও কম নয়। কিন্তু আবেগ ও মোহ থেকে আলাদা হয়ে একটু চিন্তা করুন! আমরা ইংরেজদের কেন আমাদের শত্রু মনে করতাম? গোলামির প্রতি আমাদের ঘৃণা কেন ছিল? এজন্য যে, জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য আমাদের সহায়ক ছিল না। আমাদের কোনো স্বস্তি ছিল না।
আমাদের জীবনের প্রয়োজন পূরণ সহজসাধ্য ছিল না। আমরা সহমর্মিতা, একনিষ্ঠতা, সহযোগিতাবোধ এবং প্রেম-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলাম- যাতে অতীত জীবন হয় তিক্ত এবং এই দুনিয়ার জেলখানাসদৃশ। মনে করুন, যদি বাইরের গোলামির অবসান ঘটে কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যেই একে অপরকে গোলাম বানানোর প্রবণতা চালু হয়ে গেল। আমাদের পরস্পরে জুলুমে স্বাদ অনুভূত হতে লাগল। আমরাও একে অন্যের অপরিচিত, অজ্ঞাত। সহযোগিতা ও সহমর্মিতা থেকে অনেক দূরে। এক শহরের লোক অন্য শহরের লোকের সঙ্গে এমন আচরণ করতেই উদ্বুদ্ধ হচ্ছি, শুধু সুযোগের প্রত্যাশায় আছিÑযা বিজয়ী গোলামের সঙ্গে এবং শত্রুর সঙ্গে করে। আমরা আমাদের সঞ্চিত সম্পদে অন্যের অপরিহার্য প্রয়োজনীয় সম্পদটুকু ঢুকিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারায় লিপ্ত। এ ধরনের মানসিকতা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। কুরআনে কারিম এটাকে একটি ঘটনার দ্বারা বিবৃত করেছে।
কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, হযরত দাউদ (আ.)এর কাছে দুই পক্ষ মুকাদ্দামা নিয়ে এলো। একজনে বলল, হে আল্লাহর নবী! হে বাদশা! আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের প্রতি একটু ইনসাফ করুন। আমার এই ভাইয়ের কাছে ৯৯টি ভেড়া আছে, আমার আছে মাত্র একটি ভেড়া। কিন্তু এই জালেম বলছে, আমি যেন তাকে আমার ভেড়াটিও দিয়ে দেই, তবে তার শত পুরো হবে। আমি আপনার কাছে জানতে চাই, যদি কোনো রাষ্ট্রে বা শহরে এ ধরনের মনোভাবের প্রসার ঘটে তবে কি স্বাধীনতার প্রকৃত সম্পদ সেখানে বাস্তবে রক্ষিত আছে? বিষয়টি কি এমন নয় যে, উপনিবেশ গোষ্ঠী যে আচরণ করত সেটাই স্বজাতি, প্রতিবেশীর দ্বারা করা হচ্ছে। পরাধীনতার সব শৃঙ্খলই কি এখানে কোনো না কোনোভাবে বিদ্যমান নয়? এসব কিছু এজন্য যে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য প্রাণপণে লড়াই করে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের মন-মগজ এবং তার আত্মার প্রশস্তির জন্য কোনো চেষ্টা করা হয়নি। ফলে সেগুলো যথারীতি গোলামই রয়ে গেছে। দেশ থেকে জালেম বিতাড়িত করা হয়েছে কিন্তু দিল থেকে জুলুমের বাসনা নির্মূল করা হয়নি। সেটি বহাল আছে এবং নিজের কাজ করে যাচ্ছে।
আত্মার আলো
নবী-রাসূলেরা আল্লাহপ্রদত্ত সমস্ত শক্তি এবং নিজেদের পুরো মনোযোগ ব্যয় করেছেন প্রকৃত অর্থে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরির কাজে। তারা শুধু রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাকে নিজেদের দৃষ্টিভূত করেননি। বরং অনুভূতির জ্বলন তৈরি, ঈমান-আকিদাকে মন-মগজে সুদৃঢ়করণ এবং ওই আখলাক সৃষ্টির প্রতি গভীর মনোযোগ দিয়েছেন যাতে উপনিবেশ ও আভ্যন্তরীণ কোনো দাসত্বেরই সুযোগ ছিল না। যার কারণে মানুষ অন্যের গোলামিও বরদাশত করতো না এবং অন্যের ওপর নিজের গোলাম আরোপ করার মনোবাসনাও পোষণ করতো না। যার ফলে অন্যের শিকারেও পরিণত হতো না আবার অন্যকেও নিজেদের শিকারে পরিণত করতো না। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)এর দৃষ্টান্ত দেখুন! তাঁর পাশে আত্মত্যাগী, উৎসর্গকারী যে বিশাল জামাত জড়ো হয়েছিলেন তাদের দ্বারা তিনি যেকোনো কাজ আঞ্জাম দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাদের চারিত্রিক উৎকর্ষ ও মানবিকতা উন্নয়নে তাঁর সমস্ত সামর্থ্য ব্যয় করেছেন।
তিনি মানবতাকে এমন কোনো চোখ ধাঁধানো আবিষ্কার কিংবা তথ্য-প্রযুক্তি দেননি ইউরোপের বিজ্ঞানীরা যা এ যুগে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী [রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম আজমাইন] এর মতো কিছু মানুষ তৈরি করে গেছেন যারা মানবতার জন্য রহমত ও বরকতের ভাণ্ডার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন। আজও যদি মানবতাকে প্রশ্ন করা হয়Ñতারা শাসনকর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের জন্য আবু বকর (রাযি.)এর মতো মানুষ চায় নাকি সর্বাধুনিক আবিষ্কারসমূহ হাতের নাগালে চায়। নিশ্চয় তাদের কাছ থেকে উত্তর আসবেÑআবু বকর (রাযি.)এর মতো মানুষই তাদের বেশি প্রয়োজন। কেননা, তারা আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি এবং আবিষ্কারসমূহ ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করে দেখছে, প্রকৃত মানুষের অবর্তমানে এসব দুনিয়ার জন্য মুসিবত ও ধ্বংসের বার্তাবাহক।
মুক্তির মহাতন্ত্র
আমি বারবার বলেছি এবং বলব, সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষ বানাতে হবে। তখন তার মধ্যে গোনাহ ও জুলুমের বাসনা নির্মূল হবে, নেক ও খেদমতের জযবা সৃষ্টি হবে। মানুষের জীবনধারায় হাজারো প্রতিকূলতা সৃষ্টি হয়, মানবিক জীবনে অসংখ্য সমস্যা ও সংকট দেখা দেয়, ভারী ভারী তালা পড়ে, আর এসব সংকট ও তালা খোলার একটি মাত্র চাবি, এটাকে মুক্তির মহাতন্ত্র, মূল চাবিকাঠি (Master ke) হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এই চাবিকাঠি আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলদের কাছে ছিল। একমাত্র তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কায়েমের মাধ্যমেই এটা অর্জিত হয়। এই চাবিকাঠি হচ্ছে, আল্লাহর মহান সত্তার প্রতি নিটোল বিশ্বাস এবং তাঁর ভয়। এই চাবিকাঠি দ্বারাই মানবিক জীবনের সমস্ত সমস্যা ও সংকট অতি সহজে দূরীভূত হয় এবং জীবনের সব পঙ্কিলতা মুক্ত হয়। মনে করুন, পয়গাম্বরদের হাত বৈদ্যুতিক সুইচের উপর। তারা ওই সুইচে টিপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘর আলোকিত হয়ে গেল। যাদের আঙ্গুল ওই সুইচ পর্যন্ত পৌঁছবে না তারা ঘর আলোকিত করতে পারবে না।
আরও পড়তে পারেন-
পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
আহলে কুরআন: কুরআন বলে ‘তুমি মিথ্যাবাদি’
আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
ব্যক্তিগঠন ও চারিত্রিক সংশোধন ছাড়া কোনো প্রজেক্ট সফল হয় না
বর্তমানে প্রতিটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন-অগ্রগতি ও আধুনিক ব্যবস্থাপনার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হয়। আমাদের দেশেও (ভারত) এই কাজ দ্রুতগতিতে হচ্ছে। আল্লাহ এসব প্রজেক্টকে সফল করুন। কিন্তু এই প্রজেক্ট আমাদের দৃষ্টিতে এখনও অপূর্ণাঙ্গ ও অপরিপক্ক। এখানে মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠন এবং চারিত্রিক সংশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, যতক্ষণ পর্যন্ত অন্তরে লোভ-লালসার শিখা অনির্বাণ থাকবে, সম্পদ জমানোর ভূত সক্রিয় থাকবে, মানুষ শুধু সম্পদ উপার্জন ও ভোগ-বিলাসেই নিজেদের জীবনের পরম লক্ষ্য মনে করবে- ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো নকশা এবং কোনো প্রজেক্টই সাফল্যের মুখ দেখবে না। যেসব দেশে এ ধরনের প্লান-প্রোগ্রাম সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন হয়েছে, উন্নতির বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে এসেছে- তাদের কি প্রকৃত স্বস্তি ও নিরাপত্তা হাসিল হয়েছে? সেখানে কি অপরাধমূলক কর্মকা- সংঘটিত হয় না? অপরাধের দিক থেকে তো ওই সব দেশ আমাদের থেকে অনেক ধাপ এগিয়ে। সেখানে দিনে-দুপুরে ডাকাতি-লুটপাট হয়। বড় বড় সম্পদশালী, শিল্পপতিদের দিবালোকে ছিনতাই করে নেয়া হয়। তাদেরকে আটক করে আত্মীয়দের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করা হয়। বর্তমানে ওই সব তথাকথিত সুসভ্য দেশের চারিত্রিক পদ¯খলন এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা তাদের নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান। জাতিপূজা এবং দেশপ্রীতি তাদের অস্তিত্বকে কোনো রকম টিকিয়ে রাখছে। তবুও তাদের বিলুপ্তি খুব বেশি দূরে নয়। আল্লামা ইকবালের ভাষায় বললে অত্যুক্তি হবে না ‘গাছের পাকা ফলের মতো নিজে নিজেই ঝরে পড়ছে, দেখুন! অবশেষে ফিরিঙ্গিরা কার ঝুলিতে খসে পড়ে।’
ব্যক্তি গঠনের প্রয়োজনীয়তা
ধন-সম্পদের এই হয়রানি, স্বৈরাচারী এই চিন্তাধারা এবং জুলুম-নির্যাতনের প্রবৃত্তি কোনো ধর্মের প্রবর্তন অথবা কোনো গোষ্ঠীর সহায়ক হতে পারে না। চোর এবং অপরাধীর ধর্ম হিন্দুও না, মুসলমানও না। যার মধ্যে এই প্রকৃতি ও আচরণ চলে আসে তার কাছে এটার কোনো পরোয়া নেই- সে কার গলা কাটছে, সে কোন ধর্ম বিশ্বাসের অনুসারী। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনও তার কাছে মূল্যহীন। এরচেয়ে বড় কোনো দুর্যোগ নেই, এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো বিপদ নেই- আল্লাহর আওয়াজকে বুলন্দ করার মতো কোনো লোক এদেশে নেই। নৈতিক সংশোধন এবং প্রকৃত মানুষ গড়ার কোনো দাওয়াত ও আন্দোলন নেই। বর্তমানে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা তথা পুরো সমাজ-ব্যবস্থায় হয়তো ব্যবসায়িক আধিপত্য অথবা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। এদেশের বড় বড় সংবাদপত্র পড়ে দেখুন- এ দুটি বিষয় ছাড়া এমন কোনো বিষয় পাওয়া যাবে না যার সম্পর্ক আত্মার সঙ্গে কিংবা চরিত্র ও মানবিকতার সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে সমস্ত রাজনৈতিক দল ও মতবাদের একই দৃষ্টিভঙ্গি। এ ব্যাপারে কারো কোনো মতানৈক্য বা বিরোধ নেই। যাদের যাবতীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত হচ্ছে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দখল নিয়ে। যা কিছু হচ্ছে সবকিছুর কৃতিত্ব নিজেদের অনুকূলে নেয়ার জন্য।
নৈতিক অবক্ষয়
নৈতিক অবক্ষয় বাড়তে বাড়তে এই সীমা অতিক্রম করেছে যে, এখন মানুষের মনুষ্যত্ব নির্মূল হয়ে গেলে ফূর্তি করা হয়। বরং হাসি-বিদ্রƒপ এত বেড়ে গেছে যে, মনুষত্ববোধ যতই নিম্নগামী হয় পরিতৃপ্তি ও আনন্দের মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। এই ফিল্ম-ফটো, নভেল-নাটক, পর্নোগ্রাফি এবং অশ্লীল গান-বাদ্য কেন আপনার বিনোদনের উপকরণ? এগুলোতে কি মানবিক মূল্যবোধকে পদদলন করা হয় না? এগুলো কি আদম-হাওয়ার সন্তানদের, যারা আপনাদের ভাইবোনÑএমনভাবে উপস্থাপন করে না যা মানবিক মূল্যবোধের জন্য অপমানজনক? আপনার কি এসব ছায়াছবি, খেলাধুলা, পর্নো ফিল্ম এবং নভেল-নাটকে মানবতার পদস্খলন ও চরম যিল্লতি নজরে ভাসে না? তবুও কেন আপনার রুচিতে কোনো ঘৃণাবোধ জাগছে না? আপনি এগুলোর সঙ্গে কীভাবে একাত্মতা পোষণ করেন?
যখন কোনো সমাজ নৈতিকভাবে অনুকরণীয় হয় তখন এর কোনো সদস্য অপর সদস্যের অপমান সহ্য করা তো দূরের কথা তার ব্যাপারে মন্দ কোনো কথা শোনাও পছন্দ করে না। কুরআনে কারিমে একটি মিথ্যা অপবাদের কথা উল্লেখপূর্বক বলা হয়েছে- ‘তোমরা একথা শুনেই কেন এটা প্রত্যাখ্যান করোনি, স্পষ্ট করে কেন বলে দাওনি- এটা নিছক অপবাদ। তোমরা নিজেদের ব্যাপারে সুধারণা কেন পোষণ করোনি। নিজের ওপরে আস্থার সঙ্গে কেন কাজ করোনি’। এটা ওই সমাজের কথা যাকে আইডিয়াল সমাজব্যবস্থা বলার যোগ্য। যে সমাজে প্রত্যেকেই ছিলেন পরস্পরের আয়নাসদৃশ। এর তুলনা করুন অধঃপতিত এই সমাজব্যবস্থার সঙ্গে, যার কতিপয় সদস্য অন্যান্য সদস্যের চারিত্রিক স্খলন এবং মানবিক মূল্যবোধ পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে খুশি প্রকাশ করে।
একজন মানুষ তার শরীর উলঙ্গ করছে, কুপ্রবৃত্তির শিকার হয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ করছে, নিজের ইজ্জত-আব্রু বিকিয়ে দিচ্ছে আর হাজার হাজার মানুষ এর তামাশা দেখছে, তা দেখে আনন্দ-ফূর্তি করছে- চারিত্রিক স্খলন ও মূল্যবোধবিনাশী এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? উদ্ভূত পরিস্থিতি ও ভয়াবহ চিত্র অশনি সংকেত দিয়ে যাচ্ছে যে, এদেশ বস্তুগত উৎকর্ষ ও বাহ্যিক চাকচিক্য সত্ত্বেও না জানি কখন পতনের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। এসব অসৎ চরিত্র, পাপাচার ও অবৈধ ভোগ-বিলাসের প্রবণতা মরণব্যাধি থেকেও ভয়াবহ। আপনি অতীত কোনো জাতির নাম বলুন, যাদের ব্যাপারে ইতিহাসে এ কথা লেখা আছে যে, পুরো জাতি অমুক ব্যাধিতে অথবা অমুক বিপর্যয়ে পতিত হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি এমন বিশটি জাতির নাম বলতে পারব যারা দুশ্চরিত্রের শিকার হয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে লীন হয়ে গেছে।
মানবিক মূল্যবোধ
এদেশ স্বাধীন করতে আপনারা সর্বাত্মক চেষ্টা-সাধনা করেছেন, ত্যাগের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, নেতৃবৃন্দের দেখানো পথে গমন করেছেনÑফলে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা আপনাদের অর্জিত হয়েছে। এখন মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন করে আপনাদের চেষ্টা-সাধনা করতে হবে। প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের এটাই একমাত্র পথ। আর এটা ওই পথ যে পথের নির্দেশ করেছেন আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলেরা, যে পথে গমন করে গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন অনুসারীরা। তারা দুনিয়াতে প্রকৃত মানুষের নমুনা প্রদর্শন করেছেন।
এ পথের পাথেয় হচ্ছে ঈমান, একিন এবং খোদাভীতি। প্রকৃত খোদাভীতি, তাজা ঈমান এবং জাগ্রত কলব নবী-রাসূলদের ছাড়া আর কোথাও মিলবে না। এটাই তাদের ভাণ্ডার, এই ভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণ করতে আমাদের কোনো লজ্জা-সংকোচ থাকা উচিত নয়। আজ যদি এসব গুণ অর্জন এবং প্রচার-প্রসারে আজাদি সংগ্রামের মতো ত্যাগ-তিতিক্ষার সূচনা হয়, উপনিবেশ বিতাড়নে যে সাধনা করা হয়েছে সে সাধনা যদি করা হয়- তবে দেশের চেহারাই ভিন্ন রূপ ধারণ করবে। অর্জিত হবে প্রকৃত অর্থে শান্তি ও নিরাপত্তা। বন্ধ হবে দাসত্বের চলমান ধারা। দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা এবং জীবনের প্রকৃত স্বাদ তখনই হাসিল হবে।
অনুবাদ: জহির উদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক- ঢাকা টাইমস্।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/