রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুমহান মর্যাদা এবং বেয়াদবির শাস্তি

।। আল্লামা মুফতি জসিমুদ্দীন ।।

হযরত আদম (আ.) থেকে হযরত ঈসা (আ.) পর্যন্ত যত নবী-রাসূল দুনিয়াতে এসেছেন তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন আমাদের প্রিয়নবী সায়্যিদুল মুরসালীন, রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)। তিনি নবী-রাসূলদের সর্দার।

امام الانبیاء سید المرسلین، خاتم النبین، شفیع المذنبین، رحمۃ اللعلمین، اوّ من یرفع من القبور، اول ما یجازی الصراط فاتح للشفاعۃ، اول ما یقرع باب الجنۃ، اول من یدخل الجنۃ، وشرفہ اکرمہ اللہ تعالی بقولہ انک لعلی خلق عظیم۔

অর্থাৎ- নবী-রাসূলদের ইমাম, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল, পাপীদের জন্য সুপারিশকারী, সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত। তিনিই কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম কবর থেকে উঠে দাঁড়াবেন, সর্বপ্রথম পুলসিরাত অতিক্রম করবেন, উম্মতের জন্য সর্বপ্রথম সুপারিশ করবেন, সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজায় করাঘাত করবেন এবং সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন। তাঁর সম্মান ও মর্যাদা পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাআলা এভাবে বর্ণনা করেছেন-

وَإِنَّكَ لَعَلَىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍۢ

অর্থাৎ- আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী (সূরা কলম, ৪ আয়াত)।

তাঁর আগমনে বিশ্ববাসী পেয়েছে আলোর সন্ধান এবং তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ মানুষকে দিয়েছে মানবতার মুক্তি ও কল্যাণ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তাঁর কাছে পেয়েছে তাদের আশার বাণী এবং লাভ করেছে ইহকাল ও পরকালের মুক্তি।

মহান আল্লাহপাক রাসূল (সা.)কে সারা বিশ্বের জন্য রহমতের প্রতীক হিসেবে পাঠিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি’।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর অতুলনীয় মর্যাদা সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রাযি.) বর্ণনা করেছেন, রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন, আমাকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এমন পাঁচটি বিষয় দেয়া হয়েছে, যা আমার আগে আর কাউকে দেয়া হয়নি। এতে আমার কোনো গর্ব নেই। (১) পূর্ববর্তী নবী-রাসূলরা কোনো বিশেষ জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। আর আমি সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত হয়েছি। (২) আমার জন্য দুনিয়ার সমগ্র মাটি মসজিদের মতো পরিণত করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ জমিনের যেকোনো অংশে উম্মতে মুহাম্মদিয়া যাতে নামাজ আদায় করতে পারে এবং মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে পবিত্রতা অর্জন করতে পারে। এর আগে অন্য কোনো উম্মতের এ সুযোগ ছিল না। (৩) আমার জন্য যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (গণিমত) হালাল করে দেয়া হয়েছে। যা আমার আগে কারো জন্য হালাল ছিল না। (৪) আমাকে সাহায্য করা হয়েছে শত্রুর অন্তরে ভয়ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে। (৫) আমাকে ব্যাপকভিত্তিক সুপারিশের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নবীকে একটি করে বিশেষ সুপারিশের অধিকার দান করেছেন। অন্য নবীরা দুনিয়াতেই সেই অধিকার ব্যবহার করেছেন; কিন্তু আমি বিশেষ সুপারিশের এ অধিকার আমার উম্মতের জন্য সংরক্ষণ করেছি। যে আল্লাহ তায়ালার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করেনি, সে কিয়ামতের দিন এ সুপারিশের ফল লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। (বুখারি ও মুসলিম)।

হাশরের ময়দানে রাসূল (সা.) মর্যাদার যে সুমহান স্থান লাভ করবেন তার নাম হলো মাকামে মাহমুদ বা প্রশংসিত স্থান। সেদিন তাঁকে হাউজে কাওসারের সার্বিক অধিকার দেয়া হবে। নবী (সা.) এক দিন সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান কাওসার কী? সাহাবারা বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, এটা জান্নাতের নহর। আমার প্রভু আমাকে এটি দেবেন বলে অঙ্গীকার বলেছেন। এতে অনেক কল্যাণ রয়েছে। আর আমার উম্মতরা হাশরের সেই ভীষণ দিনে এর থেকে পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করবে।

হযরত রাসূলে কারীম (সা.)এর উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন- وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ অর্থাৎ- আমি আপনার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি। (সূরা ইনশিরাহ, ৪ আয়াত)।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমার হাতেই থাকবে আল্লাহ তায়ালার হামদের পতাকা। আদম (আ.) এবং তাঁর পর যত লোক এসেছে এবং আসবে সবাই আমার পতাকাতলে আশ্রয় নেবে। এটিও রাসূল (সা.)এর অন্যতম একটি মর্যাদা।

আল্লামা জামি (রহ.)এর ভাষায়-

یا صاحب الجمال و یا سید البشر

من وجہک المنیرلقد نور القمر

لا یمکن الثناء کما کان حقہ

بعد از خدا بزرگ توئی قصہ مختصر

অর্থাৎ- হে জ্যোতির্ময়! হে মানব শ্রেষ্ঠ! আপনার পূত চেহারার দীপ্তি থেকেই চাঁদ আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে। আমরা আপনার যথোপযুক্ত প্রশংসা করতে অক্ষম; বরং সংক্ষিপ্তভাবে আমরা এটিই বলতে পারি আল্লাহর পর তাঁর সৃষ্টিকুলে আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহান।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর মুহাব্বত মুমিনের দ্বীন ও ঈমানের অংশ এবং তিনি ঈমানদারের জীবন ও কর্মের আদর্শ। নবী (সা.)এর মুহাব্বত ও ভালবাসা কেবল আবেগের বিষয় নয়, দ্বীন ও ঈমানের বিষয়। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন জায়গায় এ  কথা বলা হয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

قُلۡ اِنۡ کَانَ اٰبَآؤُکُمۡ وَاَبۡنَآؤُکُمۡ وَاِخۡوَانُکُمۡ وَاَزۡوَاجُکُمۡ وَعَشِیۡرَتُکُمۡ وَاَمۡوَالُۨ اقۡتَرَفۡتُمُوۡهَا وَتِجَارَۃٌ تَخۡشَوۡنَ کَسَادَهَا وَمَسٰکِنُ تَرۡضَوۡنَهَاۤ اَحَبَّ اِلَیۡکُمۡ مِّنَ اللّٰهِ وَرَسُوۡلِهٖ وَجِهَادٍ فِیۡ سَبِیۡلِهٖ فَتَرَبَّصُوۡا حَتّٰی یَاۡتِیَ اللّٰهُ بِاَمۡرِهٖ ؕ وَاللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الۡفٰسِقِیۡنَ

অর্থাৎ- বলুন, ‘তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছো এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছো, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা করো আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত’। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না। (সূরা তাওবা, ২৪ আয়াত)।

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-

مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡهُ وَمَا نَهاکُمۡ عَنۡهُ فَانۡتَهُوۡا وَاتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ

অর্থাৎ- রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ করো, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর। (সূরা হাশর, ৭ আয়াত)।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ-নিষেধ সমর্পিত চিত্তে মেনে নেয়াই ঈমানের আলামত। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

 اِنَّمَا کَانَ قَوۡلَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذَا دُعُوۡۤا اِلَی اللّٰهِ وَرَسُوۡلِهٖ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَهُمۡ اَنۡ یَّقُوۡلُوۡا سَمِعۡنَا وَاَطَعۡنَا ؕ وَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ

অর্থাৎ- মুমিনদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি এ মর্মে আহবান করা হয় যে, তিনি তাদের মধ্যে বিচার, মীমাংসা করবেন, তাদের কথা তো এই হয় যে, তখন তারা বলে: ‘আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম।’ আর তারাই সফলকাম। (সূরা নূর , ৫১ আয়াত)।

হাদীস শরীফে নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন-

لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ

অর্থাৎ- “তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা থেকে, পুত্র থেকে এবং সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হই। (হযরত আনাস (রাযি.)এর সূত্রে, বুখারী, কিতাবুল ঈমান, হাদীস- ১৫; মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হাদীস- ১৭৭)।

কুরআন ও হাদীসের এই সুস্পষ্ট নির্দেশনা সর্বযুগে মুমিনের চেতনাকে জাগ্রত রেখেছে। তারা আল্লাহর নবীকে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালবেসেছেন এবং সমর্পিত চিত্তে তাঁর আনুগত্য করেছেন। অন্যদিকে ঈমানের দৌলত থেকে বঞ্চিত লোকেরাই আল্লাহর নবীকে ত্যাগ করেছে এবং বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাঁর বিরোধিতা করেছে। তাই খোদাদ্রোহীদের রাসূল-অবমাননার ঘটনা নতুন নয়। আর তাদের পরিণতিও কারো অজানা নয়। স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগেও রিসালত-অবমাননার ঘটনা ঘটেছে এবং নবী-প্রেমিক সাহাবীগণ তার সমুচিত জবাব দিয়েছেন।

মদীনা মুনাওয়ারায় আবু ইফক নামক এক ব্যক্তি নবী (সা.)এর নিন্দা করে কবিতা রচনা করেছিল। সালিম ইবনে উমাইর (রাযি.) তাকে হত্যা করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ৪/২৮২)।

ফাতহে মক্কার সাধারণ ক্ষমার সময়ও ইবনে খাত্তালকে ক্ষমা করা হয়নি। সে আত্মরক্ষার জন্য কাবা ঘরের গিলাফ ধরে রেখেছিল। ঐ অবস্থায় তাকে নবী (সা.)এর আদেশে হত্যা করা হয়। তার দুই দাসীকেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল, যারা ইবনে খাত্তাল রচিত কবিতা লোকদের আবৃত্তি করে শোনাত। (সহীহ বুখারী, হাদীস- ৪০৩৫; আলকামিল ইবনুল আছীর, ২/১৬৯)।

হাদীসের কিতাবে একজন অন্ধ সাহাবীর ঘটনা আছে। তার দাসী রাসূলুল্লাহ (সা.)এর শানে গোসতাখি করত। সাহাবী তাকে নিষেধ করতেন। একদিন সে যখন আবার গোসতাখি করল তো সাহাবী তাকে তরবারি দিয়ে শেষ করে দিলেন। ঘটনাটি শোনার পর হুযূর (সা.) বললেন, دَمُھَا ھَدرٌ অর্থাৎ এ হত্যার কোনো শাস্তি নেই।

ইহুদি-নেতা কাব ইবনে আশরাফ নবী (সা.)এর শানে গোসতাখি করত এবং নিন্দা ও উপহাসমূলক কবিতা পাঠ করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা (রাযি.) তাকে খতম করেছেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস, ৪০৩৭)।

নবী-যুগের এইসব ঘটনা প্রমাণ করে যে, তাওহীনে রিসালাত বা রাসূল-অবমাননা একটি চরম অপরাধ, যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। উম্মাহর চার ইমাম এ বিষয়ে একমত।

আল্লামা শামী (রহ.) বলেন, ‘রাসূল (সা.) সম্পর্কে কটূক্তিকারী ঈমান থেকে খারিজ ও হত্যার উপযুক্ত। চার ইমাম এ বিষয়ে একমত’।

ইসলামের বিজয়ের যুগে যখন মুসলমানদের আইন-আদালত অমুসলিমদের প্রভাব-প্রতিপত্তি থেকে মুক্ত ছিল তখন এ ধরনের অপরাধী মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হতো। এমনকি ইতিহাসে আছে যে, নবম শতকের মাঝামাঝিতে আন্দালুসে এক খ্রিস্টানের নেতৃত্বে কিছু লোক দলবদ্ধভাবে রাসূলের অবমাননায় লিপ্ত হয়েছিল। মুসলিম বিচারকরা সে সময় বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। এদের মৃত্যুদ- দেয়ার কারণে স্পেন থেকে এই ফিতনা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। (তারীখে হিসপানিয়া- ১ম খ-, ২০০ পৃষ্ঠা)।

খ্রিস্টজগতের সাথে মুসলিমজাহানের দ্বন্দ-সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খ্রিস্টান পাদ্রীদের ইসলাম-বিদ্বেষ এবং মুসলিম-বিরোধী প্রোপাগান্ডা খোদ খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেন।

ডব্লু-মন্টগোমারি ওয়াট লেখেন, ‘মুশকিল এই যে, এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছি, যার শিকড় মধ্যযুগের যুদ্ধকালীন প্রোপাগান্ডার মাঝে প্রোথিত। এখন তা প্রকাশ্যে স্বীকার করা উচিত। অষ্টম শতাব্দী থেকে ইউরোপের খ্রিস্টজগত ইসলামকে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ভাবতে থাকে। কারণ, তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আধিপত্যের জন্য ইসলামই ছিল একমাত্র চ্যালেঞ্জ। তারা প্রতিপক্ষের চরিত্রহননের মাধ্যমে তাদের ধর্ম-বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। বিংশ শতকের মাঝামাঝিতেও এর জের অবশিষ্ট রয়েছে। (ইসলাম কেয়া হ্যায়, ২০১ পৃষ্ঠা)।

জে জে সান্ডারস লিখেছেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আরবের নবী (সা.)কে খ্রিস্টানরা কখনো আগ্রহ ও সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখেনি। অথচ হযরত ঈসা (আ.)এর ন¤্র ও নিষ্পাপ ব্যক্তিত্বই ছিল তাঁর আদর্শ। (ক্রুসেড আমলে) ইসলামের কারণে খ্রিস্টজগতের স্বার্থহানি এবং ক্রুসেডারদের অব্যাহত প্রোপাগান্ডার কারণে ইসলাম সম্পর্কে নিরপেক্ষ বিচার-বিবেচনার পরিবেশ ছিল না। ওই সময় থেকে আজ পর্যন্ত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে অন্যায়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ভিত্তিহীন কথাবার্তা প্রচার করা হয়েছে। সুদীর্ঘকাল যাবত এগুলোই হচ্ছে মুহাম্মাদ সম্পর্কে খ্রিস্টান জনসাধারণের বিশ্বাস। (আহদে উসতাকে ইসলাম কী তারীখ, ৩৪-৩৫ পৃষ্ঠা)।

এই বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাই অমুসলিমদেরকে নবী (সা.)এর অবমাননার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। আর বিগত দুই তিন শতাব্দী যাবত ইউরোপ থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নামক যে বিষাক্ত মতবাদ প্রচার করা হয়েছে তা দিয়ে রিসালাত-অবমাননার মতো চরম অপরাধকেও বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরাও আগের যে কোন সময়ের তুলনায় নগ্নভাবে ইসলাম ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে মাঠে নেমেছে।

আরও পড়তে পারেন-

মনে রাখা চাই, একজন মুমিনের কাছে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মান ও মর্যাদা দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদ ও সম্পর্ক থেকে অধিক মূল্যবান হতে হবে। রাসূলের অবমাননা ও বিরুদ্ধাচরণের বিষয়ে কোনো ঈমানদার আপস করতে পারেন না। কারণ রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সম্পর্কে কুরআন মজীদ কঠিন ভাষা ব্যবহার করেছে। সূরা মুজাদালার ২১-২২নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

 کَتَبَ اللّٰهُ لَاَغۡلِبَنَّ اَنَا وَ رُسُلِیۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ قَوِیٌّ عَزِیۡزٌ- لَا تَجِدُ قَوۡمًا یُّؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ یُوَآدُّوۡنَ مَنۡ حَآدَّ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ لَوۡ کَانُوۡۤا اٰبَآءَهُمۡ اَوۡ اَبۡنَآءَهُمۡ اَوۡ اِخۡوَانَهُمۡ اَوۡ عَشِیۡرَتَهُمۡ ؕ اُولٰٓئِکَ کَتَبَ فِیۡ قُلُوۡبِهِمُ الۡاِیۡمَانَ وَ اَیَّدَهُمۡ بِرُوۡحٍ مِّنۡهُ

অর্থাৎ- “আল্লাহ লিখে দিয়েছেন যে, ‘আমি ও আমার রাসূলগণ অবশ্যই বিজয়ী হব’। নিশ্চয় আল্লাহ মহা শক্তিমান, মহা পরাক্রমশালী। তুমি পাবে না এমন জাতিকে যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে, বন্ধুত্ব করতে তার সাথে যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধীতা করে, যদিও তারা তাদের পিতা, অথবা পুত্র, অথবা ভাই, অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়। এরাই, যাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন”।

সূরাতুল কাউসারের শেষ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

اِنَّ شَانِئَکَ هُوَ الۡاَبۡتَرُ

অর্থাৎ- ‘নিঃসন্দেহে তোমার শত্রু ই হবে নির্বংশ’।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণকারীদের অবস্থা এবং এদের বিষয়ে মুমিন-মুসলমানের অবস্থান বোঝার জন্য এ দুটি আয়াতই যথেষ্ট।

রিসালাত-অবমাননার শাস্তি সম্পর্কে সবার আগে যে কথাটি স্পষ্টভাবে বলতে চাই তা এই যে, এটি কোনো ইজতিহাদী মাসআলা নয়; বরং কুরআন-সুন্নাহর দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত একটি বিষয়।

কুরআন শরীফের একাধিক আয়াত থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, রাসূলে কারীম (সা.)এর শানে বেয়াদবির শাস্তি দুনিয়াতে মৃত্যুদন্ড। আর আখেরাতে জাহান্নামের আযাব।

এ প্রসঙ্গে সূরা ফুরকানের কয়েকটি আয়াত তুলে ধরছি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ یَوۡمَ یَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰی یَدَیۡهِ یَقُوۡلُ یٰلَیۡتَنِی اتَّخَذۡتُ مَعَ الرَّسُوۡلِ سَبِیۡلًا – یٰوَیۡلَتٰی لَیۡتَنِیۡ لَمۡ اَتَّخِذۡ فُلَانًا خَلِیۡلًا – لَقَدۡ اَضَلَّنِیۡ عَنِ الذِّکۡرِ بَعۡدَ اِذۡ جَآءَنِیۡ ؕ وَ کَانَ الشَّیۡطٰنُ لِلۡاِنۡسَانِ خَذُوۡلًا

অর্থৎ- আর সেদিন যালিম নিজের হাত দু’টো কামড়িয়ে বলবে, হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে একই পথ অবলম্বন করতাম! হায় আমার দুর্ভোগ, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। অবশ্যই সে তো আমাকে উপদেশবাণী থেকে বিভ্রান্ত করেছিল, আমার কাছে তা আসার পর। আর শয়তান তো মানুষের জন্য চরম প্রতারক। (সূরা ফুরকান- ২৭-২৯ আয়াত)।

হাদীসের কিতাবে আছে যে, উবাই ইবনে খালাফের প্ররোচনায় উকবা ইবনে আবী মুয়াইত হযরত রাসূলে কারীম (সা.)এর শানে গোস্তাখি করেছিল। তখন রাসূলে কারীম (সা.) তাকে সতর্ক করেছিলেন যে, মক্কার বাইরে তোমাকে পেলে তোমাকে হত্যা করব। বদরের যুদ্ধে রাসূলে কারীম (সা.) তাকে বন্দি অবস্থায় হত্যা করেছিলেন।

অন্য আয়াতে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি করে তাদের শাস্তি ঘোষণা করে বলা হয়েছে-

اِنَّمَا جَزٰٓؤُا الَّذِیۡنَ یُحَارِبُوۡنَ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ یَسۡعَوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ فَسَادًا اَنۡ یُّقَتَّلُوۡۤا اَوۡ یُصَلَّبُوۡۤا اَوۡ تُقَطَّعَ اَیۡدِیۡهِمۡ وَ اَرۡجُلُهُمۡ مِّنۡ خِلَافٍ اَوۡ یُنۡفَوۡا مِنَ الۡاَرۡضِ ؕ ذٰلِکَ لَهُمۡ خِزۡیٌ فِی الدُّنۡیَا وَ لَهُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ

অর্থাৎ-  যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং যমীনে ফাসাদ করে বেড়ায়, তাদের আযাব কেবল এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে কিংবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে। এটি তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্ছনা এবং তাদের জন্য আখিরাতে রয়েছে মহা আযাব। (সূরা মায়েদা, ৩৩ আয়াত)।

ওই ব্যক্তির চেয়ে অধিক অশান্তি সৃষ্টিকারী আর কে হতে পারে, যে রাসূল (সা.)এর শানে বেয়াদবি করে?

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-

وَاِنۡ نَّکَثُوۡۤا اَیۡمَانَهُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ عَهۡدِهِمۡ وَ طَعَنُوۡا فِیۡ دِیۡنِکُمۡ فَقَاتِلُوۡۤا اَئِمَّۃَ الۡکُفۡرِ ۙ اِنَّهُمۡ لَاۤ اَیۡمَانَ لَهُمۡ لَعَلَّهُمۡ یَنۡتَهُوۡنَ

অর্থাৎ- আর যদি তারা তাদের অঙ্গীকারের পর তাদের কসম ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে কটূক্তি করে, তাহলে তোমরা কুফরের নেতাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো, নিশ্চয় তাদের কোন কসম নেই, যেন তারা বিরত হয়। (সূরা তাওবা, ১২ আয়াত)।

এই আয়াত স্পষ্ট ঘোষণা করে যে, দ্বীনের নিন্দা হত্যাযোগ্য অপরাধ। সুতরাং যে রাসূলের নিন্দা-সমালোচনা করে তার শাস্তি মৃত্যুদ-। তার সাথে মুসলমানদের কোনো চুক্তি বা অঙ্গিকার থাকলে রাসূল-অবমাননার কারণে তা বাতিল হয়ে যায়।

হাদীসের কিতাবে এমন অনেক ঘটনা আছে যে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) রিসালত-অবমাননাকারীকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করেছেন। এ থেকেও প্রমাণ হয় যে, রিসালাত-অবমাননার দুনিয়াবী সাজা মৃত্যুদন্ড।

সুতরাং উপরের বিস্তারিত আলোচনা থেকে জানা গেল, রাসূল আবমাননা বিষয়ে ইসলাম কতোটা কঠোর এবং এর একামত্র শাস্তি মৃত্যুদ-। আর এই বিধান প্রয়োগের দায়িত্ব রাষ্ট্রের বা আদালতের। তবে কোনভাবেই এমন বিধান কার্যকরের দায়িত্ব কোন ব্যক্তিবিশেষ নিজ হাতে তুলে নিতে পারবে না।

এখন যে আমাদের দেশে কখনো কখনো ইসলাম ও রাসূল অবমাননার ঘটনা ঘটে, এসব ক্ষেত্রে আমাদেরকে রাষ্ট্রের বা সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এসব রোধকল্পে কঠোর আইন প্রণয়ন ও কার্যকরের দাবি জানাতে হবে। আর সরকারে যারা আছেন, তারা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এমন আইন প্রণয়ন ও শাস্তি না দিলে পরকালে আল্লাহর দরবারে তাদেরকে অবশ্যই কঠোর জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হবে।

এছাড়া বর্তমানে ভারতে রাসূল (সা.) এবং আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাযি.)কে মারাত্মক অবমাননার যে ঘটনা ঘটেছে, আমরা ব্যক্তিগতভাবে যার যার অবস্থান থেকে এই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ এবং এই দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হিসেবে স্বীকৃত। সুতরাং সরকারেরও কর্তব্য কূটনৈতিকভাবে ভারত সরকারের কাছে এই ঘটনার জোরালো প্রতিবাদ করা এবং মুসলিম উম্মাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি জানানো। দেশটি এ বিষয়ে সায় না দিলে প্রয়োজনে কূটনৈতিক চ্যানেলে এর প্রতিবাদে অন্যান্য পদক্ষেপও সরকারিভাবে নেয়াটা কর্তব্য এবং জনপ্রত্যাশা।

মেহেরবান আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের অন্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর প্রতি মুহাব্বত সীমাহীন কোটিগুণ বৃদ্ধি করে দিন, জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাহ পরিপূর্ণরূপে আমল করার তাওফীক দান করুন এবং আমাদের দেশের সরকারে যারা আছেন, তাদেরকে সুমতি দান করুন। আমিন।

লেখক: মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুফতি ও সহযোগী পরিচালক- আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।