রাসূল (সা.)এর একাধিক সহধর্মিনী: আপত্তি ও খন্ডন

।। মুফতি ফরীদুল হক ।।

ইসলামবিদ্বেষী কুচক্রী মহল আখেরী নবী হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর উপর যে কয়টি আপত্তি উত্থাপন করে থাকে, তার অন্যতম একটি হলো, রাসূলূল্লাহ (সা.) কেন এতগুলো বিবাহ করেছেন? কেন তিনি হযরত আয়েশা (রাযি.)কে এতো অল্প বয়সে বিয়ে করলেন? হযরত সফিয়্যা (রাযি.)কে কেন অন্য একজন সাহাবী থেকে নিয়ে নিলেন? কেন হযরত যাইনাব (রাযি.)কে নিজ পালক পুত্র থেকে নিয়ে বিয়ে করে নিলেন ইত্যাদি।

এসব আপত্তির মাধ্যমে তারা মূলত প্রমাণ করতে চায় যে, রাসূল (সা.) প্রবৃত্তিপূজারী ও নারীলিপ্সু ছিলেন। নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক, এসব আপত্তি সন্দেহাতীতভাবে অনেক বড় অপবাদ।

তাদের এই সমস্ত আপত্তির যথাযথ খন্ডন ও প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের আগে প্রাসঙ্গিকভাবে আমরা শুরুতে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো। এরপর ধারাবাহিকভাবে তাদের আপত্তিগুলোর জবাব দেওয়া হবে, ইনশাআল্লাহ।

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর চারিত্রিক পবিত্রতা

রাসূলুল্লাহ (সা.)এর চারিত্রিক পবিত্রতা সাব্যস্তের জন্য নতুন করে কোনো দলিল দেয়ার প্রয়োজন নেই। এর বড় দলীল তো এটাই যে, তাঁর জন্মলগ্ন থেকে দীর্ঘ ১৩০০ বছর পর্যন্ত কেউ তাঁর চরিত্র নিয়ে কোনো আপত্তি তোলা তো দূরের কথা,  সামান্য সন্দেহ করার অবকাশ পর্যন্ত পায়নি। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সবচাইতে বড় দুশমন মক্কার মুশরিকরা পর্যন্ত রাসূল (সা.)কে উন্মাদ, পাগল, জাদুকর, গণক, কবি ইত্যাদি বলে কটূক্তি করলেও তাঁর চরিত্র সম্পর্কে কখনো কোনো আপত্তি করতে পারেনি। এমনিভাবে মদীনার ইহুদিরা এবং অন্যান্য বিধর্মী ও মুনাফিকরাও এমন সমালোচনার সুযোগ খুঁজে পায়নি; বরং রাসূল (সা.) যখন দ্বীনের দাওয়াত দেয়া শুরু করলেন, তখন মুশরিকরা তাঁকে নিভৃত করার জন্য এই প্রলোভনও দেখিয়েছিল যে, তিনি রাজি হলে মক্কার সর্বাপেক্ষা সুন্দরী নারীকে তাঁর হাতে তুলে দেয়া হবে,  বিনিময়ে তিনি দ্বীন প্রচার বন্ধ করে দিবেন। রাসূল (সা.) তখন কোন বিষয়টিকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন, ইতিহাস আজো তার সাক্ষী। (আল লু’লুউল মাকনূন ফী সীরাতিন নাবিয়্যিল মামূন- ১/৩৩৩)।

স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তাঁর উত্তম চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন। তেমনি সহীহ বুখারীতে আম্মাজান হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণনা রয়েছে- রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবনে কোনো নারীর হাত স্পর্শ করেননি (এমনকি বাইআত নেয়ার সময়ও)। (বুখারী, হাদীস নং-৪৯৩৮)।

একজন স্বামী সম্পর্কে স্ত্রীর এই স্বীকারোক্তিই কি তাঁর চরিত্র বিচারের জন্য যথেষ্ট নয়? যদিও মহান আল্লাহর স্বীকৃতির পর রাসূলুল্লাহর (সা.) পবিত্রতা প্রমাণের জন্য আর কোনো দলিলেরই প্রয়োজন পড়ে না।

রাসূল (সা.)এর পুরো জীবনের প্রতি দৃষ্টি দিলে যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো, বিবাহ কেন্দ্রিক তাঁর পুরো জীবন চার ভাগে বিভক্ত ছিলো। প্রথম ভাগ হলো জীবনের শুরু থেকে ২৪ বছর বয়স পর্যন্ত। দ্বিতীয় ভাগ ২৫ থেকে শুরু হয়ে ৫৩ বছর পর্যন্ত। তৃতীয় ভাগ এরপর থেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত। আর বাকী ৩ বছর হলো চতুর্থ ভাগ।

রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবনের ১ম ও ৪র্থ ভাগে তথা ১-২৪ ও ৬১-৬৩ বছর বয়সে কোনো বিবাহ করেননি। বরং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগেই তাঁর সকল বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।

জীবনের ২য় অংশটি তথা ২৫-৫৩ বছর বয়স পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পূর্ণ যৌবনের সময়। শুধু তাঁর নয়, সকল মানুষেরই জীবনের সক্ষমতার সময় এই অংশটি। যৌবনের উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে যাওয়ার কিংবা প্রবৃত্তির চাহিদা ও আকাক্সক্ষাগুলো পূরণের সকল সামর্থ্য ও সক্ষমতা এই সময়েই থাকে পূর্ণমাত্রায়। রাসূল (সা.)এর বেলায়ও এর ব্যতিক্রম নয়। অথচ পূর্ণ যৌবনের এই সময়ে সুদীর্ঘ ২৯টি বছর রাসূল (সা.)এর কাছে একই সাথে একের অধিক স্ত্রী ছিলো না, যা ঐতিহাসিকভাবে সাব্যস্ত। ২৫-৫০ বছর পর্যন্ত কেবলমাত্র হযরত খাদীজা (রাযি.)। আর তাঁর ওফাতের পর পরবর্তী চার বছর ছিলেন শুধু হযরত সাওদা (রাযি.)।

এর চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রথম যে স্ত্রীকে নিয়ে রাসূল (সা.) ভরা যৌবনের সুদীর্ঘ ২৫টি বছর অতিবাহিত করলেন, বয়সে তিনি ছিলেন রাসূল (সা.)এর ১৫ বছরের বড়। শুধু তাই নয়, বরং রাসূল (সা.)এর আগে আরো দুইজনের সাথে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিলো এবং সেসব স্বামী থেকে তাঁর কয়েকজন সন্তানও ছিলো।

কিন্তু ইসলামের জন্য একনিষ্ঠ আত্মত্যাগী ও শুরুলগ্ন থেকেই দা’ওয়াতি কার্যক্রমে রাসূল (সা.)এর সর্বোত্তম সহযোগী হওয়ায় রাসূল (সা.)  তাঁকে ভালোবেসেছেন আমৃত্যু। তাঁর মৃত্যুর পরও সদা তাঁর প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। এমনকি তাঁর মৃত্যুর বছরকে “আমুল হুযন” তথা “বেদনাবিধুর বর্ষ” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ- ১১/১৫৫-১৫৯, আল বাসায়ের ওয়ায যাখায়ের ৪/১৮৯)।

এর পরবর্তী চার বছর যে স্ত্রীকে নিয়ে অতিবাহিত করেন, তিনি ছিলেন বয়সে রাসূল (সা.) এর থেকে প্রায় ১০ বছরের বড়।  ৬০ বছর বয়সে তিনি রাসূল (সা.)এর বিবাহ বন্ধনে আসেন এবং তিনিও ছিলেন বিধবা মহিলা। (মাউসূআতু মাহাসিনিল ইসলাম- ১১/২৪৮)।

মোটকথা, উপর্যুক্ত দুটি বিবাহের বর্ণনা থেকেই এ বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, রাসূল (সা.)এর চরিত্র নিয়ে যারা কটূক্তি করার দুঃসাহস দেখায়, তাদের এসব আপত্তি নিছক ভিত্তিহীন প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছু নয়। এর কোনো বাস্তবতা নেই। কারণ, যে মানুষটি পূর্ণ যৌবন এমন মহিলার সাথে কাটিয়ে দেন, তাঁর উপর নারী লিপ্সার অপবাদ দেয়া হীন চক্রান্ত ছাড়া আর কী হতে পারে? যার মনে নারীদের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে, এমন কোনো পুরুষ কীভাবে পূর্ণ যৌবনের দুটি যুগ প্রৌঢ়া ও বিধবা স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে?

জীবনের তৃতীয় অংশে অর্থাৎ ৫৪-৬০ বছরের মধ্যে রাসূল (সা.)-এর বাকি ৯টি বিবাহ সম্পন্ন হয়। হযরত আয়েশা (রাযি.)এর বিবাহ যদিও ২য় ভাগেই সংঘটিত হয়েছিলো, তবে তিনি রাসূল (সা.)এর ঘরে আসেন ৩য় অংশেই। (বুখারী-৩৮৯৪)।

উল্লেখ্য যে, হযরত আয়েশা (রাযি.) ছাড়া এঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন বিধবা এবং প্রায় প্রত্যেকেরই আগের স্বামী থেকে সন্তানাদি ছিল। (আস সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ লি ইবনে হিব্বান ১/৪০৪-৪০৬, সুবুলুল হুদা ওয়ার রশাদ ১১/১৪৩-২১২)।

একজন মানুষ যখন জীবনের ৫০তম বর্ষে পদার্পণ করে, তখন থেকেই সে ধীরে ধীরে বার্ধক্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তো এমন সময়ে এসে এ ধরনের মহিলাদের বিবাহ করার কারণে কীভাবে একজন মানুষকে কামুক বলা যায়? উপরন্ত যখন তাঁর প্রত্যেকটি বিবাহই ছিল বড় বড় দ্বীনি স্বার্থকে কেন্দ্র করে! (যা স্বতন্ত্র অনুচ্ছেদে সামনে আসছে)।

সুতরাং এমন একজন ব্যক্তির উপর কীভাবে প্রবৃত্তিপূজা ও নারীলিপ্সার অপবাদ আরোপ করা যায়! অথচ নারীলিপ্সুদের নিকট একজন কুমারী নারীও কিছুদিন থাকলে তার আবেদন হারিয়ে ফেলে!!

উপর্যুক্ত আলোচনার নিরিখে আশা করি পাঠকদের সামনে এসব কুচক্রীদের সমস্ত আপত্তির বাস্তবতা ও প্রকৃত সত্যতা স্পষ্ট হয়ে গেছে। এ পর্যায়ে আমরা রাসূল (সা.)এর নির্দিষ্ট কিছু বিবাহ নিয়ে আলোচনা করব যেগুলোকে কেন্দ্র করেও তারা প্রিয় নবীজির উপর ভিত্তিহীন কিছু আপত্তির অপপ্রয়াস চালিয়ে থাকে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব প্রশ্ন দ্বারাও রাসূল (সা.)এর চরিত্রের উপর আক্রমণ করাই তাদের উদ্দেশ্য। রাসূল (সা.)কে দুশ্চরিত্রের অধিকারী আখ্যায়িত করে দুর্বল মুসলমানদের ঈমান-আকিদার ভিত নড়বড়ে করে দেয়া এবং অন্য ধর্মাবলম্বিদেরকে ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলাই তাদের প্রোপাগান্ডার আসল রহস্য। তো এই লক্ষ্যে তারা যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে পানিঘোলা করার চেষ্টা করে, এর অন্যতম হচ্ছে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর বিবাহ।

এ বিবাহকে কেন্দ্র করে যে আপত্তি করা হয়, তা হলো- রাসূল (সা.) তাঁর প্রতি আসক্ত হয়েই তাঁকে বাল্য বয়সে বিবাহ করেছিলেন। যদি তিনি নারীলোভী না হতেন, তাহলে একজন ছয় বছর বয়সী মেয়েকে কেন বিবাহ করলেন, অথচ তখন তাঁর নিজের বয়স পঞ্চাশেরও বেশি?

এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হলো, প্রথমত এটা কোনোভাবেই প্রমাণিত নয় যে, রাসূল (সা.) হযরত আয়েশা (রাযি.)কে বিবাহের প্রতি পূর্ব থেকেই আগ্রহী ছিলেন। কেননা এর বিপরীতে এমন বহু বিষয় রয়েছে- যা থেকে এটাই স্পষ্ট যে, অন্যান্য বিবাহের ন্যায় রাসূল (সা.)এর এই বিবাহটিও একদম স্বাভাবিক ছিলো। কেননা ঐতিহাসিকভাবে সাব্যস্ত যে, রাসূল (সা.) হযরত আয়েশা (রাযি.)কে বিবাহের আগ্রহ আগে প্রকাশ করেননি, বরং হযরত খাদীজা (রাযি.)এর ইন্তিকালের পর হযরত খাওলা (রাযি.)ই রাসূল (সা.)কে সর্বপ্রথম-এর পরামর্শ দেন। (মুসতাদরাকে হাকেম- ৪৫০০)।

তদুপরি যদি রাসূল (সা.) নিজ আগ্রহ ও আকাক্সক্ষাতেই এই বিবাহ করতেন, তাহলে বিবাহের পরপরই কেন তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসেননি? কেন দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন? কোনো নারীর প্রতি আসক্ত হলে তো কারো পক্ষে এমনটি কল্পনাও করা যায় না!

এর চেয়ে বড় কথা হলো, হযরত আয়েশা (রাযি.)কে রাসূল (সা.) তখন বিবাহ করেছিলেন, যখন তিনি যৌবন ও পৌঢ়ত্ব অতিক্রম করে বার্ধক্যে পদার্পণ করতে যাচ্ছেন। এরপরও কি এই বিবাহকে কেন্দ্র করে রাসূল (সা.)এর উপর আপত্তির কোনো সুযোগ বাকি থাকতে পারে?

বাকি রইলো, যদি বাল্যবিয়ের বিষয়টি কেউ এখানে টেনে আনতে চায় সেক্ষেত্রে তাও তার অজ্ঞতা ও মূর্খতারই পরিচায়ক হবে। কেননা, আরব সমাজে তখন থেকেই কম বয়সে বিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এমনকি রাসূল (সা.)এর সাথে সমন্ধের আগেই হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সাথে জুবাইর বিন মুতইম (রাযি.)এর বিবাহের কথা চলছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সবাই একমত না হওয়ায় সেখানে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। (মুসতাদরাকে হাকেম- ৪৫০০)।

এছাড়াও এর আরো বহু উদাহরণ রয়েছে। যেমন, সাহাবাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি এমন ছিলেন, যাঁরা বাল্য বয়সেই নিজ মেয়েকে বিবাহ দিয়ে দিয়েছিলেন।

বুখারী শরীফে হাসান বিন সালেহের বক্তব্য উল্লেখ রয়েছে- আমি এমন একজন মেয়েকে দেখেছি যে একুশ বছর বয়সেই নানি হয়ে গিয়েছিলো। (বুখারী ৫২/১৮)।

অনুরূপ “ফাতহুল বারী”তে ইমাম শাফিঈ (রহ.) থেকে বর্ণনা রয়েছে- তিনি একজন মেয়েকে দেখেছেন, যে ১০ বছর বয়সেই মা হয়ে গিয়েছিল। (ফাতহুল বারী- ৫/৩১২)।

এ ঘটনাগুলো থেকে এ বিষয়টিও উপলব্ধ যে, প্রাকৃতিকভাবেও যদি ৯-১০ বছরে মেয়েরা বিয়ের উপযুক্ত না হয়, তাহলে এই বয়সে তাদের মা হওয়া কীভাবে সম্ভব? এজন্য কোনো ধর্ম ও মতাদর্শেই এর সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায় না।

“ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ক্যাথলজিক” এ রয়েছে, হযরত মরিয়মের বিবাহ যখন ইউসুফ নাজ্জারের সাথে হয়, তখন তার বয়স ছিল ১২ আর ইউসুফ নাজ্জারের বয়স ছিল ৯০ বছর। (www.newadvent.org)

এক তথ্য অনুযায়ী ঊনবিংশ শতাব্দির শুরু পর্যন্ত ইউরোপীয় অঞ্চলেও ১০ বছর বয়সে মেয়েদের বিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিলো। (Wikipedia: wiki/ages of consent)।

শেষ কথা হলো, যারা বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়, তারাই আবার বিবাহ না করে নিজেদের কুকামনা চরিতার্থের জন্য বাল্যবয়স থেকেই অবৈধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে যায়।

ওয়াশিংটন পোস্টে “স্যার বডম্যানের” একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি লিখেন- বাস্তবতা হলো, বর্তমানে পশ্চিমা অঞ্চলে ৯ বছর বয়স থেকেই বাচ্চারা যৌন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। (Washington post, May 10, 2006)

অতএব, বাল্যবিবাহ অবৈধ হওয়ার শ্লোগান দিয়ে আড়ালে কুকর্মের দ্বার উন্মোচন করা এবং একে পুঁজি করে রাসূল (সা.)এর পুষ্পময় চরিত্রের উপর আপত্তি তোলা তাদের হীন অসৎ স্বার্থ চরিতার্থের ঘৃণ্য অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

এসব কুচক্রী মহল হযরত আয়েশা (রাযি.) ছাড়াও আরো কয়েকজন স্ত্রীর বিবাহকে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর চরিত্রকে নিশানা বানিয়ে থাকে। যেমন, রাসূল (সা.) হযরত যাইনাব (রাযি.)এর প্রতি আসক্ত হয়ে তাঁকে নিজ পালক পুত্র থেকে নিয়ে বিবাহ করেছিলেন। অনুরূপ একই কারণে হযরত সফিয়্যা (রাযি.)কে দিহইয়া-য়ে-কালবী (রাযি.) থেকে ফিরিয়ে নিয়ে নিজেই বিবাহ করে নিয়েছিলেন। (নাউযুবিল্লাহ)।

বলাবাহুল্য যে, ইসলাম বিদ্বেষী গুটিকয়েক অসাধু মহল কর্তৃক, সর্বজন স্বীকৃত ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের উপর এসকল ঘৃণ্য ও অসত্য আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে বলেই এগুলোর সত্যতা যাচাই ও প্রকৃত বাস্তবতা উদঘাটনের লক্ষ্যে সেগুলো আমাদের উল্লেখ করতে হচ্ছে। না হয় এসব কথা এতোটাই জঘন্য যে, স্বাভাবিক অবস্থায় তা মুখে উচ্চারণ করতেও গা শিউরে ওঠে।

হযরত যাইনাব (রাযি.) কেন্দ্রিক তাদের যে আপত্তি উল্লেখ করা হয়েছে, রাসূল (সা.) সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও যার রয়েছে, সেই বলতে পারবে, এটা কতোটা জঘন্য মিথ্যাচার ও বাস্তবতা প্রণোদিত বক্তব্য। তাদের এই জঘন্য অপবাদের ভিত্তি হলো নিতান্তই দুর্বল, জাল ও বানোয়াট কিছু বর্ণনা। নিজেদের অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে তারা এসব বর্ণনার অবস্থা ও সত্যতা যাচাইয়ের বিষয়টিও অনায়াসেই ভুলে গিয়েছে। আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে শুধু কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করবো, যা থেকেই তাদের কথার বাস্তবতা নির্ণয় করা সহজ হয়ে যাবে।

প্রথম কথা হলো, হযরত যাইনাব (রাযি.) ছিলেন হুজুর (সা.)এর আপন ফুফাতো বোন। বাল্যকাল থেকে রাসূল (সা.)এর সামনেই তিনি বড় হয়েছেন। তখনো পর্যন্ত পর্দার বিধান অবতীর্ণ হয়নি। এমনকি হযরত যায়েদ (রাযি.)এর সাথে হযরত যাইনাব (রাযি.)এর প্রথম বিবাহও খোদ রাসূল (সা.)ই দিয়েছিলেন। এরপরও এই আপত্তির কী যৌক্তিকতা থাকতে পারে যে, তিনি তাঁর প্রতি আসক্ত হয়ে তাঁকে হযরত যায়েদ থেকে নিয়ে নেন? এমন কোনো মানুষও কি জগতে পাওয়া যাবে, যে কোনো মহিলার প্রতি আসক্ত হয়ে নিজে তাকে অন্যত্র বিবাহ দিয়ে দেয়? আর হযরত যায়েদ (রাযি.)এর স্ত্রী হওয়ার পরই বা এমন কী বিষয় দেখা দিল যে, তিনি তাঁর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লেন, যা এর আগে বিদ্যমান ছিল না?

দ্বিতীয়ত এ কথারও তো কোনো প্রমাণ নেই যে, রাসূল (সা.) হযরত যায়েদ (রাযি.)কে বাধ্য করেছেন বা বলেছেন হযরত যাইনাব (রাযি.)কে তালাক দিতে! বরং এটাই সু-প্রমাণিত যে, তাঁরা নিজেদের পারস্পরিক মনোমালিন্যের কারণেই বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। সুতরাং কী প্রমাণের ভিত্তিতে রাসূল (সা.) হযরত যাইনাব (রাযি.)কে হযরত যায়েদ (রাযি.)এর থেকে নিয়ে নিয়েছেন বলে দাবি করা যায়? (মাউসূআতু মাহাসিনিল ইসলাম- ১১/২৫৩, মাজাল্লাহ বাহস ওয়া নাযার, সংখ্যা- ১০১-১০৩, পৃ: ১৮৫-১৯০)।

অনুরূপভাবে হযরত সফিয়্যা (রাযি.)কে কেন্দ্র করে যে আপত্তি তোলা হয়, বাস্তবতা সামনে আনা হলে তাও ধূলির প্রাসাদের ন্যায় হাওয়ায় মিশে যাবে।

এ বিষয়ে আলোচনার দু’টি অংশ। (ক) হযরত সফিয়্যা (রাযি.)কে দিহইয়া-য়ে-কালবী (রাযি.) থেকে ফিরিয়ে নেয়ার কারণ। (খ) হুজুর (সা.) তাঁকে বিবাহ করার ঘটনা।

একথা তো জানাই আছে যে, হযরত সফিয়্যা (রাযি.) ছিলেন ইহুদীদের সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী গোত্র বনু নজীরের সর্দার হুয়াই বিন আখতাবের মেয়ে। খায়বার বিজয়ের পর রাসূল (সা.) যখন সকলের মাঝে গনীমতের মাল বণ্টন করছিলেন, সে ধারাবাহিকতায় হযরত দিহইয়া (রাযি.)কেও  যুদ্ধ-বন্দীদের মধ্য হতে একটি বাঁদী নিতে বললেন। হযরত দিহইয়া (রাযি.) সফিয়্যা (রাযি.)কে বেছে নেন। কিছুক্ষণ পর অন্য একজন সাহাবী রাসূল (সা.)এর নিকট এসে বললেন, সফিয়্যা (রাযি.) ইহুদীদের সর্দারের মেয়ে। তাই তাঁকে যে কাউকে না দিয়ে যেন স্বয়ং রাসূল (সা.)ই রেখে দেন। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সাহাবীর পরামর্শ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, হযরত সফিয়্যা (রাযি.) সাধারণ বন্দীদের মতো ছিলেন না।

রাসূল (সা.) তাঁর পরামর্শ আমলে নিয়ে হযরত দিহইয়াকে সফিয়্যা (রাযি.)সহ ডেকে পাঠান। তাঁরা আসলে হুযূর (সা.) দিহইয়া (রাযি.)কে বললেন, তুমি সফিয়্যা (রাযি.)এর পরিবর্তে অন্য আরেকজন বাঁদী নিয়ে নাও। (মুসলিম- ১৩৬৫)। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, স্বয়ং রাসূল (সা.) হযরত দিহইয়াকে ইখতিয়ার দিয়েছিলেন, চাইলে তাঁকেই রাখতে পারেন, চাইলে তাঁর পরিবর্তে অন্য কাউকে নিতে পারেন।

আরও পড়তে পারেন-

এখানে উল্লেখ্য যে, রাসূল (সা.) হযরত সফিয়্যা (রাযি.)কে দিহইয়া (রাযি.)এর জন্য বণ্টন করে দেননি, কিংবা নির্দিষ্ট কোনো বণ্টন পদ্ধতিতেও তিনি তাঁর ভাগে আসেননি। বরং তাঁকে যেকোনো একজন বন্দী নিয়ে যেতে বললে তিনি সফিয়্যা (রাযি.)কে নিয়ে যান। আর হযরত সফিয়্যা (রাযি.) অনেক দিক বিবেচনায়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। পাশাপাশি হযরত দিহইয়া (রাযি.)এর সাথে তাঁর সমতা-সামঞ্জস্যতায় বিস্তর ফারাক ছিলো। কেননা তিনি ছিলেন এক নেতার মেয়ে এবং আরেক নেতার স্ত্রী। তাই হযরত সফিয়্যা (রাযি.)কে তাঁর থেকে ফিরিয়ে নেয়াটাই সঙ্গত ছিলো।

দ্বিতীয় বিষয় হলো, রাসূল (সা.) হযরত সফিয়্যা (রাযি.)এর প্রতি আগ্রহী হওয়ার কোনো বিষয়ই এখানে পাওয়া যায় না। কারণ, হযরত দিহইয়া থেকে নেয়ার পর রাসূল (সা.) সফিয়্যা (রাযি.)কে বললেন- তোমার জন্য দুটি বিষয়ের যেকোনো একটি গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। যদি তুমি চাও মুক্তি লাভ করে তোমার পরিবারের সাথে গিয়ে মিলিত হবে। আর যদি সম্মত হও যে, তোমাকে আযাদ করে দেয়া হবে, এরপর তুমি আমার বিবাহে থাকবে, তবে তার সুযোগও রয়েছে। হযরত সফিয়্যা (রাযি.) তখন রাসূল (সা.)এর বিবাহে থাকাকেই বেছে নেন। (রাওয়াইউল বায়ান- ২/৩২৫)। সুতরাং এখান থেকে একথা কীভাবে সাব্যস্ত হয় যে, রাসূল (সা.) তাঁর প্রতি আগ্রহী হয়ে তাঁকে বিবাহ করে নেন! আর এসকল বিবাহের মাঝে কী পরিমাণ দ্বীনি ও মুসলমানদের কৌশলগত ফায়দা নিহিত ছিলো, তার বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ তো গেল বিভিন্ন বিবাহ কেন্দ্রিক রাসূল (সা.)এর উপর উত্থাপিত কিছু ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আপত্তির সংক্ষিপ্ত জবাব। এখন আলোচনা করা হবে রাসূল (সা.)এর বহুবিবাহের পেছনে কী কী মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত ছিল তা নিয়ে।

রাসূল (সা.)এর বহুবিবাহের প্রেক্ষাপট ও হেকমত

বহুবিবাহ কেন্দ্রিক রাসূল (সা.)এর মহৎ উদ্দেশ্যগুলোকে প্রধানত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১. দ্বীনি বিধানসমূহের ব্যাপক বিস্তারের পথ সুগম করা

রাসূল (সা.)এর বহুবিবাহের অন্যতম লক্ষ্য ছিল পারিবারিক জীবনে ইসলামের ভাবাদর্শ মানুষের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি ব্যাপক প্রচার প্রসার  ঘটানো। তেমনিভাবে একান্তই মহিলা সংশ্লিষ্ট মাসআলা-মাসায়েলও তাঁদের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে অন্যদের কাছে পৌঁছানো।

তাই তো দেখা যায়, মক্কী জীবনে রাসূল (সা.)এর কাছে একই সঙ্গে একাধিক স্ত্রী ছিলেন না; বরং এ ধারা শুরু হয় মাদানী জীবন থেকে, যেহেতু তখন ব্যাপকহারে শরয়ী বিধি-বিধান জারি হতে শুরু করে। আর এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ উদ্দেশ্য পূরণে কয়েকজন স্ত্রীর সহায়তার কতটা প্রয়োজন ছিল। মুহাদ্দিসীনে কেরামের গণনা অনুযায়ী তাঁদের থেকে বর্ণিত হাদিস সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। আর রাসূল (সা.)এর ওফাত পরবর্তী যমানায় তাঁদের প্রদত্ত ফাতাওয়ার সংখ্যা তো অগণিত। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা)।

২. জাহিলী যুগের কুপ্রথার মূলোৎপাটন

রাসূল (সা.)এর কোনো কোনো বিবাহের উদ্দেশ্য ছিল আমলীভাবে কোনো কুসংস্কার মূলোৎপাটন করা। কেননা কোনো কুসংস্কার যদি মানুষের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে যায়, তখন মৌখিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তার নিষ্পত্তি দুষ্কর হয়ে পড়ে। আর তৎকালীনদের আরবদের মাঝে এ কুসংস্কার বিদ্যমান ছিল যে, তারা গোলামদেরকে খুবই নিচু চোখে দেখতো, এমনকি আযাদ হওয়ার পরও সমাজে তাদের মূল্যায়ন হতো না।

অপরদিকে পালকপুত্রকে তারা আপন পুত্রের মতো মনে করত। অর্থাৎ আপন পুত্রের জন্যেও একই রকম মনে করতো। সেই হিসেবে তারা নিজ পালকপুত্রের তালাকপ্রাপ্তা বা বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করা অবৈধ মনে করতো।

এই উভয় কুসংস্কার মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথমত কুরআনে বিভিন্ন আয়াত নাযিল করলেন। আর আমলীভাবে এর উৎখাতের জন্য এক চমৎকার প্রেক্ষাপট এভাবে তৈরি করে দিলেন যে, হুযূর (সা.) হযরত যাইনাব বিনতে জাহাশ (রাযি.)কে স্বীয় আযাদকৃত গোলাম হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রাযি.)এর কাছে বিবাহ দেন। একটানা দীর্ঘ ১৩ বছর তাঁরা উভয়ে ঘর সংসার করার পর একপর্যায়ে তাদের মাঝে সম্পর্কের টানাপড়েনের দরুন হযরত যায়েদ (রাযি.) তাঁকে তালাক দিতে বাধ্য হন। এরপর রাসূল (সা.) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশে তাঁকে বিবাহ করেন। (সূরা আহযাব, আয়াত নং-৩৭)। এর মাধ্যমে একই সাথে বড় বড় দুটি কুসংস্কারের মূলোৎপাটন ঘটে এবং সমাজের কাছে বিষয়টি অনেকটা হালকা হয়ে যায়। এটাই ছিল এই বিবাহের মূল উদ্দেশ্য।

৩. সামাজিক বন্ধন অটূট করণ:

এই মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রাসূল (সা.) তাঁর কয়েকজন প্রিয় সাহাবার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। যেমন হযরত ওসমান (রাযি.)এর সাথে নিজের দুই কন্যা বিবাহ দেন। হযরত আলী (রাযি.)এর সাথে নিজের সবচেয়ে প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রাযি.)কে বিবাহ দেন। তেমনিভাবে নিজেও হযরত আবু বকর (রাযি.) ও হযরত ওমর (রাযি.)এর মেয়ে বিবাহ করেন।

এতে করে একদিকে যেমন তাদের পারস্পারিক সম্প্রীতি সুগভীর হয়, তেমনি কুরাইশের বিভিন্ন শাখা গোত্রের সাথেও রাসূল (সা.)এর আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সাথে সাথে মহান এই চার সাহাবী তাঁদের ইসলামের উপর অবিচলতা এবং আত্মত্যাগের একটি বড় পুরস্কারও লাভ করেন। সর্বোপরি এটা রাসূল (সা.)এর বিরাট মহানুভবতা, বিচক্ষণতা এবং কৃতজ্ঞচিত্ত হওয়ার প্রমাণ বহন করে।

৪. রাজনৈতিক কারণ:

রাজনৈতিক বড় বড় উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়েও রাসূল (সা.) কয়েকটি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। উদাহরণস্বরূপ- হযরত উম্মে হাবীবা (রাযি.)এর বিবাহ; তিনি হযরত আবু সুফিয়ান (রাযি.)এর কন্যা ছিলেন। আর হযরত আবু সুফিয়ান (রাযি.) ছিলেন তৎকালীন কুরাইশ গোত্র তথা পুরো আরবের শীর্ষস্তরের নেতা। সে যুগে আরবের রীতি অনুযায়ী কেউ কোনো কবিলার মেয়ে বিবাহ করলে সে শুধু ওই মেয়ের খানদানেরই জামাই নয়; বরং পুরো কবিলার জামাই বলে বিবেচিত হতো। আর জামাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া তাদের নিকট অত্যন্ত  লজ্জাজনক ও মানহানিকর বিষয় ছিল। তো রাসূল (সা.) চাচ্ছিলেন আরব মুশরিকদের সাথে শত্রুতা কমিয়ে এনে তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে। সেই হিসেবে হযরত উম্মে হাবীবা (রাযি.)এর প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর সপ্তম হিজরীতে তিনি তাঁকে বিবাহ করে নেন।

এ বিবাহ হযরত আবু সুফিয়ান (রাযি.) এবং কবিলায়ে বনু উমাইয়ার ইসলাম গ্রহণের পথ অনেকটা সুগম করে দেয়। যার কারণে দেখা যায় পরের বছরই মক্কা বিজয়ের সময় তিনি ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং তাঁর আগে-পরে এ গোত্রের বহু লোক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়।

হযরত সফিয়্যা (রাযি.)এর সাথে বিবাহ

তিনি ছিলেন মদিনার প্রসিদ্ধ ইহুদি গোত্র বনু নজীরের গোত্র প্রধানের কন্যা। এরা ইসলামের দুশমনী এবং মুসলমানদের সাথে কৃত চুক্তিভঙ্গে সদা তৎপর থাকতো। ফলে প্রথমে তাদেরকে মদিনা থেকে বিতাড়িত করে খাইবারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপরও তাদের স্পর্ধা না কমলে হুযূর (সা.) খাইবারে তাদের অবরোধ করেন এবং তা বিজয় করে নেন। এ যুদ্ধে হযরত সফিয়্যা (রাযি.) এর স্বামী নিহত হয়, আর তিনি মুসলমানদের হাতে বন্দী হন। (পরবর্তী ঘটনা বিস্তারিত পূর্বে উল্লেখ হয়েছে)। তখন রাসূল (সা.) তাকে দুটি বিষয়ের যে কোনো একটি গ্রহণে ইচ্ছাধিকার দিলে তিনি প্রথমটিই বেছে নেন। অর্থাৎ রাসূল (সা.)এর স্ত্রী হয়ে থাকাকেই পছন্দ করেন।

এই মোবারক বিবাহের দ্বারা যে বিরাট লাভ অর্জিত হয় তা হল, এ গোত্রের অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং ইসলামের প্রতি বনু নজীরের বিরুদ্ধাচরণের মাত্রাও অনেকাংশে কমে আসে। আর মুসলমানরাও তাদের দিক থেকে অনেকটা নিরাপদ হয়ে যান। সাথে সাথে একজন গোত্রপতির কন্যা সাধারণ এক মুসলমানের বাঁদী হওয়া থেকে রেহাই পেয়ে মুসলিম উম্মাহর জননী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।

হযরত মাইমূনা (রাযি.)এর সাথে বিবাহ

রাসূল (সা.)এর কিছু বিবাহ এমন ছিল, যা অনেক বড় বড় কবিলা কিংবা বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার মাধ্যম হয়েছিল। এর মধ্যে হযরত মাইমূনা (রাযি.)এর বিবাহ অন্যতম। ৭ম হিজরীতে রাসূল (সা.) তাঁর প্রিয় সাহাবাদের নিয়ে ‘উমরাতুল কাযা’র উদ্দেশ্যে মক্কায় তিনদিন অবস্থান করেন। সেখানে তাদের অবস্থা দেখে অনেক কাফের মুসলমান হয়ে যায়। এদের মধ্যে হযরত মাইমুনা (রাযি.)ও ছিলেন। যিনি সম্পর্কে হযরত আব্বাস (রাযি.) (রাসূল (সা.)এর চাচা)এর শালিকা হন। তিনি বিধবা ছিলেন বিধায় হযরত আব্বাস (রাযি.) রাসূল (সা.)এর কাছে তাঁর পক্ষ থেকে প্রস্তাব পেশ করেন। রাসূল (সা.) আপন দূরদর্শিতার ফলে এই বিবাহের সুদূরপ্রসারী সুফল দেখতে পেয়ে তাঁকে বিবাহ করে নেন। পরবর্তীতে একে কেন্দ্র করে তাঁর ভাগিনা হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ (রাযি.) ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁদের কবিলার মধ্য থেকে হযরত আমর ইবনুল আস (রাযি.), ত্বলহা ইবনে উসমান (রাযি.)সহ বড় বড় ব্যক্তিবর্গ মুসলমান হন।

এর আরেকটি বড় লাভজনক দিক এই ছিল যে, এর মাধ্যমে নজদবাসীর কাছেও ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো সহজ হয়ে যায়। কেননা হযরত মাইমূনা (রাযি.)এর এক বোন ‘নজদে’র এক সরদারের বিবাহ বন্ধনে ছিলেন। যার ফলে তাদের সাথেও রাসূল (সা.)এর আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে পুরো নজদবাসী ইসলাম গ্রহণে ধন্য হয়। অথচ এরাই এর কিছুদিন পূর্বে ৭০ জন সাহাবীকে নির্মমভাবে শহীদ করেছিল।

হযরত জুয়াইরিয়া (রাযি.)এর সাথে বিবাহ

তিনি ছিলেন কবিলায়ে ‘বনু মুসতালিকে’র সরদার হারিস ইবনে আবি জিরারের কন্যা। খন্দক যুদ্ধের পর তারা মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে এসে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। নেতা হারিস ময়দান ছেড়ে পালায়। হযরত জুয়াইরিয়া (রাযি.)এর  স্বামী এ যুদ্ধে নিহত হয়। আর তিনি সহ তাঁর কবিলার আরো ১০০ জন লোক মুসলমানদের হাতে বন্দী হন। গনীমতের মাল হিসেবে তিনি হযরত সাবেত বিন কায়েসের ভাগে পড়েন এবং তাঁকে মোকাতাবা চুক্তির তথা মুক্তিপণ দিয়ে তাঁর থেকে আযাদ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করিয়ে ফেলেন। এরপর মূল্য পরিশোধে সহযোগিতার জন্য রাসূল (সা.)এর দ্বারস্থ হন। চূড়ান্ত আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, রাসূল (সা.) তাঁর পক্ষ থেকে মূল্য পরিশোধ করে দিবেন এবং তাঁকে নিজের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে নিবেন। মৌলিকভাবে দুটি মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এক, হযরত জুয়াইরিয়া যিনি একজন বড় সরদারের কন্যা ছিলেন তাঁকে একজন সাধারণ মুসলমানের বাঁদী বানিয়ে অপমানকর জীবন যাপন থেকে রক্ষা করা। দুই, তাঁর কবিলাকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা।

অবশেষে এ বিবাহের ফল এই দাঁড়ায় যে, সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) এই কবিলার সকল বন্দীকে স্বেচ্ছায় আযাদ করে দেন। কেননা এদের সাথে রাসূলে কারীম (সা.)এর আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। মুসলমানদের এহেন ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তাঁরা সকলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে সোনার মানুষে পরিণত হন। অথচ ইতঃপূর্বে তারা একটি ডাকাতগোষ্ঠী হিসেবেই প্রসিদ্ধ ছিলেন। (শুবুহাতুন ওয়া আবাতীলু হাওলা তা’আদ্দুদি যাওজাতির রাসূল (সা.), ১৩-৩৩)।

৫. একান্ত দয়াপরবশ হয়ে:

এছাড়া রাসূল (সা.)এর অনেক বিবাহ ছিল ইসলামের জন্য একনিষ্ঠ আত্মত্যাগী মহিলাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে। যারা একসময় বিধবা হয়ে পড়ে এবং তাদের দেখাশোনা ও ভরণপোষণের জন্য অন্য স্বামী গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। সেই হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদেরকে নিজের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে নেন।

কেননা তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন আরবের উচ্চ বংশীয়, সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী। যারা শুধু ইসলামের খাতিরে পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদি সবই বিসর্জন দিয়েছিলেন। আবার কাফেরদের নানা নির্যাতন-নিপীড়নে অতিষ্ট হয়ে এক পর্যায়ে তাদের কেউ কেউ সপরিবারে হিজরত করে হাবশায় চলে যান, আবার কেউ মদিনায়। হিজরতের পর এক সময় তাঁরা তাঁদের একমাত্র সম্বল স্বামীকেও হারান। তাঁদের মধ্যে কারো স্বামী হাবশায় ইন্তেকাল করেন, যেমন হযরত সাওদা (রাযি.)। কারো স্বামী সেখানে গিয়ে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে যায়। যেমন হযরত উম্মে হাবীবা (রাযি.)। আবার কারো কারো স্বামী মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে শরীক হয়ে শাহাদাত লাভ করেন। যেমন হযরত হাফসা (রাযি.) ও হযরত যাইনাব বিনতে খুযাইমা (রাযি.)। তাঁদের উভয়ের স্বামী বদর যুদ্ধে শহীদ হন। তেমনি হযরত উম্মে সালামা (রাযি.)। তাঁর স্বামী হযরত আবু সালামা (রাযি.) উহুদ যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হন এবং এক পর্যায়ে এটাই তাঁর  শাহাদাতের কারণ হয়। (সুবুলুল হুদা ওয়ার রশাদ ১১/১৪৩-২১২)।

এঁদের প্রত্যেকই এমন ছিলেন যাঁরা ইসলামের শুরু লগ্নেই সবকিছু বিসর্জন দিয়ে মুসলমান হয়ে ছিলেন। শেষমেষ দূর দেশে গিয়ে যখন আবার স্বামীকেও হারাতে হলো, তখন তাঁদের মানসিক অবস্থা কতটা ভঙ্গুর ও বিপর্যস্ত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আর এমতাবস্থায় আর্থিক সংকটের কথা তো বলাই বাহুল্য। নারী হয়েও এতটা আত্মত্যাগের পর তাঁদের ব্যাপারে রাহমাতুল্লিল আলামীন এর এই সিদ্ধান্তের চেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত আর কী হতে পারতো যে; তিনি তাঁদেরকে নিজ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়ে মুসলিম জাতির মাতা হওয়ার সৌভাগ্য লাভে ধন্য করলেন। (আহকামে ইসলাম আকল কী নাযার মেঁ, ১৫৮-১৬০)।

শুধু তাই নয়, বরং এঁদের প্রত্যেককেই রাসূল (সা.) পরিপূর্ণ স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন। পূর্ণরূপে সকলের হক আদায় করেছেন এবং প্রত্যেকের মাঝে সমবন্টন করেছেন। যা পদে পদে রাসূল (সা.)এর সমুচ্চ আখলাক, দয়া, বিচক্ষণতা এবং ন্যায়পরায়ণতার উজ্জল প্রমাণ বহন করে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তই ছিল যথার্থ ও যথোপযুক্ত। চক্ষুষ্মান ব্যক্তি মাত্রই এতে প্রভুত কল্যাণ নিহিত দেখতে পায়। যা তাঁর সামনে রাসূল (সা.)এর শান-মানকে শুধু বাড়াতেই থাকে। তাঁকে নিয়ে আপত্তি করা তো বহু দূরের কথা।

লেখক: মুফতি ও সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।