শিক্ষাবিষয়ক একটি প্রশ্ন ও তার সমাধান

মাওলানা সাঈদুর রহমান, বগুড়া।

প্রশ্ন: আমি কওমী মাদরাসার একজন মুদাররিস। আমরা যারা কওমী অঙ্গনে কাজ করি, উলামায়ে দেওবন্দের মাসলাক ও চিন্তা-ফিকির অনুসারেই কাজ করার চেষ্টা করি। সর্ববিষয়েই দেওবন্দী মাসলাক আমদের দৃষ্টিতে মান্য ও অনুসরণীয়। আকীদা, ইবাদত, আখলাক, মুআমালা ও মুআশারাত সর্ববিষয়েই উলামায়ে দেওবন্দের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দেই। সেভাবেই ইসলামকে বোঝার চেষ্টা করি। বাতিলকে রদ করি। ফিক্হ-ফাতওয়ার ক্ষেত্রেও উলাময়ে দেওবন্দ যে মতকে গ্রহণ করেছেন আমরাও তা গ্রহণ করি। উলামায়ে দেওবন্দ কর্তৃক লিখিত কিতাব ও রিসালা সর্বদাই আমাদের আগ্রহের কেন্দ্র ও পছন্দের বিষয় ছিলো, এখনো আছে, আগামীতেও থাকবে। গোটা কওমী অঙ্গন এ চিন্তা ধারাতেই গড়ে উঠেছে। এটি শত বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আগামীতেও এ ধারা চলমান থাকবে; ইনশাআল্লাহ।

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এখন সকল মত ও পথের রমরমা বাজার। সকলের জন্যই স্থান করে দিয়েছে অনলাইন। কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে। মানুষের রুচি-অভিরুচির ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইসলামী অঙ্গনগুলোতে ভিনদেশি চিন্তক ও লেখকের আগমন ঘটছে। ভিন্ন চিন্তা ও আদর্শের লেখকদের কিতাব অনুবাদ করা হচ্ছে উর্ধ্বগতিতে। তাদের কিতাবের সাথে সাথে তাদের চিন্তা চেতনা ও আদর্শ সবই পরিচিতি পাচ্ছে; ব্যাপকভাবে প্রচারও হচ্ছে। এ পথেই ব্যাপকতা পাচ্ছে সালাফীদের আদর্শ। ইউরোপ-আমেরিকার কিছু মুসলিম ভাই ও দাঈ যারা সেখানের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে ইসলাম ও ইসলামী আকীদা ও সভ্যতার ব্যাখ্যা করছেন। ইসলামের উপকারিতা ও যথার্থতা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন তাদের কিতাবগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তারাই আদর্শ ও আইডলে রূপান্তরিত হচ্ছে। যাদের যবানে ও কলমে হযরত থানবী ও নানুতবী রহ.সহ আকাবিরে দেওবন্দের নাম উচ্চারিত হতো তন্মধ্যে অনেকের যাবানে ও কলমে কোনো সালাফী বা ভিন্নমতালম্বীর নাম উচ্চারিত হচ্ছে। মানসম্পন্ন অনুবাদ এবং আভিজাত মুদ্রণ ও প্রচারণার কল্যাণে তা সাধারণ পাঠকদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠছে। কওমী অঙ্গনেও তার প্রভাব প্রকাশ পাচ্ছে। তাদের প্রচারিত নতুন কথা আর নবমত প্রচারে সাধারণ মানুষ প্রভাবিতও হচ্ছে। সংশয়েও ভুগছে।

দাবি করা হচ্ছে, আকাবিরে দেওবন্দের কিতাব পুরনো এবং কঠিন। উপস্থাপনাও দুর্বোধ্য । কুরআন ও হাদীস কম; গল্প ও কাহানী বেশি। পক্ষান্তরে সালাফীদের লেখা সহজ ও দলীলসমৃদ্ধ। তাই পাঠকপ্রিয়তা বেশি; চাহিদাও ঢের। এ কারণেই দেওবন্দী কিতাবের স্থান দখল করে নিচ্ছে সালাফীসহ ভিন্নমতাবলম্বীদের কিতাব।
মুহতারাম! আমার চে’ বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার অবগতি আরও গভীর ও বস্তুনিষ্ট। এটাই আমার বিশ্বাস। তাই আর লম্বা করছি না। এ পরিস্থিতিতে আমার জানার বিষয় হলো, দেওবন্দী মাসলাক ও চিন্তা চেতনাকে জনপ্রিয় করার জন্য আমরা কীভাবে কাজ করতে পারি। সঠিক কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দিলে উপকৃত হতাম।

সমাধান: মুহতারাম মাওলানা সাঈদুর রহমান! বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনি যেভাবে পেরেশানী প্রকাশ করেছেন; সকল সচেতন উলামায়ে কেরাম তা উপলব্ধি করছেন। সামর্থ্য অনুপাতে প্রতিকার খুঁজছেন এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। আপনার আলোচ্যবিষয়টি দীর্ঘ আলোচনার দাবি রাখে। এখানে সংক্ষেপে বড়দের থেকে শ্রুত ও গৃহীত দু’একটি কথা পেশ করছি।

প্রথমত: দেওবন্দী মাসলাকের প্রয়োজনীয়তা কী এবং কতটুকু তা আমাদেরকে উত্তমরূপে বুঝতে হবে। এ মাসলাকের ভিতরে থাকলে কী ফায়দা এবং বাহিরে গেলে কী ক্ষতি তা ফুটিয়ে তুলতে হবে। ইসলামকে বোঝার জন্য বিভিন্ন মানহাজ ও মাসলাক রয়েছে। বিভিন্ন মানহাজে বর্তমানে ইসলামের উপস্থাপনার কাজও চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলাম ও ইসলামী উলূমের চর্চা হচ্ছে। খোদ আমাদের দেশেই ইসলামকে একাধিক মানহাজে উপস্থাপন করা হয়। তাহলে কেন আমরা দেওবন্দী মাসলাক বা মানহাজ গ্রহণ করবো? কেন অন্যটি নয়? অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এই প্রশ্ন-উত্তরগুলোর গুরুত্ব দেই না। দেওবন্দী মাসলাকে আমি পড়শোনা করেছি তাই আমি দেওবন্দী। অথবা দেওবন্দী পরিবেশে বড় হয়েছি তাই এই মাসলাক অনুসরণ করি; বা আমার আকাবির এই মাসলাকের ছিলেন তাই আমিও এ মাসলাকের। এভাবেই আমরা দেওবন্দী মাসলাককে বোঝার চেষ্টা করি। বাস্তবতার আলোকে বিচার করি না। আমি উলামায়ে দেওবন্দের ভক্ত তাই আমি এ মাসলাক পছন্দ করি কিন্তু যে ভক্ত নয় তার সামনে এ মাসলাকের যথার্থতা ও অপরিহার্যতা প্রকাশ ও প্রমাণ করার কথা ভাবি না।

তাই আমাদের প্রথম করণীয় হলো দেওবন্দী মাসলাক ও মাসলাকের প্রয়োজনীয়তাকে বোঝা। আমাদেরকে যথাযথভাবে বুঝে নিতে হবে যে, উলামায়ে দেওবন্দ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের রক্ষণশীল ধারার উত্তম প্রতিনিধি; সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীনের আদর্শ ও মেযাজের ধারক ও বাহক। লেবাস-পোশাকে, বেশ-ভুষায়, আচার-আচরণে, চলনে-বলনে, চিন্তা-চেতনায় সর্ব বিষয়েই সালাফের আদর্শের অবিচল পথিক। ইতিদাল ও মধ্যপন্থা তাদের অন্যতম প্রতীক। সাদেকী ও সরলতা, বিনয় ও আত্মত্যাগ তাদের স্বভাবজাত ঝোক ও প্রবণতা।

সুনির্দিষ্ট নেযাম ও যাবেতা ব্যতীত কোনো মাসলাক গঠন হতে পারে না। দেওবন্দী মাসলাকেরও রয়েছে কিছু নেযাম ও যাবেতা। আদর্শ ও চিন্তাধারা। কোনো মাসলাকের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণের ক্ষেত্রে সেই নেযাম ও যাবেতাই বেশি ভূমিকা রাখে। আমাদেরকে সেই নেযাম ও যাবেতার প্রামাণ্য উপস্থাপন করতে হবে। আমরা অনেক ক্ষেত্রে কিছু ঘটনার মাধ্যমে মাসলাককে প্রমাণ করতে চাই। মূলত কিছু ঘটনার উপর কোনো মাসলাক টিকে থাকতে পারে না। ভক্তদের মাঝে প্রভাব ফেললেও অন্যান্য মাসলাকের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণে যথার্থতা প্রমাণ করা যায় না। তাই দেওবন্দী মাসলাকের নেযাম ও যাবেতা, আদর্শ ও চিন্তাধারাগুলো আলোচনার সাথে সাথে অন্য মাসলাক ও মানহাজের ক্ষতির দিকগুলোও তুলে আনা দরকার। শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী হাফি. উলামায়ে দেওবন্দ ও কওমী মাদরাসার অবদান প্রসঙ্গে এক আলোচনায় বলেন-

“আমি বাগদাদ গিয়েছিলাম। বাগদাদ এক ঐতিহ্যবাহী মুসলিম নগর। বহু শতাব্দী এ নগর ছিল মুসলিম জাহানের রাজধানী। ‘আব্বাসী খিলাফতের শান-শওকত এ জগত এককালে সেখানে প্রত্যক্ষ করেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় একদার সরগরম সেই মহানগরে যখন আমি পৌঁছাই, বড় কৌতূহল জাগলো কোনও মাদরাসা সম্পর্কে জানার ও তা পরিদর্শন করার। জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কোনো মাদরাসা আছে? এমন কোনও দ্বীনী প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে ইলমে দ্বীনের তালীম হয়? যদি থাকে তাহলে সেখানে যেতে চাই।

উত্তর পাওয়া গেল, এখানে এরকম কোনো মাদরাসার নাম-নিশানাও নেই। যা ছিল সবই স্কুল-কলেজে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। দ্বীন শেখার জন্য এখানকার ইউনিভার্সিটিগুলোতে ইসলামী ফ্যাকাল্টি আছে, তাতে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হয় বটে, কিন্তু তার সুরতহাল বড় বেদনাদায়ক। শিক্ষকদেরকে দেখলে আলেম বলে অনুমান করা বড় কঠিন। বরং সন্দেহ জাগে তারা আদৌ মুসলিম কি না। সেসব ফ্যাকাল্টিতেও সহশিক্ষাই চলছে। ছেলে-মেয়েরা একত্রে মিলেমিশে পড়াশুনা করছে। তাতে ইসলাম কেবল একটা মতবাদ হিসেবেই টিকে আছে। কেবল ঐতিহাসিক দর্শন হিসেবে তা পড়ানো হয়। জীবন-প্রণালীতে তার কোনো প্রভাব দেখা যায় না। ওরিয়েন্টালিষ্টদের লেখাপড়ার সাথে তাদের কোনো পার্থক্য নেই। আজ আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের ইউনিভার্সিটিগুলোতেও ইসলামী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। ইসলামের বিভিন্ন বিষয় তাতে পড়ানো হয়। কুরআন, হাদীস, ফিকহ ইত্যাদির তালীম দেয়ার ব্যবস্থা আছে। তাদের লেখা নিবন্ধ পড়লে আপনি হয়রান হয়ে যাবেন। তাতে এমন-এমন কিতাবের হাওয়ালা পাবেন, আমাদের সাদাসিধা আলেমগণ কখনও তার নামও শোনেনি। বাহ্যত খুবই গবেষণামূলক কাজ হচ্ছে। কিন্তু আপনিই বলুন, এটা কিসের দ্বীনী তালীম হলো, যা মানুষকে ঈমানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে পারে না? সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইসলামী জ্ঞান-সাগরে অকাতর ডুবাতে থাকে, অথচ তা থেকে ঈমান-ইসলামের কোনও মুক্তা কুড়াতে সক্ষম হয় না। দ্বীনের এক ফোঁটা জ্ঞান দ্বারাও তারা গলা ভেজাতে পারে না। পাশ্চাত্যের ওসব শিক্ষাকেন্দ্রে শরঈ কলেজ ও উসূলুদ-দ্বীনের কলেজও আছে, কিন্তু তার শিক্ষার্র্থীদের জীবনে সে শিক্ষার কোনো প্রভাব নযরে আসে না। বস্তুত তাতে যা আছে তা শিক্ষার খোলস মাত্র, সামান্যতম সারবস্তুও নেই। ‘ইলমে দ্বীনের রূহ থেকে তা সম্পূর্ণ বঞ্চিত।” (ইসলাম ও আমাদের জীবন-১৩/১০২)।

মুফতী তাকী উসমানী হাফি. এখানে যে ব্যবধান তুলে ধরেছেন এটা শুধু এর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। ব্যবধানের পরিব্যাপ্তি আরও ব্যাপক। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অবস্থা নিয়ে চিন্তা ও অধ্যয়ন করলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে আশা রাখি।

মাসলাক বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যে, মাসলাকের প্রাণ ও দেহ; মগজ ও সিলকা এক নয়। দুটিকে স্ব স্ব অবস্থানে রেখে মূল্যায়ন করতে হবে। জানা কথা যে, রসমকে হাকীকাত জ্ঞান করা কতটা ভয়ংকর। যুগ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমরা এ বাস্তবতা অনেক সময় ভুলে যাই। সূরতকে হাকীকত ভেবে বসি। গ্রহণ ও বর্জনের মাপকাঠি বানাই।

যেমন ধরুন বর্তমান সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে। জেনারেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যারা বের হচ্ছেন তারা সেক্যুলার চিন্তা নিয়েই বের হচ্ছেন। সন্তান মুসলিমের; চিন্তায় সেকুলার। বর্তমান আমাদের দেশে এটি সর্বগ্রাসী একটি ফিতনা। এ পরিস্থিতিতে অনেক চিন্তাশীল উলামায়ে কেরামই মনে করেন যে, আমাদেরকে ইসলামী কারিকুলামে ও সিলেবাসে মানসম্পন্ন কিছু স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক মজলিসে এ নিয়ে কথা উঠার সাথে সাথেই এক মাওলানা সাহেব বলে উঠলেন যে, এটি দেওবন্দীয়াতের খেলাফ। এখানেই কৌতুহল জাগে যে, উনি কি দেওবন্দীয়াতের রূহ ও প্রাণ অনুধাবন করেছেন কি না। উলামায়ে দেওবন্দ কি এমন কোনো পদক্ষেপকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন? অথচ ইতিহাস তো উল্টোটাই বলে। খোদ আকাবিরে দেওবন্দ এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ২৯ অক্টোবর ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ‘জামিয়া মিল্লিয়া’ প্রতিষ্ঠিত হয়। উলামায়ে দেওবন্দ জামিয়া মিল্লিয়া প্রতিষ্ঠায় অন্যতম অংশীদার ছিলেন। শায়খুল হিন্দ রহ. নিজে এর ভিত্তিস্থাপন করেছেন। আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী রহ. শায়খুর হিন্দ রহ. এর পক্ষে বক্তব্য দেন। (দ্র. علماء حق، اسیران مالٹا، نقش حیات، تحریک آزادی ہند میں مسلم علماء اور عوام کا کردار)

হযরত মাওলানা কারী তায়্যিব রহ. জামিয়া মিল্লিয়ার এক সেমিনারে বক্তব্যে বলেন-
جامعہ کی بنیاد حضرت شیخ الہند مولانا محمود حسن صاحب قدس سرہ نے رکھی تھی، جس کا نصب العین ہی قدیم وجدید تعلیم کو یکجا کر کے ملت کی مختلف صلاحیتوں کو ایک مرکز پر جمع کردینا تھا، تاکہ فکر واحد کے راستے سے قوم کے ان دو گروہوں مین قدیم وجدید کی دوری ختم کر کے انہیں افکار وخیالات اور عقائد ومقاصد کی وحدت سے قوم واحد بنا دیا جائے۔(خطبات حکیم الاسلام ۴/৩০৭)

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ অনেক স্কুল কালেজ প্রতিষ্ঠা করছে। তারা এখন আরও বেশি প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা আরশাদ মাদানী ২০২১-২০২২ সালের জন্য শিক্ষাবৃত্তি ঘোষণা কালে বলেন, ‘ভারতজুড়ে এখন যে ধরণের ধর্মীয় ও আদর্শিক যুদ্ধের সূচনা হয়েছে, তার মোকাবেলা কোনও অস্ত্র বা প্রযুক্তির মাধ্যমে করা সম্ভব নয়; বরং এই যুদ্ধ জয়ের একমাত্র উপায় আমাদের নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করে এমনভাবে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা যে, তারা নিজেদের জ্ঞান এবং প্রতিভার অস্ত্র দিয়ে এই আদর্শিক যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। যাতে তারা সাফল্যের সেই গন্তব্যসমূহে পৌঁছাতে পারে, যেখান পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে আমাদের পৌঁছানো কঠিন থেকে কঠিনতর করে তোলা হয়েছে।

এখন সময় এসেছে, মুসলমানদের পেটে পাথর বেঁধে তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার। আমাদের এমন সব স্কুল ও কলেজের ভীষণ প্রয়োজন, যেখানে আমাদের ধর্মীয় পরিচয়সহ আমাদের সন্তানরা কোনো বাঁধা বা বৈষম্য ছাড়াই উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারে। অবস্থা বিবেচনায় এখন মুসলমানদের নেতৃত্বের বদলে তাদের মধ্যে শিক্ষা অর্জনের স্পৃহা গড়ে তোলা জরুরি প্রয়োজন। (ইসলাম টাইমস)।

পাকিস্তানেও উলামায়ে কেরাম এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। অনেকে সফলও হয়েছেন। সুতরাং উলামায়ে দেওবন্দের মেযাজের খেলাফ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। হয়তো বলা হতে পারে যে, কাসেম নানুতবী রহ. তো কোনো ইসলামী স্কুল প্রতিষ্ঠা করে যাননি। তিনি তো মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তখন তো অস্তিত্বের লড়াই ছিলো। মাদরাসার প্রয়োজনটাই বড় এবং সর্বাগ্রে ছিলো। হযরত কাসেম নানুতবী রহ. নিজেই এর কারণ ব্যক্ত করেছেন। (দ্র. সাওয়ানেহে কাসেমী)।

সর্বোপরি আমাদের ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে যে, উলামায়ে দেওবন্দের মেযাজ ও চিন্তা চেতনা বলতে কী বুঝায়। দেওবন্দী মাসলাকের উসূল ও যাবেতা কী এবং আদর্শ ও মেযাজ কী।

দ্বিতীয়ত: মাসলাক বুঝে নেয়ার পর আমাদের করণীয় হবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা ফিকির করা। চিন্তা করা যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেওবন্দী মাসলাককে জনপ্রিয় করার মাধ্যম কী হতে পারে। নি¤েœ নিছক পরামর্শ হিসেবে কয়েকটি দিক তুলে ধরা হবে। হতে পারে এ দিকগুলো আলোচ্যবিষয়ে চিন্তা করতে সহায়কের ভূমিকা রাখবে।

এক. বর্তমান যুগ ও যুগের চাহিদাকে বোঝা।

যুগ পরিবর্তন হবে। এটি খুবই স্বাভাবিক বিষয়। আল্লাহ তাআলাই পরিবর্তন ঘটান। কুরআন ও হাদীসে বিভিন্নভাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ। আমাদের দায়িত্ব হলো পরিবর্তনকে বোঝা। পরিবর্তনের ফলাফলগুলো নির্ণয় করা। মানুষের চিন্তা চেতনা, মন ও মননের পরিস্থিতি ও চাহিদাকে বোঝা। সার্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইসলামকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা।
মৌলিক চাহিদা ও গৌণ চাহিদার পার্থক্য বোঝা। স্থায়ী ও অস্থায়ীর ব্যবধান জানা। প্রকৃত ও কৃত্রিম চাহিদার বিভেদ বোঝা। এ সবই এক্ষেত্রে আবশ্যক। চাহিদার ধরণ ও প্রকৃতিও নির্ণয় করা জরুরি।

দুই. প্রয়োজন নতুন উপস্থাপনার

কোনো চিন্তা বা মাসলাক মানুষের মাঝে প্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে প্রাচীন কিতাবের প্রচারই যথেষ্ট নয়; বরং প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী কিতাব রচনা করা। যুগের সাথে মানুষের ভাষা ও পরিভাষার যাতে রূপান্তর ঘটে, তাই মানুষের পরিচিত ভাষায় নতুনরূপে উপস্থাপন করতে হবে। সাহাবা যুগ থেকে আজ পর্যন্ত আহলে সুন্নাতের মাসলাক ও মানহাজ বর্তমান রয়েছে। এ মাসলাক কিন্তু নিছক প্রাচীন কিতাবের মাধ্যমে আজ স্বীকৃত ও জনপ্রিয় নয়। প্রতিটি যুগের প্রতিনিধিরা যুগমাফিক কিতাব রচনা করে মানুষের বোধ ও বুঝের অনুকূলে রাখার চেষ্টা করেছেন। পেছনের ইতিহাস দেখলেই তা অনুধাবন করা যায়। আমরা উলামায়ে দেওবন্দের ইতিহাসটাই দেখতে পারি। দেওবন্দী মাসলাকের বড় একটি কেন্দ্র হলেন ইমাম শাহ ওলীউল্লাহ দেহলবী রহ.। তিনি যুগের চাহিদা বিবেচনায় বেশ কয়েকটি কিতাব রচনা করেছেন। যা আজও দেওবন্দী মাসলাকের উৎস গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। তার মাঝে অন্যতম হলো, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা। দেহলবী রহ. অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, অনেকেই ইসলাম ও শরীআতের সকল বিধানের পেছনের কারণ ও হিকমত জানতে চাচ্ছে। অন্যথায় ইসলাম ও শরীআর প্রতি আস্থাহীন হয়ে যাচ্ছে। এ সকল ব্যক্তিদের প্রতি লক্ষ্য রেখে তিনি গোটা ইসলাম ও শরীআহকে হিকমত ও মাসলাহাত ভিত্তিক উপস্থাপন করলেন। দেহলবী রহ. নিজেই এ কিতাব রচনার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন-

ومنها: إن المبتدعين شككوا في كثير من المسائل الإسلامية بأنها مخالفة للعقل، وكل ما هو مخالف له يجب رده أو تأويله، كقولهم في عذاب القبر: إنه يكذبه الحس والعقل، وقالوا في الحساب والصراط والميزان نحوا من ذلك، فطفقوا يؤولون بتأويلات بعيدة.
وأثارت طائفة فتنة الشك، فقالوا: لم كان صوم آخر يوم من رمضان واجبا، وصوم أول يوم من شوال ممنوعا عنه؟ ونحو ذلك من الكلام.
واستهزأت طائفة بالترغيبات والترهيبات، ظانين إنها لمجرد الحث والتحريض، لا ترجع إلى أصل أصيل، حتى قام أشقى القوم، فوضع حديث: باذنجان لما أكل له، يعرّض بأن أضر الأشياء لا يتميز عند المسلمين من النافع.
ولا سبيل إلى دفع هذه المفسدة إلا بأن تبين المصالح، وتؤسس لها القواعد، كما فعل نحو من ذلك في مخاصمات اليهود والنصارى والدهرية وأمثالهم.(حجة الله البالغة ১/৫৬-৫৭)

হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার মাধ্যমে দেহলবী রহ. যে অবদান রেখে গেছেন তার মূল কিন্তু একদম নতুন কোনো আবিষ্কার ছিলো না। আহলে সুন্নাহ কেউই বলেননি, তিনিই প্রথমে বললেন, এমন দাবি খোদ দেহলবী রহ. নিজেও করেননি; বরং আহলে সুন্নাহর অনেক ইমামই এ বিষয়ে কথা বলেছেন। দেহলবী রহ.ও তা স্বীকার করেছেন। উপর্যুক্ত নসের শেষ অংশে তিনি তার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। এ ছাড়া তিনি ভূমিকায় বলেছেন-
فاعلم أني لم اجترئ عليه إلا بعد أن رأيت الآيات والأحاديث وآثار لاصحابة والتابعين متظاهرة فيه، ورأيت جماعات من خواص إهل السنة، المتميزين منهم بالعلم اللدني يقولون به، وبينوا قواعدهم عليه.

দারু ইবনে কাছীর থেকে প্রকাশিত নুসখার ভূমিকায় মাওলানা নুর আলম খলীল আমীনী হাফি. তিন জনের নাম উল্লেখ করেছেন যারা দেহলবী রহ. এর পূর্বে এ বিষয়ে কলম ধরেছেন। এ বিষয়ে ইমাম গাযালী (৫০৫হি.) রহ.-কে প্রধান হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন। অথচ খোদ ইমাম গাযালী রহ. এ বিষয়ে যার কিতাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। যার কিতাব থেকে উপকৃত হয়েছেন, তার নাম তিনি উল্লেখ করেননি। ইমাম গাযালী রহ. আসরারে শরীআহসহ অনেক বিষয়েই হাকীম তিরমিযী রহ. (৩২০হি.) এর কিতাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আসরারে শরীআ বিষয়ে তিনি একাধিক কিতাব রচনা করেছেন। তন্মধ্যে إثبات العلل কিতাবটি বেশ বড় ও পূর্ণাঙ্গ।

তো ইমাম দেহলবী রহ. মূল ফিকরা নিয়েছেন সালাফ থেকে; তবে দলীল ও উপস্থাপনা যোগ করেছেন নিজ ইজতিহাদের ভিত্তিতে। তিনি নিছক সালাফের কোনো কিতাবের অনুবাদ করেননি; বরং যুগের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা স্মরণ রেখে নতুন রচনা করেছেন। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, যুুগের চাহিদা অনুযায়ী নতুন উপস্থাপনা ও দলীল ও রচনার প্রয়োজন আছে।

যুগ থেমে থাকে না। ইমাম দেহলবী রহ. যে যুগ দেখেছেন; যে ধরনের মানসিকতার মুকাবিলা করেছেন তাও পরিবর্তন হয়ে যায়। গড়ে ওঠে নতুন রুচি ও অভিরুচি। ক্রমে ক্রমে যুুগ যুক্তি ও বিজ্ঞানের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। নতুন কৌতুহল জন্ম নেয়। পূর্বের কিতাবগুলোর উপস্থাপনাও কঠিন হয়ে পড়ে। এ পরিবর্তন ও চাহিদা সম্পর্কে উলামায়ে দেওবন্দ সচেতন ছিলেন। তারা হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার অনুবাদকে যথেষ্ট মনে করেননি। বরং প্রয়োজন মাফিক কিতাব রচনা করেছেন। নতুন ভাবে আহলে সুন্নাহর প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এ প্রসঙ্গে কারী তায়্যিব সাহেব রহ. দীর্ঘ আলোচনা করেছেন ‘তারীখে দারুল উলূম দেওবন্দ’ কিতাবের ভুমিকায়। এখানে অংশ বিশেষ তুলে ধরছি-

واضح ہے کہ نقلی اور روایتی دین کو عقلی دلائل، طبعی مصالح اور روحانی اسرار وحکم کے جامہ میں پیش کیا جانا اور دین کو دین فطرت دکھلا کر اس دور کی عقل زدہ طیبعتوں کے لئے قابل قبول بنا دینا اس الہامی مکتب فکر کا پہلا جزو ہے جو شاہ صاحب کے قلب میں من جانب اللہ القا ہوا۔

لیکن حجۃ اللہ ہی کے اسلوب بیان اور طرز تفہیم سے جس میں عقائد ومسائل کے اثبات کے لئے عقلی حکمتیں اور حجتیں پیش فرمائی ہیں یہ بھی نمایا ہے کہ حضرت شاہ صاحب نے ان حکمتوں کو متعلقہ آیات وروایات کی طرف منسوب فرما کر انہیں زیادہ تر کشفی اور ذوقی رنگ میں پیش فرمایا ہے۔ اس لئے قدرتی طور پر اس سے صرف وہی عقل پسند طبیعتیں مطمئن ہو سکتی ہیں جو کسی نہ کسی حد تک ان روایات کو مانتے ہوئے اس ذوق اور اندورنی وجدان کی کوئی اہمیت ذہن میں لئے ہوئے ہوں۔ اور ان کا ایمانی احساس بالکل مردہ نہ ہو چکا ہو، ورنہ جو لوگ سرے سے اس اعتقاد ارو ذوق کے اس کوچہ ہی سے نا بلد اور بے ذوق محض ہوں وہ اسے علم وحکمت کہنے کے بجائےتخیل آفرینی کا عنوان دے کر اڑا دیتے اور بے التفاتی کی نذر کرکے دین سے بدستور محروم رہ جاتے چہ جائیکہ اس سے کوئی فائدہ اٹھاتے۔

چنانچہ اس عقل پسندی کے اتبدائی دور میں جو انگریزوں کی دراندازیوں، عیارانہ سازشوں اور ان کے ملحدانہ نظریات کا بھی ابتدائی دور تھا۔۔۔ لیکن اس دور کی طفولیت کا زمانہ گذرجانے پر جب عقل پسندی کے شباب کا دور آیا اور انگریزی اقتدار بھی مخفی اور سازشی دور سے گذر کر کھلے میدانوں میں دوڑنے لگا تو اسی نسبت سے یہ ذوق بھی گھٹنے لگا، بلکہ اس کے ساتھ جب کہ فرنگی نظریات اور الحادی افکار دین کے مقالبہ میں ایک حریف کی صورت میں سامنے آنے لگے اور فلسلفے کے ساتھ سائنس کا جوڑ لگ جانے سے یہ نظریات محسوس کی صورت اختیار کرنے لگے تو عقل محض بھی پیچھے رہ گئی، اور اس کے تخت حکومت پر یلغار کر کے محسوس پسندی نے قبضہ جمالیا اور کسی منقول کو معقول بنا کر پیش کردیا جانا بھی اس کے مان لینے کا ضامن نہ رہا جب تک کہ اسے محسوسات کا لباس پہنا کر سامنے نہ کردیا جائے۔۔۔

اس دور کے مریضان روح کے علاج کے لئے اس ولی اللہی خاندان کی پانچویں علمی پشت میں ایک فرد اٹھا جس نے۔۔۔ایک نئی حسیاتی فلسفہ وحکمت کی بنیاد ڈالی، ہم اسی شخصیت کو حضرت قاسم العلوم مولانا محمد قاسم نانوتوی رحمہ اللہ کے نام سے یاد کرتے ہیں، جو شاہ ولی اللہ شاہ عبد العزیز، شاہ محمد اسحق اور شاہ عبد الغنی کے علوم کا نچوڑ اور ان کے دینی تفقہ کا خلاصہ تھا، اور اس نے وہی امانت جو ولی اللہی دور سے لی تھی اس دور کے مناسب حال حکیمانہ انداز سے دنیا کے سامنے رکھ دی۔ (تاریخ دار العلوم دیوبند ۱/১৬-২১)

হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী রহ. আহলে সুন্নাহ ও দেহলবী রহ. এর ফিকরার তারজুমানী করতে তিনি অনেক কিতাব রচনা করেছেন। তার মাঝে تقریر دل پذیر وحجۃ الاسلام অন্যতম।

যুগ যখন আরও পরিবর্তন হয়েছে। উলাময়ে দেওবন্দ নতুন উপস্থাপনার প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. আকাবিরে দেওবন্দের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ইসলামের প্রয়োজনীয় প্রতিটি শাখায় তিনি যুগের চাহিদা মাফিক উপস্থাপনার মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আলোচ্যবিষয়ে তিনি রচনা করেছেন, الانتباہات المفیدۃ، اشرف الجواب، احکام اسلام عقل کی نظر میں । আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী রহ.ও ….العقل والنقل….কিতাব রচনা করে উত্তম প্রতিনিধির পরিচয় দিয়েছেন।

নতুন উপস্থাপনার ধারা আজও চলমান। আজও বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম দেওবন্দী মাসলাকের আলোকে দ্বীনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। ফাতওয়া প্রদান করছেন। ঈমান ও আমলের মেহনত করছেন।
এখানে উলামায়ে দেওবন্দের ফিকিরের ক্রমধারা ও প্রতিনিধিত্ব করার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নিছক আকাবিরদের কিতাব প্রচার করাই যথেষ্ট নয়; বরং বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী কিতাবও রচনা করতে হবে।

আরও পড়তে পারেন-

বলা বাহুল্য যে, প্রাচীন কোনো কিতাব কঠিন হতে পারে, কিন্তু আকাবিরদের ফিকির তো কঠিন নয়। তাই তাদের ফিকির বলবৎ রেখে নতুন দলীল ও উপস্থাপনায় মানুষের সামনে তা পেশ করতে হবে। হযরত কারী তায়্যিব সাহেব রহ.ও এমন পরামর্শই দিয়েছেন। তিনি যুগের চাহিদা মাফিক মাদরাসার নেসাব পরিবর্তন বিষয়ক এক সেমিনারে বক্তব দিতে গিয়ে বলেন-

مسائل پرانے ہوں اور دلائل نئے ہوں، ہم ان ہی فطری مسائل کو جدید آلات سے مسلح کر کے میدان میں لائیں گے۔ (خطبات حکیم الاسلام ৮/১৪৩)

তিনি فکر اسلامی کی تشکیل جدید নামক এক সেমিনারে এমনি মন্তব্য করেছেন। বিষয়টি খুবই অর্থবহ। মূলনীতি পর্যায়ের। যেমনটি আকাবির উলামায়ে দেওবন্দ করেছেন। এখানে আরও একটি উদাহরণ যোগ করার মতো। হযরত মুফতী শফী রহ. ‘মাআরিফুল কুরআন’ রচনা করেছেন। যা মূলত ‘বায়ানুল কুরআনের’ নতুন ভার্সন বলা যেতে পারে। নিয়মতান্ত্রিক তিনি ‘বায়ানুল কুরআনের’ কোনো শরাহ লেখেননি। তবে বায়ানুল কুরআনের কথাগুলো নিজ যুগ মাফিক উপস্থাপন করেছেন।

এক্ষেত্রে বড় একটি প্রশ্ন হলো, একাজটি করবে কে? এ কাজ করার জন্য কী কী যোগ্যতার প্রয়োজন? এ বিষয়ে বড়দের পরামর্শ নিতে হবে। যে কারও এ বিষয়ে অনুপ্রবেশ করাটা ক্ষতি বয়ে আনবে।

তিন. কিতাব সহজিকরণ

উলামায়ে দেওবন্দের চিন্তা চেতনা বা মাসলাকে দেওবন্দকে পরিচিত ও জনপ্রিয় করার আরেকটি পদ্ধতি হলো, আকাবির হযরাতদের কিতাবগুলো প্রয়োজনীয় টীকা ও ব্যাখ্যাসহ যতটা সম্ভব সহজ করে প্রকাশ করা। উলামায়ে দেওবন্দ নিজেরাও এ বিষয়ে কাজ করেছেন এবং কাজ করে যাচ্ছেন। এতে সাধারণ পাঠকগণ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করতে না পারলেও চিন্তাশীল মহল তা গ্রহণ করবে; ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলার তাওফীক হলে তারা নিজেদের লেখনি ও আলোচনার মাধ্যমে সহজ করে মানুষের সামনে পেশ করবেন।
হযরত কাসেম নানুতবী রহ. এর কিতাবের ‘তাসহীল’ এর কাজ শায়খুল হিন্দ রহ. এর যুগেই আরম্ভ হয়েছে; বরং তিনি এতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ কিতাবের তাসহীল শেষে তিনি ফিকরী ভূমিকা লিখেছেন; তিনি এতে বলেন-

خدام مدرسہ عالیہ دیوبند نے تو یہ تہیہ بنام خدا کر لیا ہے، کہ تالیفات موصوفہ (یعنی تصنیفات امام نانوتوی) مع بعض تالیفات حضرت شاہ ولی اللہ قدس سرہ وغیرہ تصحیح اور کسی قدر توضیح وتسہیل کے ساتھ عمدہ چھاپ کر اور نصاب تعلیم میں داخل کر کے، ان کی ترویج میں اگر حق تعالی توفیق دے، تو جان توڑ کر ہر طرح کی سعی کی جائے، اور اللہ کا فضل حامی ہو، تو وہ نفع جو ان کے ذہن میں ہے، اوروں کو بھی اس کے جمال سے کامیاب کیا جائے۔(مقدمہ حجۃ الاسلام ص/১৭)

হযরত থানবী রহ. সহ আরও অনেকের কিতাবের তাসহীল ও তাশরীহের কাজ হচ্ছে। বাংলা ভাষাতেও কাজ আরম্ভ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই।

চার. ভাবানুবাদ বা ছায়ানুবাদ

অনুবাদ হলো কোনো কিতাব বা কথাকে সহজীকরণ ও সাধারণীকরণের একটি প্রক্রিয়া। যেমন আরবী ভাষা অনেকেই বোঝে না। অনুবাদের মাধ্যমে সহজ করে সাধারণের কাছে পৌঁছানো হলো। এক্ষেত্রে ভাবানুবাদ ও ছায়ানুবাদ বেশ ফলদায়ক। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে প্রয়োজন নেই। অনেক দোকানে লেখা থাকে, ফিক্স রেইট। তারা ইংরেজি বাক্য ব্যবহার করে বোঝাতে চায় যে, এ দোকানে দরদাম করা যাবে না। প্রতিটি পন্যের দাম নির্দিষ্ট করা যাছে। যা আছে তাই দিতে হবে। এটি হলো ঐ বাক্যের মূল ভাব। এ ভাবটিই আরেক দোকানি প্রকাশ করতে গিয়ে লেখিছেন, ‘এক দাম’। এই ‘এক দাম’ হলো সেই ফিক্স রেইটের ভাবানুবাদ। আমাদেরকেও উলামায়ে দেওবন্দের চিন্তার ভাব বুঝে নতুন করে উপস্থাপন করতে হবে। ফিক্স রেইট থেকে ‘এক দামে’ আনতে হবে। হযরত কারী তায়্যিব রহ. উপর্যুক্ত আলোচনার দ্বারা এ দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

পাঁচ. বড়দের পরামর্শ আবশ্যক

যে কোনো বিষয়ে কিতাব রচনার ক্ষেত্রে সতর্কতা আবশ্যক। আলোচ্য বিষয়ে আবশ্যকীয়তা আরও অধিক ও গুরুতর। উলামায়ে দেওবন্দ সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। নিজেকে স্বয়ংসম্পন্ন ভাবেননি। নিজের কাজকে অন্যের সামনে পেশ করেছেন। পরামর্শ করেছেন। আকাবিরে দেওবন্দের জীবনীতে এমন উদাহরণ অনেক। এখানে দু’টি তুলে ধরছি।

দেওবন্দী মাসলাকের বড় একটি স্তম্ভ হলেন সাইয়েদ ইসমাইল শহীদ রহ.। তিনি সামাজিক অবক্ষয়, বিদআত ও শিরকের ছড়াছড়ি দেখে কিতাব লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। এ অনুভব থেকেই ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ কিতাবটি রচনা করলেন। একিতাবটি লেখার পরে তিনি উলামায়ে কেরামের সামনে উপস্থিত করলেন। এ প্রসঙ্গে খাঁন সাহেব বলেন-

مولوی اسمعیل صاحب نے تقویۃ الایمان اول عربی میں لکھی تھیৃاس کے بعد مولانا نے اس کو اردو میں لکھا، اور لکھنے کے بعد اپنے خاص خاص لوگوں کو جمع کیا جن میں سید صاحب ،مولوی عبد الحئی صاحب، شاہ اسحق صاحب، مولانا یعقوب صاحب، مولوی فرید الدین صاحب مرادآبادی، مؤمن خان، عبد اللہ خان علوی، (استاذ امام بخش صہبانی ومملوک علی صاحب) بھی تھے۔ اور ان کے سامنے تقویۃ الایمان پیش کی اور فرمایا کہ میں نے یہ کتاب لکھی ہے اور میں جانتا ہوں کہ اس میں بعض جگہ ذرا تیز الفاظ بھی آگئے ہیں اور بعض جگہ تشدد بھی ہو گیا ہے۔۔۔اگر آپ حضرات کی رائے اشاعت کی ہو تو اشاعت کی جائے گے ورنہ اسے چاک کردیا جائے۔۔۔گفتگو کے بعد بالاتفاق یہ طئے پایا کہ ترمیم کی ضرورت نہیں ہے اور اسی طرح شائع ہونی چائیے، چنانچہ اس کی اشاعت اسی طرح ہوئی۔(ارواح ثلاثہ ص/৮৩-৮৪)।

মাসলাকে দেওবন্দের কেন্দ্রীয় রুকন হলেন হযরত কাসেম নানুতবী রহ.। তিনি যুগের চাহিদা অনুযায়ী ইলমুল কালামকে নতুনরূপে পেশ করেছেন। এ ক্ষেত্রে হযরতের কিতাব ‘তাকরীরে দিলপযির’ বেশ প্রসিদ্ধ। এ কিতাবটি লেখার পর তিনি স্বীয় শায়খ হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ. এর খেদমতে পেশ করেন। তিনি নিজেই বলেন-

بامید ہائے چند در چند، ایک بار حضرت پیر ومرشد ادام اللہ فیوضہ کے گوش گزار کردینا، یا ملاحظہ سے گزار دینا ضروری سمجھاৃاپنی کم مائیگی اور ہیچ مدانی کے سبب جو تحریر مذکور کی صحت میں تردد تھا، رفع ہو گیا۔۔۔جب زبان فیض ترجمان سے آفرین وتحسین سن لی، تو اصل مضامین کی حقیقت تو اپنے نزدیک محقق ہوگئی۔ (سوانح قاسمی ۳/৮-১২)।

হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. একজন রুকন পর্যায়ের আকাবির। তিনি এ বিষয়ে বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে, বর্তমান অনেক শিক্ষিত সমাজের মাঝে ইসলাম নিয়ে নানা ধরণের প্রশ্ন ও সংশয় কাজ করছে। এজন্য ‘ইলমুল কালামকে’ নতুনভাবে উপস্থাপন করার প্রায়োজন। তবে কাজটি করার ক্ষেত্রে তিনি অন্যদের পরামর্শের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বলেন-

۔۔۔کبھی کبھی خیال ہوتاہے کہ ایک رسالہ علم کلام جدید میں (لکھا جائے)ৃاس وقت تو بحمد اللہ! ایسے علمأ موجود ہیں، کہ اگر مجھے کسی مقام پر شبہ ہو، تو ان سے رجوع کرسکتا ہوں۔ (منہاج علم وفکر ص/৪৩)
এ উদাহরণগুলো থেকেই প্রতিভাত হয়ে যে, বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের পরামর্শ কতুটুকু গুরুত্ববহ। আকাবিরগণের জীবনীতে অজস্র এমন উদাহরণ রয়েছে। আপাতত এতটুকুই যথেষ্ট।

সাত. কওমী অঙ্গনে সচেতনতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে

উপরের আলোচনাগুলো ব্যাপক হলেও লেখনির দিকটাই বেশি ভেসে উঠেছে। তাই এ দিকটি সংযোগ করা। আমাদের এ দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, দেওবন্দী মাসলাক প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হলো, বয়ান ও খুতবা। আমাদের মাসলাককে যারা প্রচার করেন তাদের মাঝে বড় সংখ্যক মুখে বা বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচার করেন। যেমন, মসজিদের ইমাম, মুআযযিন ও খতীব। এই শ্রেণির দাঈরাই বেশি ভূমিকা রাখেন।

পাশাপাশি ওয়ায়েযীন হযরাত। উনারা অধিকাংশই কওমী মাদারাসার সাথে সম্পৃক্ত। তারা বিভিন্ন ব্যস্ততায় বাড়তি কিতাব খুব বেশি পড়ার সময় পান না। নেহায়াত প্রয়োজন না হলে পড়েনও না। ইল্লা মাশা আল্লাহ। মাদরাসা থেকে যে চিন্তা তাদেরকে দেয়া হয় তাই তারা ধারণ ও বিতরণ করে থাকেন। তাই কওমী অঙ্গনের আরও একটু সচেতনতা বৃদ্ধি করলে দেখা যাবে আগামী প্রজন্মে আমরা এ সংকট থেকে বের হতে পারবো। তবে এ বিষয়ে বড়দের পরামর্শ আবশ্যক। তারাই এ ক্ষেত্রে ভালো ও কার্যকারি পদক্ষেপ নিতে পারবেন।

এখানে বিক্ষিপ্ত কিছু কথা তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হয়েছে। মুফীদ হবে বলে আশা রাখি। উপর্যুক্ত দিকগুলো বিবেচনায় রেখে আরও গভীরভাবে ভাবা যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিক পথ দেখান এবং চলার তাওফীক দান করুন॥

সালামান্তে- বান্দা আবদুল্লাহ নাজীব
যিম্মাদার- দাওয়াহ ও ইরশাদ বিভাগ, আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম এবং বিভাগী সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।