।। মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী ।।
একটি শিক্ষিত দেশ ও জাতি গঠনে মহানবী (সা.) যেমন গুরুত্বারোপ করেছেন, অন্য কোনো বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ এমনকি অন্য কোনো নবীও স্বজাতিকে শিক্ষিত করতে তেমন গুরুত্বারোপ করে যাননি। শিক্ষাকে প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে তিনি ঘোষণা করেছেন বিজ্ঞানসম্মত দর্শন ও সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কর্মসূচি। তাঁর ঘোষিত শিক্ষাদর্শন এতটাই ফলপ্রসূ ছিল যে, তাঁর প্রতিটি সাহাবী সোনার মানুষে পরিণত হয়ে যায়। তাঁর ঘোষিত শিক্ষাদর্শনে যারা শিক্ষা গ্রহণ করে বিশ্ব শাসন করেছে, বিশ্ব ইতিহাস তাদের সেই শাসনামলকে আজো সোনালি যুগ বলে স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে।
মানুষ যেসব গুণে অন্যান্য মাখলুকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, শিক্ষা তন্মধ্যে অন্যতম। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- কোন শিক্ষা মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মাখলুকাতের স্থানে পৌঁছিয়ে দেয়? তা কি তথাকথিত পুঁথিগত শিক্ষা, নাকি ইলমে অহী তথা আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষা? কোন যোগ্যতা মানুষকে পশু হতে পার্থক্য করে দিয়েছে? এসব প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো মহানবী (সা.)এর ঘোষিত শিক্ষাদর্শন মোতাবেক যে শিক্ষা, সেটিই মূলত প্রকৃত শিক্ষা। আর সেটি হলো কুরআনি শিক্ষা। যাকে বলা হয় ইলমে ওহী। এ জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা মহান আল্লাহ একমাত্র মানুষকেই দান করেছেন।
শিক্ষার গুরুত্ব বর্ণনায় মহান আল্লাহ কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন- ‘বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান?’ (সূরা জুমার ৩৯)।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞানদান করা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন’।
রাসূল (সা.) জ্ঞানার্জনকে প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরয ঘোষণা করেছেন। হাদীস শরীফে এসেছে, ইলমে ওহী অনে¦ষণ করা প্রতিটি মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য।
রাসূল (সা.) আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যে আসমানী বিধান নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেছেন এবং সমাজে যে বাণী প্রচার করেছেন তার মর্মকথা উপলব্ধি করার জন্যও জ্ঞান আহরণ জরুরী। তাই তিনি সমাজের নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও শিক্ষাকর্মসূচি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশিকা দিয়েছেন। শিক্ষাবিস্তারে তিনি যে দর্শন পেশ করেছেন, তার কাছাকাছিও অন্য কোনো শিক্ষাব্যবস্থা পেশ করতে পারেনি।
প্রিয়নবী (সা.) আরবদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে নিরক্ষরতামুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে মক্কী জীবনে আরকাম ইবনে আবুল আরকামের বাড়িতে একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
রাসূল (সা.) নিজেই ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক। আর নবদীক্ষিত সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। মদিনায় হিযরতের পর রাসূল (সা.) হযরত আবু উসামা বিন জুবায়েরের (রাযি.) বাড়িতে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। হযরত মুসআব বিন উমায়ের (রা.)কে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিযুক্ত করেন। মদিনায় হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর বাসভবনে রাসূল (সা.) আরও একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে দীর্ঘ আট মাস শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করেন।
আরও পড়তে পারেন-
- পাশ্চাত্য শিক্ষা বনাম কওমী শিক্ষা
- করোনা মহামারি ও আমাদের করণীয়
- জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে
- দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা
- ইসলামে সংশয়প্রবণতা এবং সংক্রামক রোগ
শিক্ষার আলো আরও সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে রাসূল (সা.) মসজিদভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন। সাহাবায়ে কেরাম শিক্ষার আলো আহরণের জন্য মসজিদে নববীতে সমবেত হতেন। সেখানে নিয়মিত ধর্মীয় আলোচনা হতো। মসজিদে নববীর আঙ্গিনায় বসবাসকারী ছাত্রদের ‘আসহাবুস সুফফা’ বলা হতো। তারা সব সময় রাসূল সা-এর সান্নিধ্যে থেকে দ্বীনি জ্ঞান আহরণ করতেন। রাসূল (সা.)এর ইন্তেকালের পর তারাই মুসলিম বিশ্বে শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করেন।
মহানবী (সা.) শিক্ষা অর্জনের প্রতি সাহাবায়ে কেরামকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেছেন যে, দূরবর্তী গোত্রগুলো থেকে অনেক নওমুসলিম শিক্ষা গ্রহণের জন্য মদিনায় আসতে থাকেন। তারা কিছুদিন রাসূল (সা.)এর সাহচর্যে থেকে দ্বীনি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে আবার স্বগোত্রে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ফিরে যেতেন। মালিক ইবনে হুওয়াইরিস (রাযি.) একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মদিনায় আগমন করেন এবং বিশ দিন সেখানে থেকে দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেন। ফিরে যাওয়ার সময় রাসূল (সা.) তাকে ও তার সঙ্গীদের বলেন, ‘তারা যা কিছু শিখেছে তা যেন তার গোত্রের লোকদের শিক্ষা দেয়’।
বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা.) নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজনে জীবনের চরম শত্রুকেও শিক্ষকের মর্যাদায় সমাসীন করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি। বদরের যুদ্ধে কাফেরদের ৭০ জন মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। রাসূল (সা.) তাদের অনেককে এই শর্তে মুক্ত করে দেন যে, তাদের প্রত্যেকেই দশজন করে নিরক্ষর মুসলমানকে অক্ষরজ্ঞান দান করবে। দূরবর্তী এলাকার যেসব নওমুসলিম মদিনায় আসতে পারতো না, তাদের জন্য নিজ এলাকায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থাও করা হয়। এজন্য বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষকদের পাঠানো হয়।
তাছাড়া ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত গভর্নরদের প্রতি নির্দেশ ছিল- তারা যেন নিজ নিজ এলাকার অধিবাসীদের ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষাদান করেন। মোটকথা রাসূল (সা.) তাঁর অনুসারীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে নিরক্ষরতামুক্ত একটি আলোকিত সমাজ গড়ে তোলেন। পর্যায়ক্রমে যা বিশ্বসভ্যতা বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যায়।
শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী যত অনিয়ম, অন্যায়, হানাহানি, খুনাখুনি, লুটপাট, অস্ত্রবাজি চলছে তা এই তথাকথিত শিক্ষিত নামধারীদের মাধ্যমেই সংঘটিত হচ্ছে। শিক্ষিতের লেবেলধারীরাই হিরোশিমা-নাগাসাকিতে লাখো বনি আদমকে হত্যা করেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব আজো বিশ্ববাসী অসহায়ভাবে বয়ে চলেছে। বিশ্বশিক্ষিত দাবিদাররাই ইরাক-আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনে রক্তের হোলিখেলায় সমানতালে মেতেছে। কথিত শিক্ষিতরাই গাজায় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে দানব উন্মাদনায় মেতেছে, সভ্যতার ধ্বজাধারীরাই আরাকানে, মিয়ানমারে, বার্মায় জীবন্ত মানুষকে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মেরেছে। চেয়ারধারী শিক্ষিতের কলমের খোঁচায়ই দেশ ও জাতি আজ ক্ষতবিক্ষত। তাই এ কথা অকপটেই স্বীকার করতে হবে যে, শুধু পুঁথিগত বিদ্যাই জাতির মেরুদ- নয়; বরং সুশিক্ষাই জাতির প্রকৃত মেরুদণ্ড। আর এই সুশিক্ষাই একটি দেশের প্রকৃত মানবসম্পদ গড়ে তোলে। তাই আজও যদি সর্বস্তরে মহানবী (সা.)এর শিক্ষাদর্শন বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে মানুষে মানুষে পার্থক্য, সম্পদের লুটপাট এবং সকল প্রকার অসভ্যতা ও নোংরামি থেকে জাতি মুক্তি পাবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে সঠিক শিক্ষালাভ করে আদর্শ মানুষ হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমিন।
লেখক: মুহাদ্দিস- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা এবং খতীব- তিস্তা গেট জামে মসজিদ, টংগী, গাজীপুর।
মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/