।। বিনতে এন. এম. জাহাঙ্গীর ।।
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ! প্রিয় বন্ধু সকল! আশা করি সকলেই ভাল আছ। এটা কোন মাস মনে আছে তো? উহু, অক্টোবর মাসের কথা বলিনি! হিজরি মাসের কথা বলছি। এখন থেকে হিজরি মাসের হিসেবও রাখবে, কেমন? এটা হল রবিউল আওয়াল মাস। এই মাসটি অনেক দামী। এ মাসে ধরায় পদার্পণ করেছেন, জগতের শ্রেষ্ঠ মানব, আমাদের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সা.)।
হাদীসবিশারদ আলিমগণ বলেছেন, ১২ নয়, বরং ৮ই রবিউল আউয়াল নবীজির (সা.) জন্মতারিখ। দিনটি ছিল সোমবার। পরবর্তীতে এই মাসেই নবীজি (সা.) দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ করেন। তো বন্ধুরা! বুঝতেই পারছ কত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাসে আজ আমরা মজলিসে এসেছি। তবে নবীজি (সা.) নিজে, পরবর্তীতে সাহাবীগণ (রাযি.) বা আলিমগণ কখনও তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে কোন মীলাদ বা কথিত ঈদে মীলাদুন্নবীর আয়োজন করেননি। তাই আমরা অবশ্যই এসব ইসলাম বহির্ভূত প্রথা থেকে দূরে থাকব। শিশুরা জান্নাতী ফুল! নবীজি (সা.) শিশুদের খুব ভালবাসতেন! তাই এসো! আজ জেনে নেই নবীজি (সা.) শিশু-কিশোরদের কেমন আদর-স্নেহ করতেন!
শিশু জন্মের পর নবীজির (সা.) অভ্যর্থনা আয়োজন
একদিন নবীজি (সা.)এর মজলিসে সাহাবীগণ (রাযি.) বসা ছিলেন। আরও ছিল ছোট ছোট শিশু-কিশোররা। নবীজি (সা.) সাহাবীদের সাথে কথা বলছেন, আবার শিশু সাহাবীদের কাছে ডেকে আদরও করছেন। নবীজি (সা.)এর মমতার ছোঁয়া পেয়ে শিশুরা খিল খিল করে হাসছে! যেন চাঁদমুখ বেয়ে জোৎ¯œা ঝরছে! এক বেদুঈন সাহাবী (রাযি.) অবাক হয়ে তা দেখছিলেন এবং বললেন-
‘আপনারা বাচ্চাদের এত আদর করেন, কপালে চুমু দেন! আমরা আদর করি না, চুমুও দেই না! নবীজি (সা.) বললেনÑ ‘আল্লাহ যদি তোমার অন্তরে দয়া-মায়া না দেন, তবে আমি কী করব’! (বুখারী- ৫৯৯৮, মুসলিম- ২৩১৭)। সুতরাং যাদের দিল নরম, তাঁরাই শিশুদের আদর-সোহাগ করতে পারে।হযরত আনাস (রাযি.) বলেন, আমি দশ বছর নবীজি (সা.)এর খেদমত করেছি। তিনি এ দীর্ঘ সময়ে আমাকে উহ্ শব্দও বলেননি। আমি কোন (ভুল) কাজ করে ফেললেও তিনি রাগত: হয়ে কখনও বলেননি এ কাজ কেন করলে? আর কোন কাজ ছেড়ে দিলেও বলেননি, এ কাজ কেন করলে না? (মুসলিম- ২৩০৯, আবূ দাঊদ- ৪৭৭৩, শামায়েল)।
কন্যা শিশুদের প্রতি বিশেষ মায়া
একবার ঈদুল ফিতরের দিন। নবীজি (সা.) রাওয়ানা হয়েছেন ঈদের জামাতের উদ্দেশ্যে। সাথে আছে ছোট্ট দুই নাতি হাসান ও হুসাইন (রাযি.)। ছোট ছেলে-মেয়েরা সেজে রাস্তায় ছুটোছুটি করছে। সবার পরনে সুন্দর পোশাক এবং মনে ঈদের খুশি! তাদের কেউ কেউ নবীজির কোলে উঠার বায়না করছে, নবীজি (সা.)এর চাদর ধরে ঝুলছে কেউ! নবীজিও হেসে তাদের বায়না পূরণ করছেন, আর এগিয়ে চলছেন ঈদগাহের দিকে। কিছু দূর যেয়ে নবীজি (সা.) দেখলেন এক ধূলো-মলিন বালক একা বিষণœ মনে দাঁড়িয়ে আছে। নবীজি (সা.) আদর মেখে বললেন- ‘ঈদের দিনে তুমি এমন বিষন্ন-মলিন কেন?’
নবীজির (সা.) আদরমাখা কথায় বালকটি গলে গেল, কষ্টগুলো যেন ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু হয়ে ঝরতে লাগল। সে বলল, আমার মা-বাবা নেই, এতিম আমি। কে আমায় সাজাবে! নবীজি (সা.) স্নেহ মাথায় হাত বুলালেন ও বললেন-
‘মুহাম্মাদ যদি তোমার বাবা, আর আয়িশা যদি তোমার মা হয়, তোমায় নতুন পোশাকে সাজিয়ে দেয়, তুমি খুশী হবে তো’? ছেলেটির মন খুশিতে ভরে উঠল! নবীজি (সা.) বাড়ি ফিরে এলেন। আয়িশা (রাযি.) ছেলেটিকে মায়ের মত সাজিয়ে দিলেন এবং নবীজি (সা.) এতিম ছেলেটিকে নিয়ে ঈদগাহে গেলেন। এভাবেই এতিম শিশুদের আদর করতেন নবীজি (সা.)।
মুতার যুদ্ধে হযরত জা’ফর (রাযি.) শাহাদাত বরণ করেন। নবীজি (সা.) জা’ফর (রাযি.)কে অনেক ভালোবাসতেন। আসমা (রাযি.)এর কাছে যেয়ে বললেন ‘জা’ফরের সন্তানেরা কোথায়’? তাঁরা এলে নবীজি (সা.) তাঁদের বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদলেন। জা’ফর (রাযি.)এর ছেলে দু’টির ঘ্রাণ শুঁকলেন! দু’ভাইকে বসিয়ে ছাতু খেতে দিলেন। নাপিত ডেকে মাথার চুল মু-িয়ে দিলেন।
নবীজির (সা.) বাহনে শিশুরা
যুদ্ধজয় করে যখন সেনাপতি শহরে প্রবেশ করে, তখন সে গর্বে বুক ফুলিয়ে মাথা উচিঁয়ে রাখে। মক্কা বিজয়ের দিন আমাদের নবীজি (সা.) বিনয়ের সাথে মাথানিচু করে প্রবেশ করেছিলেন। সকলকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। সেদিনও নবীজি (সা.) ভুলেননি শিশুদের কথা। যেন শিশুরা ছিল নবীজির স্পন্দন! সেদিন নবীজির (সা.) বাহনের পিঠে ছিল তাঁর চাচা আব্বাস (রাযি.)এর দু’কিশোর ছেলে কাছম ও ফযল (রাযি.)।
আরও পড়তে পারেন-
- পাশ্চাত্য শিক্ষা বনাম কওমী শিক্ষা
- করোনা মহামারি ও আমাদের করণীয়
- জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে
- দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা
- ইসলামে সংশয়প্রবণতা এবং সংক্রামক রোগ
শিশুদের অনুভূতির মূল্যায়ন
শিশুরা বড় আগ্রহের সাথে জুমআর দিন মসজিদে যায়। দুষ্টুমি ও দৌঁড়ঝাপ শুরু করে। মসজিদে দৌঁড়ঝাপ ভাল নয়। তাই বড়রা শিশুদের বকাঝকা করেন। কিন্তু নবীজি (সা.) শিশুদের সাথে কেমন আচরণ করতেন, জানো?
নবীজি (সা.) যখন নামায পড়তেন, সিজদায় গেলেই হল! শিশু হাসান ও হুসাইন (রাযি.) নবীজির পিঠে চড়ে বসতেন, নামতে চাইতেন না। এমন মোলায়েম দেহ হতে যে নামতে ইচ্ছে করে না! নবীজিও সিজদা লম্বা করতেন। (নাসায়ী- ১১৪১)।
নবীজির (সা.) নাতি হযরত উমামা (রাযি.)। সেও নবীজির (সা.) কাঁধে চড়ে বসতো। নবীজি (সা.) রুকুতে যাওয়ার সময় উমামাকে নামিয়ে দিতেন। তারপর নবীজি (সা.) সিজদায় গেলে উমামা আবার পিঠে উঠে বসত। (বুখারী- ৫৯৯৬, মুসলিম- ৫৪৩)। নবীজি (সা.) এই দুষ্টুমির জন্য উমামাকে কিছুই বলতেন না।
শিশুদের সাথে নবীজির (সা.) আনন্দ
হযরত আনাস (রাযি.)এর ছোট ভাই শিশু উমায়ের। তাঁর একটি নুগায়ের পাখি ছিল, যা দিয়ে সে খেলা করত। পাখিটি মারা গেল। নবীজি (সা.) ঠাট্টা করে বলতেন-‘ওহে আবু উমায়ের! কি হল তোমার নুগায়ের’! (বুখারী- ৬২০৩, মুসলিম- ২১৫০)।
শিশুদের ভুল কাজে নবীজির (সা.) সবর
একবার কিছু বালক রাস্তায় খেলছিল। তাদের মাঝে আবূ যুরআ নামের এক অমুসলিম বালক ছিল। নবীজিকে দেখে সে ব্যঙ্গ করে আযান বলছিল। নবীজি (সা.) রাগ না করে হেসে আদর করে বললেন, ‘কি বলেছিলে, আবার বলো তো!’ বালকটি লজ্জা পেলো, ধীরে ধীরে শব্দগুলো বলল। কিন্তু কালেমা শাহাদাত বলার সময় এবার তার মনটা পরিবর্তন হল। মক্কা বিজয়ের সময় সেই বালকটি মুসলমান হয়ে যায়।
শিশুদের জন্য বদদুআ না করা
নবীজি (সা.) বলেন, তোমরা নিজেদের জন্য, বাচ্চাদের জন্য, সম্পদের জন্য বদদুআ করো না। হতে পারে, দুয়া কবুল হবার সময় বদদুআ করলে, আর আল্লাহ তাআলা তা কবুল করে নিলেন। (মুসলিম- ৩০০৯, আবূ দাঊদ- ১৫৩২)।
নবীজির (সা.) নিকট মদীনার শিশুদের নিয়ে আসা হত। নবীজি (সা.) তাদের জন্য বরকতের দুআ করতেন। (বুখারী- ৬৩৫৫, মুসলিম- ২৮৬)।
শিশুদের প্রতি নবীজির (সা.) শিক্ষা
হযরত উমর ইবনে আবি সালামা (রাযি.) নবীজি (সা.)এর নিকট হাজির হলেন। তখন তাঁর সামনে খাবার ছিল। নবীজি (সা.) বললেন, বাবা! সামনে এসো এবং ডান হাত দিয়ে তোমার সামনের দিক হতে খাও। (শামায়েল- ১৮২)।
কিশোর আনাস (রাযি.)এর প্রতি নবীজির (সা.) উপদেশমালা হতে কয়েকটি এমন ছিল- বাবা! পরিপূর্ণভাবে অযু করো, তোমাকে দেখভালকারী ফেরেশতারা ভালবাসবে। এতে তোমার বয়স (বরকত) বাড়বে। বাবা! সম্ভব হলে সর্বদা অযুর হালতে থেকো। কারণ, যে ব্যক্তি অযুর হালতে মারা যাবে, সে শহীদি মৃত্যুর মর্যাদা পাবে। বাবা! সর্বদা নামাযের পাবন্দী করো। যতক্ষণ তুমি নামাযে থাকবে, ফেরেশতারা ততক্ষণ তোমার মাগফিরাত কামনা করবে। নামাযে এদিক-ওদিক তাকাবে না। কারণ, নামাযে এদিক-সেদিক তাকানো ধংসাত্মক। যদি কোন কারণে তাকাতেই হয়, তবে তা নফল নামাযে, ফরযে নয়। হে বৎস! বাড়িতে প্রবেশকালে নিজের ও পরিবারের জন্য সালাম বলো। (ইবনে আসাকির- ৩/১৪৫)।
নবীজি (সা.) শিশুদের সাত বছর বয়সে নামায পড়তে আদেশ করেছেন।
আপনাকে ভালবাসি হে রাসূল (সা.)!
নবীজি (সা.) যখন মাদীনায় হিজরত করে পৌঁছেন। ছোটরা নাশীদ গেয়ে নবীজিকে (সা.) মারহাবা জানায়। বিশেষ করে নাজ্জার গোত্রের শিশুরা। তারা ছিল নবীজির (সা.) দাদীর বংশের। তারা বলে, ‘নাজ্জার গোত্রের আমরা ভাগ্যবতী মেয়ে। শোকর রবের, মুহাম্মাদকে মেহমান পেয়ে’! নবীজি (সা.) খুশীতে বলেন- ‘সত্যি তোমারা এত ভালোবাসো আমায়’! শিশুরা বলে, সত্যি! খুব ভালোবাসি আপনাকে হে রাসূল! নবীজি (সা.) খুশির সাথে বললেন, ‘আমিও তোমাদের অনেক ভালবাসি’!
জানলে তো বন্ধুরা! নবীজি (সা.) ছোটদের কত্তো বেশি ভালোবেসেছেন। এসো নবীজির (সা.) প্রিয় দরূদ ‘দরূদে ইবরাহীম’ পাঠ করি। তবে আমরাও পেতে পারি নবীজির (সা.) সুপারিশ ও জান্নাতের আদর!
اَللّهُمَّ صَلِّ عَلي مُحَمَّدٍ وَّ عَلٰي اٰلِ مُحَمَّدٍ؛ كَمَا صَلَّيْتَ عَلٰي إِبْرَاهِيْمَ وَ عَلٰي اٰلِ إِبْرَاهِيْمَ؛ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ – اَللّهُمَّ بَارِكْ عَلي مُحَمَّدٍ وَّ عَلٰي اٰلِ مُحَمَّدٍ؛ كَمَا بَارَكْتَ عَلٰي إِبْرَاهِيْمَ وَ عَلٰي اٰلِ إِبْرَاهِيْمَ؛ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ-
মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/