সন্তানের জীবন গঠনে মায়ের ভূমিকা

।। মুশতারী তাসনীম মুন্নী ।।

পারিবারিক জীবন গঠন হয় স্বামী স্ত্রী তথা বাবা মায়ের যৌথ সম্পর্কে। সেখান হতেই ভবিষ্যত প্রজন্মের পথচলা।
তবে জীবনের শুরুটা মায়ের গর্ভ হতেই আসে। এক অন্ধকার জগতে শুধু নয় থেকে দশ মাসের যাত্রায় সেই গর্ভজাত শিশুর ঘুমিয়ে বা খেলাধূলা করেই কাটে না, বরং সে মায়ের কণ্ঠ ও কাজের প্রভাবে সে প্রভাবিত হতে থাকে। গর্ভকালীন সময়কে টপকে যখন পৃথিবীর আলোয় আসে, তখনও কিন্তু শিশু সবচেয়ে কাছের ও ভালো বন্ধু হিসেবে মাকেই পায়।

আমার আজকে লেখার প্রধান উদ্দেশ্য মাকে নিয়ে। একটি মেয়ের চরিত্র গঠনে একজন মায়ের ভূমিকা যে কতবেশী, তা লেখার ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। গ্রামীণ সমাজে মায়েরা একটু বেশী খুঁতখুঁতে ও শাসনভার রাখেন। পর্দানশীন পরিবার বাদই দিলাম, একটু ভদ্র ও মধ্যস্তরের শিক্ষিত পরিবারগুলো মেয়েদের যথেষ্ট নজরে ও শাসনে রাখেন। এ সমাজে শেখানো হয় মেয়েরা কাজ শিখবে, মেয়েরা কারুকার্য শিখবে, পড়ালেখা শিখবে, কুরআন শিখবে, নামায শিখবে, পর্দায় না থাকলেও পরপুরুষ হতে কিশোরী হবার সাথে সাথেই মেয়েদের দূরত্ব রাখতে হবে।পর্দাহীন পরিবারে হুট করেই একজন অচেনা ব্যক্তির সামনে স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে দেন না গ্রামীণ মায়েরা। যেটা একজন মেয়ের লাজুক, কোমল কিংবা ভদ্র হবার জন্য সঠিক উপাদান হিসেবে কাজ করে। নিজ ইজ্জতকে ঢালাওভাবে প্রকাশ কিংবা নিজেকে খোলামেলা করার যে অপপ্রয়াস আছে সেগুলো গ্রামীণ সমাজের মায়েরা কন্যাদেরকে অভ্যস্ত হতে দেন না। কেননা গ্রামীণ সমাজে এখনও সম্মান নিয়ে বাঁচা যেন পারিবারিক ও সামাজিক রুটিন হয়ে বাঁধা। একজন গ্রামীণ মা তার মেয়েকে আদর্শ ও শালীনতার জন্য এখনও কড়া হাতের শাসনকেই বেছে নেন।

এবার আসি শহুরে চাকচিক্য জীবনের গল্পে। এখানকার একজন মা গর্ভ হতেই মেয়ের স্মার্ট হবার প্রত্যাশা করেন। বোঝার বয়সের আগে হতেই কাপড়ের রুচিবোধ তৈরি করে শর্টকাট। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুকে ওড়না হবে গলায় প্যাঁচানো কিংবা এক দিক হতে পায়ের গোড়ালি অব্দি ঝুলানো এটা পারিবারিক ফ্যাশনও বলতে পারেন।

একজন শহুরে স্মার্ট মা যখন উঠতি বয়সী মেয়েকে সাথে চলেন ,তখন তার শর্টকাট পোশাকের ফাঁকে শত জোড়া চোখের লোলুপ দৃষ্টি মেয়ের সর্বাঙ্গে বুলিয়ে নেয়। মা বুঝতে পারেন কিন্তু এতে লজ্জিত হয়নি তিনি বরং মেয়ের ফ্যাশন দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হওয়াতে তিনি গর্ববোধ করেন। যে সমাজে মায়ের হাত ধরেই এমন প্রদর্শনের আসর বসে নিত্য পথে পথে তখন সে সমাজ পঁচে গলে যেতে কতক্ষণ?

আবার সংসার ধর্মে একজন শহুরে মা নিজেও কাজের মেয়ের রান্না, কাপড় ধোয়ায় অলস জীবন যাপনে অভ্যস্ত।ছোট হতেই মেয়েটিও মায়ের মতোই গৃহকর্মীর ওপর নির্ভরশীল হয়, যার পরিণতিতে তার মেয়েটিও অকর্মার ঢেঁকি হয়ে বেড়ে ওঠে । আমি এখানে কাজের লোক থাকার বিপক্ষে বলছি না। বলছি, একটি মা যখন এমন জীবন নির্বাহে অভ্যস্ত হয়, তখন মেয়েটিও মাকে অনুসরণে এমনই হয়। যেমন মা সংসারে ভালোবেসে যখন রান্না করে, মেয়েটিও রান্নার প্রতি আগ্রহী হবে, মা যখন পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হবে মেয়েটিও নিজ হতে দায়িত্ববোধ শিখে নিবে।

এখানে মা তাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জীবনের শিক্ষা দেয় না, তাকে নারী হবার যোগ্য উপকরণ হতে দূরে রাখা হয়।যেমন ঘরোয়া কাজ, বাবা ভাই কিংবা ছোটদের প্রতি কোনও দায়িত্ব না দেয়ায় সে দায়িত্বহীন হয়েই বেড়ে ওঠে।

মেয়েকে বুকে নিয়ে প্রায়শই এসব মাকে গর্বভরে বলতে দেখা যায়, আমার মেয়েকে যেই সেই পরিবারের কাজের বুয়া হতে বিয়ে দেব নাকি? মেয়েকে রাজপুত্রের কাছে বিয়ে দেব। একটা মেয়ে অকর্মা হতে আর কী লাগে?

শহুরে জীবনে কুরআন শেখানো হয় বাসায় হুজুর রেখে। কিন্তু বাসায় নামাযের শিক্ষা নেই মায়ের হতে। বয়স হয়নি মাত্র কিশোরী। মেয়েকে শিষ্টাচার শেখানো হয় না, বরং উৎসাহ দেয়া হয় প্রতিবাদি হবার। স্বামীর আনুগত্য ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন এখানে খুব কমই শেখানো হয়।

তবে স্থানীয়দের মধ্যে এই অবাধ্যতার পরিধি একটু বেশী। গ্রামীণ অঞ্চলের মা শহরে এসেই নিজেকে পাল্টে নিতে পারে না। কোথাও যেন স্মার্ট হবার পেছনে ওই গ্রামীণ ভদ্রতা শরীরে জড়ায়। আমি এখানে সময়ের সাথে স্মার্ট হবার বিরোধিতা করছি না। কেননা যুগ এখন আধুনিকতার।তাই বলে আমাদের স্মার্ট হয়ে চলা ও বলা কি ভদ্রতার বাইরে হবে?

না, বরং ভদ্রতা ও শালীনতায় মোড়ানো মোড়কেই আসল স্মার্ট লুকিয়ে থাকে। শহুরে ছেলেরা শহুরে মেয়েদের সাথে পার্কে রেস্টুরেন্টে কিংবা লং ড্রাইভ বা লং জার্নিতেও যায়। কিন্তু অধিকাংশ ঢাকাইয়া পোলাপান বিয়ে করে ঢাকার বাইরের কিংবা মহল্লায় শালীনভাবে চলা মেয়েটিকে। তারাও জানে স্মার্ট শরীরে নয়।

আরও পড়তে পারেন-

এখন আসি শহর কিংবা গ্রামীণ সমাজে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মায়েদের শাসনভার কেমন হওয়া উচিত সেই আলোচনায়। একজন মা সে সব দেশে সব জায়গাতেই মা। একজন মেয়ে সে সব দেশ কিংবা সমাজের সকল ক্ষেত্রে সে মেয়ে। তাই মায়েদের শাসন কিংবা শিষ্টাচার শেখানোর পন্থাও ভিন্ন নয়।

আমার মা একজন আরবি শিক্ষিকা, একজন দ্বীনি তালিমের শিক্ষিকা। সব পরিচয়ের আগে তিনি আমাদের শিক্ষিকা। ছোট বেলায় অনেক রাগ হতো আম্মুর ওপরে। ভয়ে বলতাম না। একটু বড়ো হতেই হিজাব ছাড়া চলাচল আমাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিলো। স্কুলে সর্বপ্রথম আমাদের পরিবারই স্কুল ড্রেসের কালারে ক্লাস সিক্স হতে বোরকা পড়াতো। প্রথম প্রথম নিজেকে একটু আলাদাই লাগতো সবার হতে।একটু অসস্তি হতো। আস্তে আস্তে আমাদের অনুকরণের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ভালো লাগতো খুব। অনুষ্ঠান বাড়িতে কখনোই রাত কাটানোর সুযোগ দিতো না মা। বলতো এসব সময়ে বহু লোকজনের সমেগম থাকে, তখন মেয়েদের প্রতি একটু বেখেয়াল হলে যে কোনো অঘটন ঘটতে পারে। মাহরাম ছাড়া কারও সামনে যাওয়া বন্ধ করা হয় ক্লাস সেভেন হতে। পর্দার ভেতরেই আমাদের জন্য তৈরি হয় এক রাজত্ব। যেখানে সব ধরনের শখ আহ্লাদ কে আম্মু প্রাধান্য দিতো যদি তা ধর্মীয় রীতির বাইরে না হতো।

সাপ্তাহিক একদিন রান্নার আয়োজন করা বাধ্যতামূলক ছিলো, যাতে বড়ো হয়ে শশুর বাড়ী রান্নার জন্য লজ্জা পেতে না হয়। নিজ বিছানা, নিজ কাপড়, ঘর গোছানো কড়া হাতে শেখানো হয়েছিল।যাতে সংসার জীবনে গোছানো হতে পারি মুখে মুখে তর্ক, বড়োদের কথার ওপর কথা কিংবা বেয়াদবি কখনও বরদাশত করেননি।কেননা এসব আচরন ভবিষ্যত জীবনে অসুখী করতে সহায়তা করে।

আম্মু বিভিন্ন ধরনের সেলাই, কাপড় তৈরি কিংবা টুপি বুননে পারদর্শী ছিলেন। ওখান হতেই কিছুটা হলেও আমরা আয়ত্ত করেছি। বলতেন গুনী মেয়েরা সংসারে মুল্যায়ন পায়। সংসারে উজ্জ্বলতা বাড়ায়।

আমরা জান্নাত ও জাহান্নাম তার চোখ দিয়েই চিনেছি। দুনিয়ার চাওয়া আর আখিরাতের পাওয়ার হিসেব একজন মা সবচেয়ে ভালো শিখাতে পারেন। এজন্যে বলা যে, একজন মা একজন মেয়ের কারিগর। মায়ের শিক্ষা আপনাকে আমাকে ভদ্র ও শালীনতার শিখরে নিতে পারে। আবার একজন মায়ের গাফলতি একটি মেয়ের সর্বনাশের কারণও হতে পারে।

একজন আদর্শ মা মেয়েকে শিশুকাল হতেই ন¤্র হতে শিক্ষা দিন। ন¤্রতা মেয়েদের বিশেষ গুণ। একজন মা মেয়েকে শালীন পোশাক পরতে শেখান। মেয়ে লাজুক, সভ্য, সহনশীল, সেবামানসিকতা লালন করবে, এমনটাই আশা করুন। একজন মা মেয়েকে সব ধরনের পরিবেশে সব ধরনের মানুষের রুচিবোধ শেখান। সেখান হতে আপনার মেয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখবে।

একজন মা মেয়েকে উচ্চাভিলাষ হতে দূরে রাখুন। অল্পে তুষ্ট হতে অভ্যস্ত করুন। এতে মেয়ের ভবিষ্যত জীবন সুখের হবে। একজন মা মেয়েকে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা দিন। নামায তাকে খারাপী হতে দূরে রাখবে। সবর তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে। তাক্বওয়া তার সময়কে কন্ট্রোল করবে। আর পরকালীন ভয় তাকে পবিত্র রাখবে। বড়ো হতেই মেয়েকে স্বামীর মর্যাদা কিংবা সন্তান পালনের জন্য মায়ের মর্যাদা শেখান। এতে সে সংসার জীবনে সন্তানের প্রতি দায়িত্ববান হবে।

মেয়েরা বড়ো হলে নিয়ম করে ঘরোয়া তালীম করুন। সব ধরনের মাসায়ালা, সব ধরনের সম্পর্কগুলোর মর্যাদা জানান দিন। শুধু যে মেয়েরা সভ্য শালীন ভদ্র হলে সমাজ বদলে যাবে তা নয়, একজন মা ছেলে সন্তানকেও সেইম জিনিস শিক্ষা দিন।

বড়ো হতে হতে মা বাবার মর্যাদা ও অবমাননার ফারাক বোঝান। সময় দিন ওদের চাওয়াগুলোর। বুঝতে চেষ্টা করুন ছেলের রুচিবোধ ও আচরণ। তরুণ বয়সে ছেলেকে বিয়ে এবং দায়িত্ব সম্পর্কে নিজে বোঝান, নয়তো পরিচিত কাউকে দিয়ে বোঝান। সামর্থ্য থাকলে ছেলেকে পর্যাপ্ত বয়সে জীবনসঙ্গী দিন। নয়তো তার চরিত্র নড়বড়ে হবার আশঙ্কা থাকবে।

ছেলেদেরকে দ্বীনের সাথে রাখুন। দ্বীনি শিক্ষার অংশ হিসেবে নম্রতা, ভদ্রতা, সহনশীলতা, পরোপকারি মানসিকতা গড়তে সচেষ্ট থাকুন এবং সমাজসেবামূলক কর্মকা-ে উদ্বুদ্ধ করুন। এভাবেই একজন মা একটি পরিবার একটি সমাজ তথা একটি সভ্য জাতির ধারক ও বাহক হতে সক্ষম হয়ে ওঠবেন।

এছাড়া মাকে আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে খেয়াল করতে হবে। পরিবারের কর্তা স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ও মুরুব্বিদের সাথে আনুগত্যপূর্ণ, বিনয় ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করুন। সর্বদা সত্য কথা বলতে হবে। পরিপাটি ও রুচিশীল হয়ে চলবেন। বিশুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলার চেষ্টা করুন। ঘরের আসবাবপত্র, বিছানা, বাথরুমসহ ঘরোয়া পরিবেশ সাধ্যমতো সর্বোচ্চ গোছানো ও পরিষ্কার রাখবেন। খাওয়ার সময় সকলে একসাথে বসে খাওয়ার চেষ্টা করুন এবং খাওয়ার আদবসমূহ মেনে চলুন। কখনোই সন্তানদের মনভুলানোর জন্য হলেও মিথ্যা কথা বলা যাবে না। বাসায় অতিথি আসলে তাদের সাথে আন্তরিকতা দেখান ও সুন্দর আচরণ করুন। সময়মতো নামায আদায়, সকালে ও রাতে কুরআন তিলাওয়াত, নফল ইবাদত করুন। কিছু সময় বই পড়ার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, এভাবে চলতে পারলে একদিকে যেমন পরিবারে আপনার বিশেষ অবস্থান গড়ে ওঠে মর্যাদাবান হবেন, তেমনি সন্তানরা এসব দেখতে দেখেতে মনের অবচেতনেই এই অভ্যাসসমূহে আত্মস্থ হয়ে ওঠবে।

মা কখনোই একটি শব্দে সীমাবদ্ধ নয়। বরং একজন মা আমাদের জন্য জান্নাত বা জাহান্নামের পথপ্রদর্শক। তাই আসুন, যারা মা হয়েছি বা যারা ভবিষ্যত মা হবো, তারা আজই দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, সন্তান হবে আমার যোগ্য উত্তরাধিকার। সন্তানকে উপযুক্ত দ্বীনি শিক্ষা ও সময়োপযোগী শিক্ষার সমন্বয়ে এ যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় গ্রহণ করি। ইনশাআল্লাহ, এমন নিয়্যাত পোষণ করলে আল্লাহ তাআলা গায়েবিভাবে মদদ করবেন।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।