।। আল্লামা মুফতি কিফায়াতুল্লাহ ।।
প্রশ্নঃ জনৈক ব্যক্তি বিবাহ করেছে নোয়াখালী সদরে। তার বাড়ি নেত্রকোনা জেলা শহরে। বিয়ের পর সে তার স্ত্রীসহ নিজ বাড়ি নেত্রকোনায় বসবাস করে। মাঝে মাঝে স্ত্রীকে নিয়ে শ^শুর বাড়ী বেড়াতে আসে। নেত্রকোনা থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ লোক যখন তার স্ত্রীকে নিয়ে শশুর বাড়ী তথা স্ত্রীর পিত্রালয়ে বেড়াতে যায়, তখন ১৫ দিনের কম সময় অবস্থানের নিয়ত করলে তারা মুকীম হিসেবে গণ্য হবে, নাকি মুসাফির?
-আহকার আবুল কাশেম
জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা।
উত্তরঃ স্বামীর জন্য শ্বশুরালয়
স্ত্রী যদি পিত্রালয়ে বসবাস করে, এমতাবস্থায় স্বামী সেখানে গমন করলে মুকীম হিসেবে গণ্য হবে। তখন শ^শুরালয় স্বামীর জন্য ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থান রূপে গণ্য হবে। আর যদি স্ত্রী স্বামীর বাড়ীতে বসবাস করে, তবে স্বামী স্ত্রীর পিত্রালয়ে গমন করলে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে।
সাধারণতঃ তিন কারণে কোন স্থান ফিকাহশাস্ত্রে বর্ণিত ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থানের মর্যাদা লাভ করে থাকে। আদ-দুররুল মুখতার গ্রন্থে বলা হয়েছে- “ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থান হলো- (১) জন্মস্থান, (২) শশুরালয় (যদি সেখানে পরিবার বসবাস করে) ও (৩) সাধারণ বাসস্থান”। অর্থাৎ জন্মসূত্রে যেখানে বসবাস করা হয় অথবা বিবাহোত্তর পরিবার নিয়ে যেখানে বসবাস করা হয় কিংবা জন্মস্থানও নয়, শশুরালয়ও নয় বরং এমন কোন স্থান, যেখানে স্বপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য গ্রহণ করা হয়। এরূপ তিন প্রকার বাসস্থান ফিকাহশাস্ত্রের পরিভাষায় ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থান হিসেবে গণ্য হবে। আর এসব বাসস্থানে তার উপর মুকীমের হুকুম বর্তাবে।
তবে কেবল বিবাহ করলেই শশুরালয় ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থান হিসেবে গণ্য হবে না। শ^শুরালয় কেবল তখনই ওয়াতনে আসলী হিসেবে গণ্য হবে যখন সেটাকে তার পরিবারের স্থায়ী বসবাসের স্থান রূপে গড়ে তুলে সেখানে বসবাস করতে থাকে। কেননা, বৈবাহিক সূত্রে কোন স্থান ওয়াতনে আসলী হওয়ার ব্যাপারে ফুকাহায়ে কিরামের যেসব উদ্ধৃতি রয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করলে এটাই বোঝা যায়।
আল্লামা ইবনে হুমাম (রহ.) ফাতহুল ক্বাদীর গ্রন্থে লিখেন- “ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থান হলো, জন্মস্থান অথবা বিবাহ করে যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইচ্ছা রয়েছে”। (ফাতহুল ক্বাদীর-২/১৬)।
আল্লামা কাযীখান (রহ.) লিখেন- “ওয়াতনে আসলী এমন স্থান, যেখানে জন্মস্থান হিসেবে বসবাস করছে অথবা জন্মস্থান নয় কিন্তু বিবাহ করে তাকে (শ^শুরালয়) স্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে নিয়েছে”। (ফাতওয়ায়ে কাযীখান-১/৮০)।
ফুকাহায়ে কেরামের উপরিউক্ত বর্ণনার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শুধু বিবাহকে ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থানের জন্য যথেষ্ট মনে করা হয়নি। তাই তার সাথে প্রথম উদ্ধৃতিতে “যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইচ্ছা রয়েছে” এবং দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে “তাকে (শ^শুরালয়) স্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে নিয়েছে” ইত্যাদি বাক্যাবলী জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বুঝা গেল, শুধু বিবাহ করলেই শ^শুরালয় ওয়াতনে আসলী হয়ে যায় না, বরং স্বয়ং অথবা স্ত্রীর শ^শুরালয়ে বসবাস করা শর্ত।
মুসনাদে ইমাম আহমদে বর্ণিত এক হাদীসে রয়েছে- “হযরত উসমান (রাযি.) মক্কা সফরে পূর্ণ চার রাকআত নামায আদায় করলেন। লোকেরা তা অপছন্দ করলে তিনি কারণ হিসেবে বললেন- আমি মক্কায় এসে বিবাহ করেছি। আর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কেউ কোন শহরে বিবাহ করলে সেখানে মুকীমের ন্যায় পূর্ণ নামায পড়বে”। (মুসনাদে আহমদ- ১/৬২)।
এ প্রসঙ্গে কিফায়াহ গ্রন্থে বলা হয়েছে- “হযরত উসমান (রাযি.)এর মক্কায় এক পরিবার ছিল এবং মদীনায় ছিল আরেক পরিবার। তাই তিনি উভয় স্থানে মুকীমের ন্যায় পূর্ণ নামায পড়তেন”। (কিফায়াহ বিহামেশ ফাতহুল ক্বাদীর- ২/১৭)।
বোঝা গেল, মক্কায় হযরত উসমান (রাযি.)এর এক পরিবার বসবাস করার কারণে তিনি পূর্ণ নামায পড়েছেন, কেবল বিবাহের কারণে নয়।
হযরত জাফর আহমদ উসমানী (রহ.) লিখেন- “কোথাও শুধু বিবাহ করার কারণে যদি মুকীম হতো, তাহলে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয় ও বিদায় হজ্জের দিন কসর পড়তেন না। কারণ, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই বিবি হযরত সাওদা (রাযি.) এবং হযরত মাইমুনা (রাযি.)এর পিত্রালয় এবং আত্মীয়-স্বজন তখন মক্কায় বসবাস করছিলেন। অথচ সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় কসর পড়েছেন”। (ইমদাদুল আহকাম- ১/৬০৪)।
এছাড়া মুফতি আযীযুর রহমান (রহ.) লিখেন- “বিবাহের স্থান তথা শ^শুরালয় ওয়াতনে আসলী হিসেবে কেবল তখনই গণ্য হবে, যখন সেখানে স্বপরিবারে বসবাস করার ইচ্ছা থাকে। এমন নয় যে, বিবাহোত্তর স্ত্রীকে স্বামীর বাড়ীতে নিয়ে আসার পরও শ^শুরালয় স্বামীর জন্য ওয়াতনে আসলী হিসেবে বহাল থাকবে”। (দারুল উলূম- ৪/৪৮৩)।
আল্লামা জাফর আহ্মদ উসমানী (রহ.) লিখেন- “বিবাহোত্তর স্ত্রীকে শ^শুরালয়ে না রেখে নিজ বাড়ীতে নিয়ে আসলে স্ত্রীর পিত্রালয় স্বামীর জন্য ওয়াতনে আসলী হবে না। স্বামী সেখানে গেলে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি স্ত্রীকে তার পিত্রালয়ে বসবাসের জন্য রেখে দেয়, তাহলে স্ত্রীর পিত্রালয় স্বামীর জন্য ওয়াতনে আসলী হিসেবে গণ্য হবে”। (ইমাদাদুল আহকাম-১/৬০৫)।
মুফতি আব্দুর রহীম লাজপুরী (রহ.) এবং মুফতি মাহমূদুল হাসান গুঙ্গুহী (রহ.)ও তাঁদের স্ব-স্ব ফাতওয়া গ্রন্থে একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
স্ত্রীর জন্য পিত্রালয়
বিবাহোত্তর স্ত্রী তার পিত্রালয়ে গমন করলে মুকীম হিসেবেই গণ্য হবে। যদিও পিত্রালয় ৪৮ মাইল বা ৭৭.২৫ কি.মি. অথবা ততোধিক দূরবর্তী হয়। কেননা, পিত্রালয় জন্মসূত্রে ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থান। বিবাহোত্তর স্বামীর বাড়ী নতুন ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থান রূপে গণ্য হলেও পিত্রালয়ের ওয়াতনে আসলী বাতিল হবে না। কারণ, এক বাসস্থান দ্বারা অন্য বাসস্থান কেবল তখনই বাতিল হবে, যখন প্রথমটি সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা হয়। যদি প্রথমটি সম্পূর্ণ ত্যাগ না করে দ্বিতীয় আরেকটি বাসস্থান গ্রহণ করে, তবে উভয়টি স্থায়ী বাসস্থান রূপে গণ্য হবে এবং উভয় স্থানেই মুকীম হবে।
এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইব্নে হুমাম (রহ.) লিখেন- “কেউ নিজস্ব বাসস্থান ত্যাগ করে অন্য কোথাও আরেকটি বাসস্থান গ্রহণ করল। অতঃপর কখনো পূর্ববর্তী বাসস্থানে গমন করল, তখন সে মুসাফির হিসেবে নামায কসর পড়বে। কিন্তু যদি প্রথমটি সম্পূর্ণ ত্যাগ না করে, বরং অন্য কোথাও আরেকটি নতুন বাসস্থান গ্রহণ করে, তবে দ্বিতীয় বাসস্থানের ন্যায় প্রথম স্থানেও মুকীম হিসেবে পূর্ণ নামায পড়বে”। (ফাতহুল কাদীর- ২/১৬)।
তিনি আরও লিখেন- “একটি ওয়াতনে আসলী ত্যাগ করা ব্যতীত আরেকটি ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থান গ্রহণ করার কারণে প্রথমটি বাতিল হবে না”। (ফাতহুল কাদীর- ২/১৬)।
আল্লামা ইব্নে নুজাইম (রহ.) বাহ্রুর রায়েক গ্রন্থে লিখেন- “ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থান কেবল আরেকটি স্থায়ী বাসস্থান দ্বারা বাতিল হয়, অন্য কোন বাসস্থান দ্বারা নয়। অর্থাৎ অন্য শহরে নতুন বাসস্থান গড়ে তুলে পরিবার-পরিজনকে সেখানে স্থানান্তর করতঃ প্রথম বাসস্থানটি ত্যাগ করলে কেবল তখনই প্রথম বাসস্থানটি বাতিল বলে গণ্য হবে। অতঃপর পুরাতন বাসস্থানে কখনো গমন করলে নামায কসর পড়বে। পক্ষান্তরে যদি প্রথমটি পরিত্যাগ না করে, বরং অন্য স্থানে আরেকটি নতুন বাসস্থান গ্রহণ করে, তবে প্রথমটি বাতিল হবে না এবং সেখানে মুকীম হিসেবে পূর্ণ নামায পড়বে”। (বাহ্রুর রায়েক্ব-২/১৩৬)।
এমনিভাবে ফাতওয়ায়ে আলমগীরী, বাদায়েউস সানায়ে’, দুররুল মুখ্তার, কাযীখান, জাওহারাতুন নাইয়্যারাহ প্রভৃতি ফিকাহ গ্রন্থসমূহের ভাষ্যও অনুরূপ। অর্থাৎ এক ওয়াতনে আসলী ত্যাগ করে আরেক ওয়াতনে আসলী গ্রহণ করলেই কেবল প্রথম ওয়াতনে আসলী বাতিল বলে গণ্য হবে, অন্যথায় নয়।
আর কোন মহিলাই বিবাহোত্তর নিজ পিত্রালয় সম্পূর্ণ ত্যাগ করে স্বামীর বাড়ী চলে যায় না; বরং জন্মসূত্রে পিত্রালয়কেই তার আসল বাড়ী মনে করে থাকে। তাই কখনো বিবাহ বিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যু ঘটলে তাদেরকে পিত্রালয়ে ফিরে যেতে দেখা যায়। তখন মনে করা হয় যে, সে নিজ বাড়ীতেই ফিরে এসেছে।
আমাদের সামাজিক রীতি-নীতি ও সাধারণ ধ্যান-ধারণা মতেও পিত্রালয়কে স্ত্রীর নিজের বাড়ী বলেই গণ্য করা হয়। প্রচলিত এই সামাজিক রীতি-নীতি ও ধ্যান-ধারণাকে ফিকাহবিদগণের পরিভাষায় ‘উরফ’ বলা হয়। আর শরীয়তে ‘উরফে’র বিশেষ একটি স্থান রয়েছে।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
এ প্রসঙ্গে আল্লামা শামী (রহ.) লিখেন- অর্থাৎ, ‘উরফ’ ও ‘আদত’ তথা প্রচলিত রীতি-নীতি শরীয়তে গ্রহণযোগ্য, যদি তা শরীয়ত পরিপন্থি না হয়। এর উপর ভিত্তি করে অসংখ্য মাসআলা প্রণীত হয়। এজন্য ফিকাহবিদগণ ‘উরফ’ ও ‘আদত’কে একটি মূলনীতি হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। (শরহে উকুদে রাসমুল মুফতী- ৩৭ পৃষ্ঠা)।
এছাড়া স্বয়ং ফুকাহায়ে কিরামের বহু উদ্ধৃতিতেও বিবাহোত্তর পিত্রালয়কে স্ত্রীর ওয়াতন বা বাসস্থান রূপে আখ্যা দিতে দেখা যায়।
ফাতওয়ায়ে ক্বাযীখানের এক স্থানে উল্লেখ রয়েছে- “ঐ মহিলাও মুসাফির হবে যাকে তার স্বামী সফর অবস্থায় তালাক দিয়েছে। এমতাবস্থায় তার ইদ্দতও শেষ হয়ে গেছে। যদিও তার বর্তমান অবস্থান ও বাসস্থানের দূরত্ব তিন দিনের পথ অর্থাৎ- ৪৮ মাইলের কম হয়। কিন্তু তালাকে রাজয়ীর ক্ষেত্রে ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পূর্বে তার হুকুম স্বামীর ন্যায় হবে অর্থাৎ সে স্বামীর অধীন থাকবে”। (কাযীখান- ১/৮১)।
এখানে তালাকের পর ইদ্দত শেষ হওয়ার সাথে সাথে যেহেতু স্বামীর সাথে স্ত্রীর সব ধরনের সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে, কাজেই স্ত্রী এখন স্বামীর অধীন নয়। তাই কারো এ ধারণা হতে পারে যে, স্ত্রীর বাসস্থান যেহেতু বর্তমান অবস্থান থেকে ৪৮ মাইলের কম দূরত্বে, তাই স্ত্রী এখন থেকে মুকীম বলে গণ্য হবে। এই ভুল ধারণাকে খণ্ডন করে কাযীখানের অত্র উদ্ধৃতিতে মহিলাকে মুসাফির বলা হয়েছে। কেননা, মহিলার বাসস্থান যদিও বর্তমান অবস্থান থেকে নিকটবর্তী তথাপি যেহেতু এখনও সফর অবস্থায় রয়েছে, তাই তার এলাকায় প্রবেশের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তার উপর মুসাফিরের হুকুমই বহাল থাকবে। উল্লিখিত উদ্ধৃতিতে ‘ওয়াতন’ বা বাড়ী বলতে স্বামীর বাড়ীকে নিশ্চয়ই বোঝানো হয়নি, বরং বিবাহ পূর্ব বাড়ীকেই বোঝানো হয়েছে। এ বাড়ী স্ত্রীর পিত্রালয় কিংবা নিজস্ব বাড়ী, যাই ধরা হোক, এ কথা স্পষ্ট যে, বিবাহের কারণে স্ত্রীর বিবাহ পূর্ব বাসস্থান বাতিল হয়নি। যদি বাতিল হয়ে যেত, তাহলে সেটাকে তার ওয়াতন বা বাড়ী বলে আখ্যা দেওয়া হত না। কাজেই বিবাহের কারণে স্ত্রীর ওয়াতনে আসলী বাতিল হয়নি। সুতরাং পিত্রালয়ে আসলে মুকীম বলে গণ্য হবে এবং পূর্ণ নামায পড়বে।
এ প্রসঙ্গে মুফতি আব্দুর রহীম লাজপুরী (রহ.) লিখেন- “বিবাহোত্তর নববধু স্বামীর বাড়ীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করা আরম্ভ করলে মুকীম হিসেবে গণ্য হবে এবং পূর্ণ নামায পড়বে। তেমনি পিত্রালয়ে গেলেও পূর্ণ নামায পড়বে। কেননা, সে পিত্রালয় সম্পূর্ণ ত্যাগ করে চলে আসেনি। আর স্বামী শশুরালয়ে গেলে মুসাফির হিসেবে নামায কসর পড়বে। (যদি নিজ বাড়ী থেকে শ^শুরালয় ৪৮ মাইল বা ততোধিক দূরবর্তী হয়)। হ্যা, স্ত্রীকে নিয়ে শ^শুরালয়ে বসবাস করলে মুকীম হিসেবে পূর্ণ নামায পড়বে”। (ফাতওয়ায়ে রহীমিয়্যা- ৫/১০)।
ফাতওয়ায়ে দারুল উলূমে মুফতি আযীযুর রহমান (রহ.) এক প্রশ্নের উত্তরে লিখেন- “বিবাহোত্তর স্ত্রী নিজ পিত্রালয়ে গেলে মুকীম হিসেবে পূর্ণ নামায পড়বে। কেননা, স্বামীর বাড়ীর ন্যায় এটাও তার ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থান রূপে গণ্য”। (ফাতওয়ায়ে দারুল উলূম- ৪/৪৫৯)।
তবে কেউ যদি তার পিত্রালয় সম্পূর্ণ ত্যাগ করে চলে আসে, যেমন- মাতা-পিতার মৃত্যুর পর তার প্রাপ্য সম্পত্তি কাউকে দান করে বা বিক্রি করে স্বামীর বাড়ী চলে এল, এমতাবস্থায় কখনো পিত্রালয়ে গমন করলে মুসাফির বলেই গণ্য হবে। কেননা, তখন পিত্রালয় তার নিজের বাড়ী থাকবে না।
একটি সন্দেহের নিরসন
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ‘হালবী কাবীর’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, যে সন্তান পিতা-মাতার বাসস্থানে বসবাস করে না, তার জন্য পিতা-মাতার বাড়ী ওয়াতনে আসলী বলে গণ্য হবে না। হালবী কাবীরের বর্ণনা নিম্নরূপ- “কারো পিতা-মাতা তার জন্মস্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে বসবাস করে আর সে পৃথক স্থানে বসবাস করে, তবে মাতা-পিতার বাসস্থান তার জন্য ওয়াতনে আসলী হবে না”। (হালবী কাবীর- ৫৪৪ পৃষ্ঠা)।
কাজেই কোন মহিলা বিবাহোত্তর স্বামীর বাড়ী চলে গেলে, মাতা-পিতার বাসস্থান তার নিজের বাড়ী বলে গণ্য না হওয়ারই কথা; বরং পিতা-মাতার বাড়ীতে আসলে তার মুসাফির হওয়ার কথা। এ প্রসঙ্গে শরীয়তের ব্যাখ্যা কী?
জবাবঃ পিতা-মাতার বাসস্থান ত্যাগ করে যদি সন্তান অন্য কোথাও নতুন বাসস্থান গ্রহণ করে এবং পিতার বর্তমান বাসস্থান সন্তানের জন্মস্থান না হয়, তবে পিতার বাড়ীতে সন্তান সফরে গেলে অথবা সন্তানের বাড়ীতে পিতা আসলে উভয়ে মুসাফির হবে। এখানে যে দিকটি লক্ষণীয় তা হলো, মাতা-পিতা ও সন্তান তাদের পৃথক পৃথক নিজস্ব বাড়ীতে বসবাস করার কারণে পিতার বাড়ীকে সন্তান নিজের বাড়ী বলে মনেই করে না। দ্বিতীয়তঃ হালবী কাবীর গ্রন্থের উদ্ধৃতিতে মাতা-পিতার বাসস্থানকে ছেলের জন্মস্থান নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই মাতা-পিতার বাসস্থান সন্তানের ওয়াতনে আসলী নয়। কেননা, ইতঃপূর্বের আলোচনায় তিনটি স্থান ওয়াতনে আসলী রূপে সাব্যস্ত হয়েছে, বাসস্থান, জন্মস্থান ও বিবাহোত্তর স্বপরিবারে বসবাস করার স্থান। আর এক্ষেত্রে এর কোনটিই পাওয়া যায়নি। তাই সন্তান মুসাফির হবে।
পক্ষান্তরে বিবাহোত্তর মহিলা তার পিত্রালয় সম্পূর্ণ ত্যাগ না করলে এবং পিত্রালয় তার জন্মসূত্রে বাসস্থান হলে, উক্ত মহিলা পিত্রালয়ে মুকীম হবে।
এখানে আরেকটি প্রশ্ন হতে পারে, ফাতওয়ায়ে আলমগিরিয়্যার এক বর্ণনায় রয়েছে, সফরের বিধানে স্ত্রী স্বামীর অধীন অর্থাৎ স্বামী মুসাফির হলে স্ত্রীও মুসাফির হয় আর স্বামী মুকীম হলে স্ত্রীও মুকীম হয়। অর্থাৎ- “স্ত্রীকে মহর আদায় করে দেওয়ার পর স্ত্রী স্বামীর অধীন হয়ে যাবে।” (ফাতওয়ায়ে আলমগিরিয়্যা- ১/১৪১)। কাজেই স্ত্রী স্বামীর সাথে নিজ পিত্রালয়ে গেলেও স্বামী যেহেতু ওখানে মুসাফির তাই স্ত্রীও মুসাফির হবে।
এর জবাব হলো, স্ত্রী স্বামীর অধীন থাকবে যতক্ষণ তারা সফর অবস্থায় থাকবে। নিজ বাড়ীতে প্রবেশের পর স্ত্রী স্বামীর নিয়তের অধীন থাকবে না। তাই স্ত্রী পিত্রালয়ে পৌঁছলে তার ওয়াতনে আসলী বা স্থায়ী বাসস্থানে পৌঁছে গেল। সুতরাং সেখানে সে মুকীম হবে।
উপরের দীর্ঘ আলোচনায় একথা প্রমাণিত হলো যে, প্রশ্নে বর্ণিত মাসআলায় স্বামী তার স্ত্রীকে নিয়ে নোয়াখালীর শশুরালয়ে বেড়াতে গিয়ে ১৫ দিনের কম অবস্থানের নিয়ত করলে স্বামী মুসাফির হবে এবং স্ত্রী মুকীম হবে।
লেখক: প্রখ্যাত ইসলামী গবেষক, আইনবিশারদ এবং মুফতি ও মুহাদ্দিস- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/