– রশীদ জামীল
সাতশ’ কোটি মানবের এই পৃথিবীতে দানবের সংখ্যা কত? এক হাজার? এক লক্ষ? এক কোটিই ধরলাম। তাহলেও তো এই সংখ্যা পৃথিবীবাসীর ওয়ান পার্সেন্টও হয় না। অথচ, গোটা পৃথিবীটাকে অশান্ত করে রেখেছে তারা। তাদের দাপটে দিশেহারা আজ প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য, ইউরোপ থেকে আমেরিকা, আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য।
কেন এমন হচ্ছে? কারণ কী?
কারণ অনুসন্ধানে যাওয়ার আগে ১৩ আগস্ট নিউ ইয়র্কে ঘাতকের গুলিতে ইমাম আলাউদ্দিন এবং তারা উদ্দিন হত্যাকান্ডে শোকার্ত ক্ষোভ জানাই। ইতোমধ্যেই ঘাতককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার ঘরে তল্লাশি চালিয়ে অবৈধ অস্ত্রও উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত ইমামের শরীরে বিদ্ধ গুলির সাথে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের গুলির মিল রয়েছে। অতএব, একথা বলাই যায়, ন্যায় বিচারের স্বার্থে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত ইতোমধ্যেই পুলিশ সংগ্রহ করতে পেরেছে। এখন আইনি প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক গতি কোনো কারণে মন্থর না হলে, অথবা বাদী পক্ষের আইনজীবি মামলা পরিচালনায় অযোগ্যতার প্রমাণ না দিলে, ঘাতকের শাস্তি অনিবার্য।
নিউ ইয়র্ক সিটি মেয়র এবং এনওয়াইপিডিকে ধন্যবাদ। তাঁরা কথা দিয়েছিলেন, ‘দ্রুত সময়ে ঘাতককে গ্রেফতার করা হবে’। কথা রেখেছেন তাঁরা। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই ঘাতক অস্কার মোর্যালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নিউ ইয়র্কাররা এখন আশা করতে ভরসা পাচ্ছেন, বিচার হবে। আর কোনো মুসলমান, শুধু মুসলমানই না, কোনো মানুষের জীবনই আর আততায়ীর ট্রিগারের নিশানা হবে না। হলেও ঘাতক পার পাবে না। সবাই চাইছে, এই দৃষ্টান্তটি স্থাপিত হোক।
[ দুই ]
বিশ্বের মানুষ শান্তি চায়। একজন মানুষও খুঁজে মিলবে না, যে বলতে পারে, ‘আমি শান্তি চাই না’! এমনকি মানুষ হত্যার মাঝে যারা পৈশাচিক আনন্দের অনুসন্ধান করে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলেও বলবে, ‘অশান্তির বিরুদ্ধেই তো আমাদের লড়াই’! এখন সবাই যদি শান্তিই চায়, তবে পৃথিবী জুড়ে এতো অশান্তি কেনো? আজ এখানে বোমা, কাল ওখানে গুলি। আজ এখানে আক্রমণ, তো কাল ওখানে তা-ব! কেনো? গলদ কোথায়? প্রতিকারই-বা কী?
এটাই এখন পৃথিবীর কাছে পৃথিবীর প্রশ্ন। এই একটি মাত্র প্রশ্নের সঠিক জবাবের উপরেই নির্ভর করছে আগামীর পৃথিবীর ভাল থাকা। যদি সঠিক জবাব খুঁজে বের করার প্রতি আগ্রহী হয় বিশ্ব নেতৃত্ব, তাহলেই সম্ভব পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করা। এখানে জবাব খোঁজা মানে সংশোধিত পরিমার্জন বোঝানো হচ্ছে। এটা যেমন প্রতিকার হতে পারে, তেমনি হতে পারে স্বতিকারও। বাড়তি কথাটি এ কারণে বললাম, বোদ্ধাজনেরা জানেন, ‘জবাব তাদের জানাই আছে যাদের জানার কথা’।
[ তিন ]
‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলে কেষ্টা বেটাই চোর’! মুসলমানের হয়েছে রবি ঠাকুরের কেষ্টার অবস্থা। দোষ যেই করুক, দোষ মুসলমানের। বিশ্বের যেখানে সন্ত্রাস সেখানেই মুসলমানকে টেনে আনতে হবে। ঘটনা যেখানেই ঘটুক, দায় মুসলমানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে হবে! এই ডবল স্ট্যান্ডার্ড, বিশ্ব সভ্যতার সূচককে কোথায় নিয়ে নামাবে কেউ জানে না। কিন্তু অনেকেই আন্দাজ করতে চেষ্টা করছেন।
এতে করে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা। সমাধান যদি হয় গাণিতিক হারে, তো সমস্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে! আগে মানুষ জীবনের নিরাপত্তা চাইত, এখন মরণের নিরাপত্তা চায়। আগে চাইত অধিকার, এখন থাকে অজ্ঞাত কারো করুণার কাঙাল হয়ে।
[ চার ]
রসিকম-লে দু’টি কথার প্রচলন আছে। একটি হল, ‘গরিবের বউ গ্রামবাসীর ভাবী’। আর অপরটি হচ্ছে, ‘বোকার সম্পদে বুদ্ধিমানের বারো আনা হক্ব’। কথাগুলো হালকা হলেও ফেলনা নয়। মুসলমান ছিল বিশ্ববিজেতা জাতি। মুসলমান ছিল প্রকৃতির প্রাকৃতিক আধিপত্যের অধিপতি। কিন্তু খাসলতের দোষে এখন তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে অন্যদের দয়ার দিকে।
যতটা না অভাবে, তারচে’ বেশি স্বভাবের কারণে। ‘ভাবী’ মানে গরিবের বউ প্রথম প্রথম গ্রামের কোনো দেবরকেই অসন্তুষ্ট করতে চায় না। এক সময় আর অসন্তুষ্ট করার মতো সুযোগও থাকে না। মুসলিম বিশ্বের নেতা উপনেতা পাতিনেতাগণ প্রথম প্রথম বিশ্ব দেবরদের সন্তুষ্টি আর বিশ্ব ভাসুরদের কুর্নিশ করতে করতে এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন যে, এখন বসে বসে রীতিমতো ভাবসম্প্রসারণ করতে হয়, ‘ইচ্ছা থাকিলেও উপায় হয় না কেনো’?
[ পাঁচ ]
বিশ্ব রাজধানী খ্যাত নিউ ইয়র্কের ওজনপার্কের ঘটনা পৃথিবীর অসহায়ত্বটাকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে! মধ্য-দুপুরের রাস্তায় প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে ফেলা হল দু’জন মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে সম-সাময়িক বিশ্বে এভাবেই মেরে ফেলা হচ্ছে নিরীহ নিরপরাধ মানুষদের। মরার আগে জানতেও পারছে না কেনো মারা হচ্ছে তাদের! পৃথিবীটা কি তবে আস্তে আস্তে সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ নগরীতে পরিণত হতে চলেছে?
নিউ ইয়র্কের এই হত্যাকান্ডের পর আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নিউ ইয়র্কের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মানুষের মনে বাড়ছে ভীতিকর আতংক! সবার মনেই প্রশ্ন, শক্তিশালী নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা নিউ ইয়র্ক নগরীতেই যদি মানুষকে টেরোরিস্টের ভয় নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়, এভাবেই যদি মূল্যহীন হতে থাকে মানুষের জীবন, আর এটা যদি হয় কঠিন কিছুর সহজ সূচনা, তাহলে কী আছে আগামীর কপালে?
সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারানো নিউ ইয়র্কের ইমাম মাওলানা আলাউদ্দিন আখঞ্জি এবং একই মসজিদের মুসল্লি জনাব তারা উদ্দিনকে যেভাবে এবং অসহায়ভাবে হত্যা করা হল, তাতে যে কোনো সাধারণ মানুষেরই আতংকিত হবার কারণ আছে। কোনো মানবের জীবন তো এভাবে দানবের আঘাতে শেষ হতে পারে না। মসজিদের ইমাম বা মুসলিম বলেই কথাগুলো বলছি না। যে কোনো ধর্মের কোনো মানুষকে এভাবে হত্যা করা হলে, আমরা একই কথা বলবো।
[ ছয় ]
সাম্প্রতিক সময়ে উপর্যোপরি অনেকগুলো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ফ্রান্স, টার্কি, পাকিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালানো হয়েছে নারকীয় তা-ব! কোথাও সেগুলো ঘটিয়েছে নামধারী মুসলমান, কোথাও ম্যাকাপ মুসলমান, আবার কোথাও অমুসলিম সন্ত্রাসীরা। কিন্তু ঘটনা যেখানেই ঘটুক, আর যারাই ঘটাক, খেসারত দিতে হচ্ছে মুসলমানকে। সেটা শারীরিকভাবে হোক আর মানষিকভাবেই হোক। অথচ বিশ্বব্যাপী টেরোরিস্ট আক্রমণের বেশিরভাগ শিকার কিন্তু মুসলমানদেরই হতে হচ্ছে। তার মানে, মার খেতে হচ্ছে আবার মাইরের দামও দিতে হচ্ছে।
চলতি বছরের কথাই ধরি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কথাই সামনে রাখি। সন্ত্রাসী যে ঘটনাগুলো ঘটলো, তার অধিকাংশ ভিকটমই ছিল মুসলমান। জানুয়ারিতে ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টারে মুজিবুর রহমান নামের পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মুসলমান শিকার হলেন হেইট ক্রাইমের। এপ্রিলে জ্যমাইকা মুসলিম সেন্টারে যোহরের নামাযের সময় মসজিদে ঢুকে নামাযরত মুসল্লিদের উপর হামলা চালালো কৃষ্ণাঙ্গ এক যুবক। রক্তাক্ত হল মসজিদ। আহত হলেন বেশকিছু মুসল্লি। অবশ্য প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী হামলাকারী ছেলেটি অ্যাবনরম্যাল ছিল। জুনে ব্রঙ্কসের স্টারলিং এভিনিউতে হামলার শিকার হলেন সোহেল চৌধুরি নামের এক যুবক। জুলাইতে ব্রুকলিনে মসজিদের সামনেই দুই মুসলিম কিশোর মারধরের শিকার হল। চলতি আগস্টে ওয়েস্টচেস্টারে হামলার শিকার হলেন আলী হায়দার নামের এক বাংলাদেশি। সর্বশেষ শিকার মাওলানা আখঞ্জি এবং তারা উদ্দিন।
যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্র্যাম্প এবং ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন এখন দিনরাত পার করছেন মাঠে-ময়দানে। মানুষকে আশা আর ভালোবাসার বাণী শোনাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছেন। দু’জনেই চেষ্টা করছেন ভোটারদের আকৃষ্ট করতে। আর এটা করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে বেফাস কথাবার্তাও বলছেন তাদের কেউ। বিশেষতঃ মিস্টার ট্র্যাম্পের বেশ কিছু বক্তব্য শান্তিপ্রিয় আমেরিকানদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। সাম্প্রতিক হেইট ক্রাইমের ঘটনাগুলোর পেছনে ট্র্যাম্পের বক্তব্য দুষ্কৃতকারীদের জন্য উস্কানির খোরাক হচ্ছে কিনা, বিজ্ঞজনেরা ভাবতে শুরু করেছেন। একটি শান্তি ও স্বস্তির সহাবস্থানের জন্য এই অবস্থা তো মোটেও আশাব্যঞ্জক হতে পারে না। অবশ্য প্রথম প্রথম মিস্টার ট্র্যাম্পের অ্যান্টি মুসলিম বক্তব্যকে কেউ কেউ নির্বাচনি স্ট্যান্ডবাজি ভাবছিলেন। কিছুদিন পর দেখাগেল আরো অনেক ব্যাপারেই উনার কথাবার্তা রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভুত। যাহোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
[ সাত ]
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় সমকামী ক্লাবে হামলা চালিয়ে ৫০জনকে হত্যা করল ওমর মতিন নামের একলোক। যে নিজেই ছিল একজন সমকামী। বিশ্ববিবেক নিন্দা করল। নিন্দা করল মুসলমানরাও।
এভাবে মানুষ হত্যার নির্দেশ ইসলামে নেই। কিন্তু যেহেতু ‘ওমর মতিন’ নামটি ছিল মুসলিম, সে কারণে ঘটনাটির পর তার ধর্মকে দোষারোপ করতে শুরু করল বিশ্ব মানবতার ধ্বজাধারগণ। কিন্তু ইমরান ইউসুফ নামের অন্য এক মুসলিম তরুণ যে সে দিন প্রায় ৭০ জনের প্রাণ বাঁচিয়েছিল, সেটা নিয়ে কেউ কিছু বলল না! যারা ওমর মতিনের জন্য তার ধর্মকে গালি দিয়েছিল, তারা কিন্তু ইমরানের জন্য ইমরানের ধর্মকে বাহবা দিল না। এই ঘটনার পর ফ্লোরিডাসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্টেইটে মুসলমানরা হেইট ক্রাইমের শিকার হলেন। কেউ বলল না, মুসলমানরা সন্ত্রাসীদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন!
কোথাও কোনো নামধারী মুসলমান কর্তৃক সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলে সে জন্য গোটা মুসলিম জাতিকে দোষ চাপানো হয়। বলা হয়, ‘দ্যা মুসলিমস আর টেরোরিস্ট’! কিন্তু অন্যধর্মের লোক কর্তৃক সেইম ঘটনা ঘটলে সেটার দায় তার ধর্মের ঘাড়ে চাপানো হয় না! এই ডবল স্ট্যান্ডার্ড সমাধানের ভেতরেই নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করছে কিনা, খতিয়ে দেখার দরকার ছিল।
এই পৃথিবীটা সাতশ’ কোটি মানুষের। গুটি কতেক দানবের নয়। মানুষ চাইলে এই দানবদের রুখে দেয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হল, মানুষ চাইতে রাজি হবে কিনা! তারচে’ও বড় প্রশ্ন; মানুষ কারে কয়?