।। ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ।।
নবুওয়তী ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ মিশন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে পূর্ণতা লাভ করে। তাঁর মিশনের লক্ষ্য ছিল- যুলুমের অবসান ঘটিয়ে মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করা। যে লক্ষ্য নিয়ে তিনি দুনিয়ায় আবির্ভূত হন, ২৩ বছরে প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে তিনি তা কার্যকর করেন সার্থকভাবে। তাঁর উপস্থাপিত জীবনব্যবস্থা মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বদিক দিয়ে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নিয়ামক ও চালিকা শক্তি। পবিত্র কুর’আনের ভাষ্য অনুযায়ী মহান আল্লাহ সব নবী ও রাসূলকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের বিধান এবং তা কার্যকর করার দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন। (সূরা হাদীদ- ২৫) ।
জীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফের গুরুত্ব অপরিহার্য। কারণ, ন্যায়বিচার ছাড়া মানব জীবনের কোন ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না।
আল্লাহ তাআলার নির্দেশনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সমাজে ন্যায়বিচারের মানদ- সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। জাতি-ধর্ম, বর্ণ-শ্রেণি, পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, ধনী-গরিব, প্রভু-ভৃত্য সবার ক্ষেত্রে বিচার সমান, এখানে বিন্দুমাত্র হেরফেরের অবকাশ ছিল না। দয়া বা পক্ষপাতিত্ব আল্লাহ্র বিধান কার্যকরকরণে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। হযরত ‘আয়েশা (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর নিজস্ব ব্যাপারে কারও নিকট হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি (হাফিয আবূ শায়খ ইস্ফাহানী, আখলাকুন্ নবী (সা.), পৃ. ১৯)।
একদা কুরাইশ বংশীয় মাখযুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়লে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তার হাত কাটার নির্দেশ দেন। আভিজাত্য ও বংশ মর্যাদার উল্লেখ করে সে মহিলার শাস্তি লাঘবের জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর নিকট তাঁর একান্ত স্নেহভাজন উসামা ইব্ন যায়দ (রাযি.) সুপারিশ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে বলেন, তুমি কি আল্লাহ্র দ-বিধির ব্যাপারে সুপারিশ করছ? অতঃপর লোকজনকে আহ্বান করে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন-
“হে মানবম-লী! নিশ্চয় তোমাদের পূর্ববর্তী জনগণ পথভ্রষ্ট হয়েছে। এ জন্য যে তাদের কোন সম্মানিত লোক চুরি করলে তখন তারা তাকে রেহাই দিত। আর যখন কোন দুর্বল লোক চুরি করত তখন তারা তার উপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহ্র কসম! মুহাম্মদ এর কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করে, তবে অবশ্যই তাঁর হস্ত কর্তন করে দিতাম’। (বুখারী ও মুসলিম, সূত্র- মিশকাত, পৃ. ৩১৪)।
এইভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সমাজে ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি তাঁর পরিচালিত সমাজ ও রাষ্ট্রে সুবিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে কতখানি যতœবান ছিলেন উপরিউক্ত ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যায়বিচার অপরিহার্য পূর্বশর্ত। অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদান সুবিচার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। একতরফা রায় বিচারকে প্রহসনে পরিণত করে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হযরত ‘আলী (রাযি.)-কে ইয়ামানের বিচারক নিয়োগের সময় নিম্নোক্ত পরামর্শ দেন-
“যখন তোমার সামনে বাদী-বিবাদী উপস্থিত হয়ে বিচার প্রার্থনা করবে তখন তুমি দ্বিতীয় পক্ষের মতামত না শুনে প্রথম পক্ষের অনুকূলে রায় ঘোষণা করবে না। কেননা, দ্বিতীয় পক্ষের বক্তব্য তোমাকে মামলার প্রকৃতি উপলব্ধিতে ও সঠিক রায় দানে সাহায্য করবে”। (বায়হাকী, সূত্র- মিশকাত, পৃ. ১৯৯)।
মানবজীবনের গতিধারা বিশ্লেষণ করলে প্রমাণিত হয় যে, মানুষের সামাজিক জীবনে ন্যায়বিচার ও ইনসাফের প্রয়োজন অপরিহার্য। এটা ছাড়া সমাজ টিকে থাকতে পারে না। সামাজিক জীবনকে নির্বিঘ্ন, নিরুপদ্রব ও স্বচ্ছন্দ করে তুলতে ন্যায়বিচার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেবল অঢেল বিত্ত ও বৈভব মানুষকে শান্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারে না, যদি সেখানে ন্যায় ইনসাফ ও সুবিচারের ব্যবস্থা না থাকে। অপর দিকে বিত্তের প্রাচুর্য ও সম্পদের পাহাড় না থাকলেও কেবল ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থার কারণে যেকোন সমাজে শান্তি, স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। (মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, অর্থনৈতিক সুবিচার ও হযরত মুহাম্মদ, পৃ-০৯)।
সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য পবিত্র কুরআন, হাদীস ও সাহাবাদের ঐকমত্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা বাঞ্চনীয়। পক্ষপাতিত্ব, যুলুম ও অজ্ঞতা বিচার ব্যবস্থাকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ইজতেহাদ করে বিচার করে এবং তাঁর ইজতেহাদ যদি সঠিক হয় তা হলে তাঁর জন্য দু’টি পুরস্কার। আর ইজতেহাদে ভুল হলে একটি পুরস্কার। বিচারক তিন প্রকার। তন্মধ্যে দু’ প্রকার জাহান্নামী এবং একপ্রকার জান্নাতী। যে ব্যক্তি হক জেনে তার দ্বারা ফায়সালা করে সে জান্নাতী। যে ব্যক্তি অজ্ঞতাবশত ফায়সালা করে- সে জাহান্নামী এবং যে ব্যক্তি বিচারের ক্ষেত্রে যুলুম করে, সেও জাহান্নামী। (ইব্ন মাজাহ, সুনান, ২খ., পৃ. ৩৪১-৩৪২)।
সামাজিক জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বেশ কয়েকটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমত তিনি অর্থ সম্পদ অর্জন, সঞ্চয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনার প্রয়াস চালান। সমকালীন দুনিয়া বিশেষত প্রাক ইসলামী সমাজে ধন সম্পদ ছিল আভিজাত্যের মাপকাঠি, কামিয়াবীর নিদর্শন, শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। তাই মানুষ হন্য হয়ে অর্থ ও সম্পদ অর্জনের পেছনে ছুটেছে সারা জীবন। বৈধ-অবৈধ, হালাল-হারাম, ন্যায়-নীতি, পাপ-পুণ্য এ সব ধার ধারেনি। এভাবে মানুষ হয়েছে অর্থ সম্পদের দাস আর অর্থ সম্পদ হয়েছে তাদের প্রভূ। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের লক্ষ্যে ওহীনির্ভর যে দর্শন পেশ করেন তা হল মানব জীবনে অর্থ-সম্পদ অপরিহার্য। জীবন ও জীবিকার তাগিদে অর্থ-সম্পদ অর্জন করতে হয়, কাজে লাগাতে হয়, কিন্তু তা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। অর্থ ও ধন সম্পদসহ দুনিয়ার সব কিছুই মানুষের সেবক ও খাদেম। পৃথিবীর বস্তুনিচয় মানুষের জন্য সৃষ্টি। (সূরা আল বাকারা- ২৯)।
মানুষ ও মানুষের সব কর্মকা- কেবল আল্লাহ্র জন্য এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিবেদিত। সুতরাং অর্থ-সম্পদ অর্জন, সঞ্চয় ও ব্যয় করতে হবে আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে। এতেই নিহিত আছে মানুষের মুক্তি ও কামিয়াবী।
সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) জনগণকে নীতি ও বিধিসম্মতভাবে অর্থ-সম্পদ অর্জন করার এবং যাকাত ও সাদ্কার মাধ্যমে সে অর্জিত সম্পদের কিয়দংশ দুঃখী ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের নির্দেশ দেন। অধিকন্তু রাষ্ট্রের আর্থিক সম্পদে জনগণের অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য তিনি ছয় প্রকার রাজস্ব প্রবর্তন করেন। এগুলো হল ১.আল-গণিমাহ্ বা যুদ্ধলব্ধ সম্পত্তি, ২. যাকাত বা ধনীদের দেয়া দরিদ্র কর, ৩. খারাজ বা অমুসলিম কৃষকদের ভূমি কর, ৪. জিযিয়া বা অমুসলিমদের নিরাপত্তা কর, ৫. আল-ফে বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, ৬. সদাকা বা স্বেচ্ছাধীন দান।
এসব খাতে সংগৃহীত রাজস্ব নির্ধারিত হারে জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হত। এ ব্যবস্থা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মদীনা জীবনে এবং পরবর্তীতে খুলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলে জনগণের সামাজিক জীবনে আশানুরূপ সুফল বয়ে আনে। অভাব দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর উক্ত পদক্ষেপ ছিল যুগান্তকারী। স্বাচ্ছন্দ্য এমন অবস্থায় পৌঁছেছিল যে, যাকাত গ্রহণের জন্য কোন দুঃস্থ পাওয়া যায়নি। জাস্টিস সায়্যিদ আমীর আলী তার বিখ্যাত গ্রন্থ “দি স্পিরিট অব ইসলাম”- এ লিখেন, “ইসলামের পূর্বে পৃথিবীর কোন ধর্মই ধর্মীয় ব্যবস্থার মধ্যে সরাসরি আইন প্রণয়ন করে যাকাত প্রদান, বিধবাদের রক্ষণাবেক্ষণ, ইয়াতীম ও নিঃসম্বলদের লালনকে পবিত্র করেনি। প্রাথমিক পর্যায়ে খ্রিষ্টানদের মধ্যে দানোৎসব ব্যক্তির ইচ্ছার উপর নির্ভর করত”। (জাস্টিস সৈয়দ আমীর আলী, দি স্পিরিট অব ইসলাম, পৃ. ২৫৭)।
সামাজিক ন্যায়বিচার ও ইনসাফ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে মহানবী (সা.) আল্লাহ তাআলার নির্দেশ অনুযায়ী ঘোষণা দেন যে, মূলত সম্পদের মালিকানা নিরঙ্কুশভাবে আল্লাহ্র। মানুষ ভোগ-দখলের অধিকারী মাত্র। আবার ভোগ-দখলের ক্ষেত্রে তার নিজের সাথে সমাজের অপরাপর দুঃস্থ ও বঞ্চিত সদস্যরাও শরীক। যাকাত ছাড়াও ধনীদের সম্পদে গরিবের অধিকার বা হক রয়েছে।
‘হক’ বা অধিকার শব্দের দ্বারা সমাজের ধনী-দরিদ্রের পারস্পরিক সহমর্মিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণ ও সুষম বণ্টনের এমন এক সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন যাতে সম্পদ শুধু সমাজের ধনাঢ্যদের মাঝে আবর্তিত হতে না পারে। ধনী আরও ধনী, গরিব আরও গরিব হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, যেসব ধনকুবের অর্থ সম্পদ সঞ্চিত করে দুঃখী মানুষের কল্যাণে ব্যয় করে না, কিয়ামতের দিন এসব ধনরাশি তার শাস্তির উপকরণ হয়ে দাঁড়াবে।
আরও পড়তে পারেন-
- পাশ্চাত্য শিক্ষা বনাম কওমী শিক্ষা
- করোনা মহামারি ও আমাদের করণীয়
- জান্নাত পেতে চাইলে শিরকমুক্ত নেক আমল করতে হবে
- দুর্দিন ও দুঃসময়ে নবী জীবন থেকে সান্ত্বনা
- ইসলামে সংশয়প্রবণতা এবং সংক্রামক রোগ
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলেন। বংশ কৌলীন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজবন্ধন সুদৃঢ় করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, আরবের উপর অনারবের, অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সব মানুষ একে অপরের ভাই। সব মানুষ আদমের বংশধর আর আদম মাটি হতে তৈরি। (আহমদ ইব্ন হাম্বল, মুসনাদ, ৫খ., পৃ. ৪১১; জাহিয, আল বয়ান ওয়াত তিবঈন, ২খ., পৃ. ৩৩)।
“তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যার মধ্যে খোদাভীতি প্রবল”। তাঁর এ ঘোষণা ছিল তৎকালীন সমাজের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ও দ্রোহ। কারণ, বংশকৌলিন্য ও রক্তের মর্যাদা ছিল সামাজিক আভিজাত্যের ভিত্তি। তিনি ঈমানদারদের সুভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সুদৃঢ় করে এক অখ- দেহসত্তায় পরিণত করেন। তিনি বলেন- “সকল মু’মিন এক মানব দেহের মত, যদি তার চোখ অসুস্থ হয় তখন তার সর্বাঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর যদি তাঁর মাথা ব্যথা হয় তখন তার পুরো দেহই ব্যথিত হয়”। (মিশকাতুল মাসাবীহ, ৯খ., পৃ. ১২৮)।
এই পৃথিবীতে সব মানুষই যে আল্লাহ্র দৃষ্টিতে সমান, কৃষ্ণ-শ্বেত, ধনী-নির্ধন সকলই যে আল্লাহ্র সৃষ্ট মানুষ, সব মানুষই যে পরস্পর ভাই ভাই, ধর্মীয় ও কর্মীয় অধিকার যে সব মানুষেরই সমান-এ কথা বলিষ্ট কণ্ঠে ঘোষণা করেন এবং স্বীয় কর্মে ও আচরণে প্রমাণ করেন ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনিই সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন মানুষের মুক্তিবাণী। সারা জীবনের সাধনায় তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন এমন এক সমাজ, যে সমাজে মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়, ব্যক্তি ও জাতি-গোত্র পায় পূর্ণ স্বাধীনতার আস্বাদন। মানুষ সমাজের বুকে মানুষ রূপে শির উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ লাভ করে। মানব জাতির প্রতি ইসলামের বৈপ্লবিক অবদানের মধ্যে মানুষের প্রতি ন্যায়বিচারই হল অন্যতম (ব্যারিস্টার এস.এ সিদ্দিকী, ন্যায়বিচার, ব্যক্তি ও ধর্মীয় স্বাধীনতায় ইসলামের বৈপ্লবিক অবদান, পৃ. ক,ঙ)।
সমাজ জীবনে মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তাই পারস্পরিক সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব, সমঝোতা প্রভৃতি সদাচরণ সমাজে অন্যায় ও যুলুমের অবসান ঘটায় এবং ক্রমান্বয়ে মানবসভ্যতাকে গতিশীল করে তোলে। তাই দেখা যায় মানুষ যখন পারস্পরিক সমঝোতা ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে অখ- ভ্রাতৃসমাজ গঠন করেছে তখন তাঁরা অগ্রগতি ও শান্তির উচ্চমার্গে পৌঁছে গেছে। আর যখনই বিভেদ মাথাচাড়া দিয়া উঠেছে তখন পতন হয়েছে অনিবার্য পরিণতি। ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরা এইরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্তে ভরা। সমাজের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক দয়া, সৌহার্দ্য ও সৌজন্য সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। সহমর্মিতাসুলভ গুণাবলী মানুষকে একে অপরের নিকটে নিয়ে আসে। হিংসা-বিদ্বেষ বিভেদের বীজ বপিত করে। যার ফলশ্রুতিতে সামাজিক সংহতি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়ে যায়। তিনি এমন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন যার ভিত্তি ছিল পারস্পরিক সম্মানবোধ, ন্যায়বিচার ও মানবিকতাবোধ (আল হায়সামী, কাশফুল আসতার, ২খ., পৃ. ৩৫)।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) শতাব্দীর এমন এক ক্রান্তিকালে নুতন সমাজ গড়ার প্রয়াসী হন যখন গোটা দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজে বর্ণপ্রথা, বর্ণবৈষম্য, বংশ কৌলীন্য ও আভিজাত্যের দম্ভ মানুষকে গৃহপালিত জন্তু অথবা বিশেষ বৃক্ষের চেয়ে হীন পর্যায়ে নিয়ে আসে। জন্তুবিশেষ ও বৃক্ষবিশেষকে পবিত্র জ্ঞানে অর্চনা করা হত তখন। সাধারণ মানুষের তুলনায় এসব জন্তু-বস্তুর মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মানুষের মনন ও মানসিকতায় এ কথা চিত্রায়িত করতে সক্ষম হন যে, সৃষ্টিজগতে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান, সম্মানের যোগ্য ও ভালবাসার পাত্র হল মানুষ (সায়্যিদ আবুল হাসান ‘আলী নদভী, নবীয়ে রহমত, ২খ., পৃ. ২২০)।
মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। দুনিয়ার সবকিছু মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। মানুষ জগতের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। আল কুরআনের ভাষায়- “নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে উহাদের চলাচলের বাহন করে দিয়েছি; তাদেরকে উত্তম রিয্ক দান করেছি এবং আমি যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর তাদের (মানবজাতি) শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি”। ( সূরা বনী ইসরাঈল, ৭০ আয়াত)।
এর চেয়ে অধিকতর সম্মান ও মর্যাদা মানুষের জন্য আর কী হতে পারে? আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে এ বিরাট স্বীকৃতি মানুষকে পৃথিবীর অপরাপর বস্তুনিচয়ের উপর সম্মানের উচ্চ মর্যাদায় আসীন করে। এ কারণে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) গুরুত্ব সহকারে বলেন- “সমস্ত সৃষ্টিজগত (মাখলূক) আল্লাহ তাআলার পরিবার। সুতরাং মাখলুকের মধ্যে আল্লাহ তাআলার নিকট সে-ই সর্বাপেক্ষা প্রিয়, যে আল্লাহর পরিবারের সঙ্গে ন্যায় আচরণ করে”। (মিশকাতুল মাসাবীহ, ৯খ., পৃ. ১৪১)।
মানবতার উচ্চমর্যাদা, আল্লাহর নৈকট্য ও সৃষ্টজগতের প্রতি ন্যায়পূর্ণ আচরণের গুরুত্ব প্রকাশের জন্য এর চেয়ে আর কী সুন্দর ভাষা হতে পারে?
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মদীনায় ইনসাফপূর্ণ যে সমাজ কায়েম করেন তার ভিত্তি ছিল নৈতিকতা ও মানবজাতির সার্বজনীনতা। মানুষ যদি রিপুর তাড়নার নিকট পরাভূত হয় তাহলে সুস্থ সমাজের বিকাশধারায় সে কোন তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারে না। মনুষ্যত্বের উজ্জীবন, চারিত্রিক, উৎকর্ষ ও নৈতিক উপলব্ধি সুস্থ সমাজ বিকাশের সহায়ক আর ইন্দ্রিয়জাত প্রবণতা, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ, অনিষ্টকর প্রথা সমাজের সুস্থতার ভিত্তিমূলকে একেবারে নড়বড়ে করে দেয়, জন্ম হয় যুলুম ও না-ইনসাফীর। এই উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) জুয়া খেলা, মদ্যপান, নেশাগ্রহণ, কুসীদপ্রথা, যিনা-সমকামিতা ও অহেতুক রক্তপাত নিষিদ্ধ করে দেন। (জালালউদ্দীন সায়ূতী, দুর আল মানসুর, ১খ., পৃ. ৩৯১; ইব্ন কাসীর, সিরাতুন নববিয়াহ, ৪খ, ১৯৭৮, পৃ.৩৯২)।
ফলে সমাজবিরোধী কার্যকলাপের ভয়াবহতার হাত হতে মানুষ রেহাই পায়। উল্লেখ্য যে, মদ্যপান, জুয়া যাবতীয় অমার্জিত, নীচ স্বভাবের অনিষ্ট কার্যকলাপ ও সব ধরনের আতিশয্য হল খ্রিষ্ট-ইয়াহুদী ও পৌত্তলিক সমাজের অভিশাপ। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল সভ্যতার অভিশাপ হতে মানুষকে মুক্তি দিয়ে ধর্ম নিয়ন্ত্রিত ও মানবিকতায় উজ্জীবিত নতুন সমাজের গোড়াপত্তন। বিশ্ব মানবতার প্রতি এটা মহান রাসুলের ইহসান।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা ছিল যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক। মদীনায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত সমাজ কাঠামোতে যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিল পৃথিবীর অন্য কোন সমাজে তার নযীর পাওয়া মুশকিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)এর শিক্ষা ও আদর্শের অনুসরণে খুলাফায়ে রাশিদীন যে সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেন তা ছিল পুরোপুরি সুবিচার ও ইনসাফনির্ভর। মানুষের প্রতি ন্যায়বিচারের যে নযীর ইসলামের মহান রাসূল (সা.) দুনিয়ার বুকে স্থাপন করে গেছেন, তার আলোক শিখা এখনও পৃথিবীতে অনির্বাণ।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক।
ইমেইল- drkhalid09@gmail.com
মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/