বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও নানাস্তরে আদর্শিক মতপার্থক্য ও দ্বন্দ্ব দেখাগেলেও ধর্মীয় সহাবস্থান বজায় রেখে চলার পক্ষে সুস্পষ্টভাবে জাতীয় ঐক্য ও অভিন্ন অবস্থান রয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হোক, এটা কেউ চায় না। বাংলাদেশ বৃহৎ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হওয়া সত্ত্বেও এই দেশের কোন মুসলিম ধর্মীয় নেতা, আলেম-উলামা, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা সংখ্যালঘুদের সাথে মুসলমানদের সামাজিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়, এমন বক্তব্য কখনোই দেন না। বরং সকলেই সবসময় সামাজিক সহাবস্থান ও সম্প্রীতির পক্ষে কথা বলেন, উৎসাহিত করেন। দেশের মাদ্রাসাসমূহের পাঠ্যক্রমে এবং মসজিদে ও ওয়াজ-মাহফিলে সবসময় সামাজিক সহাবস্থানের ইতিবাচক তাৎপর্য ও গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। এ ধরনের সুন্দর দৃষ্টান্ত বিশ্বের বহু দেশে দেখা যায় না।
কিন্তু সংখ্যালঘুদের প্রতি বাংলাদেশের আলেম-উলামা ও মুসলমানদের এমন যত্নপূর্ণ সহযোগী মনোভাব সত্ত্বেও রহস্যজনকভাবে সময়ে সময়ে আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল (সা.) ও ইসলামের বিরুদ্ধে অবমাননা ঘটিয়ে বাংলাদেশের বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উস্কানী সৃষ্টি করে বাংলাদেশের সুন্দর সামাজিক অবস্থানকে নস্যাৎ ও গোলযোগ সৃষ্টির একটা অপপ্রয়াস দেখা যায়।
এমনই এক ঘটনায় সম্প্রতি নড়াইলের লোহাগড়ায় এক হিন্দু যুবকের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর বিরুদ্ধে কটূক্তিমূলক পোস্ট দেয়ার অভিযোগ ওঠে। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সেখানে উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে গত ১৫ জুলাই শুক্রবার রাতে হঠাৎ করে বহিরাগত অচেনা একদল লোক হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এলাকার লোকজন হামলাকারীদের চেনে না বলে জানায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় নড়াইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেছেন, ‘যারা হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলার চেষ্টা করেছেন, তারা অধিকাংশই বাইরের লোক। তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন মনে হয়েছে। তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে’। এ ছাড়া অভিযুক্ত আকাশ সাহা নামের পলাতক সেই যুবককে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়েছে পুলিশ।
এটি হলো নড়াইলে একই ধরনের দ্বিতীয় ঘটনা। এর আগে গত ১৮ জুন সদর উপজেলার ইউনাইটেড কলেজের ছাত্র রাহুল দেব রায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে কটাক্ষকারী ভারতের নূপুর শর্মার বক্তব্যকে সমর্থন করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়। ওই ফেসবুক পোস্টেরও ব্যাপক প্রতিবাদ হয় এবং এটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একটা চিহ্নিত গোষ্ঠিকে বাংলাদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচারণায় সরব হয়ে ওঠতে দেখা যায়। নূপুর শর্মা কা-ে যেসময় ভারতের হিন্দুত্ববাদি বিজেপি সরকার কোণঠাসা, তখন বাংলাদেশের মতো বৃহৎ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে একের পর এক ইসলাম অবমাননার ঘটনা গভীর রহস্যজনক।
আরও পড়তে পারেন-
- নূপুর শর্মা, হেট স্পিচ ও বাকস্বাধীনতা
- রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সাথে হযরত আয়েশা (রাযি.)এর সংসার ও দাম্পত্য জীবন
- প্রাকৃতিক দুর্যোগঃ ইসলাম কী বলে?
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
মতলববাজদের মতলব যাই থাকুক, ওই দুই হিন্দু তরুণের বুঝা উচিত ছিল, মহানবী (সা.)কে নিয়ে কুৎসা-কটাক্ষ করে আজ পর্যন্ত কেউ পার পায়নি। ভারতকে পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে হয়েছে। এর ফলাফল বা পরিণাম কী হতে পারে, তা আন্দাজে থাকলে তারা কখনো এটা করার সাহস পেতো না।
এটা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন যে, এ দেশের সরকার ও জনগণ সব সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে। এ পর্যায়ে দেশবাসীর স্বাভাবিক প্রত্যাশা যে, সব ধর্মের মানুষ সামাজিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে ও শান্তিতে বসবাস করবে। কেউ কোনো দিক দিয়ে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত দিলে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সম্প্রতি যারা নড়াইলের দুই ঘটনাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কোন আধিপত্যবাদি বা মুসলিমবিদ্বেষী বৈরিশক্তির হাতে একটা অজুহাত তুলে দিতে চেষ্টা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং সামাজিক সুন্দর সহাবস্থানকে নিরাপদ রাখতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের এসব চক্রান্ত শক্তহাতে দমন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের কর্তব্য- সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে নিবিড় তদন্তের মাধ্যমে এসব ষড়যন্ত্রকারীকে সমূলে উৎখাত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। সংখ্যালঘুদের উপর যে কোন সহিংসতা ও হামলা চালিয়ে তার দায় ও কালিমা আলেম-উলামা ও মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়ার হীন রাজনৈতিক ও আধিপত্যবাদি কৌশল যাতে কেউ বাস্তবায়ন করতে না পারে, সে বিষয়ে সার্বক্ষণিক আমাদের সকলকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা অপরাপর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে পূর্ণ সহযোগিতা করা, তাদের যে কোন প্রয়োজনে সহযোগিতা নিয়ে পাশে দাঁড়ানোকে নিজেদের কর্তব্য বিবেচনা করে। এ পর্যায়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব হচ্ছে, তাদের কারো কোন আচরণে যাতে মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অবমাননা ও উস্কানী না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা। ইসলাম ও মুসলমানদেরকে বাদ দিয়ে মন্দির ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকার মাপকাঠি; এমন একচোখা মানসিকতা সর্বাবস্থায় পরিত্যাগ করতে হবে। ‘ইসলাম অবমাননায় সবাই চুপচাপ থাকো- না হয় সাম্প্রদায়িকতা নষ্ট হবে। আর মন্দিরে আঁচড় কাটলে সেটাকে দ্রুত প্রচার করো এবং আন্তর্জাতিকিকরণ করো’, এটা তো ন্যায্যতা নয়। শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে সকলকেই মিলেমিশে কাজ করতে হবে।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/