সালাতে মোবাইল রিংটোন: আদাব ও মাসাইল

।। মুফতি ফরীদুল হক ।।

মসজিদ আল্লাহ তাআলার পবিত্র ঘর। মুসলমানদের ইবাদতের উৎকৃষ্ট স্থান। পৃথিবীর বুকে সর্বোচ্চ সম্মানিত ও

সর্বোত্তম জায়গা। হাদীস শরীফে আছে, হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন: পৃথিবীর বুকে আল্লাহ তাআলার নিকট প্রিয়তম স্থান হলো মসজিদ। আর নিকৃষ্টতম স্থান হলো বাজার। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ৬৭১)।

নবী কারীম (সা.) নিজেও মসজিদের আদব ও সম্মানের প্রতি খুব বেশি যতœবান থাকতেন এবং সাহাবায়ে কেরামদেরকেও তার আদব ও সম্মান রক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। সুতরাং, মসজিদের সম্মান বজায় রাখা প্রত্যেক মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য।

মসজিদের যেসব গুরুত্বপূর্ণ আদব রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো মসজিদে শোরগোল না করা। হাদীস শরীফে আছে-

عن عبد الله بن مسعود -رضي الله تعالى عنهما- قال قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم- ليلني منكم أولوا الأحلام والنهي ثم الذين يلونهم ثلاثا، وإياكم وهيشات الأسواق

হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী (সা.) বলেছেন- তোমাদের মধ্যেকার বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তিরা যেন নামাযে আমার নিকটে দাঁড়ায়। অতঃপর পর্যায়ক্রমে যারা বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতায় তাদের নিকটতম লোকেরা দাঁড়াবে। একথা তিনবার বললেন। অতঃপর বললেন- তোমরা মসজিদে বাজারের ন্যায় শোরগোল করা থেকে বেঁচে থাকো। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: ৪৩২) হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহ., ১১৭৬ হি.) তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ “হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ” -এ লিখেন-

্রآداب المسجد: …ومنها الاحتراز عن تشويش العباد وهيشات الأسواق

‘মসজিদের আদব সমূহের মধ্যে অন্যতম আদব হলো- ইবাদতে মশগুল ব্যক্তিদের ইবাদতে বিঘœতা ঘটানো থেকে বিরত থাকা এবং শোরগোল থেকে বিরত থাকা’। (২/২৬, দারু ইবনি কাছীর)।

আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপূরী (রহ.) ‘রহমাতুল্লাহিল ওয়াসিআ’ কিতাবে লিখেন- “মসজিদ সম্পর্কে তৃতীয় মৌলিক আলোচনা হলো- মসজিদে এমন কোনো কাজ না করা উচিত যার কারণে ইবাদতে মশগুল ব্যক্তিদের অন্তর বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং মসজিদে বাজারের মতো শোরগোলও করা উচিত নয়। হাদীস শরীফে আছে, হযরত জাবের (রাযি.) বলেন- এক ব্যক্তি খোলা তীর নিয়ে মসজিদে গেলে নবী কারীম (সা.) তাকে বললেন, এর থেকে তীরটা নিয়ে নাও। যাতে কারো গায়ে লেগে না যায়। প্রকাশ থাকে যে, কেউ যদি খোলা ছুরি, তীর-ধনুক ইত্যাদি নিয়ে মসজিদে উপস্থিত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই ইবাদতে মশগুল সকলে পেরেশান হয়ে যাবে এবং এই আশঙ্কায় থাকবে যে আমার গায়ে না লেগে যায়”। (৩/৩৪৭, মাকতাবায়ে হিজায)।

অতএব ইবাদতে মশগুল ব্যক্তিদের অন্তরে বিঘœতা সৃষ্টি হয় এজাতীয় সকল কাজ থেকে বিরত থাকা কাম্য। বলাবাহুল্য যে, বর্তমানে নামাযে মনোযোগ নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, নামায অবস্থায় রিংটোন বেজে ওঠা। তাই এবিষয়ে আমাদের করণীয় কী -তা জেনে নেয়া অত্যন্ত জরুরি।

প্রত্যেক মুসল্লির জন্য মসজিদে প্রবেশের পূর্বেই মোবাইল ফোন বন্ধ করা অতীব জরুরী। মসজিদে হঠাৎ কারো ফোন বেজে উঠলে শোরগোলের মতো আওয়াজ হয়, যা আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে প্রতিনিয়তই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ জন্য মসজিদে প্রবেশের পূর্বে প্রত্যেকের খুবই সতর্কতা ও সচেতনতার সাথে মোবাইলের রিংটোন বন্ধ করা উচিত।

কেউ যদি ভুলে মোবাইলের রিংটোন বন্ধ না করে জামাতে শরীক হয় এবং নামাযরত অবস্থায় রিংটোন বেজে উঠে, তাহলে সাথে সাথে রিংটোন বন্ধ করা উচিত। যাতে অন্যান্য মুসল্লিদের নামাযে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। কেননা, প্রত্যেক মুসল্লির জন্য এমন সকল বিষয় থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য, যা নামাযের একাগ্রতায় বিঘœতা সৃষ্টি করে। অসংখ্য হাদীস শরীফেও এ জাতীয় কর্মের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে, যা নামাযের একাগ্রতা নষ্ট করে। যেমন-

* নামাযরত অবস্থায় অতীব প্রয়োজন ছাড়া এদিক ওদিক তাকানোর ব্যাপারে হাদীস শরীফে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। হাদীস শরীফে আছে-

عن أنس -رضي الله تعالى عنه- قال قال لي رسول الله صلى الله عليه وسلم: يا بني إياك والالتفات فإن الالتفات في الصلاة هلكة، فان كان لا بد ففي التطوع لا في الفريضة.

“হযরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী (সা.) আমাকে বলেছেন: বেটা! নামাযে এদিক সেদিক তাকানো হতে বিরত থাক, কেননা নামাযে এদিক-সেদিক তাকানো ধ্বংসের কারণ। যদি কোনো কারণে অনন্যোপায় হয়ে তাকাতেই হয়, তাহলে নফল নামাযে তাকাতে পারবে ফরজ নামাযে নয়।” (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং- ৫৮৯)।

এভাবে নামাযরত অবস্থায় বিনা প্রয়োজনে শরীরের কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বা কাপড় চোপড় নড়াচড়া করার ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আল্লামা ইরাকী (রহ.) বর্ণনা করেন-

وقد روي أن رسول الله صلى الله عليه وسلم رأى رجلا يعبث في الصلاة، فقال: لو خشع قلب هذا لخشعت جوارحه.

নবী কারীম (সা.) থেকে বর্ণিত, তিনি এক ব্যক্তিকে নামাযে খেলা করতে দেখে বলেন, এই লোকটার অন্তরে যদি একাগ্রতা থাকত তাহলে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাঝে স্থিরতা দেখা যেত। (অর্থাৎ, সে নামাযে খেলা করত না, বরং একাগ্রতার সহিত শান্ত চিত্তে নামায আদায় করত)। (তাখরীজুল ইহইয়া- ১/২০৫)।

“আল ফিকহুল হানাফী ফি ছাওবিহীল জাদীদ” নামক কিতাবে আছে-

لأنه مخل بحال الخشوع. من مكروهات الصلاة: العبث بالثوب أو بالبدن لغير غرض شرعي

যে সমস্ত কাজ নামাযে করা মাকরূহ তন্মধ্যে একটি হলো- শরঈ প্রয়োজন ব্যতীত অযথা শরীরের কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বা কাপড় চোপড় নড়াচড়া করা। কেননা, তা নামাযের একাগ্রতায় বিঘœ সৃষ্টি করে। (দারুল কলম- ১/২৩০) ইবনে কুদামা আল মাকদিসী (রহ., ৬২০হি.) ‘আল মুগনী’ নামক কিতাবে লিখেন- “নামাযে কোন কিছু নিয়ে খেলা করা (তথা কাপড় চোপড় বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অহেতুক নড়াচড়া করা) কিংবা এমন কোন কাজে লিপ্ত হওয়া যা নামাযে ব্যাঘাত ঘটায় এবং নামাযী ব্যক্তির একাগ্রতা ও ধ্যান-মগ্নতা নষ্ট করে, সে সকল কাজ করা মাকরূহ। নবী কারীম (সা.) থেকে বর্ণিত, তিনি এক ব্যক্তিকে নামাযে খেলা করতে দেখে বলেন, এই লোকটার অন্তরে যদি একাগ্রতা থাকত তাহলে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাঝে স্থিরতা দেখা যেত। (অর্থাৎ, সে নামাযে খেলা করত না, বরং একাগ্রতার সহিত শান্ত চিত্তে নামায আদায় করত)। (আল মুগনী, ২/১৯২, দারুল হাদীস)।

অনেকে মনে করেন যে, নামাযরত অবস্থায় রিংটোন বন্ধ করলে নামায ভেঙে যাবে অথবা গুনাহ হবে। অথচ এটা একটা ভুল ধারণা] বাস্তবতা হলো এর বিপরীত। জামাতে নামায চলাকালীন মোবাইলের রিংটোন যদি বেজে ওঠে তখন সাথে সাথে রিংটোন বন্ধ করা উচিত। অন্যথায় কয়েক ধরনের সমস্যা পরিলক্ষিত হয়, যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

ক, মসজিদে শোরগোল সৃষ্টি হয়; অথচ মসজিদে শোরগোল করা নিষেধ।

খ, মুসল্লিদের নামাযে ব্যাঘাত ঘটে। বিশেষত মোবাইল যদি ইমাম সাহেবের নিকটবর্তী স্থানে হয় তখন ইমাম সাহেবের কেরাত পড়তে সমস্যা হয়।

গ, মুসল্লিরা কষ্ট পায়। অথচ কাউকে কষ্ট দেয়া হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন-

والذين يؤذون المؤمنين والمؤمنات بغير ما اكتسبوا فقد احتملوا بهتانا وإثما مبينا.

“যারা বিনা অপরাধে মুসলিম নর নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে”। (সূরা আহযাব- ৫৮)।

আরও পড়তে পারেন-

আল্লামা মুফতী শফী (রহ.) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “মাআরিফুল কোরআন” এ উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-

কোন মুসলমানকে শরয়ী কোন কারণ ব্যতীত কষ্ট দেয়া হারাম। উল্লিখিত আয়াত থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, কোন মুসলমানকে শরয়ী কোন কারণ ব্যতীত কোন প্রকারের দুঃখ-কষ্ট দেয়া হারাম। নবী কারীম (সা.) বলেন- প্রকৃত মুসলমান সে, যার হাত এবং জিহ্বা থেকে সমস্ত মুসলমান নিরাপদ থাকবে, কোন ধরনের কষ্ট পাবে না। এবং ওই ব্যক্তি প্রকৃত ঈমানদার যার থেকে সমস্ত মানুষের জান ও মাল নিরাপদ থাকে। (ফরীদ বুক ডিপু- ৬/২৯৫)।

সুতরাং, প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য অপর ভাইকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা।

ঘ, নামাযী ব্যক্তির একাগ্রতা ও ধ্যান মগ্নতায় ব্যাঘাত ঘটে, অথচ নামাযের রূহ হলো খুশু। মূলতঃ “খুশু”র মূল বিষয় হলো “স্থিরতা। দিলের স্থিরতা হলো: ইচ্ছাকৃতভাবে দিলে আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য

কোন কিছুর ধ্যান-খেয়াল না করা। আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্থিরতা হলো- অনর্থক অপ্রয়োজনীয় কাজে নড়াচড়া না করা। গ্রহণযোগ্য মতানুসারে খুশু আল্লাহ তা’আলার নিকট নামায কবুল হওয়ার জন্য স্তম্ভ স্বরূপ। (বয়ানুল কুরআন, ২/৫৩৩, মাকতাবাতুল ইত্তিহাদ)।

আল্লাহ তাআলা বলেন-

 قد أفلح المؤمنون. الذين هم في صلاتهم خاشعون

অর্থাৎ- নিশ্চয়ই ঐ সকল ঈমানদারগণ সফলকাম যারা একাগ্রতা ও স্থিরতার সহিত নামায আদায় করে। (সূরা আল মু’মিনূন- ১ ও ২)।

এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, নামাযে একাগ্রতা ও স্থিরতা কাম্য। সুতরাং উপরোল্লিখিত সকল সমস্যা থেকে বেঁচে থাকার জন্য রিংটোন বন্ধ করা জরুরি। কারো যদি মোবাইলের রিংটোন খোলা রাখার বদঅভ্যাস থেকে থাকে, অথবা কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে মোবাইল খোলা রাখে এবং তার মোবাইল বেজে উঠে তখন সে গুনাহগার হবে। এখন জানার বিষয় হলো, এক রুকনে কতবার রিংটোন বন্ধ করা যাবে? পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, রিংটোন বেজে উঠলে তা বন্ধ করা উচিত। সুতরাং মোবাইল যদি মুসল্লির হাতের নাগালে থাকে (যেমন- পকেটে বা লুঙ্গির গিটে) চাই মুসল্লি দাঁড়ানো অবস্থায় হোক বা বসা অবস্থায়, রুকু অবস্থায় হোক বা সেজদা অবস্থায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই নামাযে থেকে যতটুকু সম্ভব নড়াচড়া কম করে এক হাত দিয়ে রিং বন্ধ করে দিবে। আর যদি মোবাইল সামনে থাকে এবং মুসল্লি রুকু, সিজদা বা বসা অবস্থায় থাকে তখনও স্বাভাবিকভাবেই নামাযে থেকে এক হাত দিয়ে রিং বন্ধ করে দিবে।

উল্লেখ্য যে, সামনে মোবাইল রেখে নামায পড়া উচিত নয়। কেননা, তাতে নিজের এবং আশপাশের অনেক মুসল্লির নামাযে বিঘœতা সৃষ্টি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন- মোবাইলের দিকে সাধারণত দৃষ্টি যায়, ফলে নামাযের একাগ্রতায় ব্যাঘাত ঘটে। বিশেষ করে যখন রিং বেজে ওঠে মোবাইলের মালিক তার করণীয় সম্পর্কে জানা না থাকার কারণে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। না পারে রিংটোন বন্ধ করতে, কেননা নামায ফাসেদ হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। না পারে রিং বাজতে দিতে, কারণ সে বুঝতে পারে যে, মুসল্লীরা তার কারণে কষ্ট পাচ্ছে এবং বিরক্তবোধ করছে। ফলে সে নামাযে এক অস্থিরতায় ভোগে। এমনকি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পেরে এক পর্যায়ে নামায ভঙ্গ হয়ে যাওয়ার মতো কর্মে জড়িয়ে পড়ে।

অতএব, কারো যেন এধরনের বিপাকে পড়তে না হয়, প্রত্যেকের জন্যই এ ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক থাকা

উচিত। আল্লামা আলাউদ্দীন কাসানী (রাহ. ৫৮৭ হি.) ‘বাদায়েউস সানায়ে’ নামক কিতাবে নামায ভঙ্গের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে-

ومنها: العمل الكثير الذي ليس من أعمال الصلاة في الصلاة من غير ضرورة، فأما القليل غير مفسد

“নামায ভঙ্গের কারণসমূহের একটা হলো আমলে কাছির। আর বিনা প্রয়োজনে নামায বহির্ভুত এমন কাজ নামাযের মধ্যে করা হলে তাতে নামায ফাসেদ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে “আমলে কালীল”-এর কারণে নামায ভেঙে যায় না”। (১/৫৫৩, মাকতাবায়ে আশরাফিয়া)।

আমলে কাছির কাকে বলে? আমলে কাছিরের সংজ্ঞায় মতানৈক্য রয়েছে। তন্মধ্যে প্রসিদ্ধ সংজ্ঞা হলো তিনটি; যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

আল্লামা খতীব তুমুরতাশী (রহ.) তাঁর “তানভীরুল আবছার” নামক কিতাবে লিখেন- “আমলে কাছির বলা হয়: যে সকল কাজে লিপ্ত হলে দূর থেকে কেউ দেখলে মনে করবে যে সে নামাযে নেই। (মাকতাবায়ে যাকারিয়া, ২/৩৮৪)।

আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহ. (১২৫২ হি.) আমলে কাছিরের সংজ্ঞায় বলেন, “হানাফী উলামা মাশায়েখদের অধিকাংশই এই সংজ্ঞাকে বিশুদ্ধ সংজ্ঞা বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমলে কাছিরের দ্বিতীয় সংজ্ঞা হলো- যে সকল কাজ সাধারণত দু’হাতে করা হয় তা আমলে কাছিরের অন্তর্ভুক্ত, যদিও তা নামাযে এক হাতে করা হয়। যেমন: পাগড়ি বাঁধা, পায়জামা পরিধান করা ইত্যাদি এবং যে সকল কাজ স্বাভাবিক ভাবেই এক হাত দ্বারা করা হয় তা আমলে কালীলের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- পায়জামা খোলা, টুপি পরা ও খোলা, হ্যাঁ যদি লাগাতার তিনবার করে তখন আমলে কাছীরের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।

তৃতীয় হলো, একাধারে তিনবার নামায বহির্ভূত কোন কাজ করা আমলে কাছির আমলে কাছির সংক্রান্ত যেসব ফুরূয়ী মাসাইল ফুকাহায়ে কিরাম বর্ণনা করেছেন, তার অধিকাংশেরই ভিত্তি প্রথম দুই সংজ্ঞার উপর। বস্তুত দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি প্রথম সংজ্ঞার অর্ন্তভুক্ত। কেননা যে সকল কাজ সাধারণত দু’হাতে করা হয় তা যদি কেউ নামাযে করে তখন দূর থেকে দেখলে দর্শকের প্রবল ধারণা হবে যে সেই লোকটা নামাযে নেই। তদ্রƒপ তৃতীয় সংজ্ঞাও অর্থাৎ কেউ যদি লাগাতার তিনবার কোন কাজ করে তখন দূর থেকে দর্শকের প্রবল ধারণা হবে যে সে নামাযে নেই। এজন্য অধিকাংশ মাশায়েখগণ প্রথম সংজ্ঞাটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।” (রদ্দুল মুহতার, মাকতাবায়ে যাকারিয়া, ২/৩৮৪ ও ৩৮৫)।

এক্ষেত্রে জ্ঞাতব্য যে, কেউ যদি তিন তাসবীহ পরিমাণ সময়ে একাধারে তিনবার নামায বহির্ভূত কোন কাজ করে তখন আমলে কাছির হওয়ায় তার নামায ফাসেদ হয়ে যাবে। যেমন আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রহ.) (১২৫২ হি.) “রদ্দুল মুহতার” নামক কিতাবে উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করেন যে-

قال في الفيض:الحك بيد واحد في ركن ثلاث مرات يفسد الصلاة إن رفع يده في كل مرة

“নামাযের এক রুকনে এক হাত দ্বারা প্রত্যেকবার হাত উঠিয়ে তিনবার চুলকালে নামায ফাসেদ হয়ে যাবে। (১/৫৯৯). বলা বাহুল্য যে, এক রুকনের নিম্নতম সময় হলো তিন তাসবীহ পরিমাণ। যেমনটি আল্লামা আলাউদ্দীন হাসকাফি (রহ.) “দুররে মুখতার” নামক কিতাবে বলেন- (অর্থাৎ) “পূর্ণ এক রুকন পরিমাণ তথা তিন তাসবীহ পরিমাণ সময় পর্যন্ত যদি নামাযে কারো সতর খোলা থাকে অথবা নাপাকি লেগে থাকে তাহলে তার নামায ফাসেদ হয়ে যাবে।“ (মাকতাবায়ে আশরাফিয়া- ২/৪৬৭)।

অতএব, কেউ যদি এক রুকন তথা তিন তাসবীহ পরিমাণ সময়ের মধ্যে লাগাতার হাত উঠিয়ে তিনবার তিনস্থানে চুলকায় তার নামায ফাসেদ হয়ে যাবে। আর যদি হাত না সরিয়ে প্রয়োজনে একই স্থানে একাধিক বার চুলকায় তখন নামায ফাসেদ হবে না। একইভাবে যদি ভিন্ন ভিন্ন রুকনে তিন বা ততোধিক বার চুলকায় তখনও নামায ফাসেদ হবে না।

উল্লিখিত আলোচনা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, এক রুকনে অর্থাৎ তিন তাসবীহ পরিমাণ সময়ে একাধিকবার ফোন আসলে এক থেকে দুই বার পর্যন্ত তা বন্ধ করা যাবে। তাও নামাযের ধরন, প্রকৃতি ও অবস্থা ঠিক রেখে, এবং প্রয়োজনের চাইতে বেশি সময় না দিয়ে। কেননা, মূলনীতি রয়েছে-

الضرورة تتقدر بقدر الضرورة

প্রয়োজন পূরণ করতে যতটুকু সময় লাগবে ততটুকু শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত। এভাবে নামাযের কিয়াম, রুকু, সেজদা ইত্যাদির একাধিক রুকনে পৃথক পৃথক ভাবে একাধিকবার ফোন বেজে উঠলে তখনও উল্লিখিত নিয়মে রিং বন্ধ করা যাবে। তদ্রƒপ একই রাকাত ও একাধিক রাকাতের ক্ষেত্রেও এই বিধান প্রযোজ্য। মোটকথা, মূলনীতি হলো এক রুকন তথা তিন তাসবীহ পরিমাণ সময়ে লাগাতার তিনবার রিং বন্ধ করতে পারবে না। কেবল এক বা দুই বার বন্ধ করতে পারবে। লাগাতার তিনবার রিং বন্ধ করলে নামায ফাসেদ হয়ে যাবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সঠিকভাবে দ্বীন জেনে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: মুফতি ও সিনিয়র শিক্ষক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ

মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/

ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা ও মাসআলা-মাসায়েলবিষয়ক লেখা পেতে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম-এর ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।