।। মুফতি আবদুল্লাহ নোমান ।।
আল্লাহ তাআলা মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। যৌবনের বসন্ত-প্রাঙ্গণে মানুষ বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হয়। সুখময় দাম্পত্য জীবন লাভের আশায় শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর যুগল পথচলা। পরস্পরের সান্নিধ্যে জীবন হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত ও সুখময়। ক্ষণিকের এ জীবনের পাঠ চুকিয়ে মানুষ যখন পরপারে পাড়ি জমাবে, জান্নাতেও এ সুখময় সম্পর্ক বহাল থাকবে। দাম্পত্য জীবন, সে তো ক্ষণস্থায়ী জীবনের বুকে চিরস্থায়ী ভালোবাসার বর্ণাঢ্য আয়োজন। স্বর্গীয় বন্ধনের কল্যাণময় যাত্রা। মানব-মানবীর এই যুগল বাঁধনে যেমনিভাবে মানসিক তৃপ্তি ও কর্মোদ্দীপনা লাভ করা যায়, তেমনি গঠন করা যায় অনাবিল সুখ ও শান্তিময় নির্মল জীবন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তাঁর (আল্লাহর) নিদর্শন সমূহের একটি নিদর্শন হলো, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে গিয়ে শান্তি লাভ করো এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে সেইসব লোকের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা চিন্তাভাবনা করে’। (সূরা রূম- ২১)।
দাম্পত্য জীবনকে সুখময় ও স্থায়ী করতে আমাদের মহান পথিকৃত প্রিয়নবী (সা.)এর সুন্নাহই একমাত্র পাথেয়। তাঁর আদর্শ অনুসরণের মাঝেই রয়েছে চূড়ান্ত সফলতা। মহীয়সী স্ত্রীদের সঙ্গে নবীজি (সা.)এর চরিত্র মাধুর্য ও নান্দনিক কোমল পেলব আচরণে সুখময় দাম্পত্য জীবনের চমৎকার নির্দেশনা রয়েছে।
স্ত্রীর প্রতি কোমল আচরণ
কোমলতা মুমিনের ভূষণ। প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে আচরণে উচ্চারণে নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন করা বিচক্ষণ স্বামীর বৈশিষ্ট্য। দয়াময় আল্লাহ কোমলতাকে ভালোবাসেন। আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘হে আয়েশা! আল্লাহ নম্র ব্যবহারকারী। তিনি নম্রতা পছন্দ করেন। তিনি নম্রতার দরুন এমন কিছু দান করেন, যা কঠোরতা বা অন্য কিছুর দরুন দান করেন না’। (মুসলিম, ৬৪৯৫)। যে মেয়েটি আজন্ম বেড়ে ওঠা চিরচেনা পরিবেশ ও পিতা-মাতা ভাই-বোন ছেড়ে স্বামীর হাত ধরে চলে এলো বুকচাপা কান্নায় অচেনা এক জায়গায়, সে কি তার জীবন সাথীর ভালো আচরণ পাওয়ার অধিকার রাখে না? যে রমণী হাজারো স্বপ্ন বুকে নিয়ে রাত দিন পরিশ্রম করে সংসারকে আগলে রাখে, সে কি জীবন সঙ্গীর একটু মধুমাখা ব্যবহার পেতে পারে না? বেদনার কথা হলো, অনেক মুখোশধারী স্বামী বাইরে ভালো মানুষের ছদ্মবেশ ধারণ করলেও ঘরে স্ত্রীর সাথে তার আচরণ হয় চরম অমানবিক। ঠুনকো বিষয়ে স্ত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, কটূ কথা বলে। এমনকি গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করে না। পান থেকে চুন খসলেই নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে স্ত্রীকে।
স্বামী স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক। তাই সুখময় দাম্পত্য জীবনের প্রত্যাশী হলে পারস্পরিক বোঝাপড়ার সাথে কাজ করা চাই। একে অপরের প্রতি বিনম্র থাকা একান্তই কাম্য।
স্ত্রীর সাথে সদ্ব্যবহার করা
নারী জাতি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও লাজুক প্রকৃতির। তারা হলো কাঁচের মতো। যা সামান্য অমনোযোগিতা ও অবহেলার কারণে মুহূর্তেই ভেঙে যেতে পারে। তাই তাদের সাথে মিষ্টি মধুর সদাচরণ করাই শুভবুদ্ধির পরিচয়। মহিলাদের সাথে সদাচরণের উপদেশ দিয়ে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যখন কোন বিষয় প্রত্যক্ষ করবে তখন হয়তো উত্তম কথা বলবে, না হয় চুপ থাকবে। আর তোমরা নারীদের প্রতি কল্যাণের (ও সদাচরণের) অঙ্গীকার গ্রহণ করো। (মুসলিম শরীফ, ৩৫৩৯)। স্ত্রীর ছোটখাটো ভুল ত্রুটির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে জীবন যাপন করা উচিত। খাবারের লবণ কম হওয়া, মরিচ বেশি হওয়া, ইত্যকার অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য স্ত্রীকে না শাসিয়ে তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখাই বাঞ্ছনীয়।
বিশ্বমানবতার অনুপম রূপকার মহানবী (সা.) উত্তম ব্যক্তির সার্টিফিকেট দিয়েছেন এই বলে, ‘তোমাদের মাঝে সেই ভালো, যে তার পরিবারের নিকট ভালো। আর আমি আমার পরিবারের নিকট তোমাদের চেয়ে উত্তম’। (তিরমিযী শরীফ, ৩৮৯৫)। অতএব, দুঃখ বেদনা ও বিপদাপদে সহমর্মিতা, উৎসাহ, প্রেরণা দিয়ে তাকে আশাবাদী করে তুলুন। তাঁর পাশে দাঁড়ান।
পারিবারিক কাজে সাহায্য করা
মহানবী (সা.) যেমন ছিলেন সফল রাষ্ট্রপ্রধান, ছিলেন আদর্শ স্বামী। তিনি স্ত্রীদের মনোরঞ্জন করতেন। ঘরোয়া কাজে তাদের সাহায্য করতেন। আসওয়াদ (রহ.) বলেন, আমি আয়েশা (রাযি.)কে জিজ্ঞাসা করলাম, নবী (সা.) ঘরে থাকাবস্থায় কী করতেন? তিনি বললেন, ঘরের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিবারবর্গের সহায়তা করতেন। আর সালাতের সময় মসজিদে গমন করতেন’। (সহীহ বুখারি, ৬৭৬)।
পুরুষের মতো মহিলাও রক্তমাংসের গড়া একজন দুর্বল মানুষ। তাই স্বামীর উচিত তার জীবনসঙ্গীনীকে রান্না করা, কাপড় কাঁচা, ঘর মোছা ইত্যাদি কাজে একটু এগিয়ে দেয়া। এতে স্ত্রীর হৃদয়-ভূমিতে বপিত হয় স্বামীর প্রতি ভালোবাসা ও ভালোলাগার ফুলেল বীজ। যা ধীরে ধীরে অঙ্কুরোদগম হয়ে প্রস্ফূটিত হয় আপন মহিমায় এবং মোহনীয় সুবাস ছড়ায়। কিন্তু আমাদের ঘুণেধরা সমাজে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এটাকে অনেকে লজ্জাজনক ও অপমান মনে করে। যা খুবই দুঃখজনক।
স্ত্রীর প্রতি যত্নশীল হওয়া ও তাকে সময় দেয়া
জীবন সঙ্গিনীর ভাল-মন্দ খোঁজ রাখা, সময় দেয়া ও তার যত্ন নেয়া একজন আদর্শ স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) সহধর্মীনিদের যথেষ্ট সময় দিতেন এবং ভালো-মন্দ খোঁজ-খবর নিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারীম (সা.) ফজরের নামাযের পর নামাযের স্থানে বসে থাকতেন। সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত লোকেরাও তাঁর চারপাশে বসে থাকত। অতঃপর তিনি তাঁর প্রত্যেক স্ত্রীর কাছে যেতেন, তাঁদের সালাম দিতেন, তাঁদের জন্য দোয়া করতেন এবং যার দিন থাকতো তার কাছে গিয়ে বসতেন’। (তবরানী, ৮৭৬৪)।
অনেকে স্ত্রীর ভাল-মন্দ ও স্বাস্থ্যের খোঁজ না রেখে, সময় না দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদিতে বুঁদ হয়ে সময় কাটায়। আবার কারো কারো বদ অভ্যাস হলো, রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফেরা। যখন ঘুমের ঘোরে কাত হয়ে পড়ে তখন ঢলতে ঢলতে ফিরে শুয়ে পড়ে। স্ত্রীর ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধার প্রতি তার কোন ভ্রুক্ষেপই থাকে না। এসব লোক ঘরকে মনে করে ধূসর মরুভূমি। আর বন্ধুদের আড্ডাখানাকে মনে করে পরম শান্তির আলয়। ফলে যতই দিন গড়ায়, দাম্পত্য কলহ বাড়তেই থাকে। অশান্তি ও ঝগড়া ফাসাদ লেগেই থাকে। এ থেকে নিস্তার চাইলে স্ত্রীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তার সুবিধা-অসুবিধার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। কেননা এসব তার ধর্মীয় মৌলিক অধিকার।
স্ত্রীর রাগ-অভিমান বুঝা
দাম্পত্য জীবনে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কখনো কখনো মনোমালিন্য ও মতপার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক। তখন একঘেয়েমি করে বসে না থেকে স্ত্রীর সাথে খুনসুটি ও রোমান্টিকতা করে তার অভিমান দূর করতে হবে। ভাঙা মনকে চাঙ্গা করতে হবে। রাসূলে আরাবী (সা.) স্ত্রীদের রাগ অভিমান এবং মন বোঝার চেষ্টা করতেন। তিনি (আয়েশা রাযি.কে লক্ষ করে) বলেন, ‘আয়েশা! তুমি আমার ওপর রেগে থাকলে আমি বুঝতে পারি। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.), আপনি কীভাবে বোঝেন ? রাসূল (সা.) বললেন, তুমি আমার উপর প্রসন্ন থাকলে বলো, না! মুহাম্মদ (সা.)এর রবের কসম! আর আমার উপর রেগে থাকলে বলো, না! ইবরাহীম (আ.)এর রবের কসম! আমি বললাম, আপনি ঠিকই বলেছেন। আল্লাহর শপথ, হে আল্লাহর রাসূল! সে ক্ষেত্রে শুধু আপনার নাম উচ্চারণ করা থেকেই বিরত থাকি।’ (তবে আপনার ভালোবাসা আমার হৃদয়ে থাকে)। (সহীহ বুখারী- ৫২২৮)।
স্ত্রীর মন খারাপের দিনে স্বামীর কর্তব্য হলো, স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতি জানানো। তাকে সান্ত্বনা দেয়া। নিজ হাতে তার চোখের পানি মুছে দেওয়া। তার মলিন মুখে হাসি ফোটানো। এক সফরে রাসূলুল্লাহ (সা.) একটু সামনে এগিয়ে যান; আর সাফিয়া (রাযি.) সামান্য পেছনে পড়ে যান। এতে তিনি কেঁদে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন নিজ হাতে তার চোখ মুছে দেন এবং কাঁদতে নিষেধ করেন’। (সুনানে কুবরা লিন-নাসায়ি- ৯১৬২)।
স্ত্রীর সাথে সহাস্যমুখে সালাম বিনিময় করা
বাসায় আসা-যাওয়ার প্রাক্কালে স্ত্রীর সাথে সহাস্যমুখে সালাম বিনিময় করা নবীজি (সা.)এর সুন্নাত। এতে পরস্পরের প্রতি যেমন নিখাদ ভালোবাসা ও আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়, তেমনি সংসার জীবনেও আসে অবারিত বরকত ও কল্যাণ। আনাস (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছেন, ‘হে প্রিয় বৎস! তুমি যখন তোমার পরিবার-পরিজনের কাছে যাও, তখন সালাম দেবে, তাতে তোমার ও তোমার পরিবার পরিজনের বরকত হবে’। (তিরমিযী- ২৬৯৮)।
হাসি হলো সৌন্দর্যের প্রতীক। হাস্যোজ্জল চেহারায় রয়েছে আশ্চর্য এক জাদুময়তা। তা মানুষকে মুহূর্তেই ভালোবাসার বাগডোরে আবদ্ধ করে। তাই মনে হাজারো দুঃখ বেদনা থাকলেও নিজেকে সাধ্যমত হাসিখুশি রাখা চাই। গোমরা মুখে না থেকে মুচকি হাসি দিয়ে কথা বলা রাসূল (সা.)এর শাশ্বত সুন্নাত। মজার বিষয় হচ্ছে, তিনি মানুষের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাত করাকে সদকার সওয়াব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, ‘তোমার ভায়ের সাথে হাসিমুখে (মুচকি হাসি) থাকা সদকার সাওয়াব’। (তিরমিযী শরীফ, ১৯৫৭) তাই স্বামীর উচিত বাইরের ঝগড়া-বিবাদ চিন্তা পেরেশানি বাইরেই দাফন করে আসবে। প্রফুল্ল মনে চেহারায় হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে ঘরে ঢুকবে। এতে তাদের মধুর সম্পর্ক যেমন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে, তেমনি পরস্পরের হৃদয়ে বাজতে থাকবে স্বর্গীয় ভালোবাসার সুললিত বীন।
নিজেকে পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন রাখা
প্রিয়তমা স্ত্রীর সামনে নিজেকে পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন রাখা আদর্শ স্বামীর ভূষণ। দম্পতি একে অপরের সামনে সুন্দর ফিটনেস ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করার দ্বারা পরস্পরের সম্পর্ক মধুময় হয়। হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর জন্য পরিপাটিময় থাকতে পছন্দ করি; যেমনটা আমিও চাই স্ত্রী আমার জন্য সাজুক।’ (বায়হাকি, ১৪৭২৮)। অনেক স্বামী মুখে ও শরীরে অসহনীয় দূর্গন্ধ এবং নোংরাভাবে স্ত্রীর সামনে উপস্থিত হয়। তেমনি অনেক স্ত্রীও অপরিচ্ছন্ন ও দৃষ্টিকটূ অবস্থায় স্বামীর সামনে নিজেকে প্রেজেন্ট করে। এতে একদিকে যেমন পরস্পরের প্রতি আগ্রহের জোয়ারে ভাটা পড়ে, তেমনি উভয়ের অন্তরে একে অপরের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হয়। ফলে এক সময় দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হয় এবং তা বিবাহ বিচ্ছেদে রূপ নেয়। তাই উভয়কেই পরিচ্ছন্ন পরিপাটি থাকা চাই। অনেকের দাঁত থাকে অপরিষ্কার, জামা থাকে ময়লাযুক্ত, মুখে থাকে সিগারেটের দুর্গন্ধ, তার কাছে যেতেও বিব্রত বোধ হয়। এমন অপরিচ্ছন্ন মানুষের সাথে সংসার করা সত্যিই অনেক কষ্টের। দাম্পত্য জীবনকে আনন্দঘন করতে চাইলে এসব বদ অভ্যাস দ্রুতই পরিত্যাগ করতে হবে। সেই সাথে নিজেদের ভালো পারফিউম বা আতরের সুবাসে সুবাসিত রাখা চাই। যাতে একে অপরকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। ঘ্রাণ নিতে মনে চায়।
উত্তম কাজের স্বীকৃতি প্রদান
প্রিয়তমা স্ত্রী ভালো কিছু করলে সেটির স্বীকৃতি দেয়া চাই। এর দ্বারা যেমন সে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ হবে, তেমনি সারা দিনের ক্লান্তি ও পরিশ্রম মুহূর্তেই ভুলে যাবে। তার হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠবে স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও ভালোলাগায়। সঙ্গিনী ভালো কিছু রান্না করলে তার প্রশংসা করা উচিত। কদাচিত অনাকাক্সিক্ষতভাবে একটু বেশ কম হয়ে গেলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখাই বাঞ্ছনীয়। নবীজি (সা.) কখনো খাবারের দোষ বর্ণনা করতেন না। ভালো লাগলে খেতেন, অন্যথায় চুপ থাকতেন। আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) কখনো কোন খাদ্যকে মন্দ বলতেন না। রুচি হলে খেতেন, না হলে চুপচাপ রেখে দিতেন। (বুখারী শরীফ, ৩৫৬৩)।
সুন্দর নাম বা চমৎকার উপাধিতে ডাকা
স্ত্রীদের সঙ্গে রাসূল (সা.)এর প্রেমময় আচরণ-উচ্চারণ একটি আদর্শ দাম্পত্য জীবনের শ্রেষ্ঠ উপমা। তিনি নানা উপায়ে স্ত্রীদের মন জয় করার চেষ্টা করতেন। রোমাঞ্চকর কথা বলে তাদেরকে অভিভূত করতেন। ফলে আম্মাজানগণ প্রিয় নবীজি (সা.)এর ভালোবাসায় উচ্ছ্বসিত থাকতেন। তাঁকে কাছে পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। তিনি আয়েশা (রাযি.)কে ভালোবাসা ও মায়া মমতা প্রকাশার্থে কখনো কখনো হুমায়রা বলে ডাকতেন। (যার অর্থ হচ্ছে, লাল রঙের পাখি বিশেষ) (ইবনে মাজাহ- ২৪৭৪)। স্ত্রীকে তার পছন্দনীয় কোন নামে ডাকার দ্বারা তার মন খুশিতে নেচে ওঠে। কেননা এটি তার প্রিয়তমের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এতে থাকে প্রেম- প্রীতি ও প্রণয়ের ম্যাসেজ।
স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করা
যে কোন কাজে অভিজ্ঞ জনের সাথে পরামর্শ করা আল্লাহ তাআলার আদেশ। পবিত্র কুরআনের বাণী, ‘আর আপনি তাদের (সাহাবীদের) সাথে পরামর্শ করুন’। (সূরা আলে ইমরান, ১৬৯ আয়াত)। এতে কাজে আসে কাক্সিক্ষত সফলতা, দূর হয় অনভিপ্রেত ব্যর্থতা। চেতনার বাতিঘর মহানবী (সা.) স্ত্রীদের সঙ্গেও পরামর্শ করতেন। শুধু ঘরোয়া বিষয়ে নয়; বরং মুসলিম উম্মাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়াদির ক্ষেত্রেও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’র মতো তাৎপর্যপূর্ণ প্রেক্ষাপটে তিনি উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা (রাযি.) থেকে পরামর্শ নিয়েছিলেন। সেই মতামতের অসাধারণ কার্যকারিতা ও অবাক করা ফলাফল পরিলক্ষিত হয়েছিল। ইসলামের সোনালি ইতিহাসের পাতায় যা এখনো চির অম্লান। (সহীহ বুখারি, ২৭৩১)। তাই ছোট বড় যেকোনো কাজেই স্ত্রীর মতামত নেয়া উচিত। অনেকে অবহেলা করে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য ব্যক্তিগত কাজে সঙ্গিনীর মতামত নেয় না। এটা অনুচিত।
ইবাদতে একে অপরের সহযোগী হওয়া
দাম্পত্য জীবনের লক্ষ্য শুধুমাত্র জৈবিক চাহিদা পূরণ নয়। এর উদ্দেশ্য সুদূরপ্রসারী। দুদিনের এই পান্থশালায় পুণ্যময় জীবন গঠন করে পরকালে চির সুখের জান্নাত লাভ করাও এর অন্যতম লক্ষ্য। তাই দয়াময় আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর বিধিবিধান পালনে একে অপরকে উদ্বুদ্ধ করা চাই। তাহাজ্জুদ, যিকির আযকার ও অন্যান্য ইবাদতেও পরস্পর সহযোগী হওয়া কাম্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ এমন ব্যক্তিকে দয়া করুন, যে রাতে উঠে নিজেও সালাত আদায় করে, তার স্ত্রীকেও জাগ্রত করে এবং সেও সালাত আদায় করে। সে উঠতে না চাইলে তার মুখমন্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়। আল্লাহ এমন নারীর প্রতিও অনুগ্রহ করুন, যে রাতে উঠে নিজে নামাজ আদায় করে এবং তার স্বামী কেও জাগায়। তার মুখমন্ডলে পানি ছিটিয়ে দেয়। (আবু দাউদ, ১৪৫০)।
স্ত্রীর মুখ লাগানো খাবার খাওয়া
রসূল (সা.) স্ত্রীদের সঙ্গে এতটাই আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করতেন যে, পানাহারেও পরস্পরে ভাগাভাগি করতেন। স্ত্রীর মুখ লাগানো স্থানে মুখ রেখে খেতেন। আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি হাড় থেকে গোশত কামড়ে নিতাম। তারপর আমি যেখানে মুখ রাখতাম আল্লাহর রাসূল (সা.)ও সেখানে কামড় বসিয়ে খাবার নিতেন। অথচ তখন আমি ঋতুমতী ছিলাম। আমি পাত্র থেকে পানি পান করতাম। তারপর তিনি সে স্থানে মুখ রাখতেন, যেখানে আমি মুখ রাখতাম। অথচ আমি তখন ঋতুমতী ছিলাম’। (নাসায়ি, ৭০)। সুন্নাহসম্মত এই আমলটি স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের মুহাব্বত বৃদ্ধিতে অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে কুরআন তিলাওয়াত করা
সঙ্গীনির সাথে খোশগল্প করা এবং জায়েয হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠা উত্তম কাজ। তার কোলে মাথা রেখে কুরআন তিলাওয়াত করা সুন্নাত। আয়েশা (রাযি.) বলেন, নবীজি (সা.) আমার কোলে হেলান দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর তখন আমি হায়েয অবস্থায় ছিলাম। (বুখারী, ২৯৭)। এটি বিশ্ব চরাচরে মনোরম ও সুন্দরতম দৃশ্যের একটি। এছাড়াও স্ত্রীর হাতে চুল আঁচড়ে নেয়াও নববী আদর্শ। আয়েশা (রাযি.) রাসূল (সা.)এর চুল আঁচড়ে দিতেন। আয়েশা (রাযি.) বলেন, ‘আমি ঋতুকালীন অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (সা.)এর মাথা আঁচড়ে দিতাম’। (বুখারী শরীফ, ২৯৫)। সেই সাথে স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমময় কবিতার মধুর আলাপনীতে মেতে ওঠে সুখের রাজ্যে হারিয়ে যেতেও নিষেধ নেই। মানা নেই খোশগল্পে মেতে ওঠে আনন্দের ডানায় ভর করে নিঃসীম নীলিমায় হারিয়ে যেতে। ভালোবাসামাখা ইসলামী নাশীদ শুনিয়েও স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে প্রফুল্ল করা যায়।
স্ত্রীর জন্য হাদিয়া নিয়ে আসা
স্বামী স্ত্রীর মুহাব্বত বৃদ্ধির জন্য উপহার-উপঢৌকনের গুরুত্ব অপরিসীম। হাদিয়া আদান-প্রদানে ভালোবাসা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। দূর হয় মনের ময়লা, হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার মনোভাব। আবু হুরায়রা (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত। হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা একে অপরকে উপহার দাও। উপহার মনের ময়লা দূর করে। এক প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীকে ছাগলের পায়ের এক টুকরা খুর হলেও উপহার দিতে যেন অবহেলা না করে’। (তিরমিযী- ২১৩০)। অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা একে অপরকে হাদিয়া দাও, (এতে) তোমাদের ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে’। (আল আদাবুল মুফরাদ- ৫৯৪)। বাজার থেকে যাওয়ার সময় সামান্য কিছু হলেও প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে যান। হতে পারে তা পাঁচ টাকার চনাবুট, দশ টাকার বাদাম বা অন্য কিছু। এতে তার দেহ মনে জাগ্রত হবে আপনার প্রতি প্রেম-ভালোবাসার শিহরণ। ছড়িয়ে পড়বে তার কোমল হৃদয়ে আলোকোজ্জ্বল স্বপ্নের পিদিম। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ওঃ রং হড়ঃ ঃযব ঃযরহম যিরপয পড়ঁহঃ রঃ রং ঃযড়ঁমযঃ. কাব্যাকারে যার ভাবার্থ হলো- “তোমার দেয়া তোহফাটুকু অল্পমূল্যের হলেও, আমি মনে করি এটা আমার প্রাণের চেয়েও দামি! ”
এ সোনালি নীতি অবলম্বন করে খুব সহজেই স্ত্রীর মন জয় করা যায়।
স্ত্রীর সঙ্গে খেলার প্রতিযোগিতা করা
আনন্দিত ও প্রফুল্ল রাখার উদ্দেশ্যে জীবন সঙ্গিনীর সঙ্গে রোমান্টিকতা ও খেলার প্রতিযোগিতা করা সুন্নাত। আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, ‘তিনি এক সফরে প্রিয় নবী (সা.)এর সাথে ছিলেন। তিনি বলেন, আমি তাঁর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করে তাঁর আগে চলে গেলাম। পরবর্তীতে আমি মোটা হয়ে যাওয়ার পর তাঁর সাথে আবারো দৌড় প্রতিযোগিতা করলাম। এবার তিনি আমাকে পেছনে ফেলে বিজয়ী হলেন। তিনি বললেন, এই বিজয় আগের বিজয়ের বদলা’। (আবু দাউদ, ২৫৭৮) ঘরের একচেটিয়া কাজে মাঝে মধ্যে বিরক্তি আসে। তাই একঘেঁয়েমি দূর করার জন্য কখনো কখনো সহধর্মিনীকে নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করা যেতে পারে। সেই সাথে স্ত্রীর মানসিক প্রশান্তির জন্য চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা করা চাই।
এসব জীবনঘনিষ্ঠ নিয়ম অনুসরণ করে যদি কোন দম্পতি তাদের বৈবাহিক জীবনকে রাঙাতে পারে, তাহলে দুনিয়ার বুকেই তারা অনুভব করবে এক প্রকার জান্নাতি আমেজ, তাদের আবাস পরিণত হবে সুখ শান্তির অপূর্ব নীড়ে। মহান আল্লাহ সকল দম্পতিকে সুখময় দাম্পত্য জীবন দান করুন।
লেখক: মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম, কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/