মদসহ নেশাজাতীয় সব ধরনের পণ্যদ্রব্যই ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ (হারাম)। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, পূঁজার বেদী, লটারি ইত্যাদি ঘৃণিত ও শয়তানের কাজ, তোমরা এ থেকে বিরত থাকলে সফল হবে (সূরা মায়িদা, আয়াত-৯০)। সুতরাং, ইসলামের দৃষ্টিতে মদ্যপানের ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় বা শিথিলতা নেই।
সম্প্রতি মদ্যপানের ব্যাপারে সরকার নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ থাকলেও সেই আইনে আগে কোনো বিধিমালা ছিল না। এখন নতুন বিধিমালা অনুসারে মদ্যপানের ছাড়পত্র পেতে হলে বয়স কমপক্ষে ২১ হতে হবে। যদিও তার আগ থেকে (বিশেষত ইচ্ছুক ব্যক্তি মুসলিম হলে) নিয়ম আছে যে, মদ্যপানের ইচ্ছুক ব্যক্তি পারমিট (অনুমতিপত্র) পাওয়ার জন্য একজন এসোসিয়েট পদমর্যাদার চিকিৎসকের কাছ থেকে সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত হতে হবে। ওই চিকিৎসক সেই ব্যক্তিকে মেডিকেল চেকআপের মাধ্যমে ‘শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ’ এই মর্মে পরিমিত মাত্রায় মদ্যপানের অনুমতি দিতে পারেন। তারপর সেই ব্যক্তি মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয় থেকে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলে মদ্যপানের পারমিট মেলে। তবে অমুসলিমদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সার্টিফিকেট নেয়াটা বাধ্যতামূলক না হলেও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে মুসলিম নাগরিকদের জন্য মদ্যপানের কোনোরূপ অনুমতির সুযোগ রাখা সম্পূর্ণভাবে ইসলামবিরোধী। এরইমধ্যে নতুন বিধিমালায় মদ্যপানের অনুমতির জন্য সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তার মানে বয়স ২১ বছরের ঊর্ধ্বে হলে যে কেউ মদ্যপানের পারমিট পেয়ে যাবেন! এ ধরনের আইনি ফাঁকফোকর তরুণসমাজকে আরও খোলাখুলি ধ্বংস হওয়ার সুযোগ করে দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এছাড়া ওই বিধিমালায় উল্লেখযোগ্য আরও যা-যা আছে, সেগুলো হলো-
১. হোটেল, রেস্তোরাঁয় বা যেসব স্থানে সাধারণ খাবার পরিবেশনের পাশাপাশি অ্যালকোহল সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও পরিবেশন করা হয়, সেসব ক্ষেত্রে বার স্থাপনের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যাবে।
২. কোন এলাকায় ১০০ জন দেশি মদ বা বিদেশি মদের পারমিটধারী থাকলে অ্যালকোহল বিক্রয়ের লাইসেন্স দেয়া যাবে। অর্থাৎ কোন ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানে যদি কমপক্ষে ১০০ জন পারমিটধারী সদস্য থাকেন, তাহলে সেখানেই অ্যালকোহল বিক্রি করা যাবে।
৩. অ্যালকোহল বহন বা পরিবহনের জন্য অধিদপ্তর থেকে পাসের জন্য আবেদন করা যাবে। রেল, সড়ক, নৌ ও আকাশপথের যে কোনো পথেই অ্যালকোহল পরিবহন করা যাবে। তবে সেটা পাসে উল্লেখ থাকতে হবে।
আরও পড়তে পারেন-
- বাংলায় হিন্দু রেনেসাঁস: প্রগতিশীলতা ও ইসলামবিদ্বেষ
- পরিবেশ বিপর্যয়— রুশ সাম্রাজ্যের শাপে বর?
- ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস ও হিন্দিবাদী রবীন্দ্রনাথ
- আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহিমা আত্মোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায়
- কুরআন অবমাননা: আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বনাম হিন্দুত্ববাদ
- যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আলেম সমাজের প্রস্তুতি
এ ধরনের আইনি সুযোগসমূহ কোনোভাবেই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে মদ্যপানের কারণে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে বছরে প্রায় তিন হাজার মানুষ মারা যায়। অথচ টাকার বিনিময়ে বার কর্তৃপক্ষ থেকে অনায়াসে মদ্যপানের লাইসেন্স সংগ্রহ করা সম্ভব। আর মদের বারগুলোকে যাচাই-বাছাই ছাড়া এবং বিনা শারীরিক পরীক্ষায় মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট সরবরাহ করার অভিযোগ আছে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে (৩০ ডিসেম্বর ২০২১, দৈনিক নয়া শতাব্দী)।
আগ থেকেই যখন এমন ভয়াবহ অবস্থা, তাহলে নতুন বিধিমালার সুযোগে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা অনুমান করতে বেগ পেতে হয় না।
প্রশ্ন হলো, নতুন বিধিমালার উদ্দেশ্য কী তাহলে? মাদক নিয়ন্ত্রণ নাকি মাদক সেবন নিরাপদকরণ? নয়া শতাব্দীর উল্লিখিত রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত জনবল না থাকার কারণে নিয়মমাফিক অনেক কিছুই তাদের পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ক্ষেত্রবিশেষে তাদের পুলিশের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। যদিও সেখান থেকে তারা সবসময় সবধরনের সহায়তা পাচ্ছেন না। তাই নথিপত্রে যা-ই থাকুক না কেন, মাঠের প্রকৃত চিত্র অনেকটা নাজুক- এ কথা নিঃসংকোচে স্বীকার করেন তারা’।
সুতরাং, নতুন বিধিমালার উদ্দেশ্য যে মাদক নিয়ন্ত্রণ নয়, তা বলা বাহুল্য। কারণ, যেখানে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পর্যাপ্ত জনবলের অভাব এবং পাশপাশি আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা সুস্পষ্ট, সেখানে এই নতুন বিধিমালার মাধ্যমে নিরাপদ মদ্যপানের ব্যবস্থা করে কোনোভাবেই মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বিবিসি বাংলার ১৬ ফেব্রুয়ারির এক রিপোর্টে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ডা. দুলাল কৃষ্ণ সাহার বক্তব্য থেকে এটা ধারণা করা যায় যে, মাদকদ্রব্যের লাইসেন্সভিত্তিক বেচাকেনা থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্যই নতুন বিধিমালা করা হয়েছে।
আমরা সরকারকে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই, রাষ্ট্রের কর্তব্য কি জনগণের কাছ থেকে ব্যবসা করা, নাকি নিরাপদ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং ইনসাফপূর্ণ আদর্শ সমাজ কায়েম করা? তাছাড়া রাজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে মদ্যপানকে পারমিটসহ নিরাপদ করে দিলে যুবসমাজ ধ্বংসের দিকে আরও পতিত হবে। ইসলাম ঘোষিত হারামকে সেকুলার আইনে বৈধ করে সহজ করে দিলে তা নিঃসন্দেহে আত্মঘাতী পরিণতি ডেকে আনবে। সুতরাং, এই ইসলামবিরোধী বিধিমালা অবিলম্বে প্রত্যাহার করুন।
#মাসিক মুঈনুল ইসলাম/এমএ
মাসিক মুঈনুল ইসলাম পড়তে ক্লিক করুন-
https://mueenulislam.com/